লালিবেলার বিচ্ছিন্ন জনপদে

ভোর চারটায় ফ্লাইট ল্যান্ড করল। এত ঘুম পেয়েছে যে আশেপাশে কিছু দেখার মতো অবস্থা নেই। প্লেন থেকে নেমে ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়ালাম। আমার পেছনে ইথিওপিয়ান একটা ছেলে। আর সামনে একজন মাঝবয়সী লোক সমানে হাঁচিকাশি দিয়ে যাচ্ছে। আমি শংকিত হয়ে পড়লাম। সবে যাত্রা শুরু হয়েছে। সামনে আরও অনেক জায়গা দেখা বাকি। এখনই অসুস্থ হতে চাই না। সামনের লোকের কোনো আদব-লেহাজের বালাই নেই। মুখ না ঢেকেই কাশছে। আমি অবশ্য মাস্ক পরে আছি। ভ্রমণে আমি সবসময় মাস্ক পরে থাকি। সেই কোভিডের সময় থেকে অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি ইথিওপিয়ান তবে বসবাস করে আমেরিকায়। আমি ভ্রমণ করতে এসেছি শুনে ওর চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছে। বলে, ‘দেশের অবস্থা খুব খারাপ। সরকার আর বিদ্রোহীগোষ্ঠীর মাঝে যখন-তখন বন্দুক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তুমি এর মধ্যে কি মনে করে এলে?’ আমি বলি, আমার মাথা খারাপ আছে তাই বিপদসংকুল জায়গায় ঘুরে বেড়াই।
একে একে আমার পালা এল। ইমিগ্রেশন অফিসার কিছু না জিজ্ঞেস করেই পাসপোর্টে এন্ট্রি সিল বা স্ট্যাম্প দিয়ে দিল। এখন বাজে ভোর সাড়ে চারটা। যে গেস্ট হাউসে উঠব তারা বলেছে আমাকে নিতে আসবে সকাল ছ’টার সময়। দেড় ঘণ্টা বসে থাকতে হবে।
আদ্দিস আবাবায় প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়েছে। জ্যাকেটেও শীত মানছে না। আমি এসেছি মরক্কো থেকে। মরক্কোর আবহাওয়া ছিল চমৎকার। খুব গরম বা ঠান্ডা ছিলো না। এদিকে ঠান্ডা, তার উপর ঘুমে আমি ঢলে পড়ে যাচ্ছি।
এক সময় ছ’টা বাজল আমাকে নিতে গাড়ি আসল। গাড়ি ড্রাইভ করে গেস্ট হাউসের মালিক নিজেই এসেছে। তার নাম হাইলি, বয়স হবে ৪৫-এর আশেপাশে।
আদ্দিস আবাবায় হোটেল বুক করিনি ইচ্ছে করেই। একে তো আদ্দিস আবাবায় হোটেলের ভাড়া আকাশছোঁয়া আর গেস্ট হাউসের মতো যখন যা চাই তা পাওয়া যাবে না। অন্য অনেক দেশে গেস্ট হাউসে থেকে যে সুবিধা পেয়েছি তা স্টার হোটেলেও পাইনি।
দেশের অস্থিতিশীল ইকোনমির জন্য কমবেশি সবাই অর্থ সংকটে আছে। হাইলিও হয়তোবা কস্ট কাটিং-এর জন্য ড্রাইভার রাখেনি।
গেস্ট হাউসে দু’জন কর্মচারি আছে। এদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে হাইলি উধাও হয়ে গেল। আমি এদের নাম তৎক্ষনাৎ মনে রাখতে পারিনি। ঘুমে চোখ খুলে রাখা দায়। রুমে ঢুকে বিছানায় গিয়ে কম্বল জড়িয়ে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।
