‘উৎসবে’কে যে কারণে ধন্যবাদ!

অ+ অ-

 

বাংলাদেশের সিনেমায় বইছে বসন্তের সুবাতাস। বিগত কয়েক বছরে দেশীয় সিনেমায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বরবাদ, তান্ডব, তুফান, হাওয়া, পরান কিংবা সুড়ঙ্গ; প্রতিটি সিনেমাতেই ছিল দর্শকের উল্লেখযোগ্য সাড়া। বিশেষ করে, বাংলাদেশের মানুষকে হলমুখী করতে এসব মারমার কাটকাট বাণিজ্যিক সিনেমার অবদান অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি একশান সিনেমার ফ্যান নই। বাণিজ্যিক ধারার রোমান্টিক বা ড্রামা জনরার সিনেমাও যে ভালো গল্প আর নির্মাণ ছাড়া খুব গোগ্রাসে গিলতে পছন্দ করি তেমনটাও নয়।

এ কারণে এবারের ঈদুল আজহায় মুক্তি পাওয়া উৎসব সিনেমাটি ছিল একেবারে আমার মনের মত। বিশেষ করে বিগ বাজেটের লার্জার দ্যান লাইফ টাইপ সিনেমা দেখতে দেখতে সিনেমায় একটু ভিন্ন কিছুই চাচ্ছিলাম। উৎসব যেন সেই স্বপ্নই পূরণ করলো। শুধুমাত্র ভালো নির্মাণ আর অভিনয় দিয়ে যে কত সাধারণ গল্পকেও অসাধারণ করে তোলা যায়, উৎসব তা একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কথায় কথায় এফ ওয়ার্ডের ব্যবহার, অত্যন্ত শৈল্পিক কায়দায় কোকেন গ্রহণ অথবা ঝলমলে আইটেম গানের বাইরেও সিনেমা হিট হয় এবং হয়েছেও, এই বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে আনন্দিত করেছে।

উৎসব সিনেমার কাহিনী নিয়ে মোটামুটি অনেক লেখা হয়েছে। তাই এ বিষয়ে কিছু লিখবো না। বরং সিনেমার কিছু ভালো-মন্দ নিয়েই আজকের আলাপ। একজন দর্শকের সাদা চোখে সিনেমার কোন বিষয়গুলো নজর কেড়েছে এবং কোন বিষয়গুলো নজর কাড়তে পারতো, তা নিয়েই কিছু কথা বলবো।

উৎসব সিনেমাটিকে আমার ওয়ান ম্যান শো বলে মনে হয়েছে। পুরো সিনেমার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন জাহিদ হাসান ওরফে খাইষ্টা জাহাঙ্গীর। এই সিনেমায় জাহিদ হাসান যদি খাইষ্টা জাহাঙ্গীর না হয়ে উঠতেন, তবে উৎসব হতো একটি ব্যর্থ প্রকল্প। সাথে ব্যর্থ হতো আমার মত অনেকেই যারা পরিচ্ছন্ন গল্প ভালোবাসেন, সিনেমা হলে হাসির সাথে সাথে কাঁদতে ভালোবাসেন, মিনিংফুল সংলাপ ভালবাসেন যদি সেটা কবিতা আবৃত্তি না হয় তবে। বেশিরভাগ সময়ই দেখি একটু লম্বা অর্থবোধক কোন সংলাপ দিতে গেলেই অভিনেতারা কবিতা আবৃত্তি শুরু করে দেন। এই সিনেমাতেও যে তেমনটা হয়নি, তা বলবো না। সেই আলোচনায় পরে আসছি।

জাহিদ হাসান যে কত বড় মাপের অভিনেতা এই সিনেমার মাধ্যমে আবারও তা প্রমাণ করলেন। বিশেষ করে, যখন তার অতীতের গল্প টেলিভিশনের সামনে সিনেমা হিসেবে দেখানো হচ্ছিলো সেসময় তার এক্সপ্রেশন ছিল দেখার মত। অন্তত আমি মুগ্ধ হয়েছি। চোখে জল এসেছে। জাহাঙ্গীরের চোখে হতাশা, মুখে বিব্রতভাব আর বুকজুড়ে অনুতাপ। কয়জন পারে এভাবে কিছু না বলে শুধু অভিব্যক্তি দিয়ে এমন অভিনয় করতে?

একটা বিষয় না বললেই না, জাহিদ হাসান যখন হাফ হাতা চেক শার্ট ইন করে পড়ে পা ভাজ করে কোথাও বসছিলেন, তাকে দেখতে অনেকটাই ফরেস্ট গাম্প সিনেমার টম হ্যাঙ্কস এর মত লাগছিলো। মানুষটা যেন ফরেস্ট গাম্পের মতই নিঃসঙ্গ, তার মতই হতবিহ্বল।

উৎসব সিনেমাকে উপভোগ্য করতে জাহিদ হাসানের পর যিনি সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন, তিনি চঞ্চল চৌধুরী৷ কিছুক্ষেত্রে চঞ্চল চৌধুরী আর জাহিদ হাসানের জুটিটা ছিল ক্রিকেটের সাকিব-তামিম জুটির মত। যেন দুজনই একের পর এক বাউন্ডারি হাঁকিয়ে চলেছেন আর দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে হাততালি দিয়ে যাচ্ছেন। চঞ্চল চৌধুরীর ডায়লগ ডেলিভারি আর এক্সপ্রেশনের অদলবদল দর্শককে ব্যাপক হাসিয়েছে। তার উপস্থিতির জন্যই জাহিদ হাসানের অভিনয়টা আরও পরিপূর্ণ হয়েছে বলে আমার মনে হয়।

সিনেমার আরেকটি সফল সাবজেক্ট হিসেবে লেভেল ফাইভের তুমি গানটার কথা বলা যায়। এত চমৎকার এই গানের প্লেসমেন্ট, কী বলবো। শুধুমাত্র এক জায়গাতেই যে গানটা ব্যবহার হয়েছে তা কিন্তু না। কয়েক জায়গাতে এই গানের ব্যবহার করা হয়েছে আর সেই প্লেসমেন্টও ছিল একেবারে পার্ফেক্ট যা দর্শককে সিনেমার সাথে কানেক্ট করেছে আরও ভালভাবে। দৃশ্যের সাথে মিল রেখে গানের লিরিক সংযোজন, ব্যক্তিগতভাবে আমাকে দারুণ আনন্দ দিয়েছে। যেন আসলেই জাহাঙ্গীরের শুকনো মরুভূমিতে বৃষ্টি ঝরছে অথবা তার অন্ধকার জীবনে জ্বলে উঠেছে সুখের আলো।

সিনেমায় আরও বড় বড় তারকার উপস্থিতি থাকার পরেও শুরুতেই তিনটি বিষয় উল্লেখ করলাম, এ কারণে যে, আমার চোখে, এই তিনের যথাযথ মিশেলেই উৎসব এতটা সফল আর উৎসবমুখর হয়ে উঠেছে, যে সাফল্য এখন ওটিটিতেও চলমান। জাহাঙ্গীর আর জেসমিনের তরুণ জীবনের অভিনয়ে যারা ছিলেন, তারাও বেশ ভালো করেছেন। সাম্য ও সাদিয়া আয়মানের অভিনয় সাবলীল ছিল। অতি অভিনয় নেই আবার অভিব্যক্তির আতিশয্যও নেই।

এবার, স্রোতের বিপরীতে গিয়ে একটা কথা বলি। জয়া আহসানের ক্যারেক্টার যেভাবে সাজানো হয়েছে, তিনি বোধহয় সেভাবেই ক্যামেরায় উপস্থিত হয়েছিলেন। যদিও তার অভিনয় ভালো লাগেনি আমার। কিছু জায়গায় অতি অভিনয় করেছেন। ড্রেস-আপও ছিল অকারণে অপ্রাসঙ্গিক। সব পরিচালকই কেন যেন, তাকে অত্যন্ত গ্ল্যামারাস ও আবেদনময়ী হিসেবে সামনে আনতে পছন্দ করেন। সেটা দৃশ্যের সাথে মানাচ্ছে নাকি মানাচ্ছে না, সেদিকে কারো নজর নেই; রঙিন রঙিন জামাকাপড় আর মুখভর্তি মেকাপ পরিয়ে দিলেই হলো। যেমনজয়া আহসানকে ভালো লাগেনি তান্ডবেও। ওই সিনেমাতেও জয়া আহসানের অতি অভিনয় দেখে বিরক্তই হয়েছি বলা যায়।

এবারের ঈদুল আজহায় মুক্তিপ্রাপ্ত দুটো সিনেমাতেই জয়া আহসান স্মরণকালের বাজে অভিনয় করেছেন। কিন্তু যেহেতু তাকে আমরা ভালো অভিনেতা হিসেবে জানি, এই অতি অভিনয়কেও ভালো অভিনয় বলে স্রোতের সাথে তাল মেলাতেই হবে।

উৎসবের আরেক গুরুত্বপূর্ণ অতিথিশিল্পী অপি করিম। যতক্ষণ স্ক্রিনে ছিলেন, অপি করিম বুঝিয়ে গেছেন, তিনি অভিনয় করছেন। সিনেমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তার উপস্থিতি ঘটে এবং তাকে বেশ বড় বড় ডায়লগ ডেলিভার করতে হয়। দু:খের বিষয়, তিনি সেগুলোকে কবিতা বানিয়েছেন এবং আমাকে করেছেন হতাশ। একই কথা প্রযোজ্য আফসানা মিমির বেলাতেও। এই অভিনেতার আরও ভালো অভিনয় দেখে অভ্যস্ত বলে সিনেমায় তার উপস্থিতি ততোটা নজর কাড়েনি।

এদিকে, স্বল্প সময়ে সুনেহরার উপস্থিতি সিনেমায় দ্যুতি ছড়িয়েছে৷ অবশ্য তার চরিত্রটাই এমন ছিল। তার মেকাপ, লুক সবই ছিল চরিত্র অনুযায়ী মানানসই। যদিও কফির দাম নিয়ে তার ডায়লগ ডেলিভারিটা আরও ন্যাচারাল হতে পারতো, বোঝা যাচ্ছিলো তার সামনে ক্যামেরা ধরা। তাই তিনি এমন করছেন। এছাড়া, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে অল্প স্ক্রিন টাইমে বেশ ভালো অভিনয় করেছেন তারিক আনাম খান। যেহেতু তিনি অভিনয়ে দারুণ, তাই তাকে নিয়ে আলাদা করে বলার কিছু নেই।

এবার সিনেমার সবচেয়ে হতাশার জায়গায় আসি। বাংলাদেশের সিনেমার মান দিন দিন বাড়ছে, তা আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক; বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তার সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনেতাদের মেকাপের মান কমছে বলে আমার মনে হয়। এই সময়ে এসেও যদি অভিনেতাদের সেজেগুজে ফুলটুসি হয়ে থাকতে হয়, মেকাপ দিয়েছে তা বোঝাতে হয় তবে আর কী বদলালো? এ সিনেমায় জয়া আহসানের মেকাপ খুবই চোখে লেগেছে, বুঝেছি তার চরিত্র বেশি সাজগোজ ডিমান্ড করে কিন্তু মুখের সাদা পাউডার দৃশ্যমান করা কি খুব জরুরি? অপি করিমের মেকাপও ছিল যথেষ্ট হতাশাব্যাঞ্জক। তবে সাদিয়া আয়মান, আফসানা মিমি আর সুনেহরার মেকাপ ও লুক সেই তুলনায় মানানসই ছিল।

গল্প বাছাই ও নির্মাণের ক্ষেত্রে যে সময় দেওয়া হচ্ছে, মেকাপ ও লুকের বেলায় তার অর্ধেকেরও কম সময় দিলে সিনেমার পারফেকশন যথাযথ থাকে, অভিনেতাদের মেক-আপ দেখে চোখমুখ কোচকাতে হয় না। তবে সব মিলিয়ে, উৎসব অত্যন্ত সফল একটি প্রচেষ্টা ও নির্মাণ। এই সিনেমার সাথে যুক্ত প্রতিটি কলাকুশলীদের ধন্যবাদ খুবই যত্ন সহকারে সিনেমাটি নির্মাণের জন্যে। স্ক্রিপ্টরাইটার ও নির্মাতাও বিশেষ ধন্যবাদের যোগ্য। প্রতিভাবান এবং একই সাথে সৃষ্টিশীল না হলে এমন একটি সিনেমা সৃষ্টি সম্ভব নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, একজন পরিচালককে শুধু দক্ষ হলেই হয় না, সেই সাথে সৃষ্টিশীলতা, উদারতা ও গভীরতা থাকা জরুরি; যাতে করে কাজের মধ্যে তার সেসব গুণ স্পষ্ট হয়ে উঠে।

সিনেমা দেখতে সিনেপ্লেক্সে যাওয়ার পর আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে যখন দেখলাম, কয়েক জোড়া মধ্যবয়স্ক দম্পতি সিনেমাটি দেখতে এসেছেন। এখন তো ওটিটিতেও সিনেমাটি চলছে। চাইলেই কেউ দেখে নিতে পারেন, হতাশ হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ আবারও স্বচ্ছ, সুন্দর, পরিবার ছাড়া দেখা নিষেধ এমন সিনেমার যুগে প্রবেশ করতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারছে উৎসবের কারণে, সিনেমার সাথে যুক্ত প্রতিটি মানুষের কারণে। আমি চাই, এই জয়যাত্রা অব্যাহত থাকুক।