বাংলা-উপন্যাসে অদেখা এক অধ্যায়

অ+ অ-

 

অচল ঘাটের আখ্যান
মঞ্জু সরকার
প্রকাশক: চন্দ্রাবতী একাডেমি
প্রকাশকাল: ২০১৭
মূল্য: ৩০০ টাকা

 

ফসলের মাঠ যেখানে শেষ, সেখান থেকে শুরু অনাবাদী ধু-ধু বালুচর। সাদা বালুচরের ইতিউতি উলটানো কিছু কালো নৌক।  যেন বাড়িঘর ফেলে রেখে নদী কোথাও বেড়াতে গেছে। অনেকটা চর পেরুলে ক্ষীণকায়া যে স্রোতধারা সেটাই আসলে মূল নদী, একদার প্রমত্ত তিস্তা। শুকনো  মৌসুমে হাঁটুর চেয়েও কম পানি নিয়ে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। এক জায়গায় পারাপারের জন্য একটি নৌকাও আছে। সেই নৌকা চালাতে ইঞ্জিন-লগি-বৈঠা কিছুই দরকার হয় না। মোটরসাইকেলওয়ালা ভদ্রলোক কিংবা কাপড় ভেজানোর ভয়ে ভীত  মেয়েমানুষ যাত্রী পেলে নৌকায় তুলে নদীতে নেমে নৌকা ঠেলে পার করায় দুটি বালক মাঝি।এটাই এখন ঠ্যাংভাঙা ঘাট এবং মহির ঘাটিয়ালের খেয়ানৌকা।

মঞ্জু সরকারের অচল ঘারের আখ্যান উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে। আঞ্চলিক রাজনীতির স্বার্থে পশ্চিমবঙ্গে তিস্তানদীতে যখন বাঁধ  দেওয়া হয় তখন বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমের জেলাগুলোর নদীনির্ভর জনজীবনের হাহাকার আমরা এপার বাংলায় তেমন কেউ কর্ণপাত করি না। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুড়িগ্রাম জয়পুরহটে, নওগাাঁ-র কৃষকের ক্রন্দন স্বাভাবিকভাবেই স্থিত মধ্যবিত্ত জীবনে ন্যূনতম রেখাপাতও করে না। কিন্তু সময়কে তো অস্বীকার করা যায় না, যেমন ভোলা যায় না নদীর হারানো স্রোতকে। ইতিহাসের যে প্রেক্ষাপট ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হয়ে যায় তাকে আমরা পাশ কাটিয়ে  গেলেও সে কিন্তু অমোঘ হয়েই থাকে। কোথাও না কোথাও তার সাক্ষ্য রয়ে যায়। আমরা আড়ালে রাখতে চাইলেও সময়ের ইতিহাস, বিপর্যয়ের ইতিবৃত্ত ঠিক লেখা থাকে। সময়ে সে উন্মোচিত হয়। মঞ্জু সরকাররর এই উপন্য্যাসে আসলে  সেই সময় চিহ্নই বিধৃত; যা আজকের পাঠককে আলোড়িত করে, ভবিষ্যতের সমাজ-গবেষক যে বইয়ের সন্ধানে ফিরবে।