ঘুম থেকে উঠতে উঠতে বেলা প্রায় একটা বেজে গেল। আমার রুমের আসবাবপত্র খুবই সাধারণ মানের। বিছানা, একটা কাঠের আলমারি আর চেয়ার-টেবিল। রুম থেকে বেরোলে উঠোন। উঠোন ঘিরে গোল করে করা অতিথিদের জন্য দশটা রুম। বের হতেই লম্বা মতো যে ছেলেটির সাথে দেখা হল তার নাম আব্রাহাম। এখন আবার জিজ্ঞেস করে নাম জানলাম। কফি দিতে বললাম। আমি মুখহাত ধুয়ে আমার রুমের সামনের বারান্দায় চেয়ার পেতে রোদে বসলাম। কনকনে ঠান্ডা হাড় অবধি ঢুকে যাচ্ছে। আব্রাহাম ইথিওপিয়ার বিখ্যাত কফি নিয়ে আসল। এ কফি ক্ষুদ্রাকার কাপে করে চুমুক দিতে হয়। কফি কাপের হাতল থাকে না। এক চুমুক দিতেই রন্ধ্রে রন্ধ্রে কড়া কফির স্বাদ ও ঘ্রাণ ঢুকে গেল। ইথিওপিয়ান কফি এত কড়া হয়! আমার চেহারা দেখে আব্রাহাম বুঝে গেল কি সমস্যা! ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বলল, ‘সুগার। কফি ওকে।’ মানে কফির কড়াভাব কমাতে আরও চিনি মেশাতে হবে। ব্ল্যাক কফিতে এক গাদা চিনি আব্রাহামই ঢেলে দিল। এরা কফি এভাবেই পান করে। খুব কড়া ব্ল্যাক কফি, ছোট একটা কাপে, বেশ অনেকটা চিনি মিশিয়ে। তবে ইথিওপিয়ান কফির স্বাদ ও ঘ্রাণ অন্য কফির তুলনায় একেবারেই আলাদা। খুব ভালো মানের কফি মনে হল।
কফি, নাশতা সারার পর গেস্ট হাউসে হাইলি চলে এল। আমি যাব লালিবেলা, গন্ডার ইত্যাদি জায়গায়। অবশ্য লালিবেলা, গন্ডার ছাড়া আর কোন কোন জায়গায় যাব তা এখনো ঠিক করিনি।
হাইলির কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দরকার। আগে থেকে কোনো ট্যুর কোম্পানির প্যাকেজ বুক করিনি, কারণ সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। এখানে এসে পরিস্থিতি জেনে তবেই টিকেট কাটব বলে ঠিক করেছি।
হাইলিকে খুলে বলতেই সে বলল, ‘লালিবেলা, গন্ডারে তুমি বাই রোড যেতে পারবে না। বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের সাথে প্রায়ই সেনাবাহিনীর বন্দুকযুদ্ধ হয় বলে আদ্দিস আবাবা থেকে সেসব জায়গায় যাবার রাস্তা সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। একমাত্র উপায় প্লেনে করে যেতে হবে।’
আমি এ প্রস্তাবের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমি বাজেট ট্রাভেলার, সব জায়গায় প্লেনে করে যেতে হলে বাকি যেসব দেশ ঘুরব সেখানে যাবার টাকায় টান পড়তে পারে। কিন্তু প্লেনে না গিয়েও উপায় নেই। যেতে যখন হবে তখন হাইলিকে বললাম আমার টিকেটের ব্যবস্থা করে দিতে। হাইলি গেস্ট হাউসের অফিসে আমাকে নিয়ে বসল। আমি দিনক্ষণ বলছি আর ও একটার পর একটা টিকেট অনলাইনে বুক করছে। আপাতত লালিবেলা আর গন্ডারের টিকেট কাটলাম। পরের টিকেটগুলো দেশের রাজনৈতিক অবস্থার উপর নির্ভর করে কাটব।
হাইলি চলে যাবার আগে বুঝিয়ে দিল কোথায় কিভাবে যেতে হবে। আমি পরশু যাচ্ছি লালিবেলা। আশেপাশে ঘুরে দেখা দরকার আর কোথায় কি পাওয়া যায় তাও জানা দরকার।
লালিবেলায় যাবার দিন আদ্দিস আবাবা এয়ারপোর্টে আমাকে হাইলি নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমার সাথে একটা ব্যাকপ্যাক। ইথিওপিয়া ভ্রমণের সব জিনিসপত্র এই ব্যাকপ্যাকে এঁটে গিয়েছে। আদ্দিস আবাবার ঠান্ডায় মনে হয় জমেই যাব। জ্যাকেটেও শীত মানছেনা। মাথায় স্কার্ফ বেঁধে নিলাম।
ফ্লাইটের সময় হতেই গেটের কাছে চলে গেলাম। আদ্দিস আবাবা ডমেস্টিক এয়ারপোর্টটা খুবই সাধারণ মানের। তবে বেশ বড়। এদেশে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনস ছাড়া অন্য কোন এয়ারলাইন কম্পানি নেই। তাই এদেরই একচ্ছত্র আধিপত্য। আর দেশটাও এত বড় যে অনেকগুলো ডেস্টিনেশনে ফ্লাইট যাওয়া-আসা করে।
লালিবেলায় যাবার আগে এত বিধিনিষেধ শুনছি, কে জানে ওখানে গেলে কি হয়। ফ্লাইটে খুব বেশি প্যাসেঞ্জার নেই। এখন নাকি ট্যুরিস্ট বলতে গেলে যায়না। অথচ ইথিওপিয়ার নাম শুনলে প্রথমেই মনে আসে লালিবেলার নাম।
আদ্দিস আবাবার উঁচু উঁচু দালানকোঠা পার হয়ে মেঘের ওপর দিয়ে প্লেন এখন যাচ্ছে সাত আসমানের কাছাকাছি। আমি অবশ্য একটা আসমানই দেখতে পাচ্ছি। এক ঘন্টার পথে স্ন্যাকস বলতে স্যান্ডউইচ আর জুস দিল। এদের ভাড়া মোটামুটি আয়ত্তের মাঝে। একেকটা ফ্লাইটে ৪০০০ বির-এর (ইথিওপিয়ান মুদ্রা) মতো পড়েছে। এক ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে লালিবেলার কাছাকাছি আসতেই ক্যাপ্টেনের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘আমরা প্রায় পৌঁছে গিয়েছি।’ পুরোটা সময় জানালা দিয়ে তাকিয়েই ছিলাম। এ দেশের রূপ এক সেকেন্ডের জন্যও মিস করতে ইচ্ছে করছিলো না। এখন জানালা দিয়ে অপার সৌন্দর্য ছক কেটে যাচ্ছে। নীচে সবুজ আর হলুদ ক্ষেত মখমল দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে। যেন মখমল ছাড়া অন্য কিছু চেনানোর নেই আজ।
প্লেন ল্যান্ড করার আগেই দেখি রানওয়ে ধরে কয়েক মিটার পর পর আর্মি অফিসার দাঁড়িয়ে। দেখেই মনে হল অবস্থা সংঙ্গীন। এত সুন্দর একটা ভূমিতে থরে থরে আর্মি অফিসার সাজানো দেখে একটুও ভালো লাগলো না। প্লেন ল্যান্ড করার পর ছবি তোলা যাবে কিনা জানি না। তবুও কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম। ছোট্ট একটা এয়ারপোর্ট আর তার পেছনে পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চল।
রানওয়ে থেকে হেঁটেই এয়ারপোর্টে যাবার ব্যবস্থা। আমি এর আগে ফিলিপাইনে একটা ছোট এয়ারপোর্টে এরকম হেঁটে লাগেজ বেল্টের কাছে চলে গিয়েছিলাম। এখানেও সেরকমই ব্যবস্থা করা আছে। লাগেজ বেল্ট থেকে লাগেজ নিয়ে গাড়ি পার্ক করার জায়গায় গিয়ে দেখি হোটেল থেকে আমার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। একটা কাগজে আমার নাম লিখে হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এরকম কাগজে বড় বড় করে আমার নাম লেখা দেখলে কেমন যেন সংকোচ বোধ হয়। মনে হয় আমি আলাদা কেউ। আসলে তো আমি খুব সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষের মাঝে মিশে যেতে চাই।
লালিবেলা ইথিওপিয়ার উত্তরে পড়েছে এবং সবচেয়ে বিপদসংকুল এলাকা। এখানে হোটেল বুক করার সাথে সাথে হোটেল থেকে মেসেজ এল যে তারা গাড়ি পাঠিয়ে দেবে। গাড়ি পাঠানো ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। এখানে ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। নির্দিষ্ট যাত্রীর জন্য নির্দিষ্ট গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে থাকে। যাদের যাবার জন্য কোন বাহন থাকে না, তারা হয় অন্যের গাড়িতে লিফট নেয় অথবা হেঁটে বাড়ি যায়। স্থানীয়রা এভাবেই কাজ চালাচ্ছে। সড়কপথ বন্ধ থাকার কারণে যাদের জরুরি কাজে লালিবেলার বাইরে যেতে হবে তারাও প্লেনে করেই যাওয়া আসা করছে।
আমি একটা রিসোর্টে রুম বুক করেছি। রিসোর্টে যাবার পথে এদেশের গ্রামাঞ্চলের রূপ দেখে মোহিত হয়ে যাচ্ছি। সারি সারি পাহাড় আর পাহাড়ের পায়ের কাছে হলুদ, সবুজ শস্যক্ষেত। হলুদ শস্যক্ষেত দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তোবা ফসল তোলা হয়ে গিয়েছে। আসলে তা নয়। এগুলো যে কিসের ক্ষেত তা ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানা গেলো। এগুলো সোরগাম নামক এক শষ্যের ক্ষেত। হালকা হলুদ রঙের বলে সবুজ ভুট্টা বা যবের ক্ষেত থেকে আলাদা করা যাচ্ছে।
গাড়ির পাশ দিয়ে দু’টো শিশু দৌড়ে গাড়ির সাথে পাল্লা দিতে চাইছে। কী মধুর শৈশব এদের! একদল নারী পথের পাশ দিয়ে দূরের পাহাড়ঘেরা গ্রামে হারিয়ে গেল। এ অঞ্চলের নারীরা লম্বা স্কার্ট আর টপ পরে, আর গায়ে জড়িয়ে রেখেছে সাদা চাদর।
চলতে চলতে এক রাখাল বালকের সাথে দেখা হল। কাঁধে লাঠি বসিয়ে পথ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
অনেক দূরে দূরে একটা দোচালা টিনের ঘর দেখা যাচ্ছে, মাটির দেয়াল। একেবারে পটে আঁকা ছবি। এয়ারপোর্ট থেকে লালিবেলা গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। রাস্তা ভালো বলে দ্রুতই গ্রামের ব্যস্ততম এলাকায় চলে এলাম। ব্যস্ততম বলার কারণ এখানে পথের দু’পাশে পাহাড়ের ঢালে ধাপে ধাপে বেশ কিছু বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। এছাড়া পথ, দূরের আকাশ একেবারেই ফাঁকা।
রিসোর্টে পৌঁছে রিসিপশনের ছেলেটির সাথে কথা বলছিলাম। আসার আগে সেই আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছিল। আর ভেবেছিল আমি একজন পুরুষ লোক। আমার নামে আগে মিস্টার জুড়ে দিয়ে মেসেজ করছিল। এহেন বোকার মতো কাজে হাসি পেল। ফাতিমা হল ইউনিভার্সাল নাম, যে কোন দেশে, যে কোন ধর্মের ভুরি ভুরি ফাতিমা আছে। ইথিওপিয়ায়ও আছে নিশ্চয়ই। এমনও হয়েছে, একটা গ্রুপ ট্যুরে কেউ কারো নাম মনে রাখেনি কিন্তু আমার নাম ড্রাইভার, গাইড থেকে শুরু করে সবাই মনে রেখেছে।
আমার রুম দোতলার উপরে। নীচে ডাইনিং রুম, লাউঞ্জ ইত্যাদি। পাহাড় বেয়ে বেয়ে নীচে আরও কয়েকটি রুম আছে তবে ছেলেটি আমাকে বিশেষ এই রুম দিয়েছে কারণ এখান থেকে পাহাড়ের অপার্থিব রূপ দেখা যায়। ছেলেটার নাম বিরহান। ট্যুরিস্ট নেই বলে ওই এখন রিসোর্টের ম্যানেজার। রিসোর্টের মালিকের এখন বেশি কর্মচারি রাখার সামর্থ্য নেই। তাই বিরহান আর চারজনকে দিয়ে কাজ চালাচ্ছে। ভাড়া কম বলে এই রিসোর্ট বুকিং দিয়েছি। এই বিশাল রিসোর্টে আমিই একমাত্র গেস্ট। একারণেই ভাড়া কমিয়ে দিয়েছে। লালিবেলার সব হোটেল, রিসোর্টের অবস্থা একই। রিসোর্ট মালিকদের ব্যবসা নিশ্চয়ই লাটে উঠে যাচ্ছে।
লালিবেলায় মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়া হয় হুটহাট করে। আর মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ অনেকদিন ধরে। অল্প কয়েকটি রিসোর্টে ওয়াইফাই আছে। এর বাইরে পুরো এলাকায় কেউ ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে না। প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে এ জনপদ।
দোতলায় আমার রুমের দেয়ালজোড়া জানালা তখন আমাকে সামনের সোরগাম ক্ষেতে ডেকে চলছে। লালিবেলায় ঠান্ডা আছে আদ্দিস আবাবার মতোই তবে হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে না। হাতমুখ ধুয়ে নীচে চলে গেলাম। বিরহান নীচেই ছিল। আমি বললাম, ‘আমি পেছনের সোরগাম ক্ষেত দেখতে যাচ্ছি। কোন পথ ধরে যাব?’ শুনে সে রে রে করে উঠল, ‘তুমি একা কিছুতেই যেতে পারবে না। ট্যুরিস্টদের একা ঘোরার নিয়ম নেই। আমি আসছি তোমার সাথে।’
আমি আর বিরহান বেরিয়ে পড়লাম ক্ষেত দেখতে। আমি আগে কখনো সোরগাম নামক শস্য দেখিনি, নামও শুনিনি। সোরগাম দিয়ে এরা পরেজ তৈরি করে খায়। এদের প্রধান খাদ্য অবশ্য ইঞ্জেরা। আদ্দিস আবাবাতে ইঞ্জেরা খেয়ে মনে হয়েছিল, দক্ষিণ ভারতের দোসা খাচ্ছি। অবশ্য ইঞ্জেরা দোসার চেয়ে একটু নরম হয়। রন্ধনপ্রণালী প্রায় একই। ইঞ্জেরা তৈরি করা হয় তেফ নামক এক ধরনের শস্য দিয়ে।
রিসোর্টের পেছন দিকে সোরগাম ক্ষেত এখন আরও সামনের পাহাড়ের কাছে যেতে চাইছে। আমি আরও এগিয়ে গেলাম। সোরগাম ক্ষেতের পর যবের ক্ষেত। যব ক্ষেতেও যব ধরেছে। আমার পেছন পেছন গ্রামের কয়েকটি শিশু দলবেঁধে ঘুরছে। মেইনল্যান্ড আফ্রিকায় এবার দ্বিতীয় বারের মতো এসেছি। আগের বারের অভিজ্ঞতা কিছু তো কাজে আসবেই। এই শিশুরা একজন সাদা চামড়ার মানুষ দেখে আনন্দিত হচ্ছে। যদিও আমি আসল সাদা চামড়ার মানুষ নই। আসল সাদা চামড়ার দেশের মানুষ মানে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মানুষরা এশিয়ানদের কালো বলে মনে করে, সে ইরানি হোক বা জাপানি বা তুর্কি। আমি আফ্রিকার মানুষদের বোঝালেও এরা বুঝতে চায় না যে আমি শ্বেতাঙ্গ নই। হয়তোবা চেহারায় খানিকটা স্প্যানিশ ছাপ আছে কিন্তু এটা যে নকল ছাপ সে আমার চেয়ে আর কে বা ভালো জানে!
পেছনে ঘুরঘুর করা শিশুদের সাথে কয়েকটা ছবি তুললাম। এরপর হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের দিকে চলে এলাম। আফ্রিকার জনসংখ্যা কম হবার কারণে গ্রামকে ঠিক গ্রাম বলে মনে হয় না। বিস্তীর্ণ একটা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ৪/৫ টা ঘর। আর পেছনে পাহাড়। ঘরগুলো আমাদের দেশে আগেকার দিনের মতো টিনের চাল বা খড়ের চাল দেয়া। বেশিরভাগের দেয়াল মাটির তৈরি। একই আঙিনায় আলাদা রান্নাঘর, গোয়ালঘর ও আলাদা বাথরুম। বাড়ির সামনে ফুলগাছে ফুল ফুটেছে। এখন অক্টোবর মাস সবে শুরু হয়েছে। এ অঞ্চলে শীতকাল চলে গিয়েছে প্রায়, এখন বসন্ত উঁকি দিচ্ছে গ্রামে গ্রামে। কিন্তু বসন্তকালে আমাদের দেশের শীতকালের মতো আবহাওয়া। তবে লালিবেলায় এসে যে ব্যাপারটা ভালো লাগছে তা হল, ঠান্ডা পড়লেও সহনশীল ঠান্ডা। হাড় কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে না আদ্দিস আবাবার মতো। অথচ দুই স্থানের তাপমাত্রা একই।
বিরহানকে বলতেই সে গ্রামের একটা বাড়িতে নিয়ে গেল। খুব সাধারণ ঘর কিন্তু ভীষণ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। আফ্রিকার এই বিষয়টা আমাকে প্রতিবারই মুগ্ধ করে। এরা খুব পরিচ্ছন্ন জাতি।
ঘরের ভেতরে বসার জন্য কাঠের পিড়ি মতো আছে যা আমাকে এগিয়ে দেয়া হল। বাড়িতে আসবাবপত্র বলে কিছু নেই। মেঝেতে বিছানা পেতে এরা ঘুমায়। বাড়ির কর্তা কৃষিকাজ করেন। দুটো ছোট বাচ্চা আছে বয়স ৭ ও ৫। বিদ্যুৎ আছে, তবে সবসময় বিদ্যুৎ সংযোগ থাকে না।
এই পরিবারের আমাকে আপ্যায়ন করার মতো সামর্থ নেই। বাড়ির কর্ত্রী লজ্জিত হবার আগেই আমি সে বাড়ি থেকে চলে এলাম। বিরহান বলল, ‘এখানে খাদ্যের এতই অভাব যে সবাই একবেলা খাবার খায়।’ শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অথচ আমরা বিয়েবাড়িতে বা বুফেতে খেতে গেলে কত খাবার অপচয় করি! কেউ কেউ তো নিজের বাড়িতেই খাবার অপচয় করে।
পথ চলতে চলতে গ্রামের গীর্জার পাদ্রীর সাথে দেখা হয়ে গেল। এত অমায়িক মানুষ আমি আর দেখিনি। এরা আহমারিক ভাষায় কথা বলে। পাদ্রী ইংরেজি জানেন না। মাথায় সাদা কাপড় পেঁচিয়ে যারা পাগড়ি পরে থাকেন তারাই পাদ্রী। এভাবেই তাদের চেনা যায়। আর হাতে থাকে ক্রস। সাধারণ কোটপ্যান্টের উপর এরা একটা বড় সাদা চাদর জড়িয়ে নেয়। সাধারণ জনগণও গীর্জায় গেলে সাদা চাদর জড়িয়ে তারপর গীর্জায় প্রবেশ করে। চাদরটি ইথিওপিয়ার ঐতিহ্যবাহী খাদি কাপড় যা তাঁতে বোনা হয়। এই কাপড়ের বেশ কয়েকটা কোয়ালিটি আছে। নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী মানুষ সে কাপড় খরিদ করে। তবে গীর্জায় যেতে হলে এই কাপড় অবশ্যই গায়ে জড়িয়ে যেতে হয়।