গাস্তঁ দোরেনের ‘রফতানি/ আমদানি: গ্রিক’

অ+ অ-

 

গাস্তঁ দোরেন

গাস্তঁ দোরেন একজন ভাষাতাত্ত্বিক, সাংবাদিক এবং বহুভাষাবিদ। তিনি ওলন্দাজ, লিম্বার্গিশ, ইংরেজি, জর্মন, ফরাসি, এবং হিস্পানি ভাষায় কথা বলতে পারেন, পড়তে পারেন আফ্রিকানস, ফ্রিসীয়, পর্তুগীজ, ইতালীয়, কাতালান, ডেনিশ, নরওয়েজীয়, সুইডিশ এবং লুক্সেমবুর্গিশ। ওলন্দাজ ভাষায় তিনি দুটো গ্রন্থ রচনা করেছেনঅভিবাসীদের ভাষা নিয়ে রচিত Nieuwe tongen [New Tongues], এবং Taaltoerisme [Language Tourism], যে-বইয়ের ওপর ভিত্তি করে Lingo: A Language Spotter’s Guide to Europe ইংরেজিতে রচিত হয়েছে, এবং তৈরি হয়েছে Language Lover’s Guide to Europe নামের একটি অ্যাপ! বক্ষ্যমাণ রচনাটি Lingo বইটির-ই একটি নাতিদীর্ঘ অধ্যায়ের অনুবাদ। অবসরে গাস্তঁ দোরেন গান গাইতে পছন্দ করেন, এবং অবশ্যই তা বহু ভাষায়। নেদারল্যান্ডের আমার্সফুর্ট-এ তিনি সস্ত্রীক বাস করেন। লেখাটি অনুবাদ করেছেন জি এইচ হাবীব

গাস্তঁ দোরেন © ছবি: হেডি ভারমার

রফতানি/ আমদানি: গ্রিক

প্রাচীন গ্রিক ভাষা না থাকলে আমাদের কী দশা হতো বলুন তো? কোথায় থাকতাম আমারা? এসব শব্দ না থাকলেdermatology, atom, alphabet, এবং metaphorআমরা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি নিয়ে কিভাবে কথা বলতাম? অবশ্যই, এসব বিশেষ্য ধার-কর্জ না করে আমরা হয়ত তাই করতে পারতাম যা আইসল্যান্ডবাসীরা করেছে—‘skin lore’, ‘utte kernel’, ‘bookstaff’, ‘row’, এবং ‘as-it-wereness’-এর মতো ঘরে-বানানো শব্দ তৈরি করে নিতাম। কিন্তু এমনকি ঘরকুনো আইসল্যান্ডিক ভাষাও গ্রিকদেরকে পুরোপুরি ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। এবং তারা গ্রিক বংশীয় xenon, lýra, arkitektকে আত্মস্থ করে নিয়েছে। তাই সম্ভবত একথা বলা-ই নিরাপদ যে হোমার, প্লেটো, এবং সফোক্লিসের ভাষা ইউরোপীয় প্রতিটি ভাষায় অনুপ্রবেশ করে সেগুলোর সমৃদ্ধি ঘটিয়েছে।

একথা শুনে আপনি হয়ত ভাবতে পারেন যে আধুনিক এথেন্সের ভাষার ‍উৎস সরাসরি সেই প্রাচীন শহরেই পাওয়া যাবে, ঠিক যেমন একটি নদীর গতিপথ অনুসরণ করে সেটার উৎসে ফিরে যাওয়া যায়। কিন্তু সত্যি বলতে, সমসাময়িক গ্রিক ভাষার সব শব্দই সেগুলোকে যতটা গ্রিক বলে মনে হয় ঠিক ততটা গ্রিক নয়। এসব শব্দ সেটাই দেখায়, বা গোপন করে, যেটাকে আমরা বলতে পারি সেসব শব্দের বিভিন্ন মাত্রার গ্রিকত্ব [Greekness]।

আধুনিক গ্রিক শব্দগুলোর মধ্যে যেসব অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় আস্তানা গেড়ে নিয়েছে [যে-ব্যাপারটাকে তথাকথিত আন্তর্জাতিকতাবাদ বলা যেতে পারে] সেগুলে ততটাই গ্রিক যতটা গ্রিক কোনো শব্দের পক্ষে হওয়া সম্ভব। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় সেগুলোর অস্তিত্ব ছিল, তারপর রোমকরা সেগুলোর ধার নেয়’—যে ধার সেই অর্থে কেউ শোধ করে নাআর তারপর সেগুলোকে অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষা আত্মীকৃত বা আত্মস্থ করে নেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, prógnosis-এর মানে হিসেবে আমরা পূর্বজ্ঞান, ভবিষ্যদ্বাণী [‘foreknowledge, prediction’] জেনে এসেছি, সেই ‘Classical times’ থেকেই [তফাত শুধু,  আধুনিক গ্রিক ভাষা শেষ s-টা বাদ দিয়েছে]। সক্রেটিস-পূর্ব আমল থেকে পোস্টমডার্নিস্টদের যুগ অব্দি Philosophía বলতে দর্শন-ই (philosophia) বোঝায়। Demokratía সব সময়ই গণতন্ত্র বা ‘democracy’। এই ধরনের শব্দগুলো পরীক্ষিত এবং সত্যিকারের ভাষাতাত্ত্বিক পরম্পরাক্রমে প্রাপ্ত সম্পত্তি।

সে যা-ই হোক, গ্রিক মজুদের অন্য কিছু শব্দের অর্থ ব্যাপক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গেছে, এবং সেটা একেবারে গোড়া থেকেই। যেমন, প্রাচীন গ্রিক plásma বলতে মূলত বোঝাতো কোনো জিনিস যা তৈরি বা গঠন করা হয়েছে; এবং এটা এমন একটা মানে যা দিয়ে সাধারণভাবে ‘figure’, ‘image’, ‘forgery’-ও বোঝায় [আর পরে, আরো কিছু শব্দ, যেমন ‘creature’ বা এমনকি ‘pretty woman’-এর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়।] শব্দটা কখনোই আধুনিক জীববৈজ্ঞানিক বা রাসায়নিক অর্থে ‘plasma’ বোঝাতো নাওসব ধারণা ঊনবিংশ বা বিংশ শতকের আগে উদ্ভূত হবে না। একই ভাবে, যার আক্ষরিক অর্থ যা কাটা হয়েছে সেই গ্রিক prísma  থেকে আসা prism আধুনিক সময়ের আগে সেটার অপটিকাল বা দৃষ্টিসংক্রান্ত অর্থ লাভ করেনি, যদিও আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ইউক্লিড শব্দটাকে একটা জ্যামিতি বিষয়ক অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। আর programme, সেটার ভিন্ন রূপ program-সহ গ্রিক prógramma থেকে এসেছে, যার আদি অর্থ ছিল জনসাধারণের জন্য লিখিত কোনো বিজ্ঞপ্তি বা অধ্যাদেশ [ডিক্রি]। এখন যদিও program(me) শব্দটা বিভিন্ন কাজের বিস্তারিত সময়সূচি [schedule], বা সম্প্রচারণ [broadcast] থেকে শুরু করে কোনো ‘computer application’, ইত্যাদিসহ গাদাগুচ্ছের মানে বহন করে। একদিকে যেমন আধুনিক গ্রিক অনেক ক্ষেত্রেই এসব শব্দের আদি অর্থ সংরক্ষণ করে চলেছে, সেই সঙ্গে তা সেগুলোর আন্তর্জাতিক মানেও আত্মস্থ করে নিচ্ছে; ভাষাতাত্ত্বিকরা একে বলে ঋণার্থ বা ধার-করা মানে। কাজেই, গ্রিকত্বের মাপকাঠিতে এসব শব্দ prognosis, philosophía, demokratía, এবং একই ধরনের শব্দ যেসবের রূপ ও মানে কার্যত অপরিবর্তিত ভাবে এতদিন ধরে টিকে আছেসেগুলোর চাইতে কম নম্বরের অধিকারী।

কাজেই, গ্রিকত্বের মাপকাঠিতে আমরা দুটো একক পেলাম: উত্তরাধিকারসূত্রে বা বংশানুক্রমে প্রাপ্ত সম্পত্তি, যেগুলো তাদের আন্তর্জাতিক সাফল্য সত্ত্বেও অকৃত্রিম বা অক্ষত আছে; আর, সেই সব শব্দ যেগুলো নতুন, আন্তর্জাতিক মানে বা অর্থ লাভ করেছে, আর তার ফলে যৎসামান্য কম পরিমাণে খাঁটি বা অকৃত্রিম বলে গণ্য। এই সঙ্গে একটা তৃতীয় এবং বেশ সাধারণ বা পরিচিত একটা শ্রেণী আছে: বিদেশিজাত যুগ্মশব্দ বা ফরেন-বিল্ট কম্পাউন্ড। এসব যুগ্মশব্দের অনেকগুলোই ঊনবিংশ শতকের বিজ্ঞানের অবদান, যখন বিজ্ঞানীরা দুই ধ্রুপদি ভাষা গ্রিক ও লাতিন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এন্তার নতুন শব্দ তৈরি করেছিলেন যেসব এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে: pharmacology, empathy, ontogenesis, android, hypodermic, idiolect, ichthyophobia, এবং আরো যে কত কী!

এসব যৌগিক শব্দ [কম্পাউন্ড] এমন কিছু গঠনকারী উপাদান দিয়ে তৈরি যেগুলো খুব সহজেই পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে যায়। যদি ichthyophobia মাছের ভয় [আক্ষরিকভাবে মৎস্য-ভীতি] হয়, আর pharmacology হয় ঔষধের বিজ্ঞান (ঔষধ-জ্ঞান/বিদ্যা), তাহলে ichthyology যে নিশ্চিতভাবেই মৎস্যবিদ্যা হবে  আর pharmacophobia ঔষধ-ভীতি, তা বুঝতে প্রতিভাবান হতে হয় না। এসব শব্দের উপাদানগুলো গ্রিক হলেও শব্দগুলো নিশ্চিতভাবেই গ্রিক নয়। কিন্তু সেগুলো বেশ কেজো আর তাৎক্ষণিকভাবে বোধগম্য হওয়ার কারণে আধুনিক গ্রিক ভাষা সেসব শব্দকে সর্বান্তকরণে গ্রহণ করেছে। গ্রিসে ঔষধের বিজ্ঞান বা বিদ্যাকে pharmacología বলে, আর রোগীদের শরীরের ভেতর কী ঘটছে না ঘটছে তা শোনার জন্য যে হাতিয়ার ব্যবহৃত হয় সেটাকে stëthoskópio। তারা এগুলোকে ঘরোয়া শব্দ বলেই মনে করে, আর সম্ভবত বেশির ভাগ লোকই ওগুলোকে সেরকমই মনে করে থাকে। তবে এগুলোকে গ্রিক ভাষার কৃতঋণ শব্দ বললে বোধহয় অন্যায় হয় না, যদিও সেগুলোর উৎস গ্রিক।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি কিছু কিছু অদ্ভুত ‘doppelgänger’ বা সোজা বাংলায় জোড়া বা যমজ-এর জন্ম দিয়েছে, যার একটি অন্যটির চাইতে উচ্চতর গ্রিকত্বের অধিকারী। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত phonetic এসেছে phone মানে, কণ্ঠ, শব্দ বা আওয়াজ থেকে [যেমন telephone, যার আক্ষরিক অর্থ দূরের শব্দ]। এবং এই phonetic-এর মানে বাচিক ভাষার আওয়াজ সম্পর্কিত। এটার গ্রিক প্রতিতুল্য শব্দ phonetikos একই বিদ্বজনোচিত অর্থ অর্জন করেছে, কিন্তু এই বিশেষণটির আটপৌরে মানেও আছে: ‘voice’ বা ‘vocal’; যেমন এখানে: ‘vocal cord’ (phonetikes cordes)। আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে osteopatheia, যা কিনা অস্থি আর মাংসপেশীর নিপুণ সঞ্চালনের সাহায্যে কিছু রোগের চিকিৎসা বা ‘osteopathy’-র গ্রিক নাম। শব্দটার গঠনকারী অংশগুলোর ভিত্তিতে শব্দটা দিয়ে আসলে বোঝানোর কথা হাড়ের যন্ত্রণা বা হাড়ের রোগ; আর আধুনিক গ্রিক ভাষায় শব্দটা সেই অর্থেই ব্যবহৃত হয়। একটি শব্দই একটা অবস্থা আর এক ধরনের চিকিৎসা, দুই-ই বোঝাচ্ছে।

ভিক্টোরীয় যুগের ব্রিটিশরা যখন লেসবস দ্বীপের অধিবাসী স্যাফোর কবিতাকে যৌনকামনা উদ্রেককারী হিসেবে তকমা দিল, তখন আরেকটি গ্রিক শব্দLesbiaধারকর্জের মাধ্যমে আধুনিক মানে অর্জন করে।

তো, (১) উত্তরাধিকার বা বংশপরম্পরাভাবে পাওয়া, (২) ধারকৃত অর্থ বিশিষ্ট, আর (৩) তাৎক্ষণিকভাবে বোধগম্য আমদানি-করাউল্লিখিত এই তিনটি ছাড়া অন্য কোনো মাত্রার গ্রিকত্ব আছে কি? হ্যাঁ, আছে বৈ কি একটি প্রান্তিক চতুর্থ মাত্রা। আর তা হলো হীনতর পুনঃআমদানি করা। Utopia তার একটি উদাহরণ। শব্দটি তৈরি করেছিলেন টমাস মোর, ইংল্যান্ডে। তৈরি হয়েছিল সহজেই চেনা যায় এমন দুই গ্রিক শব্দ ou (not) আর topos (place) দিয়ে। গ্রিক কোনো মানুষ এমন শব্দ তৈরি করেনি, কিন্তু তারপরেও গ্রিকরা utopia [বা, বলা চলে outopia]-কে একরকম মেনে নিয়েছে। এটা খানিকটা জাপাননির্মিত শব্দ walkman-এর মতো: কম্পাউন্ড বা যুগ্ম শব্দটাকে ঠিক ইংরেজি বলে মনে হয় না, কিন্তু তাতে শব্দটা ব্যবহারে আমাদের বাধেনি।

একইভাবে, পুরুষ কণ্ঠের প্রধান বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করার সময় গ্রিকরা আমদানি করা কিছু শব্দ ব্যবহার করে: mpásos [উচ্চারণ, ব্যসস], barýtonos এবং tenoros। কিন্তু এটাকে ঠিক যথার্থ বলে মনে হয় না, কারণ barýtonos-এর আক্ষরিক মানে, ভারী, গম্ভীর সুর, যা কিনা সবচাইতে নীচু বা খাদের ভোকাল রেঞ্জ mpásos-এর চাইতে আরো ভালোভাবে বোঝায়, কারণ mpásos এসেছে লাতিন শব্দ bassus থেকে, যারা মানে স্রেফ নীচু। আরেকটা বেখাপ্পা শব্দ হচ্ছে stéthoskoóio। আমরা তেমন কিছু না ভেবেই ‘stethoscope’ শব্দটা ব্যবহার করি। কিন্তু গ্রিকরা নিশ্চয়ই মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবে কেন এই ক্নিনিকাল হাতিয়ারটাকে বক্ষ পাহারাদার বলে যখন সেটার কাজ হচ্ছে শোনা

বিষয়টা এমন নয় যে গ্রিকরা এধরনের জটিলতা নিয়ে খুব বিচলিত। তবে তারা এই ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন যে তাদের ভাষা ইউরোপের ভাষাতাত্ত্বিক ভূদৃশ্যকে যতো গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে অন্য আর কোনো জীবন্ত ভাষা তা করতে পারেনি। তারা তাদের ভাষা সম্পর্কে যে গর্ববা (প্রাচীন) গ্রিক শব্দ ধার করে বললে hyperephania—অনুভব করে সেই গর্বে কোনো অদ্ভুত বিদেশি উদ্ভাবন বা বিভ্রান্তিকর দ্ব্যর্থবোধকতা কোনো ধরনের টোল খাওয়াতে পারেনি। 

 

টীকা

১. প্রাচীন গ্রিক থেকে ধার করা যেসব শব্দ নিয়ে ওপরে আলোচনা করা হলো তার চাইতে ঢের বেশি চেনা শব্দ হচ্ছে ‘butter’ আর ‘school’

২. ইংরেজি ভাষা যে শব্দটা গ্রিক থেকে ধার করতে পারত কিন্তু করেনি তা হচ্ছে krebatomourmoura; শব্দটার আক্ষরিক মানে শয্যা গুঞ্জন ‘pillow talk’-এর কাছাকাছি হলেও সেখানে অতটা সখ্যের আভাস নেই।