গোল্লাছুট, ম্যারাডোনা আর মেসির বিশ্বকাপ

অ+ অ-

 

এক্কেবারে ছোট্টবেলায় ধূলিমাখা উঠোনে খেলতাম গোল্লাছুট। খুবই সহজ নিয়ম- সবাইকে পাশ কাটিয়ে দৌড়ে গিয়ে ওপার ছোঁয়া। কিশোরবেলায় যে পাকা দৌড়বিদ ছিলাম তা না, তবে হরিণপায়ে দৌড়ে দৌড়ে হয়রান হতাম খুব। কখনও বাংলোঘরের কাছে দূর্বা-শোভিত মাঠে দলবেঁধে মশগুল হতাম দাঁড়িয়াবান্ধায়। নিদাঘ দুপুরে কিশোরী বোনেরা ঝিরঝিরে আলো-ছায়ায় খেলত এক্কাদোক্কা বা দড়িলাফ। দাঁড়কাকের চেঁচাচেচির মতো মাঝে মাঝে তাদের ঝগড়া বেঁধে যেত- দুয়েকটা গালির শব্দও কানে বাজত। রুক্ষ চুলের কোনো অভিমানীনি আড়ি দিয়ে হরিতকীর গুটি ছুঁড়ে মারত জলের ঘাটে। বেবুঝ কিশোররা লম্ফ দিয়ে নেমে পড়তাম শান্ত জলে। বনকলমি আর হোগলাভরা জলের কিনারায় ঘাপুত করে ঘাই দিত রাক্ষুসে মাছ। ডুব প্রতিযোগিতায় ফেল মেরে কোকিলচক্ষু হয়ে দম নিয়ে দেখতে পেতাম- শান বাঁধানো ঘাটে বেকার ছেলেরা বাঘবন্দী খেলতে শুরু করেছে। উঁচু পাড়ে ঊর্ধ্বমুখি হয়ে পিঠ দিয়ে ডিমে তা দিত বর্ণিল মাছরাঙ্গা। আশেপাশেই ভাঙা-পাতিলের কাছে পড়ে থাকত দাঁড়াশের রুপালি খোলস। ভিজে কাদায় গেঁথে  থাকত হাঁসের পালক, ইটের টুকরো, ভাঙা চূড়িএসব। দূরে কোথাও তক্ষক ডাকত বিশ্রিস্বরে। টসটসে আকন্দবনে প্রজাপতি উড়ত আপনমনে। ভরদুপুরে নাবাল জমিতে গাইগরু খুঁটাবন্দী করে বিপজ্জনকভাবে ডাংগুলি খেলত দুষ্ট  ছেলের দল।

তবে বিকেলের উজ্জ্বল আলোয় নদীর পাড়ে খেলা জমে যেতকাবাডি-কাবাডি। নাছোড়বান্দা কেউ কেউ আল্লাহ-নবিজির কসম করে বলততার দম ঠিকই আছে। তবে  ফুটবল খেলা হতো কালেভদ্রে, কাদামাখা মাঠে কিংবা ফসলতোলা খেতে। আমাদের চৌহদ্দি দেয়া মাঠ ছিল না বলে পরিত্যাক্ত ধানক্ষেতই রূপান্তরিত হতো অস্থায়ী খেলার মাঠে। এর আগে আগুন জ্বেলে বা নাড়া উপড়ে উপড়ে সমতল মাঠ বানিয়ে ফেলত উৎসাহী যুবকদের দল। গোঁফওয়ালা রেফারি বাঁশি বাজালে খেলা শুরু হয়। ম্লান বিকেলে খেলোয়াড়দের লাথি খেয়ে খেয়ে বল বেচারার নাভিশ্বাস উঠত। খুব ছোট্ট বলে আমি এ খেলার দর্শক মাত্র। ইস, কবে যে বড় হয়ে একটা গোল করতে পারব!

