বাংলার বুদ্ধিজীবী যতীন সরকার

যতীন সরকারের অনুপস্থিতি আমাদের মূলধারার জনসংস্কৃতির ধারণা ও জীবনবোধকে প্রায় রিক্ত করে দিয়েছে। কেন? কারণ, তার জীবনযাপন, সংস্কৃতিচর্চা ও জ্ঞানযাপনের মধ্যে কোন দ্বিচারিতা ছিল না। নিজেকে আড়াল রাখার, গুপ্ত রাখার, বহুরূপী সেজে বহুধর্মী ক্ষমতার সাথে মিশে থাকার বহুবিচিত্র নাগরিক বুদ্ধিজীবিতায় তিনি ছিলেন না। ময়মনসিংহ শহরের ১৭, ব্রাহ্মপল্লির বাসায় তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বোঝাপড়া’ কবিতার দুই লাইন বাঁধাই করে টানিয়ে রেখেছিলেন—‘মনেরে আজ কহ যে, ভালো মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে।’ সত্যকে সহজভাবে নেয়ার শিক্ষা তিনি শিখেছিলেন ঠাকুরদা’র থেকে, পিতার থেকে রামপুরের লোকায়ত কৃষকসমাজ থেকে। তাঁর জ্ঞান, রুচি, মূল্যবোধ দৃষ্টি ও ধারণার অমৃতআলো ময়মনসিংহের লোকায়ত সমাজ থেকেই উৎসাহিত হয়েছিল কিংবা তিনি মাটিবর্তী জনজীবন থেকেই গ্রহণ করেছিলেন এই জ্ঞান। লোকজীবনকে, লোকায়ত জ্ঞানকে, প্রকৃতিজাত আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তিনি মান্য করতেন, ধারণ করতেন এবং প্রচার করতেন। আজকের দিনের খ্যাতিমান টিভি স্টারদের কথকতা, ধান্দাবাজির বহুরূপীচর্চা, অনুশীলন কিংবা ক্ষমতাবাদের ছায়াও মারাতেন না।
যতীন সরকারের পূর্বপুরুষ কিংবা যতীন সরকার কেউই কৃষক ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের চর্চা ও যাপনে ছিল কৃষি সংস্কৃতির বিদ্যায়তন। ফলে তাঁর জীবনবোধে, অনুধাবনে নাগরিক ধান্ধা কিংবা চেয়ারে বসার তৎপরতা ছিল না। মাটির জ্ঞানকে, মাটির সংস্কৃতিকে প্রচার করার অভিপ্রায়েই তিনি বক্তৃতা এবং লেখালেখিতে যুক্ত হয়েছেন। প্রাকৃতজনের ধারণাকে, প্রকৃতির প্রকৃত তাৎপর্যকে প্রচার করার মৌলিক প্রত্যয় নিয়েই মফস্বলে বসবাস করেছেন। মফস্বলীয় ক্ষুদ্রতা, দলাদলী, স্বার্থপরতা থেকে দূরে জীবনচর্চার প্রাকৃত ধ্যান ও সত্যকে তুলে ধরেছেন। মফস্বলের অধ্যাপনাজীবী হয়েও প্রজ্ঞায়, আদর্শে, বুদ্ধিজীবিতায়, নিজের বিশ্বাস ও জ্ঞানে দৃঢ় থাকার অনন্য সাহসিকতায় তাঁর সমতুল্য মানুষ সমকালে পাওয়া যাবে কি-না সন্দেহ।
যতীন সরকার চিরকাল বাংলার লোকায়ত কবিদের কথাই প্রচার করেছেন। দেশ বিভাগের উত্তালকালে মাটি ও জনপদের কবি ইউনুছ আলীরাই ধারণা দিয়েছিলেন—রাষ্ট্র সবার। ভাঁট কবিতার মত ছোট ছোট কাব্য সংকলনে ইউনুস আলীরাই প্রচার করেছেন, রাষ্ট্র এককভাবে কোনো গোষ্ঠী কিংবা শ্রেণির হতে পারে না। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার কবি ইউনুস আলীদের সাম্যবাদী জ্ঞান ও ধারণা থেকেই তিনি রাষ্ট্রগঠনের বিচিত্র অভিমুখ ও অভিজ্ঞতাকে প্রশ্ন করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন। বাংলার লোকায়ত জীবনের প্রশ্নভিত্তিক এই জ্ঞানচর্চার ধারণাকে প্রচার করেই তিনি যতীন সরকার হয়েছেন।
১৯৩৬ সালে জন্ম নিয়ে চল্লিশের দশকের ক্রমবিকশিত, পরিবর্তিত সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির ঝঞ্ঝাসঙ্কুল পরিস্থিতিতেই যতীন সরকারের কিশোর মনের বিকাশ। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ৪৬-এর দাঙ্গা, সাতচল্লিশের ভাঙ্গাগড়ার উত্তাল-অস্থির পরিস্থিতি, সাম্প্রদায়িক টানাপড়েনের নির্মমতার ভেতরেই যতীন সরকারের বেড়ে ওঠা। এই অস্থিরতা-বিপন্নতার ভেতরেই প্রাকৃতজনের কবি ইউনুস আলীরা গাইতেন আশাবাদের গান। যতীন সরকার চিরকাল বাংলার লোকায়ত কবিদের কথাই প্রচার করেছেন। দেশ বিভাগের উত্তালকালে মাটি ও জনপদের কবি ইউনুছ আলীরাই ধারণা দিয়েছিলেন—রাষ্ট্র সবার। ভাঁট কবিতার মত ছোট ছোট কাব্য সংকলনে ইউনুস আলীরাই প্রচার করেছেন, রাষ্ট্র এককভাবে কোনো গোষ্ঠী কিংবা শ্রেণির হতে পারে না। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার কবি ইউনুস আলীদের সাম্যবাদী জ্ঞান ও ধারণা থেকেই তিনি রাষ্ট্রগঠনের বিচিত্র অভিমুখ ও অভিজ্ঞতাকে প্রশ্ন করেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন। বাংলার লোকায়ত জীবনের প্রশ্নভিত্তিক এই জ্ঞানচর্চার ধারণাকে প্রচার করেই তিনি যতীন সরকার হয়েছেন। পূর্ব ময়মনসিংহের চলমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধাক্কা দিয়েছিল চল্লিশের দশক। চল্লিশের সেই সময়ের ব্যাখ্যাকার হিসেবে কিশোর বেলাতেই বন্ধু, স্বজন, পরিচিত মহলে তিনি ‘ইঁচড়ে পাকা দার্শনিক’ অভিধা পেলেন।
দার্শনিক মানে যিনি সত্য দেখেন এবং প্রকাশ করেন। তাঁর মত সংবেদনশীল ও সাড়াপ্রবণ মানুষকে সমাজের ভেতর-বাহিরকে চিহ্নিত না-করে উপায় ছিল না। সমাজ সংকটের এই বিপন্ন পরিস্থিতিতেই তৈরি হয়েছে তাঁর মানসভূবন। পরিস্থিতির অনিবার্য বাস্তবতায় দৃষ্টি ও জ্ঞানচর্চার পথে ধাবিত হতে হতে তিনি পৌঁছে যান মার্কস-এঙ্গেলসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে। জীবন জিজ্ঞাসার ধাবমান পথে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদই হয়ে যায় তাঁর দেখার জানালা, জীবনের পরিচয়। তিনি মনে করেন, জীবনকে দেখার জন্য এর চেয়ে সত্যসূত্র নেই। এই সত্যেই তাঁর আস্থা। দেখায়, কথায়, লেখায়, চিন্তাভাবনায় এই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের সত্যসূত্রেই তিনি নির্ভর করেন।
শুরুতেই বলেছি যতীন সরকার মফস্বলে ছিলেন কিন্তু মফস্বলীয় আচরণ কিংবা ক্ষুদ্রতার মধ্যে ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করেন ইতিহাসের, ঐতিহ্যের কখনো সমাপ্তি হয় না, রূপান্তর হয়। তাই সোভিয়েত বেল্টের পতনের পর দলে দলে বামপন্থী চিন্তাবিদ, লেখক এবং তাত্ত্বিকরা ‘মার্কসবাদ ভুল’ কিংবা ‘সমাজতন্ত্র ইতিহাসের একটি ব্যর্থ চিন্তা’—এরকম এলোমেলো কথা বলতে শুরু করলেন। শুধু কথা বলা নয়, দলে দলে বামপন্থী নেতৃবৃন্দ, চিন্তাবিদ, লেখকরা, রাতারাতি মতবাদ, ঘরানা এবং দল পাল্টাতে শুরু করলেন। তলানিতে পৌঁছল তাদের বিশ্বাস ও বিজ্ঞান। যতীন সরকার তখন এই রিক্ত মহাজনদের সাথে মিশে যাননি। তিনি যেন নিজেকে নিজেই জিজ্ঞাসা করেছেন: মানুষের ইতিহাসের সমাপ্তি কি আছে? যদি মানুষের ইতিহাসের, সমাজ ও সামাজিকতার সমাপ্তি না হয়ে থাকে তবে সমাজতন্ত্রের সমাপ্তি কেন হবে? সমাজতন্ত্র তো মানব সমাজের রূপ-রূপান্তরের সংস্কৃতিকেই ধারণ করে; ভাঙ্গা গড়ার ইতিহাসকেই ধারণ করে। তাই বস্তুবাদী পৃথিবীতে ধনবাদী সমাজের বহুরূপী সুবিধাবাদ বা ফাঁপরবাজিকে তিনি চিরকাল প্রশ্ন করে এসেছেন। ধনতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের সুবিধাভোগী উত্তরাধুনিকতাকে তিনি কখনোই তাঁর চিন্তায় গ্রহণ করেননি। তিনি মনে করেন, উত্তরাধুনিকতা মানুষকে কখনোই স্বপ্ন দেখায়নি বরং হতাশই করেছে।
সত্য প্রকাশ করাই বুদ্ধিজীবীর কাজ। সেই কাজ মফস্বলে বসেও করা যায়, নদীর ধারের একটা ছোট্ট পর্ণকুটিরে বসেও করা যায়। ঢাকার টিভি চ্যানেলগুলোতে বুদ্ধিজীবীতে হয় না, হয় পরজীবিতা কিংবা প্রিয়জীবিতা। যতীন সরকার কিশোর বয়সে রামপুরের জানালা দিয়ে যেভাবে পৃথিবী দেখতে শুরু করেছিলেন সারাজীবন সেই দেখাটাকে বিকশিত করেছেন। রামপুরের মাটির শিকড়ে দাঁড়িয়েই করেছেন। নিজের শেকড়কে, নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।
যতীন সরকার মনে করেন, প্রকৃতিকে প্রকৃত রেখে সংস্কার করাই হচ্ছে সংস্কৃতি। সংস্কৃতিকে ধারণ করতে হলে আমাদের মূলের দিকে তাকাতে হবে। মাটির সংস্কৃতির উপর অন্য দেশের সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেওয়াটাও এক ধরনের জুলুম। চলমান সংস্কৃতি আপন মনেই পরদেশের সংস্কৃতিকে আত্মীয় করে। তিনি তাই ‘প্রত্যয়, প্রতীজ্ঞা, প্রতিভা’ লিখেন। শামসুর রাহমানের একটি কবিতার পংক্তি দিয়েই তিনি একটি প্রবন্ধের শিরোনাম করেছেন ‘বাঁধতে পারিনি কোন সাঁকো।’ যে নরসিংদীর মাটিতে দ্বিজ দাসের জন্ম হয়েছে সেই নরসিংদীর মাটিতেই শামসুর রাহমানের শেকড়। আধুনিক নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের কাব্যের আলোচনা করতে গিয়ে যতীন সরকার মূলত সাঁকো বাঁধতে না-পারার একটা ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করেছেন। এই ব্যর্থতার সূত্র চিহ্নিত করে তিনি লিখেছেন: ‘সাঁকো বাঁধার প্রত্যয়।’ কোন সাঁকো? সংস্কৃতির সাথে সংস্কৃতির সাঁকো। বাঙালির ঐতিহ্যে, লৌকিকধর্মে, লৌকিক সংস্কৃতি, কবিগান, বাউল গানের মধ্যেই সাঁকো বাঁধার প্রত্যয় আছে। জনগণের প্রাকৃত সমাজ ও ঐতিহ্যের পরিচয় আছে। কেবল ভাত-কাপড়ে বাঁচাই প্রকৃত বাঁচা নয়। লৌকিক ধর্মের বিচিত্র ধারণার মধ্যে সেই বাঁচার সুন্দর ও শান্তির কথা প্রচারিত আছে। যতীন সরকার আদি পুরুষের সেই সহজ সাম্যবাদী সমাজের কথা বলেন। লোক জীবনের অতলতা থেকে সত্য ও স্বপ্নকে তুলে আনতে বলেন। জালাল উদ্দিন খাঁর কবিতার ভূমিকা লিখতে গিয়ে তিনি তাই বাংলা কবিতার মূলধারার কথা বলেন। তিনি মনে করেন মাটির মায়াপূর্ণ কবিতার ভিতরেই আছে বাংলা কবিতার মুক্তি।
সত্য প্রকাশ করাই বুদ্ধিজীবীর কাজ। সেই কাজ মফস্বলে বসেও করা যায়, নদীর ধারের একটা ছোট্ট পর্ণকুটিরে বসেও করা যায়। ঢাকার টিভি চ্যানেলগুলোতে বুদ্ধিজীবীতে হয় না, হয় পরজীবিতা কিংবা প্রিয়জীবিতা। যতীন সরকার কিশোর বয়সে রামপুরের জানালা দিয়ে যেভাবে পৃথিবী দেখতে শুরু করেছিলেন সারাজীবন সেই দেখাটাকে বিকশিত করেছেন। রামপুরের মাটির শিকড়ে দাঁড়িয়েই করেছেন। নিজের শেকড়কে, নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। সমাজের প্রান্তিক মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে তিনি প্রান্তেই থেকে গেছেন। প্রান্তিক মানুষের অধিকার ও অসমবন্টনের ফাঁদকে উন্মোচন এবং নিরাময়ের লক্ষ্যে, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায়, কৃষক শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যতীন সরকার সারাজীবন লড়ে গেছেন। ধন-সম্পদের গতানুগতিক অভিলাষ, সঞ্চয়, চেয়ারে বসার রুগ্ন প্রতিযোগিতায় যতীন সরকার কখনোই ছিলেন না। নিজের দৃষ্টি ও চিন্তাকে প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে একটি অবিচল ধ্যান ও শান্তির আশ্রমবাসী হয়ে রামপুরের দার্শনিক মফস্বলেই থেকে গেছেন।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন