সবকিছুর ইতিহাস, তুমিসহ

অ+ অ-

 

|| জেনি হলওয়েল ||

সমকালীন মার্কিন কখাসাহিত্যিক। জন্ম ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা ক্রুজে, বেড়ে উঠেছেন ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডে।  তিনি ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএফএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। সেখানে তিনি কথাসাহিত্যে হেনরি হইন্স ফেলো ছিলেন। এ সময় তিনি বাল্‌চ শর্ট স্টোরি পুরুষ্কার অর্জন করেন। তার গল্পগুলো গ্লিমার ট্রেইন নিউ সাডেন ফিকশন-এর মতো সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে। অন্তর্ভুক্ত হয় বেস্ট আমেরিকান শর্ট স্টোরিজ সংকলনেও। প্রকাশিত উপন্যাস এভরিথিং লাভলি, এফোর্টলেস, সেফ (যা কিছু সুন্দর, সহজ, নিরাপদ)। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলেসে বসবাস করেন। অনূদিত গল্পটি লেখিকার প্রথম প্রকাশিত ছোটগল্প।

ছবি © Tedx-এর সৌজন্যে

 

জেনি হলওয়েলের গল্প || সবকিছুর ইতিহাস, তুমিসহ

অনুবাদ || আহসানুল করিম

 

প্রথমে ছিলেন কেবল ঈশ্বর কিংবা দেবতারা, অথবা হয়তো কিছুই ছিল না। তারপর শুরু হল সৃষ্টি প্রক্রিয়া, স্থান ও তার প্রসারণ, বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী বিস্ফোরণ, কণা, বস্তু, দহন এবং একীভবন। চরম বিশৃংখলা থেকে এলো শৃংখলার বিন্যাস। নক্ষত্ররা জন্ম নিল, দীপ্তি ছড়ালো, আবার মরেও গেলো। গ্রহেরা উপবৃত্তাকার পথে গ্যালাক্সির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে গড়াগড়ি খেলো, নানান মৌলের সংশ্লেষে এলো স্থিতাবস্থা।

প্রাণের উন্মেষ ঘটল কিংবা প্রাণ সৃষ্টি করা হলো। কাঁপতে কাঁপতে কোষ বিভাজিত হল। জলে খাবি খেতে খেতে সেই প্রাণ স্থল খুঁজে নিল। দ্রুতই তাদের পা, পাখনা, হাত, শুঁড়, মুখ, কান আর ডানা গজালো। চোখ ফুটল, যে চোখগুলো খোলা মাত্রই সকল দৃশ্যকে শুষে নিল। ধীরগতিতে চলতে চলতে, বড় হতে হতে, উড়তে উড়তে, সাঁতরিয়ে, হামাগুড়ি দিতে দিতে, মাটিতে চলার ছাপ রেখে জগতটাকে ভরিয়ে তুলল প্রাণ। চোখগুলো খুলে বুজে গেলো, আবারো খুলল। আমরা তার নাম দিলাম চোখের পলক।

মাথার উপরে জ্বলতে থাকা নক্ষত্রের নাম দিলাম সূর্য আর যে জমিনে দাঁড়িয়ে ছিলাম তার নাম দেওয়া হল পৃথিবী। এভাবে সবকিছুর নাম দিলাম, এমনকি নিজেদেরও। আমরা ছিলাম মানব-মানবী। নিঃসঙ্গ অনুভব করলে খুঁজে নিলাম নিজেদের সংখ্যা বাড়ানোর উপায়। এই উপায়ের নাম দিলাম যৌনতা। বেশিরভাগ মানুষ বিষয়টিকে উপভোগ করতে লাগলো।

আমরা প্রেমে পড়লাম। ঈশ্বরকে নিয়ে আলাপ করলাম। পাথরে পাথরে ঠোকাঠুকি করে যে স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠলো, তার নাম দিলাম আগুন। উষ্ণতা পাওয়ার সাথে সাথে আমাদের খাবারও আগের চেয়ে সুস্বাদু হল।

আমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলাম। কিছু সন্তানের জন্ম দিলাম। ওরা কাঁদল, হামাগুড়ি দিতে দিতে বেড়ে উঠল। এদের কেউ ফুল ছিঁড়ল, কোন ফাঁকে পাঁপড়িগুলো মুখেও পুরে দিল; কেউ ভালবাসলো কাঠবিড়ালির পিছনে ধাওয়া করে ছুটতে। আমরা অর্থ, সম্মান অথবা নারীর জন্যে যুদ্ধে লিপ্ত হলাম। ক্ষুধার জ্বালার সঙ্গে পরিচিত হলাম। বেশ্যার কাছে গেলাম। পানি বিশুদ্ধ করে নিয়ে পান করা শুরু করলাম। আপোস করতে শিখলাম, বাইরে ফিটফাট হলাম আর নিলাম গোপনীয়তার পাঠ। কারো কারো শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে শরীর নীল হয়ে গেলো। প্রথমে তাদেরকে পাতার আবরণে ঢেকে রাখলেও একসময়ে মাটি খুঁড়ে দাফন করতে শুরু করলাম।

তাদেরকে আমরা মনে রাখলাম। আবার ভুলেও গেলাম। আমাদের বয়স বাড়ল। দালানগুলো আরও লম্বা হতে শুরু করল। আমরা উকিল নিয়োগ দিলাম, সংগঠন গড়ে তুললাম আর কাগজপত্রে ঘটনার নানান সূত্র-প্রমাণ রেখে যেতে শুরু করলাম। দর কষাকষি করতে শিখলাম। জবানবন্দি দিলাম। ব্যাধিতে আক্রান্ত হলাম, আবার তার প্রতিকারও খুঁজলাম। আবিষ্কার করলাম প্রসাধন, টিকা, যোগব্যায়াম, সৌরশক্তি, আসক্তির চিকিৎসা, খাবার টেবিলের ভদ্রতা, আগ্নেয়াস্ত্র, জানালার পর্দা, থেরাপি, জন্মনিয়ন্ত্রণ, পিছনে লেগে থাকা, ফুটানি মারা, সম্পর্ক ভাঙার পরে খোরপোষের আইন, খেলোয়াড়ি মনোভাব, ফোকাস গ্রুপ, বিষণ্ণতার ওষুধ, রোদ থেকে বাঁচার ক্রিম, সাজানো বাগান, ছোট্ট বিমান, ফরচুন কুকি, কেমোথেরাপি, প্রক্রিয়াজাত খাবার আর যন্ত্রগণক। আমরা খেপিয়ে তুললাম মৌলবাদীদের, সেই সাথে আমাদের মায়েদেরও।

তুমি জন্ম নিলে। হাঁটতে শিখলে, ইশকুলে গেলে, খেলাধুলা করলে, কৌমার্য হারালে, ভালো কলেজে ভর্তি হলে, মনোবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা অর্জন করলে, রক গানের আসরে গেলে, রাজনীতিসচেতন হয়ে উঠলে, মাতাল হলে, লেখাপড়ার বিষয় বদলে বিপণন বেছে নিলে, গোলগলার সোয়েটার পরলে, উপন্যাসে মন দিলে, স্বেচ্ছাসেবক হলে, সিনেমা দেখলে আর দামি ব্লু চিজ ড্রেসিং-এর স্বাদ চিনলে। বন্ধুদের মাধ্যমে আমি তোমার সাথে পরিচিত হলাম। প্রথম দেখায় তোমাকে মোটেই ভালো লাগল না। তোমার দিক থেকেও বিষয়টা একইরকম ছিল। কিন্তু একে অন্যকে আমাদের সয়ে গেলো। এক আর্ট গ্যালারির পিছনে প্রথমবারের মত আমরা শারীরিকভাবে মিলিত হলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, খানিকটা মাতাল। দুহাতে আমার মুখ তুলে ধরে বললে, আমি নাকি সুন্দর। স্বীকার করলাম তুমিও সুন্দর, দীর্ঘকায়, বিশেষ করে যখন রাস্তার আলো এসে পড়ে তোমার উপরে। দুজনে তোমার বাসায় ফিরলাম, একসাথে শুনলাম হোয়াইট এলবাম। ঘরে বসে খাবার অর্ডার করলাম। ঝগড়া হল, মিটমাটও হল। দুজনেই ভালো চাকরি জুটিয়ে নিলাম, বিয়ে করলাম, এপার্টমেন্ট কিনলাম, নিয়মিত শরীরচর্চা করতে লাগলাম। খাওয়াদাওয়া বেড়ে গেলো এবং দুজনের মাঝে কথাবার্তা কমে এলো। আমি বিষণ্ণতায় ডুবে গেলাম। তুমি উপেক্ষা করলে। তোমাকে অসহনীয় মনে হতে লাগল আমার। তুমি বাড়িয়ে দিলে মদ্যপান আর খরচে বেহিসেবী হয়ে উঠলে। আমি আমার বসের সঙ্গে বিছানায় গেলাম। দুজনে কাউন্সেলিং-এর মধ্য দিয়ে গেলাম এবং একটা কুকুর পোষা শুরু করলাম। যৌনক্রিয়ার বিবিধ আসনের উপরে একটা বই কিনলাম এবং সবচেয়ে কম অপমানজনক আসনটি চেষ্টা করলাম, আসনের নাম ঠেলাগাড়ি। তুমি বিমান চালানো শেখা শুরু করলে, বাড়িতে রোলিংস্টোন  ম্যাগাজিন নিয়মিত হল। আমিও স্প্যানিশ ভাষা শিখলাম। সেইসাথে চলল বাগান করা।

আমাদের সন্তানেরা এলো, যারা কমবেশি সকলেই আমাদের হতাশ করল। দোষটা ছিল আমাদেরই। তুমি বেশি লাই দিতে আর আমি অতিরিক্ত শাসন করতাম। বলা বাহুল্য দুজনেই ভালোবাসতাম ওদের। আমাদের জীবনকালেই ওদের একজন মরে গেলো সাবওয়েতে ছুরিকাহত হয়ে। আমরা শোকগ্রস্ত হলাম, তবু জীবন চলতে লাগল। একটা বেড়াল পুষলাম। দুনিয়াটাকে মনে হতে লাগল ভীষণ অনিশ্চয়তাময়। নিজদের সাধ্যের বাইরে চলে যেতে লাগল জীবনযাত্রা। আমি হয়ে উঠলাম খুঁতখুঁতে আর খিটখিটে। তুমি সবসময় বিভ্রান্ত হয়ে থাকতে। অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়তে। আমাকে উপেক্ষা করে চলতে আর তোমাকে সইতে পারতাম না আমি। দুজনে দুজনকে ক্ষমাও করলাম। স্মৃতিগুলো ধরে রাখলাম। নানারকম ককটেইল পানীয় বানাতাম। কখনো দারুণ নাজুক হয়ে পড়তাম। একবার মনে আছে বারান্দায় বসে তুমি বলছিলে, তোমার বিশ্বাস হয় এই সবকিছু? সময়টা ছিল একেবারের শেষের দিকে। তোমার হাত কাঁপছিল। মনে হয় তুমি দুনিয়ার তাবৎ জিনিস নিয়ে কথা বলতে চাইছিলে, এমনকি আমাদের কথাও। তুমি কি জবাব চাইছিলে আমার কাছে? যাতে কথাগুলো হারিয়ে না যায়? আমার চিন্তা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল সব মিলিয়ে। সবকিছুর একেবারে শুরুতে কিছুতেই ফিরতে পারছিলাম না। বলেছিলাম, বিশ্বাস হয় না। বলতে বলতে সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখছিলাম। দূরে কোথাও একটা কুকুর ডাকছিল। তুমি ক্লান্ত ছিলে তবু হেসে বললে, শুনেছো, কুকুরটা বলছে কষ্ট কষ্ট? দুজনে একসাথে হেসে ফেললাম। তুমি অমনটাই ছিলে।

এখন তোমার সেই প্রশ্নের জবাব খোঁজাটাই আমার একমাত্র কাজ। সারাঘরে ছড়িয়ে আছে অনুসন্ধানের সঙ্কেত-সূত্র। পুরনো চিঠিগুলো সব পড়ছি আর একেকটা পাথর উল্টে দেখছি যেন তার নিচে কী ছিল। তোমার সোয়েটারে মুখ গুঁজে রাখি। নিবিড়ভাবে একটা ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি, সমুদ্রসৈকতে তোলা, আমাদের চোখে রোদ্দুর আর পিছনে জলরাশি। ভুলে যাওয়া পিকনিক বাস্কেট আর তোমার সৈকতের বালুতে বিছানোর ডোরাকাটা চাদরটার কথা স্মরণ করতে পারাটাই এখন আমার জয়। কিভাবে জেলিফিশের হুলের আঘাতে পানি থেকে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে উঠে এলে সেই স্মৃতি মনে করতে পেরে নিজেকে জয়ী মনে হয়। ক্ষততে রান্নার মাংশ নরম করার মশলা মাখিয়ে দিয়েছিলাম। তুমি বলেছিল আমি নাকি ব্যথা কমিয়ে দিয়েছিএকথা মনে পড়লে আজও জয়ের আনন্দ পাই।

তোমাকে বলছি। সকালবেলা এই টিলার উপরে দাঁড়িয়ে নিজেদের জন্য যে জমি আমরা পছন্দ করেছিলাম সেদিকে তাকাই। চোখে পড়ে টুকরো টুকরো সবুজ আর ছোট্ট সুন্দর ছাউনিটা। সেই একই কুকুর ডাকছে। মনে হয় ঝড় আসবে। আমি কোন স্বর্গের কথা ভাবছিলাম না। শুধু চেয়ে দেখছিলাম মেঘগুলো। কী সুন্দর! দেখছিলাম কিভাবে ওরা ঢেকে দিচ্ছে সূর্যটাকে।