কবিতার পাঠক পাঠকের কবিতা

অ+ অ-

 

কবিতা কীভাবে পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তা রীতিমতো এক রহস্যের ব্যাপার। পৃথিবীর প্রাচীন ও জননন্দিত এ শিল্পমাধ্যমটিই যুগে যুগে কালে কালে মানুষের শিল্পতৃষ্ণা নিবারণ করে এসেছে। আদি এ শিল্পমাধ্যম এমন কী গুণে মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে! পৃথিবীর আদি কবিতা কবির বেদনাদগ্ধ হৃদয়ের উপলব্ধি। শোকে মাতম হৃদয়ের অন্তর্গত অভিব্যক্তির লেখ্যরূপ। কবি বাল্মীকি যখন বলে উঠেছিলেন মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগত শাশ্বতী সমাঃ। যৎ ক্রৌঞ্চুমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম।’, তখন আমরা টের পাই কবি হৃদয়ের ব্যাকুল অনুভব। যা পাঠক হৃদয়কে করুণরসে সিক্ত করে দেয়। জীবন জগৎ সম্পর্কে মানুষের হৃদবেদ্য অনুভূতিতে পাঠক হৃদয় নড়েচড়ে ওঠে। তাহলে কী রস সৃষ্টি হলে পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায় কিংবা বাচ্য অলংকার গুণে। ভাব-ভাষাগুলো কেন হয়ে ওঠে কবিতা? কবিতায় এক হৃদয়ের বেদনাঘন আকুতি আরেক হৃদয়ে দোলা দেয়। তার মূলে হয়ত প্রাণ সংকটপূর্ণ মানবিকতা বা কবি হৃদয়ের শৈল্পিক ভাব প্রকাশ। তাহলে প্রশ্ন আসে কবিতা কী কেবলই বেদনাঘন হৃদয়ানুভূতির শৈল্পিক ভাব প্রকাশ। গিলগামেস তখন উচ্চারণ করেন জীবনের অবিনশ্বর সত্য। বেঁচে থাকার আকুল তিয়াশা তখন কবি হৃদয়ের আকুতি ভিন্নরূপে ধরা দেয় ভাব-ভাষায় শৈল্পিক বিন্যাসের পরতে। স্যাফোর বাণীগুলো কাব্যিক ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়ে ওঠে। প্রাচীন গ্রিসের স্যাফো কিংবা ডিথিরাম্ব ভাষাবিন্যাসগুলো যেন হৃদয়ের তন্ত্রীতে নাড়া নেয়। সেখানে বিয়োগান্তক অনুভবগুলো বেশি স্পর্শ করে। কবিতা তখন দাঁড়ায় পাঠকের কাতারে। আবার পাঠক দাঁড়ায় কবিতার সামনে। দান ও গ্রহণের অপূর্ব লীলায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে জীবন জগতের নব নব অনুভব, নব নব উপলব্ধি।

প্রাচীন গ্রিসে কবি-নাট্যকাররা অনুকরণে সত্যের বিভ্রম তৈরি করতো বলে প্লেটো তার রিপাবলিকের আদর্শ রাষ্ট্র থেকে কবিদের বিতাড়িত করতে চেয়েছেন। পর্যালোচনায় দেখা যায়, কবিতা একধরনের কাল্পনিক সত্য তৈরি করতে সক্ষম। যার কারণেই পাঠকরা সৃষ্ট শিল্পবাস্তবতাকে সত্য বলে ভ্রম করে থাকতে পারেন। এই কল্পনার আধিক্যে গড়া বাস্তবতা প্রকৃত সত্য থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয় বলেই প্লেটো কবিদের সম্পর্কে এমন খেদোক্তি করেছেন। অ্যারিস্টটল অবশ্য জীবন, সমাজ ও সভ্যতার শৈল্পিক অনুকরণকে প্রধান মনে করতেন। কবিতা এক ধরনের শিল্পসত্য তৈরি করতে পারে বলেই তা পাঠকের হৃদয়ের তন্ত্রীতে নাড়া দিতে সক্ষম। যা ঘটেছে ইতিহাস তার বর্ণনা দেয় আর কবিতা বা শিল্প যা ঘটতে পারতো তার অনুভব জানায়। যা ঘটতে পারতো বলতে অ্যারিস্টটল অবশ্য মিথ্যা ইতিহাস তৈরির কথা বোঝাননি। বরং সত্যের ভেতরের শৃঙ্খলা, নতুন আবিস্কার, নতুন ব্যাখ্যা, অনুভবের কাল্পনিক বাস্তবতা চেয়েছেন। ইতিহাস বা সত্য বিকৃতি কুৎসিত কাজ। 