গ্রামের নাম, ঘাটের নাম সবই ঠ্যাংভাঙা। নামকরণের পক্ষে একটি সরলীকৃত উপকথা আছে ঠিকই, কিন্তু সে বিষয়টিকে উপন্যাসে উচ্চকিত করে  তোলা হয়নি। বরং অনেক বড় কথা ঘাটের ওপর ঝুঁকে পড়া প্রাচীন বটবৃক্ষটি, যে গাছ নিজেও নির্বাক চরিত্র হিসেবে রূপায়িত এই লেখায়। কখনও মনে হয় শতাব্দী-প্রাচীন বটগাছটি দীর্ঘ অতীত কাল থেকে ঘটমান বর্তমান কাল পর্যন্ত ঘাটের ও তিস্তার দর্শক, যেমন গপ্পু বুড়ো এ উপন্যাসে সময়ের কথক। বটগাছটিকে সরিয়ে নিয়ে গেলে যেন উপন্যাসটি থাকে না। অথবা আর  কোনও  প্রেক্ষাপটে যেন এই উপন্যাসের প্রতিস্থাপন সম্ভব নয়। কারণ, মরা নদী, পুরানো ঘাট ও বটতলার সঙ্গে চরিত্রদের সবারই প্রতিদিনের বাাঁচার সম্পর্ক।  রোজ বটতলায় আসতে হয় সবাইকে। দরকারে আসে, নিতান্ত  অদরকারে এমনি এমনি বসে থাকতেও আসে কেউ কেউ। ডাকাত-কন্যা দুলালির  দোকানে টিভি দেখে দেশের খবরাখবর ও কেচ্ছা বুঝতেও আসে অনেকে। সব মিলিয়ে একঘেয়ে জীবনযাত্রায় মাঝেমধ্যে যে উত্তাপ ও উত্তেজনার কারণ ঘটে, তার প্রকাশ ও প্রভাব আদি ঠ্যাংভাঙা ঘাট তথা ডাকাতের দোকানেই ধরা পড়ে বেশি। লেখক বলেছেন ঠিকই, নদীমাতৃক দেশে নদীও মরে যায়। কিন্তু আড়ালে তিনি যা দেখিয়েছেন তা হল সভ্যতার তথাকথিত উন্নয়ন, মানুষের আরোপিত রাজনৈতিক বাঁধে ত্বরান্বিত হয় নদীর মৃত্যু। আন্তর্জাতিক নদীগুলির ক্ষেত্রে নিম্ন অববাহিকা অঞ্চলে বসবাসকারী কৃষি জীবনের ক্ষয় হয় মারাত্মক। তিস্তাপারও তার ব্যতিক্রম নয়। একদার ভরা নদী শুকনো মৌসুমে যখন ধু-ধু বালুচর তখন নদীতীরের জনজীবনে ছন্দপতন ঘটতেই থাকে।

যে নদীতে নৌকা ভাসিয়ে প্রথম জীবনের দুরন্ত হাডুডু খেলোয়াড়, পরে সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পর দুর্ধর্ষ ডাকাত হয়ে যাওয়া খাজা দূরে দূরে সঙ্গীসাথী নিয়ে ডাকাতি করতে যেত, জেলখাটার পর সেই খাজাই হয়ে যায় অচল ঘাটের মুদি দোকানদার। ডাকাত-পিতার বদনাম ঘোচাতে  দোকানে বসে যুবতী কন্যা দুলালি। নদী শুকিয়ে এলেও দোকানে বেচাকনার ভিড় চরিত্রময় করে তোলে গ্রামসমাজের রূপান্তর, উন্নয়নের গতি ও দুর্গতি। দশ বছর নিখোঁজ থেকে, ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবি এড়িয়ে ও পরে ইটালিতে সচ্ছলজীবন কাটিয়ে গাঁয়ে ফিরে আসে প্রবাসী বসির। জন্মভূমির প্রতি টান কিংবা কিংবদন্তির বটগাছের প্রাকৃতিক খেলাঘরের স্মৃতিকে মর্যাদা দিতে বসির বিয়ে করতে চায় দুলালিকে। কারণ বটপাতার মর্মর ধ্বনি লিবিয়া ও ইটালিতে বসে শুনতে পেয়েছে বসির। লেখক রূপায়িত করেছেন সেই জনজীবন যা নদীর মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত। অথচ সে-জীবন স্তব্ধ নয়। লেখকের কলমে মরা নদীর চরে জীবন বদলেছে, মুদি দোকানের টিভিতে বিজ্ঞাপনের ছবি ও ইটালি বসির হাজির হয়েছে বিশ্বায়নের ছায়া কাঁধে নিয়ে, কিন্তু জীবনের চলমানতা থেমে থাকেনি কখনও। লোকজনের বিশ্বাস ঠ্যাংভাঙায় তিস্তার বান কি ভাঙনও আদি ঠ্যাংভাঙা ঘাটকে গিলে হজম করতে পারেনি প্রাচীন বটবৃক্ষের অবস্থানের কারণে। পাশের দেশের নদী ঘিরে  তোলা বাঁধও তেমনি হজম করতে পারেনি মানুষের চিরায়ত সুখদুঃখের ছবিকে।

ইটালি বসিরের চোখ দিয়ে লেখক বাহ্যিক পরিবর্তনের চেহারা অনেকটাই দেখিয়েছেন। বসিরের দেখায় মরা তিস্তার বুকে অনেকখানি ফসলের খেত আর ডালপালা ছাঁটা বটগাছটির ক্ষুদ্র রূপ নিয়ে ঠ্যাংভাঙা ঘাট প্রকৃত অর্থেই একটি ভাঙা ঘাট। গ্রামে ঘরবাড়ি ও মানুষজনের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছে, কিন্তু আগেকার দিনের মতো বটেরতলে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য তেমন আর কেউ আসে না বরং নদীর চরসংলগ্ন নিচের জমিতে যে কামলারা কাজ করে তারা বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বটতলা তথা বাঁধ সংলগ্ন ডাতাদের দোকানে বসে চা-পান খায়, টিভি দেখে, গল্পগুজব করে। তিস্তার অতীতের ভরাট রূপ নিয়ে ভাবার সময় নেই কারো। দেশে থাকলেও বসিরের তেমনটাই হতো। কিন্তু দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং প্রবাসে একাকীত্বে হারানো তিস্তার জলের শব্দ এবং বটতলার হাওয়াবাতাস তার স্মৃতিকে তোলপাড় করত। বটতলার আড়ালে প্রথম নারীশরীর পাওয়া ছিল তার জীবনের প্রথম প্রেমও।

তবে এমন একটি সময়ের ধারাবিবরণী-মূলক উপন্যাসে একজন কথককেও থাকতে হয় যেন। যে-চরিত্র আসলে লেখকের নিরপেক্ষ সত্তা নয়, বরং তাঁর সচেতন দ্রষ্টা সত্তা। সাংবাদিক হিসেবে অবশ্য লেখকও রয়েছেন সংক্ষিপ্ত ভূমিকায়। তবে সচেতনভাবেই তিনি উপন্যাসের চরিত্র হয়ে উঠতে চাননি।

আইনুদ্দি বুড়ো বা গপ্পু বুড়ো নামে চরিত্রটি উপন্যাসের নাট্যমঞ্চের ভেতর দিয়ে মাঝেমাঝেই যাতায়াত করে। তার অপর নাম গপ্পুবাজ আইনুদ্দি ভাটিয়া। উত্তরা এবং ভাটিয়া, চরাঞ্চলে মৌখিকভাবে প্রচলিত এই দুই শব্দও উপন্যাসে তাৎপর্যপূর্ণভাবে ব্যবহৃত হয়েছে নিম্নবর্গীয় সমাজের ভেতর এক ধরনের সামাজিক-ভৌগলিক মেরুকরণ বোঝাতে। তিস্তার উত্তর দিক থেকে আসা মানুষগুলো উত্তরা, এবং দক্ষিণ বা ভাটি অঞ্চলের জেলাগুলি থেকে এসে চরে যারা বসতি করেছে তারা ভাটিয়া

তিস্তার পুরানো চর ভাটিয়াপাড়ার মানুষ হওয়ায় ঠ্যাংভাঙার আদি বাসিন্দারা এক সময় গপ্পু বুড়োকে বলত আইনুদ্দি ভাটিয়া। তরুণ বয়সে  নৌকার মাঝি হয়ে আইনুদ্দি নাইয়া ক্ষেতের কাজ করার সময় আইনুদ্দি কামলা এবং ভার কাঁধে দীর্ঘকাল দোকান করার সময় আইনুদ্দি দোকানদার। উত্তরা ও ভাটিয়া সবার কাছেই ছিল সে আইনুদ্দি দোকানদার। কিন্তু  শেষ বয়সে আইনুদ্দি সব নাম খুইয়ে এখন শুধু গপ্পুবাজ বুড়ো। বটতলার পুরোনো ঘাট ছাড়া তার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, পুরানো দিনের গল্প করা ছাড়া তার কিছু বলারও নেই।

লেখক মঞ্জু সরকারের সামগ্রিক সাহিত্য কীর্তির ভেতর এক আশ্চর্য চরিত্র নির্মাণ এই গপ্পুবাজ আইনুদ্দি বুড়ো। বাংলা সাহিত্যেও এ চরিত্রের প্রতিরূপ দুর্লভ।  যে চরিত্র রসিক, স্মৃতি-সচেতন আবার একই সঙ্গে সময়ের অতীও ও বর্তমান স্তর নিয়ে অসেচতন, মায়াবী ও উদাসীন, ভীতু এবং আবেগপ্রবণ। লাঠিতে ভর দেওয়া তার জীর্ণ শরীরটা যেন বর্তমানের উন্নয়ন ধামাকায় অতি দূর অতীতের রয়ে যাওয়া স্বচ্ছ জীর্ণতা, যা সে বয়ে বেড়ায় এবং প্রতিদিন ঠ্যাংভাঙা ঘাটে  টেনে নিয়ে আসে।  অন্য  লোকজনের  তো পুরানো ঘাট পার হয়ে আর  কোনো গন্তব্যে যায় না আইনুদ্দি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তার একমাত্র আসার জায়গা খাজা ডাকাতের দোকান ও বটের তল। সে কখনোই দোকানের খদ্দের নয়, টাকা-পয়সার সঙ্গে সম্পর্ক নেই বলেই হয়তো গায়ে পকেটঅলা জামা নেই। অশক্ত শরীর টেনে চলার সুবিধার জন্য তার হাতে বাঁশের লাঠি, লঠিটা হাতের কাছে রেখেই  দোকানের  বেঞ্চিতে বসে থাকে সারাদিন।  বেঞ্চে পা তুলে বসে একটা বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে চুপচাপ বেচাকেনা দেখে সে, লোকজনের কথাবার্তা শোনে, টিভিতেও চোখ রাখে কখনও-বা। গল্প দিয়ে ভিড়কে টানতে পারে না যখন, চোখ বুঁজে ঝিমোয় এবং ঘুমিয়েও পড়ে কখনো।

ইটালি বসির বা আইনুদ্দি বুড়োর মতো উপন্যাসের উল্লেখ্য চরিত্র আরও সবাই। প্রতিটি চরিত্রকেই গ্রামজীবনের এক-একটি অনুষঙ্গ ও অভিব্যক্তির সঙ্গে মিলিয়েছেন লেখক। সবার ভূমিকাও তাই নির্দিষ্ট। নির্দিষ্ট, তবে গতানুগতিক বা প্রোটোটাইপ নয়। বরং চরিত্রের মাধ্যমে  প্রোটোটাইপ ভেঙে ফেলার কাজটিই লেখক দক্ষতার সঙ্গে করে গেছেন। এই চরিত্র ভাঙার আর এক উদাহরণ হিসেবে ঘাটের মুদি  দোকানের মালিক কানাপীরের টুপি পরা খাজা ডাকাতকেও আনা যায়। খাজা যে একদিন দুর্ধর্ষ ডাকাত হবে কৈশোর কালে তার হাডুডু  খেলা  দেখেও বুঝেছিল  কেউ কেউ। খাজার বাকি পরিচয়, বলা যায় পরিচয়  ভেঙে  ফেলার পরিচয় উঠে এসেছিল সাংবাদিকের সঙ্গে তার মুখোমুখি কথায়।

এবং ডাকাত-কন্যা দুলালি। মঞ্জু সরকারের এক আশ্চর্য নারী চরিত্র নির্মাণ। উপন্যাসের চলনে এবং মরা তিস্তার ধারে ঠ্যাাংভাঙা গ্রামের আখ্যাানে দুলালি তার বাপের দোকান সামলেও কাহিনিকে যেন বয়ে নিয়ে চলেছে। যেহেতু বটতলায় তার দোকান ঘিরে উপন্যাসের মূল  স্রোত আবর্তিত, সেহেতু স্বাভাবিক ভাবেই দুলালি এসে পড়ছে বারবার। কিন্তু লেখক এত নির্মোহভাবে এই গ্রামীণ মেয়েটিকে গড়েছেন যে  সেখানে আবেগের চাইতে বড় হয়ে উঠছে দুলালির বাস্তব সচেতনতা, পারিপার্শ্বিক পৃথিবী দেখে তৈরি হওয়া জীবনবাধ। বসিরের সঙ্গে কৈশোরকালে একদা শারীরিক মিলন স্মৃতিতে কাজ করছে ঠিকই, কিন্তু ইটালি প্রত্যাগত স্বচ্ছল বসিরের সঙ্গে নদীর নির্জন চরে হাঁটতে হাঁটতে সম্পর্ক পাকাপাকি করার মুহূর্তেও দুলালি তার মনর দৃঢ়তা হারায়নি। প্রবাসী বাংলাদেশি যুবকের সঙ্গে জীবন কাটানো এবং তথাকথিক উন্নত জীবনের হাতছানি, যা এখন গ্রামগঞ্জে প্রায় অহরহ, শেষ মুহূর্তে তাকে প্রতাখ্যান নয়, বরং উপেক্ষা করেছে দুলালি। গ্রাম বদলের অনিশ্চয়তা, যৌবনের টানাপোড়েন নিয়ে বাবার সঙ্গে পরিশ্রমী দোকানদারি ও মরা নদীর বাতিল হয়ে যাওয়া ঘাটের জীবনের সঙ্গেই মিশে থাকতে চেয়েছে সে। একটি গ্রাম্য, সরলতা ও চাতুর্যে মিশ খাওয়া বাংলাদেশি নারীর কাছে বিশ্বায়ন তার সমস্ত চমক ও আধুনিকতার দেখনদারি নিয়ে পরাস্ত হয়েছে। চূড়ান্ত মুহূর্তে আবারও প্রটোটাইপ ভেঙেছেন লেখক, প্রত্যাখ্যাত ইটালি বসির হঠাৎই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।

তবে তার ঠিক আগে, উপন্যাসে সেও এক অন্তিম আখ্যান যেখানে  লেখক নির্মাণ করেছেন গপ্পোবাজ আইনুদ্দি বুড়োর মৃত্যুকালীন দৃশ্যটি,  সে দৃশ্যে শোকের কোনও অতিকথন নেই। দুই  ছেলের পৃথক ঘরসংসারের মাঝে জীর্ণ একটি টিনের ঘরের দাওয়ায় শেষ বিকেলে মৃত্যু হয় আইনুদ্দির। জগৎ-সংসার থেকে প্রত্যাখ্যাত ও সারা জীবন অচল ঘাটের নিঃসঙ্গ ধারাভাষ্যকার বুড়োর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লে হাত সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় দুলালি...

বাংলা সাহিত্যে এই প্রস্তান এক মহাকব্যিক দ্যোতনা বয়ে আনে। একদা আর এক মহাকাব্যিক মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ইন্দির ঠাকরুণের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে সেকালের অবসান হইয়া গেল। আইনুদ্দি বুড়োর মৃত্যুতে তেমন কোনো অনুভূতিই পাঠকমনে সঞ্চারিত হয়। সব মিলিয়ে অচল ঘাটের আখ্যান বাংলা উপন্যাসের চিরায়ত ধারায় বিশিষ্ট এক সংযোজন। বাংলা-উপন্যাসের সুগৌরব ধারায় নতুন এক অধ্যায়ও, নিঃসন্দেহে।