একটু বড় হলে হঠাৎ করেই একটা চার নম্বর শাদা-কালো ডিয়ার বল উপহার পেলাম বাবার কাছ থেকে। আমি মায়ের কাছে গল্প শুনতে শুনতে পিলসুজের আলোয় ঘুমিয়ে পড়া আদুরে কিশোর। পুরো একটা বলের মালিক হয়ে ঘুমকাতুরে আমারও আর ঘুম আসে না। সেই জালবন্দী ফুটবল জড়িয়ে ধরে ঘুমাই। আমার পায়ের কাছে লেপের ওমে শুয়ে থাকত একটা মায়াবী বিড়াল। অন্যদিন একে লাথি মারি, বকা দিই। নতুন বলের মালিক বলে এখন ফুরফুরে মেজাজ। নরম হাতের ছোঁয়া দিই বিড়ালের তুলতুলে গায়ে। দূরাগত কীর্তনের সুর শুনতে শুনতে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। ভাবি, ইস, কখন সকাল হবে, পরে দুপুর গড়িয়ে আবার বিকেল। পরদিন মরা রোদে ভিজে বিজয়ী বীরের মতো ফুটবল নিয়ে আগে আগে হাঁটি। আমার পেছনে এক দঙ্গল ধূলি-ধূসর সাথী। ভাজা শিঙাড়ার গন্ধ শুঁকে রাগী মিস্তিরিকে খুচরো পয়সা দিয়ে নতুন বলে হাওয়া দিই। এরপর সবাই মিলে হইহই করে চলে যাই সবুজ মাঠে। কিন্তু ফুটবল খেলতে গিয়ে দেখি, যতটা আগ্রহ, আমি আসলে ততটা কুশলী খেলোয়াড় না। একটা সহজ গোলের সুযোগ নষ্ট করে অগ্রজের বকা পর্যন্ত খাই, তবু বেশ লাগে। একবার ফাঁকা পেয়ে দূর থেকেই প্রাণপণে শট নিইপ্রতারক বল বংশদণ্ডে বাড়ি খেয়ে পাশ কেটে চলে যায়। আখখেতের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া কিশোরীরা আমার এই ব্যর্থতায় খিলখিল করে হাসে। লজ্জায় আমার চোখে পানি আসার উপক্রম।

সেবার বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল মেক্সিকোয়। ১৯৮৬ সাল। এর রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল আমাদের গাঁয়েও। অনেকের  দেখাদেখি হলুদ জার্সি পরে ব্রাজিলের সাপোর্টার বনে যাই। বিশাল জার্সি আমাকে গ্রাস করে ফেলেছে দেখে মেজপা ফিক করে হেসে ফেলেন। কিন্তু তাতে কী। গা চুলকিয়ে চুলকিয়ে উঠোনে বসে সাদাকালো টিভিতে আগের দিনের রিলে করা খেলা দেখি। আহ, কী সুন্দর ফুটবলসব ছবির মতন।

কিন্তু দক্ষ ফুটবলার না হতে পারলে কী হবে, খেলা দেখতে আমার বড্ড ভালো লাগে। ঠনঠনে ক্ষেতে ফুটবল টুর্নামেন্ট দেখি বিভোর হয়ে। কী বাহারি রংচঙে জার্সি, সবার পায়ে শক্ত বুট। ফুলহাতা হলুদ গেঞ্জিপরা ছিপছিপে গোলকিপার লাফিয়ে লাফিয়ে গা গরম করে। হায়ারে আসা প্লেয়ারের মাথাজুড়ে কী বিচিত্র চুলের স্টাইল। কেউবা একদম ন্যাড়া। কুচকুচে কালো ড্রেসপরা রেফারি পিতলের বাঁশীতে ফু দিলে একটা বল নিয়ে সবার হুড়োহুড়ি পড়ে যায়ঠিক যেন কুরুক্ষেত্র। একপাশে বসে সিগারেটে দম দিয়ে চেয়ারে বসে থাকেন চিন্তাযুক্ত চেয়ারম্যান। সম্ভবত তার দলের জয় নিয়ে শঙ্কিত। কেউ একজন গোলের সুযোগ মিস করলে তিনি রীতিমত অশ্রাব্য গালি দিয়ে দাঁড়িয়ে যান। দর্শকের উল্লসিত চিৎকারে সে গালাগাল হারিয়ে যায়। দূরাগত ইঞ্জিনের ভেঁপু শুনি। বিভোর দর্শকের উষ্মা এড়িয়ে বাদামওয়ালা এসে সন্তর্পণে কাগজের ঠোঙ্গায় বাদাম-নুন বিক্রি করে। এক পর্যায়ে পক্ষপাতদুষ্ট রেফারিং নিয়ে দুইপক্ষ মারামারি পর্যন্ত বেঁধে যায়। রঙজ্বলা পোশাকের চৌকিদার ফুড়ুত ফুড়ুত করে বাঁশি বাজায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ভয় পেয়ে বাড়ি এসে কলের মুখে ঠোঁট ছুঁইয়ে ঢকঢক করে পানি খাই।