প্রাচীন ভারতীয় কাব্যশাস্ত্রে একসময় মনে করা হতো অলংকারের গুণেই বাক্য কাব্য হয়ে উঠে। কাব্যনং গ্রাহ্যমলংকারৎৎঅলংকারের নান্দনিক প্রয়োগে পাঠককে ভালোলাগার অনুভূতিতে আবদ্ধ করে। অনেকে আবার মনে করেন অলংকার ছাড়া কী কাব্য পদবাচ্য হতে পারে না? তারা মনে করেন কবিতার জন্য রীতিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রীতিরাত্মা কাব্যস্যঅর্থাৎ রীতিই কাব্য। পদরচনার নানা ভঙ্গিই পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারে। রীতি ছাড়া কী করে কবিতা হয়। আবার কেউ কেউ বাচ্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কাব্যবস্তু বা কাব্য বিষয়ই প্রধান। তাহলে কী কবিতা ধ্বনিনির্ভর হলে কাব্য পদবাচ্য হতে পারে। ধ্বনি কিংবা ব্যঙ্গপ্রধান হলে পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে। কাব্যে বাক্যগুলো শুধু একটি কথা বলে না। বাক্যটি যখন অতিরিক্ত কিছু বলে তখনই হয়ে উঠে কবিতা। কিংবা পূর্বেই আমরা আলোচনা করেছি কবিতা কী তবে রসনির্ভর। বিংশ শতকের কবি জীবননান্দ দাশের কবিতার পঙক্তিগুলো অতিরিক্ত অর্থে ব্যঞ্জনাময় হয়ে ওঠে

পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

কিংবা

সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

ব্যঞ্জনাময় ভাবপ্রকাশে পাঠক যেমন গুরুত্বপূর্ণ। রস নিষ্পত্তির ধারাতে কবিতা যখন অন্বিষ্ট হয় তখন পাঠকই হয়ে ওঠে প্রধান। কারণ পাঠকের অনুভবই রসধারায় মুখ্য। কবির ভাব ও সৃষ্টরস জারিতের খেলায় পাঠক মন টালমাতাল। বিভাব, অনুভাব ও রস সৃষ্ট খেলায় কবি-কবিতা-পাঠক তখন একাকার। চতুর্দশ শতকের কবি বিদ্যাপতি যখন বলেন, সুখেরই লাগিয়ে এ ঘরও বাঁধিনু অনলে পুড়িয়ে গেল। তখন যেন রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের প্রচ্ছন্ন আবেগে পাঠক নিজের প্রেমোপলব্ধি বড় হয়ে উঠে। কিংবা চণ্ডীদাস যখন বলেন, সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই।তখন মানবজীবনই মহিমান্বিত হয়ে ওঠে। পাঠক খুঁজে পান নিজ সত্তার পরিচয়। কবিতা তখন পাঠকের আত্মউপলব্ধিরই অনুভব। পাঠকের হৃদয়ের সঙ্গে একীভূত হয়ে উঠে কবিহৃদয়। অপর এক কবি বলেন—‘প্রেয়সী আমার হারিয়েছি কোনকালে, তবুও বেদনা জাগে হৃদয় খুঁড়ে খুঁড়ে। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীর রসে গাইবো মা গীতখানিতখন যেন পাঠক নিজেরই বীরত্বগাঁথার অনুভবে অধীর হয়ে উঠেছেন। যুগে যুগে কালে কালে কবিতার হৃদয়বেদ্য ভাবের গভীরতা পাঠকের হৃদয়বৃত্তিতে আঘাত করেছে বলেই কবিতা শব্দবন্ধে রূপান্তরিত হয়ে উঠেছে। পাঠক খুঁজে পেয়েছে জীবন জগতের নতুন নতুন উপলব্ধি।

বাংলার কাব্যনন্দনে কবিতার অন্যতম কাজ সৌন্দর্য সৃষ্টি হলেও সত্য-কল্যাণ তাতে প্রধান। রোমের হোরেস সাহিত্যের গুণ হিসেবে ভাষার সমুন্নতিকে বড় করে দেখেছেন। দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট যখন সাহিত্য-শিল্পকে কলাকৈবল্যবাদ হিসেবে সমর্থন করেন, প্রেক্ষিতে সমালোচক চের্নিসেভস্কি হাস্য করে উল্লেখ করে ধনসম্পদের জন্য ধনসম্পদ বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞান কথাটি অদ্ভূত। কবিতা-সাহিত্য-শিল্প হবে মানুষের জন্য। বিখ্যাত সাহিত্যিক লিও তলস্তয় সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ ও সমাজের অগ্রগতি সাধনের ধারণাকে বড় করে দেখেছেন। জ্যঁ পল সার্ত্রে শিল্প আনন্দের অন্বেষণ ও সৌন্দর্যচেতনাকে জীবনের সত্য অনুভবের পন্থা হিসেবে ভেবেছেন বলে তার কাছে জীবন-সত্যই মুখ্য। সে প্রেক্ষিতের কবিতা-সাহিত্য-শিল্প জীবনের কথা বলে বলেই সাধারণ জীবনকে স্পর্শ করে থাকে।

কবি হৃদয় অর্থাৎ কবির বেদনাবিদ্ধ হৃদয় কবিতায় ধরা দেয়। পাঠক সে হৃদয়ের আকুতিকেই নিজের হৃদয়ের ভাবাবেগের স্পর্শে অনুভব করে। পাঠক ছাড়া কবিতা পূর্ণতা পায় না। রবীন্দ্রনাথ সহিত-আনন্দ-কবিকল্পনায় যে সৌধ তৈরির কথা বলেন তাতে আরও জীবনের গভীর সত্য নিহিত। ক্ষণকালীন জিনিসকে চিরকালীন করিয়া তোলাই সাহিত্যের কাজ।অবশ্য রোলা বার্থ সাহিত্যিক নানা ধরনের পাঠভেদের কথা তুলেছেন। কবিতায় কিংবা যেজন্য সাহিত্যকর্মে পাঠকই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কবি কল্পনা সেই কাব্যসত্য যেন ধরা দেয়। রবীন্দ্রনাথের কবিতায়

সেই সত্য যা রচিবে তুমি
ঘটে যা তা সব সত্য নহে।
কবি, তব মনোভূমি,
রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।

কোলরিজের মতে, অপরিহার্য শব্দের অবশ্যম্ভাবী বাণী বিন্যাসই কবিতা। কী সেই অপরিহার্য শব্দ, আবার কাদের অবশ্যম্ভাবী বাণী ও তার বিন্যাস? জীবনের অবিনশ্বর উপলব্ধির অনিবার্যই শব্দমালার ভেতর দিয়ে মানবিকবোধের প্রকাশ পায় কবিতায়। পাঠক জীবন-জগতের অনিবার্য সত্যের ভাবগত উপলব্ধি করেন। যিনি বাইরের জগৎকে গভীর পর্যবেক্ষণ করে আপন মনের কল্পনামাধুরি মিশিয়ে অবশ্যম্ভাবী শব্দবিন্যাসে ছন্দেবদ্ধ ও শিল্পসঙ্গত ভাষিক রূপ দেন তিনিই আসলে কবি। আর মানব মনের ভাবনা-কল্পনা-অনুভুতি যখন যথাচয়িত শব্দবিন্যাসে চিত্রাত্মক ও ছন্দোময় গভীরতর ভাবমূলক রূপ লাভ করে তখন তাই কবিতা। পাঠকের কাছে যা ধরা দেয় নতুন সুরে, নব ঝংকারে, নব অনুভবে। পাবলো নেরুদা, লোরকা, বোর্হেস, সিলভিয়া প্লাথ নানাজনের কবিতা চারদিকের মানুষের জীবনেরই প্রতিধ্বনি করে। কিংবা কিংবা নিকোনোর পাররার প্রতিকবিতায় জীবনকেই ভিন্নভাবে দেখে।

রেঁবো-বোদলেয়ার প্রভাবিত যে কবিতার বাস্তবতা, তা এ ভূখণ্ডের নৈতিক বাস্তবতা থেকে ভিন্ন। উপনিবেশ শাসনে এতদ্ অঞ্চলের হাজার বছরের কাব্যধারা প্রায় উপেক্ষিত হয়ে পড়ে। আধুনিকতার শিরোনামে এ দেশের কবিতা নতুন মূল্যবোধে এগিয়ে চলে। আধুনিকচর্চার মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে বিদ্যমান থাকে ইউরোপীয়করণ। টিএস এলিয়টের কবিতায় কখনো কখনো জীবনের অবক্ষয়ই বড় হয়ে উঠে। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আলো-আঁধারের রূপ দেখতে পাওয়া যায়। কবিতার অর্থ কী তাহলে পাঠক অর্ধেক বুঝতে আর অর্ধেক বুঝবে না। জীবনানন্দ দাশের রূপময়তা, আলো-আঁধারী, চিত্রময়তা শিল্পমাধুর্যে প্রত্যুজ্জল। তিনি সমস্ত কিছু দিয়েই এক অলোক আনন্দস্পর্শ ছড়িয়ে দেন। বুদ্ধদেব বসুর কবিতাগুলোতে ইউরোপীয় রীতির সঙ্গে এদেশের ঐতিহ্যমূলক বিষয়ের এক মেলবন্ধন তৈরি হয়। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কবির প্রকাশক্ষম প্রবণতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন

অন্তর হতে আহরি বচন
আনন্দলোক কবি বিরচন
গীতরসধারা কবি সিঞ্চন
সংসার ধূলিজালে।

কবির হৃদয়েবেদ্য ভাবনা ও কল্পনা যখন পাঠক হৃদয়কে আন্দোলিত করে তোলে তখনই হয়ে ওঠে কবিতা। পাঠক মুগ্ধতায় অনুভব করে কবির নিজস্ব মানসরসে সঞ্জীবিত চিত্রাত্মক ভাবকল্প। সেক্ষেত্রে কবিত্বের প্রধান উপকরণ হয়ে দাঁড়ায় কল্পনা। কল্পনা শক্তিকে নৈসর্গিকী ও সহজাত বলেও সংস্কৃত আলংকারিকগণ অভিহিত করে থাকেন। আর বাস্তব বিবর্জিত অতিকল্পনাকে প্লেটোর মতো অনেকেই নিন্দা জানিয়েছেন। কাব্যের সৌন্দর্যচিন্তাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। রোমানের ওভিদ, ফরাসির পল এলুয়ার, জার্মানির গ্যুন্টার গ্রাস, স্প্যানিশ অক্তাবিও পাস, রুশ আন্না আখমাতোভা, ইংরেজি রবার্ট ফ্রস্ট, ফিলিস্তিনি মাহমুদ দারবিশসহ নানা জনের কবিতায় ব্যক্তি অনুভবই প্রকাশ করেন।

কবি অবচেতন ও অতিচেতন মন থেকে সজ্ঞানের চিন্ময়াবস্থা বা কনসাসনেস থেকে ভাষা নির্মাণ করেন। আর্বিভূত হতে থাকে অনুভব ও বাণীর ফুল্গুধারা। চেতনা, ভাব ও ভাষায় তৈরি করে অপরূপ সৌন্দর্যের দ্যোতনা। গভীর জীবনবোধ তাকে তাড়িত করে। নারীরা যেমন রূপ, অবয়ব, ইঙ্গিত, সাজসজ্জা, প্রসাধনে নিজেকে অপরূপ করে তোলার প্রয়াসী হয়ে উঠে। ঠিক তেমনি কবিও তার কবিতায় ভাষা, অনুভব, শব্দে, ছন্দে, উপমায়, চিত্রকল্পে অনুভূতির নিবিড়তায় অপরূপ ব্যঞ্জনাময় করে তুলতে প্রয়াসী হয়ে উঠেন। কখনোই তত্ত্ব, তথ্য, নীতিপ্রচার, রাজনীতি বা ধর্মনীতি কাব্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য হতে পারে না। সেজন্য আর্নড মাথু মনে করেন, কবিতা মূলত মানব সমাজের নতুনতর ব্যাখ্যা। অর্থাৎ ক্রিটিসিজম অব লাইফ বা জীবন জিজ্ঞাসা। কবিতা গদ্য-পদ্য দুভাবেই হতে পারে। কবিতা ভাবকে দৃশ্যকল্পে রূপান্তর করে। পাঠক সে দৃশ্যকল্পের রসস্বাদন করে। ছন্দই কী কবিতাকে পাঠকের অন্বিষ্ট করে। কিংবা ছন্দের কারণেই কী কবিতা পাঠকের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে। তাই কবিতায় ছন্দ কী খুব জরুরি? ছন্দ দীর্ঘকালের একটি প্রশ্ন। কবিতায় বাস্তবসত্য না থাকলেও জীবনের অনিবার্য সত্যকে ইঙ্গিত করে। তখন কবিতা ও দর্শনের রূপভেদ অনেকটা কমে আসে।

কবিতা কবিকে কী দেয়? অর্থ-বিত্ত, সম্মান। হয়ত কিছুই না। কিন্তু ঐ যে অনুকরণ, জীবনের সত্য ও উপলব্ধির প্রকাশ করার প্রবণতা মানুষের সহজাত। পাঠককে নির্মল আনন্দ, সৌন্দর্য, বোধ, সত্য উপলব্ধি ছাড়া হয়ত খুব বেশি কিছু দেয় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সোনার তরী কাব্যগ্রস্থের পুরস্কার কবিতায় স্ত্রী আক্ষেপের স্বরে কবিকে বলেন

গাঁথিছ ছন্দ দীর্ঘ হ্রস্র
মাথা ও মুণ্ড, ছাই ও ভস্ম
মিলিবে কি তাহে হস্তী অশ্ব
না মিলে শস্যকণা!

নিজে কিছু না পেলেও পাঠককে কিছু জানাতে চান কবি। কবিতাকে ভালোবাসেন কবি। কবিতায় থাকে উপলব্ধির বহুমাত্রিক প্রকাশ। আবার বাক্যকে উল্টো-পাল্টা লিখে ব্যায়াম করালেই কবিতা হয় না। কবিতায় থাকতে হয় কাব্যগুণ। যে বাক্যবন্ধ থেকে আক্ষরিক অর্থ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না, তা কখনো কাব্য বলে গণ্য হতে পারে না। তা পাঠককে কল্পনার স্রোতে ভাসাতে পারে না। অনেক সময় কাব্যে অশ্লীলতা থাকে। এ ক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। সতর্ক থাকতে হবে ভাব-ভাষা জীবনকে ক্ষতিকর দিকে গেলো কী না? তবে কবিতা জীবনের সত্যের নান্দনিক প্রকাশ দাবি করে। কিটস-শেলীর কবিতার নন্দনে সত্যই সুন্দর আর সুন্দরই কবিতা। কবিতায় থাকবে উঁচুতর ভাষা। কবি নিজে নিজেরই সাথে কথা বলেন কবিতায়। পাঠক আড়াল থেকে শুনে ফেলে মাত্র।

হাজার বছরের এ ভূখণ্ডের কবিতায় ভাবের রূপকল্পই প্রাধান্য পেয়েছে। চর্যাপদের প্রতীকবাদী কবিতা বা কাব্যসংগীতগুলো যেন সাধকদের হৃদয়ের গভীরকে স্পর্শ করে। বৈষ্ণবপদাবলির কবিতাগুলো আমাদের হৃদয়ের তন্ত্রীতে বেদনার অপরূপ সুখানুভূতির সৃষ্টি করে। কিংবা ইসলাম ধর্মের মর্সিয়াগুলো শোকাতুর সৌন্দর্যকল্পিত ভাবাবেগ সৃষ্টি করে। ইউরোপীয় অনুশাসনে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ধারায় ছেদ পড়ে। ভারতীয় যে নন্দন তা যেন বিস্মৃত হতে থাকে। তবু কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, সুবোধ সরকারসহ নানাজনের সংশ্লেষাত্মক অভিব্যক্তিতে কবিতায় জীবন নতুন ভাবে উঠে আসে। আর কবিতা হয়ে ওঠে ব্যক্তি, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রপরিবর্তনের মুখপত্র। হাজার বছরের বাংলায় কবিতা পাঠককে নতুন চিন্তা, উদ্দীপনা ও ভালোলাগার বন্ধনে বেঁধেছে। একদিকে ঐতিহ্য, অন্যদিকে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য, সাথে নতুন স্থান-কালের প্রেক্ষিতে কবিতা তখন জীবনেরই আরেক প্রতিভূ। সমাজের নানা অসঙ্গতি, জীবনের নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ব্যক্তিমানসের চাওয়া-পাওয়ায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে কবিতা। পাঠক আত্ম-আনন্দ আর জীবন মুক্তির অনিবার্য সত্য হিসেবে কবিতাকে গ্রহণ করতে থাকেন অনায়াসে। তাই কবি ও পাঠক কবিতার পাঠসূত্রে হয়ে ওঠেন একীভূত। স্বাধীন বাংলাদেশের কবিতার ধারাও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলার ইতিহাসে প্রতি যুগে কবিতা হয়ে উঠেছিল বাঙালির মুক্তির শক্তি। এ আলোচনার পরিশেষে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কয়েকটি পঙক্তি দিয়ে অনুভব করা যেতে পারে কবিতার শক্তি

যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম কৃতদাস থেকে যাবে। ...

সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা
সুপুরুষ ভালোবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা
রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।