নারী বিবর্জিত দেশভাগের মর্মস্পর্শী আখ্যান

অ+ অ-

 

ট্রেন টু পাকিস্তান
খুসবন্ত সিং
প্রকাশক: পেঙ্গুইন হাউজ
প্রকাশকাল: ২০১৬
মূল্য: ২৫০ রুপি

দেশভাগ নিয়ে রচিত গল্প, উপন্যাসের মধ্যে খুশবন্ত সিংয়ের 'ট্রেন টু পাকিস্তান' উপন্যাস পাঠকমহলে বেশ পরিচিত ও পঠিত। উপন্যাসের শুরু হয় ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের সীমান্তবর্তী গ্রাম মানো মাজরার বর্ণনা করে। ১৯৪৭ সালে মানুষ যখন জিনিসপত্র অদলবদল করার মত ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বদলানোতে ব্যস্ত, ভারতের সীমান্তবর্তী কিছু প্রত্যন্ত গ্রাম তখনও দেশের স্বাধীনতা কিংবা দেশ ভাগাভাগি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ধর্মীয় প্রতিহিংসার ফলে যখন হিন্দু-মুসলমান পরষ্পরকে হত্যা করে নিজের জাতকে শক্তিশালী প্রমাণ করতে ব্যস্ত, সীমান্তবর্তী বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলো তখনও পরম্পরা নীতিতে হিন্দু-মুসলমান একসাথে শান্তিপূর্ণভাবে বাস করে আসছে। তেমনই একটি গ্রাম মানো মাজরা।

বহির্বিশ্বের সাথে মানো মাজরার যোগাযোগের একমাত্র সূত্র ছিল ট্রেন। ট্রেনটিকে ঘিরে উপন্যাসের প্লট আর চরিত্রগুলো যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, তাতে বলা যায় এই ট্রেনই ছিল পুরো উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। দিল্লি থেকে লাহোরগামী ট্রেন, লাহোর থেকে দিল্লি, মানো মাজরার বুক চিড়ে এই ট্রেনের আসা যাওয়ার ওপরই গ্রামবাসীর জীবনে সকাল আসে, সন্ধ্যা হয়। যে ট্রেন মানো মাজরায় জীবনযাপনের নিয়ম রচনা করে, সেই ট্রেনই গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনে নিয়ে আসে ধ্বংসযজ্ঞ আর হিংস্রতার নির্মম বার্তা। একটি ট্রেন কী করে পুরো গ্রামবাসীর বিশ্বাস, মূল্যবোধ আর ধ্যান-ধারণাকে পালটে দিতে পারে তারই দৃশ্যপট এঁকেছেন খুশবন্ত সিং তার লেখা প্রথম উপন্যাসে।

দেশভাগের ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় মানো মাজরা নামে। পরে এর নাম দেওয়া হয় ট্রেন টু পাকিস্তান। উল্লেখ্য, দেশভাগের ওপর উপন্যাসের ধারায় প্রথম ইন্দো-অ্যাংলিয়ান উপন্যাস ছিল এটি। উপন্যাসের শুরুটা হয় বেশ নাটকীয়ভাবে। রাতের অন্ধকারে ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে আসে ডাকাতের দল। যারা ডাকাতি করার প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার পথে তারা কিছু চটুল কথাবার্তা বলে, যা ছিল 'জুগ্গাত সিং' নামের একজনের জন্য চুড়ি কিনে নিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে। মূল কাহিনীতে ঢুকতে না ঢুকতেই সুদি মহাজন রাম লাল-এর বাড়িতে ডাকাতি এবং পরবর্তীতে তাকে হত্যা করা, পাঠককে আকৃষ্ট করে উপন্যাসের ভেতর যেতে হয়। পরবর্তীতেই আসে জুগ্গাত সিং আর গ্রামের ইমামের কন্যা নুরনের প্রণয়ের রগরগে কিছু মুহূর্ত।

'ট্রেন টু পাকিস্তান' নারী বিবর্জিত একটি বই এ কথা বলা যেতেই পারে। জুগ্গাতের প্রেমিকা নুরন এবং জুগগাতের মা ছাড়া পুরো উপন্যাসে উল্লেখযোগ্য কোনো নারী চরিত্র ছিল না। যদিও তাদের নামকোবাস্তে রাখা হয়েছে। বাইজী আসরের কয়েকটা দৃশ্য থাকলেও এখানে কোনো নারী চরিত্রকেই বিশেষ স্থান দেওয়া হয়নি।

উপন্যাসের প্লট থেকে আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অথচ নাটকীয় সূচনা দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে বলিউডের মারমার কাটকাট বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের কোনো দৃশ্য। ঘটনা শুরুর পরদিন সকালে দৃশ্যে ঢোকে ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম চাঁদ আর সাব ইনস্পেকটরের ডাকাতি ও হত্যা নিয়ে কথোপকথন, সাথে দেশের রাজনীতি আর সাম্প্রদায়িকতার সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে মূল্যায়ন। উপন্যাসের প্লটে একের পর এক ঢুকতে থাকে গ্রামবাসী, তাদের জীবনযাপন এবং শিখ-মুসলমান সম্পর্কের হৃদ্যতাপূর্ণ বিষয়গুলো। মানো মাজরায় আসে রহস্যময় ইকবাল চরিত্রটি। তিনি কোন ধর্মের অনুসারী, কী করতে মানো মাজরায় এসেছেন তা নিয়ে লেখক জল ঘোলা করেছেন উপন্যাসের অনেকটা সময় জুড়ে। যেহেতু পাঠক মন কোনো উপন্যাস পড়ার সময় একটি চরিত্রকে কেন্দ্রে রেখেই পাঠ করতে অভ্যস্ত, সেক্ষেত্রে তারা ইকবাল নাকি জুগ্গাত সিং কাকে তথাকথিত নায়ক বা রক্ষাকর্তা ধরে এগুবে, তা নিয়ে দ্বিধান্বিত হওয়ার সমুহ সম্ভাবনা রয়েছে।

একই দিনে মানো মাজরা থেকে গ্রেফতার হোন ইকবাল আর জুগ্গাত সিং। জুগ্গাত সিংকে ডাকাতি ও হত্যার দায়ে শ্রীঘরে পাঠানো হয়, তবে ইকবাল ঠিক কোন অপরাধে গ্রেফতার হলো তা নিয়ে লেখক রহস্য রেখেছেন। ইকবাল গুরুগম্ভীর আর জুগ্গাত সিং মুখরা। দুটি বিপরীতধর্মী চরিত্রকে সমান্তরালে রেখে পাঠকের মনে ধূম্রজাল তৈরি করে গেছেন খুশবন্ত সিং। এই ধূম্রজালে সম্ভাব্য অনেক ভবিতব্য পাঠক বিবেচনায় রাখতে পারেন। পাঠকের মস্তিষ্ককে ব্যস্ত রাখার কৌশল অবলম্বন করে খুশবন্ত সিং উপন্যাসটিকে প্রাণবন্ত করেছেন, মানো মাজরা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছেন। কোনো ক্যারেক্টার বিল্ড আপ’-এর আশেপাশে না গিয়ে লেখক সেই সময়টাকেই বারবার নিয়ে এসেছেন পাঠকের সামনে। হুকুম চাঁদ আর ইনস্পেক্টরের বয়ানে উঠে এসেছে দেশজুড়ে চলতে থাকা নৃশংসতা, হত্যার খবর

Muslims said the Hindus had planned and started the killing. According to the Hindus, the Muslims were to blame. The fact is, both sides killed. Both shot and stabbed and speared and clubbed. Both tortured. Both raped.

একদিকে গ্রামবাসীর সহজ-সরল জীবন আর অন্যদিকে ম্যাজিস্ট্রেট-ইনস্পেকটরের কথোপকথন, বারবার বুঝিয়ে দিয়েছে মানো মাজরা তখনও কতটা বাস্তবতা থেকে দূরে অবস্থান করছে। একদিন অভিশাপের কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মানো মাজরায় হাজির হয় লাহোর থেকে ছেড়ে আসা লাশবাহী ট্রেন। সেই ট্রেন আসার পর গ্রামীন জীবনের সহজ-সরল চালচিত্রে যেন কেউ কালো দাগ বসিয়ে বদলে যায়। গ্রামের নিত্যকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বদলে যায়, প্রতিবেশী মুসলমান বাড়িটি যেন পরিবর্তিত হয় দূরবর্তী কোন দ্বীপে।

দেশভাগের ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় মানো মাজরা নামে। পরে এর নাম দেওয়া হয় ট্রেন টু পাকিস্তান। উল্লেখ্য, দেশভাগের ওপর উপন্যাসের ধারায় প্রথম ইন্দো-অ্যাংলিয়ান উপন্যাস ছিল এটি। উপন্যাসের শুরুটা হয় বেশ নাটকীয়ভাবে। রাতের অন্ধকারে ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে আসে ডাকাতের দল

সংক্রামক রোগের মত সাম্প্রদায়িকতা রুখে দেয়ার পরিকল্পনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম চাঁদ। এই চরিত্রটি কখনো মনে ক্রোধের জন্ম দেবে, কখনো মনে হবে পরিস্থিতির শিকার মানবিক একজন সরকারি কর্মকর্তা। যে কিনা মানো মাজরা থেকে মুসলমানদের সরিয়ে দিতে নীলনকশা করতে পারেন, আবার নিজ সন্তানের বয়সী মুসলমান বাইজীর প্রতি দুর্বলতা বোধ করে তার নিরাপত্তা নিয়েও মনোকষ্টে ভুগতে পারেন। অনেক জল ঘোলা হওয়ার পর মুসলিমরা মানো মাজরা ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা গ্রাম ত্যাগ করার পরপরই ইকবাল আর জুগ্গাতকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে মানো মাজরা গ্রামেও জন্ম নেয় রক্তের বদলে রক্ত নেওয়ার প্রতিশোধস্পৃহা। উগ্রবাদীরা এসে গ্রামের শান্তিপ্রিয় মানুষদের উসকে দিতে থাকে। মুসলিম রক্তে হাত সিক্ত করতে দাঙ্গাবাজ হিন্দুরা ট্রেন আটকানোর উদ্দেশ্যে রেল ব্রিজ রশি বেঁধে দেয় যাতে ছাদের মধ্যে থাকা যাত্রীরা রশির সঙ্গে লেগে ছিটকে পড়ে, এরপর তারা তাদের গুলি করে হত্যা করবে। বইয়ের একেবারে শেষাংশে পাঠক যখন হত্যা, দাঙ্গা, হিংস্রতা পড়ে অনেকটাই অভ্যস্ত, যখন পাঠক জানে নিরীহ মানুষদের বাঁচাতে কোন সুপার হিরো আসবে না, আসে না কখনো, ঠিক তখনই দেব দূতের মত লাহোরগামী ট্রেন বেয়ে উপরে ওঠে পুলিশের খাতায় বদমাশ হিসেবে নাম লেখানো জুগ্গাত সিং। ট্রেনে তার প্রেমিকা নূরন থাকতে পারে এই আশংকা থেকে জুগ্গাত নিজের জীবন বাজি রাখতে তৎপর হয়। পুরো উপন্যাসে তার চরিত্রের ততোটা ব্যাপ্তি দেখতে না পেলেও উপন্যাসের শেষে জুগ্গাত সিং-ই বনে যায় গল্পের মূল নায়ক।

সন্ধ্যার অন্ধকারে সে ব্রিজ বেয়ে ওঠে কৃপান দিয়ে রশি কাটতে শুরু করে। ট্রেন আটকানোর পরিকল্পনাকারীরা দেখতে পেয়ে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকলেও সে রশি কেটে ফেলতে সক্ষম হয় এবং ট্রেনটি কোন রক্তপাত ছাড়াই নিরাপদে পাকিস্তানে চলে যায়।

উপন্যাসের শেষভাগই ছিল বইয়ের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত যা এক লহমায় একটি অবশ্যম্ভাবী ট্র্যাজেডির মুখ থেকে পাঠককে আবার আলোর জগতে ফেরত নিয়ে যায়। পুরো উপন্যাস পাঞ্জাব নিয়ে রচিত হলেও কেন উপন্যাসের নাম ট্রেন টু পাকিস্তান রাখা হয়েছে তা কাহিনির শেষাংশে এসে খোলাসা হয়। কর্মজীবনে খুশবন্ত সিং সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও লেখক ভারত পাকিস্তান রাজনীতি অনেকটা উহ্য রেখে উপন্যাসটি সম্পূর্ণ মানবিক দিক থেকে উপস্থাপন করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে দেশ স্বাধীন মনে হলেও সেই স্বাধীনতার সুবাতাস যে জনগণের কাছে পৌঁছায়নি তা বিভিন্ন কথোপকথনের মাধ্যমেই বুঝিয়ে দিয়েছেন লেখক। এইদিক থেকে খুশবন্ত সিংয়ের ট্রেন টু পাকিস্তান অনেকাংশেই সফল। বইটির বর্ণনা ছিল অনেকটা ভাসা ভাসা যেন পাঠক পাঞ্জাবের শান্তিপূর্ণ গ্রামের ছবি দেখছে। এই ভাসা ভাসা ছবির মাধ্যমেই দেশভাগের মর্মান্তিক সময় পাঠকের মর্মমূলে আঘাত করতে সফল হয়েছেন খুশবন্ত সিং, এ কথা বলাই যায়।

বইয়ের সমালোচনায় কয়েকটি বিষয় আসতে পারে। যেহেতু একটি গ্রাম নিয়েই উপন্যাসটি রচিত এবং সম্পূর্ণ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, সেক্ষেত্রে পুরো দেশের রাজনৈতিক বা সামাজিক অবস্থা নিয়ে তেমন ধারণা পাওয়া যায় না বা পাঞ্জাবের একটি বিচ্ছিন্ন গ্রাম দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের তৎকালীন সময়কে বিচার করা সম্ভব না। 'ট্রেন টু পাকিস্তান' নারী বিবর্জিত একটি বই এ কথা বলা যেতেই পারে। জুগ্গাতের প্রেমিকা নুরন এবং জুগগাতের মা ছাড়া পুরো উপন্যাসে উল্লেখযোগ্য কোনো নারী চরিত্র ছিল না। যদিও তাদের নামকোবাস্তে রাখা হয়েছে। বাইজী আসরের কয়েকটা দৃশ্য থাকলেও এখানে কোনো নারী চরিত্রকেই বিশেষ স্থান দেওয়া হয়নি। বইয়ে দেশভাগ নারীর জীবনে কী বিরূপ প্রভাব ফেলেছে তার বিস্তারিত আলোচনা তো নেই-ই বরং বইয়ের নুরন বা বাইজীর চরিত্রটি ছিল পুরুষের জৈবিক চাহিদার পুতুল মাত্র। ইকবাল চরিত্রটিকে খুশবন্ত সিং-এর রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রতিফলন বলা যেতে পারে। শুরুতে ইকবালের উপস্থিতি নিয়ে রহস্য করলেও ক্রমেই তাকে অহংকারী ও কার্যত 'অক্ষম' রাশভারি কমিউনিস্ট হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি চাইলে চরিত্রটি নিয়ে কাজ করতে পারতেন তবে এতে উপন্যাসের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ারও সম্ভাবনা ছিল। কোনো রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে না গিয়ে দেশভাগ পরবর্তী দু:সময়ের কিছুটা আঁচ পেতে 'ট্রেন টু পাকিস্তান' হতে পারে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মত একটি বই।