মনে পড়ে, সেবার বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল মেক্সিকোয়। ১৯৮৬ সাল। এর রেশ ছড়িয়ে পড়েছিল আমাদের গাঁয়েও। অনেকের  দেখাদেখি হলুদ জার্সি পরে ব্রাজিলের সাপোর্টার বনে যাই। বিশাল জার্সি আমাকে গ্রাস করে ফেলেছে দেখে মেজপা ফিক করে হেসে ফেলেন। কিন্তু তাতে কী। গা চুলকিয়ে চুলকিয়ে উঠোনে বসে সাদাকালো টিভিতে আগের দিনের রিলে করা খেলা দেখি। আহ, কী সুন্দর ফুটবলসব ছবির মতন। ব্রাজিল, ইতালি, ইংল্যান্ড, জার্মানির কী দাপুটে ফুটবল। ব্রাজিল হেরে গেলে সমগ্র পাড়া জুড়ে শশ্মানের নীরবতা ভর করে। কে যেন আমাদের ঘরে আর্জেন্টিনার প্লেয়ারদের ছবি পর্যন্ত ঝুলিয়ে দেয়। আস্তে আস্তে দেখি, সব রথী-মহারথীদের ছাড়িয়ে পুরুষ্ট উরুর এক খুদে খেলুড়ে পাদপ্রদীপের আলোয়। ঝাঁকড়া চুলের এই জাদুকরের নাম দিয়াগো ম্যারাডোনা। ওই সময়টায় সবার মুখে আর বুকে ম্যারাডোনা। বাবা একদিন বাজার থেকে এনে দিলেন আর্জেন্টিনার আকাশী-নীল জার্সি। আমি বিভীষণ হয়ে ম্যারাডোনার ছাপমারা গেঞ্জি পরে লণ্ঠনের আলোয় গ্লোব উল্টেপাল্টে খুঁজি সুদূরের দেশ আর্জেন্টিনা। এর আগে এই মুল্লুকের নামও শুনিনি। পুরো গ্লোবের খানা-তল্লাশি করেও এদেশের কোনো হদিশ পাই না। মেজপা তর্জনী দিয়ে দেখিয়ে দেয়এই বোকা, দেখ, এইতো ম্যারাডোনার দেশ। পরদিন আর্জেন্টিনার জার্সির সৌরভ শুঁকে শুঁকে গাঁয়ের পথে হাঁটি। স্কুলের মোড়ের পিলারে আর কড়ই গাছে কারা যেন ভালোবেসে সাদা-নীল নিশান পর্যন্ত উড়িয়ে দিয়েছে। সেবার ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতেছিল।

কিছুদিন পর ফুটবলের জোয়ার এড়িয়ে বুদ্ধিমান ব্রাজিলপ্রেমীরা হাজির করল ক্রিকেটের সারঞ্জামতিনকাঠির স্ট্যাম্প, কাঠের ব্যাট আর ক্রিকেট বল। ডিডি-ওয়ান চ্যানেলে এশিয়া কাপ ক্রিকেট দেখি। পুরোপুরি বুঝি না, তবু সুঠাম ক্রিকেটাররা ছক্কা মারলে হাততালি দিই, কেউ আউট হলে মন খারাপ হয়। তখন বাংলাদেশ এশিয়া কাপে খেলতে গিয়ে সবার সাথে গোহারা হারে। কী সুদর্শন দেখতে আতহার আলি, কিন্তু কয়েক বল খেলেই বোল্ড হয়। চোখে পানি পর্যন্ত চলে আসে। কিন্তু ক্রিকেট যেন ফুটবলের মতো অতোটা আকর্ষণীয় নয়। একসময় দীর্ঘসূত্রী ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে আবার ফুটবলে মগ্ন হই। কখনও একটু আধটু ফুটবল খেলি বা আবার সহপাঠীদের পীড়াপীড়িতে দলের ম্যানেজার হই, চাঁদা তুলি, গোলপোস্ট সাজাই বা সবুজ মাঠে চুনের দাগ দিই।  হাইস্কুলে এসে দেখি জমজমাট আন্তঃস্কুল ফুটবল প্রতিযোগিতা। বাসের ছাদে উঠে শহরে গিয়ে ফুটবল খেলা দেখি। অবশ্য এক পর্যায়ে আমাদের টিম হেরে গেলে মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে আসি সন্তর্পণে, সিঁধকাটা চোরের মতন।

দক্ষ ফুটবলার না হতে পারলে কী হবে, খেলা দেখতে আমার বড্ড ভালো লাগে। ঠনঠনে ক্ষেতে ফুটবল টুর্নামেন্ট দেখি বিভোর হয়ে। কী বাহারি রংচঙে জার্সি, সবার পায়ে শক্ত বুট। ফুলহাতা হলুদ গেঞ্জিপরা ছিপছিপে গোলকিপার লাফিয়ে লাফিয়ে গা গরম করে।

হঠাৎ করেই  ফিরে এলো ১৯৯০ এর বিশ্বকাপ। এই প্রথম গাঁয়ের সুপারি গাছের আগায় আগায় ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার পতাকা পতপত করে উড়তে দেখি। ইতোমধ্যে আমাদের এরিস্টোটল আলি আকবর স্যারের কাছে জেনে গেছি, কবিগুরু রবি ঠাকুর নাকি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো নামের এক আর্জেন্টাইন নারীর প্রেমে পড়েছিলেন। ১৯২৪ সালে পেরু যাবার পথে কবিগুরু আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এয়েরেসে ভিক্টোরিয়ার আতিথ্য গ্রহণ করেন। অসুখী এই নারী আর ঋষিকবির মাঝে প্রেম হয়েছিল এটা সত্য। তবে প্রেমের রকমফের নিয়ে এখনও গবেষণা চলমান। পূরবী কাব্যের অধিকাংশ কবিতা ওকাম্পোকে মনে করেই চয়ন করেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবি ঠাকুর গ্রন্থটি উৎসর্গও করেছিলেন ভিক্টোরিয়াকে এভাবে—‘বিজয়ার করকমলে বিজয়ার প্রেমিক রবি ঠাকুরের গান শিখি, কবিতা পড়ি। ভাঙামলাটের  গল্পগুচ্ছ উল্টেপাল্টে দেখি। রবীন্দ্রনাথের কারণেই প্রেমে পড়লাম কবির প্রিয়তমার দেশ আর্জেন্টিনার। বয়ঃসন্ধিকালের ঔৎসুক্যে বিশ্বকাপ গ্যালারির দিকে তাকাই, যদি এরূপ আর্জেন্টাইন কোনো উর্বশী কাউকে দেখি! নাহ, এর চেয়ে ব্রাজিলের সাম্বানৃত্যশিল্পীরাই বেশ লাস্যময়ী। বেখেয়ালে কী সৌন্দর্য মিস করতে যাচ্ছিলাম। আফ্রিকান ক্যামেরুন বাহিনীর মারকুটে ডিফেন্ডাররা বল ফেলে ম্যারাডোনাকে লাথি মারেকারবালার হাহাকার উঠে আমাদের উঠোনে। ধীরে ধীরে আর্জেন্টিনা নিজেদের গুছিয়ে নেয়। মুগ্ধ হয়ে ম্যারাডোনার খেলা দেখি। কিছুটা চরাই- উৎরাই শেষে দীঘল চুলের কেনেজিয়া নামের এক বাজপাখির ডানায় ভর করে খেয়ালি বরপুত্র ম্যারাডোনা তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে চলেন। তারাখচিত ব্রাজিল দলের কতো মনোহর পাস, ড্রিবলিং; কিন্তু তারা পরাজিত হয়ে যায়। ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা ঠিকই  খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সামনে এগোয়। সারা গাঁয়ে, হাটবাজারে, এমনকী ধানের খেতে আর্জেন্টিনার সমর্থন বেড়ে যায় হু হু করে। যা হোক, এক কুশলী গোলকিপারসহ একদল মরিয়া সহযোদ্ধা নিয়ে ম্যারাডোনা হাজির হন ফাইনালে। প্রশ্নবিদ্ধ পেনাল্টিতে গোল খেয়ে আর্জেন্টিনা রানার্স আপ হলে আমাদের এলাকায় শোকের মাতম উঠেছিল। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বড় ভাইয়েরা অনেকেই ব্রাজিলের সমর্থক। তারা  ভ্রু কুঁচকে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বলল, রাবিশ! কিন্তু, এতটা নির্মমতা আমার একদম ভালো লাগে নি।

পরের আট বছর শুধু ব্রাজিলের বিজয়রথের গল্প। হলুদ জার্সির ব্রাজিল পরপর বিশ্বকাপ জিতল ১৯৯৪-১৯৯৮ সালে।  ২০০২ সালের বিজয়ী জিদানের ফ্রান্স। পরাশক্তি জার্মানি, ইতালি বা স্পেনের কাপ জয়ের পালাও চলল। আর্জেন্টিনা বরাবরই নান্দনিক ফুটবল খেলে কিন্তু ভাগ্য সহায় হয় না। মেসির দল গোল খেলে মর্সিয়ার ক্রন্দন ওঠে বাংলাদেশের হাঁটে-মাঠে-ঘাটে। নীল-শাদা জার্সিপরা রুক্ষ রাখাল পর্যন্ত চোখ মুছে মুছে ঘাস কাটে।  বয়স্ক পথিক সান্ত্বনা দেয়- দেখিস, আর্জেন্টিনা পরের বার জিতবে। ২০১৪ সালে মেসির দল রানার্স আপ পর্যন্ত হতে পারল। এভাবে কেটে যায় বছরের পর বছর। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয় অধরা থেকে যায়।

এবার নিবিড় গবেষণার কাজে ব্যস্ত সময় কাটছে। পাঠাগারে কখন যে সময় চলে যায় খেয়াল করতে পারি না। গবেষণার গজদন্ত মিনারে বসে দর্শকদের হল্লা শুনি। বাইরে বুঝি ভুভুজেলা বাজল বা আতশবাজি-ফটকা ফুটল? কাঁচের জানালা খুলে দেখি, সন্নিহিত পার্কে প্রজেক্টর লগিয়ে আবালবৃদ্ধবনিতা বিশ্বকাপ দেখছে। কেউবা কাবাব খায়, কারো হাতে ঝলসিত ভুট্টা। প্রাণময় উদ্যান পেরিয়ে আবাসে ফিরতে ফিরতে লক্ষ্য করলাম, বিশ্বকাপে উপলক্ষে যেন আনন্দমেলার আসর বসেছে। বলে রাখি, আমার লেখায় ঔপনিবেশিকতা বিরোধী মানসিকতার পাশাপাশি বিলেতের প্রতি অচেতন অনুরাগও ফুটে উঠেছে। বিলেতি আদব-কেতা, আইন-আদালত, সাহিত্য- সংস্কৃতি আমার নজর কেড়েছে খুব, তবে তাদের ফুটবল কখনই নয়। কিন্তু এবার দেখি সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভু ব্রিটিশদের ফুটবল নৈপুণ্যও নজরকাড়া। তবে আঙুল গুণে গুণে দেখিসেই কবে ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ড একবার বিশ্বকাপ জিতেছিল! আমার কিশোরপ্রেম ছিল ব্রাজিল, পরে আরাধ্য হয় আর্জেন্টিনা। স্পেনের তিকিতাকা, হল্যান্ডের টোটাল ফুটবল ও ফ্রান্সের প্রাণময় ফুটবলেও নজর রেখেছি। তবে এবার আমাকে সবচেয়ে অবাক করেছে মরক্কোর গতিময় ফুটবল। সৌদি মরুঝড়ে হোঁচট খেয়ে মেসিবাহিনী ধীরে ধীরে নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছে। দুর্বলচিত্ত কেউবা হার্টফেল পর্যন্ত করেছে শুনে কষ্ট পেয়েছি। উন্মাতাল সমর্থকগণ কেঁদেছে, হেসেছে। ছত্রিশ বছরের বিশ্বকাপ খরা কাটল আর্জেন্টিনার। এই সাফল্য এলো ফুটবল-বাজিগর মেসির হাত ধরেই। জয়তু আর্জেন্টিনা, জয়তু মেসি। বিজয়ী মেসি যেন কিছুটা ক্লান্ত। ডি মারিয়ার চোখে পানি। ওপারের বাসিন্দা ম্যারাডোনার চোখেও বুঝি আজ মায়াবী অশ্রুজল।