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে আর আজ আমি নাশতার পর বলতে গেলে কিছুই খাইনি। বিরহানকে বলতেই বলল, ‘এখানকার একমাত্র রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যাবে আধ ঘণ্টার মধ্যে। আমরা রিসোর্টে কিছু রান্না করে দেব তোমায়।’ সেই ভালো। আমি এদের ডাল বা কারি খেতে পারি না, বেজায় ঝাল আর প্রচুর মশলা দিয়ে তৈরি করে। তার চেয়ে রিসোর্টে যদি স্বাস্থ্যকর খাবার পাওয়া যায় তাহলে আমার মতো সেদ্ধ খাবার খাওয়া মানুষের জন্য মঙ্গলকারক।
আমরা রিসোর্টে ফিরে আসতেই কিচেন থেকে জানালো যে রান্না করার মতো সবজি বা মাংস নেই। আমাকে ভদ্রোচিত খাবার অফার করতে পারছে না বলে তারা দুঃখিত। কিন্তু আমার যে খিদেয় প্রাণ যাই যাই করছে। কাহাতক কুকিস খেয়ে থাকা যায়। হঠাৎ বিরহান বলল, ‘তোমাকে স্পিনাচ পাস্তা করে দিলে খাবে?’ আমাকে এখন ক্ষেতের মাটি সুন্দর করে সাজিয়ে পরিবেশন করলেও খেয়ে ফেলব। আমি সম্মতি দিতেই দেখি বিরহান কিছু শাক কিচেন গার্ডেন থেকে তুলে এনে রান্নার ছেলেটিকে দিল। ঝটপট রান্নাও হয়ে গেল। আমি অল্প সময়ের মধ্যে এত মুখরোচক খাবার পেয়ে খুবই আনন্দিত। ওদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে আমার রুমে চলে এলাম।
রুমে তখন দেয়ালজোড়া জানালা আমার পথ চেয়ে বসে ছিল। দূরে কিছু দেখা না গেলেও বিশাল চাঁদকে ঠিকই দেখা যাচ্ছে। সামনে কোথাও কোনো বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে না। গ্রামবাসী ঘুমিয়ে গিয়েছে। শুধু জেগে আছি আমি আর আমার চাঁদ।
ঠিক এই মুহূর্তকে উদযাপন করতে হলে রাস্তায় চাঁদের পাশাপাশি হেঁটে যেতে হবে। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়। সন্ধ্যে ছ’টা থেকে এখানে কারফিউ দিয়ে দেয়া হয়। কেউ বের হতে পারে না। তাই আমি জানালায় বসে আমার চাঁদকে দেখি। চাঁদও দেখুক আমায়।
ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গেল প্রার্থনার সুরে। এই শীতের সকালে এত ভোরে এরা উঠে প্রার্থনা করে! ঘড়িতে দেখি ভোর পাঁচটা বাজে। দিনের আলো এখনো ঠিকমতো ফোটেনি। মাইকে সমানে প্রার্থনা করে যাচ্ছে আর আমার ঘুমের বারোটা বেজেছে। আর এক ঘণ্টা পর প্রার্থনা শুরু করলে কি হতো? এই শীতের সকালে উঠতেও ইচ্ছে করছে না। আধঘণ্টা কানে বালিশ চেপে যখন ঘুমাতে পারলাম না তখন উঠে গেলাম। হাতমুখ ধুয়ে চা বানিয়ে খেলাম। আফ্রিকার চা আমার কাছে এক অনন্য সুগন্ধের বলে মনে হয়। ইথিওপিয়ার কফি তো আরও অনন্য। চা খেতে খেতে জানালা দিয়ে এক অপার্থিব দৃশ্য দেখলাম। সামনের সোরগাম ক্ষেতের আইল ধরে সারি বেঁধে মাথা থেকে পা অবধি সাদা পোশাকে মুড়ে নারীরা বাড়ি ফিরছে। এখন বাজে সাড়ে ছ’টা। এরা কত ভোরে উঠে গীর্জায় গিয়েছে কে জানে!
আর সাদা পোশাকে তাদের একেকজনকে দেবদূতের মতো লাগছে। এই শোভা দেখতে দেখতে মনে হল নীচে গিয়ে নাশতা সেরে নেই। সকাল আটটায় আমার গাইড আসবে আমাকে নিয়ে পুরনো গীর্জাগুলো ঘুরিয়ে দেখাবে। আগের থেকেই সতর্কতা ছিল যে, আমি যেন গাইড ছাড়া একা কোথাও না বেরোই। তাই আমার রিসোর্ট থেকে গাইড ঠিক করে দেয়া হয়েছে।
নীচে ডাইনিং হলে গিয়ে দেখি নাশতা তৈরি হতে আরও সময় লাগবে, এরা সব গীর্জায় গিয়েছে প্রার্থনা করতে। আজ কোনো বিশেষ দিন কি? বিরহান আসলে জিজ্ঞেস করতে হবে। এই ছেলেটাই অন্যান্য স্টাফদের মধ্যে ইংরেজি জানে। আমি আরেক কাপ চা হাতে নিয়ে এদের বাগান ঘুরে ঘুরে দেখি। অনেক ফুল আর পাতাবাহারের বাগান করেছে। একপাশে ছোট একটা কিচেন গার্ডেন আছে। কমলাগাছে ফুল ফুটেছে। মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে। রিসোর্টের এক কোনায় অনুচ্চ দেয়ালের ওপর সারি সারি মদিরার বোতল রাখা আছে। সেগুলো বেয়ে লতিয়ে উঠেছে জেরেনিয়াম ফুলের ঝাড়, গোলাপি ফুলও ধরেছে। এদের অ্যাস্থেটিক সেন্স তো বেশ। মদিরার বোতলের মাঝে ফুল ফুটিয়ে দিয়েছে। সোমরস পান করলে বোধহয় মনেও ফুল ফোটে।
আমার একা বাইরে যাওয়া বারণ তাই রিসোর্টের লনে বসে বসে রোদ পোহাচ্ছি। বেশ জমিয়ে ঠান্ডা পড়েছে। এর মাঝে রিসোর্টের কুক চলে এসেছে। অন্যরাও একসাথেই এসেছে। আজ ওদের বিশেষ প্রার্থনা ছিল। আজ সোমবার, ওদের বিশেষ প্রার্থনার দিন। অবশ্য যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই জনপদে প্রার্থনা করা ছাড়া আর কোনো কাজ আছে বলে মনে হয় না।
কুক ছেলেটির নাম আইসা। ঝটপট নাশতা তৈরি করে টেবিল সাজিয়ে দিল। আমি লনের টেবিল ছেড়ে উঠিনি। রোদে বসে নাশতা করতে কার না ভালো লাগে! নাশতার আয়োজন খুবই সাধারণ। আমিই বলেছিলাম যে আমি ব্রেড টোস্ট আর অমলেট খেতে চাই। স্থানীয় খাবার সকাল সকাল খাবার ইচ্ছে নেই।
লন থেকে সামনে আদিগন্ত সোরগাম ক্ষেত দেখা যায়। আশ্চর্য এই হলদে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে সোরগাম ক্ষেতে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন