স্বাভাবিকতার অস্বাভাবিক কাহিনি
আন্ডারগ্রাউন্ড
মাসরুর আরেফিন
প্রকাশক: কথা প্রকাশ
প্রচ্ছদ: আনিসুজ্জামান সোহেল
মূল্য: ৪০০ টাকা
মাটির নীচের পৃথিবীর সন্ধান যেমনি দরকার আমাদের, ঠিক তেমনি আমাদের দরকার মাটির ওপরের পৃথিবীর। যেনবা পৃথিবীর পরতে পরতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিস্ময়, যন্ত্রণা, হাহাকার, জাত-ঘৃণা কিংবা সম্প্রদায় ঘৃণা—এটি ঐতিহাসিকভাবে এক বৈশ্বিক বাস্তবতা। যে বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারেননি কেউ, আর সৃজনশীল লেখক তো নয়-ই।
ইতিহাসের সহিংসতা ও বর্বরতাকে কিভাবে সাহিত্যে-চিন্তায় তুলে আনা যায় ভেবেছেন অনেকেই। দেখিয়েছেনও নানাজন নানাভাবে—ভাষায়, ইঙ্গিতে, প্রকাশ ও ভঙ্গিতে। এক্ষেত্রে মাসরুর আরেফিনের উপন্যাস আন্ডারগ্রাউন্ডকে অগ্রাহ্য করা যায় না। এর অন্তর্নিহিত কারণ, চেচেন তকদিরভের প্রতি রাশান দিমিত্রি, ভিতালি ও কুভালদিনের ঘৃণা, আবার চেচেন গেরিলা হিসেবে তকদিরভের আত্ম-অহংকার আর রাশান ও ইহুদি-বিদ্বেষ সব স্পষ্ট এই উপন্যাসে।
আন্ডারগ্রাউন্ড উপন্যাসটি পড়তে বারবার হ্যারল্ড পিনটারের অ্যাবসার্ড ড্রামার [বার্থডে পার্টি, উদাহরণত] কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল মনের পাতাটনে। তাঁর লেখায় যৌনতা খুব প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে। আরো এসেছে সাম্প্রদায়িকতার ইস্যুটিও। মনে হবে ঘটনা ঘটছে রাশিয়ায়, কিন্তু তার বাস্তবতা বাংলাদেশেও বরাবর উপস্থিত। রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের পতন, এবং ধনতন্ত্র কীভাবে বৈশ্বিক ভাষায় পরিণত হল, তা নিয়ে লেখকের খুব সুস্পষ্ট বোঝাপড়া লেখক উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন।
আন্ডারগ্রাউন্ড উপন্যাসটি পাঠে আকস্মিক মনে হতে পারে—এই শব্দ, বাক্য, টার্ম কোথায় যেন পড়েছিলাম আগে। যেমন করে—এনকেভিডি, লাভরেন্তি বেরিয়া, সোনাবাচ্চা, পোল্যান্ডের কাতিন ফরেস্ট, মালতি-বকুল-জুঁই, মোরগফুল, গন্ধরাজ, পাতাবাহার। একদম ঠিক। লেখকের কবিতায়ও তা ব্যবহৃত হতে দেখি বারংবার। ছায়ার মতো তাঁর প্রিয় প্রসঙ্গগুলো কবিতা বা উপন্যাসে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। স্পষ্ট করি, মস্কোর আন্ডারগ্রাউন্ড ঘোরের পর লেখক যেন উপলব্ধির পাতায় আলো ফেলে এগিয়ে চলেন—
‘আমাকে ঘুরিয়ে আনা হয়েছে বিশ্বপ্রকৃতি ও মানব ইতিহাসের সদর বারান্দা দিয়ে, যার সামনের উঠোনে পাতাবাহারের গাছ, যার ওপরের আকাশে মানুষের প্রতি হুকুমদাতা নীল, আর যার পেছনের জঙ্গলে জাতিগত বিদ্বেষ, শ্রেণীঘৃণা, বর্ণবাদ, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যালান্সশিটের টুকরোটাকরা ধরনের ইট-খোলামকুচি।’
রাষ্ট্র কর্তৃক বা স্টালিন কর্তৃক কবি ওসিপ মান্দেলশতামের নির্ধারিত মৃত্যুর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মূলত এই পৃথিবী কীভাবে চলে, তার স্বরূপ উন্মোচনের মাসরুর আরেফিনের এই তৃতীয় উপন্যাস। স্টালিন মেরে ফেলেছিলেন বিশ শতকের সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিকে, কারণ কবি মান্দেলশতাম তার সংজ্ঞা, তার সত্য উপলব্ধির শক্তির মাধ্যমে বুঝেছিলেন বিপ্লব মানুষের কণ্ঠ রোধে সচেষ্ট হবে। বুঝেছিলেন যে, রাষ্ট্র-নির্মিত সত্যের বাইরে আর কোনো সত্যের স্থান নেই। এই মিথ্যা প্রতিপাদ্যকে রাষ্ট্র সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। কারণ, ‘বিপ্লবের গলা পিপাসায় শুকনো, কিন্তু সে বাইরের কারও হাত দিয়ে জলের একটা ফোঁটাও গ্রহণ করবে না। বিপ্লবের পরে তাই তৃষ্ণা-ক্ষমতা ও রক্তের বিরাট তৃষ্ণা।’
উপন্যাস পড়তে পড়তে যতই এগিয়ে যাই ততই দেখি, মাটির ওপরের ওভারগ্রাউন্ডেই রয়েছে কত কত রকমের আন্ডারগ্রাউন্ড। তারই একটির দেখা পায় নায়ক, যখন সে ভ্যালেন্তিনা ও সাদাতকে নিয়ে ‘ওসিপ মান্দেলশতাম মিউজিয়াম’ দেখতে যায়। সেখানে মিউজিয়ামের লোকেরা ভয়ংকর এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে ভ্যালেন্তিনা, সাদাত ও নায়কের সঙ্গে...
বিপ্লবের পরে যে রক্তের তৃষ্ণা দেখা দেয়, সেই তৃষ্ণাকে মান্দেলশতাম অনুভব করতে পেরেছিলেন বিপ্লব সংঘঠিত হওয়ার পূর্বেই। মান্দেলশতাম কবি, রাষ্ট্রের নিগড়ে আটকে না থাকা এক কবি, তিনি তার কবিতায় উচ্চারণ করেছিলেন সব সত্য উপলব্ধি, যা সরাসরি আঘাত হানতে পেরেছিলো স্টালিনের দুর্গের শরীরে। তাই তিনি লিখেছিলেন—
কী এক কাল এই কাল!
অসুস্থ পুত্রের রক্তের মাঝে জমাট বাঁধছে দ্যাখো চুনের স্তর,
কাঠের কফিনে মস্কো নিদ্রাতে,
এই জালিম সময় থেকে পালিয়ে কোথায় যাবে তুমি?
উপন্যাস পড়তে পড়তে যতই এগিয়ে যাই ততই দেখি, মাটির ওপরের ওভারগ্রাউন্ডেই রয়েছে কত কত রকমের আন্ডারগ্রাউন্ড। তারই একটির দেখা পায় নায়ক, যখন সে ভ্যালেন্তিনা ও সাদাতকে নিয়ে ‘ওসিপ মান্দেলশতাম মিউজিয়াম’ দেখতে যায়। সেখানে মিউজিয়ামের লোকেরা ভয়ংকর এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে ভ্যালেন্তিনা, সাদাত ও নায়কের সঙ্গে। মান্দেলশতাম যেভাবে নিগৃহীত হয়েছিলেন, নিপীড়িত হয়েছিলেন, খুন হয়েছিলেন রাষ্ট্রের হাতে, সেটা দেখতে গিয়েই আমরা রাষ্ট্র নামক এক বড় সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত ছোট সংগঠন এক মিউজিয়ামের হাতে মানুষের কী ঘটতে পারে শুধু সেটাই দেখি না, দেখি যে ওসিপ মান্দেলশতামের রাষ্ট্রবিরোধী কাজ নিয়েও প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। অবিশ্বাস্য!
এ থেকে মাসরুর আরেফিন যেন স্বতন্ত্র হয়ে ওঠেন। হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিক ভাবনায়। এখানেই তার কৃতিত্ব। আন্ডারগ্রাউন্ড আদতেই এক বহুমাত্রিক উপন্যাস। যে উপন্যাসের ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গি ভিন্নতর। উপন্যাসে যতিচিহ্নের ব্যবহারের মাধ্যমে বাক্যকে ভেঙে ভেঙে একটি সমন্বিত মূর্ছনার ঢেউ বানান তিনি। আর তার মধ্যে প্রবিষ্ট করান গা হিম করা কাব্য-সুষমা। তার বাক্য নির্মাণ তথা তার গদ্যের পরতে পরতে থাকে আবার তার নিজস্ব জীবন ও রাজনৈতিক দর্শনের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু সেটা কখনোই কাহিনিকে উপচিয়ে যায় না। গল্পের সীমানার মধ্যে অভিযোজিত করেই সবকিছুর প্রয়োগ ঘটান তিনি। মাঝেমাঝে মনে হতে থাকে আন্ডারগ্রাউন্ড পরাবাস্তব নাকি অধিবাস্তব, তা ধরাই মূল সমস্যা। সমস্যা সাংঘাতিক উদ্ভট সেই জগতেরও, স্বাভাবিকতার কোনো সংজ্ঞার মধ্যে যেন অস্বাভাবিকতা ঢুকে পড়ে।
সেই আন্ডারগ্রাউন্ডে দেখা হয় আরো উদ্ভট কিছু চরিত্রের সাথে—জেনারেল ফ্লাশটারমেইশটার, অনেক হিজড়া, ওলগা, হুগো বোগলি, বুলডগ, ভ্রুকুস, নগুয়েন লাম খ্যাকসেয়াল এবং পরিচিত অপরিচিত আরো অনেকের। মনে হচ্ছিল, এই চরিত্ররা সব কোনো উপন্যাস থেকে উঠে আসা প্রাচীন শব চরিত্র। এই আন্ডারগ্রাউন্ডের জগতের মাধ্যমেই লেখক একটা সত্যের চেয়েও অনেক সত্যকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছেন। যা এই উপন্যাসের মূল বক্তব্যগুলোর সবকিছুই, যেমন—রাষ্ট্র, ক্ষমতা, বিপ্লব, এমনকি এই আন্ডারগ্রাউন্ডও কাঠামোর একটা অংশ এবং কাঠামোর নিজের প্রয়োজনেই, নিজের নিয়ন্ত্রণেই ঠিক করে দেয় কখন বিপ্লব হবে, আর বিপ্লব শেষে আবার রাষ্ট্র তার নতুন ক্ষমতাসহ ফ্যাসিস্ট ও ভয়ানক হয়ে উঠবে।
আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে উঠে আসার পরে উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্রদের আচরণের স্বাভাবিকতার যে নিয়তি, সেই নিয়তি কিংবা নিয়ন্ত্রণ তা আর থাকে না। এর ফলে প্রথম বা দ্বিতীয় পাঠে খানিক খটকা লাগবে স্বাভাবিক। অধিক পাঠে উপলব্ধি করলাম, এই অস্বাভাবিকতা, অ্যাবনর্মালিটি, ডিসটার্বেন্স সব যেন ইনটেনশনাল, সবই লেখকের ইনটেনশনাল।
তাই এই উপন্যাস মাটির ওপরের প্রকাশ্য পৃথিবী আর মাটির নিচের গোপন পৃথিবীর মধ্যে পরিবেশের যে ফারাক উন্মোচন করে দেখায়, সেখানে কি করে সম্ভব বর্তমান কাঠামোয় মানবসমাজের জন্য কোনো বৃহত্তর ঐক্যসূচক অর্থ দাঁড় করানো? সেখানেই প্রশ্ন। উত্তরও এর মধ্যে নিহিত। কিন্তু লেখক প্রশ্ন করেন—‘এভাবে কতদিন টিকবে আর এই সিস্টেম? কবে শেষ হবে এই অনাচার ও তামাশার, উন্নয়নের বর্ণচ্ছটা ও জনগণের দাবির নামে হালাল হওয়া সব নিষ্ঠুর ব্যবস্থার? আর শেষ হওয়াটা কি আদৌ জরুরি কোনো বিষয়?’ তাই উপন্যাস শুধু বাস্তব কাঠামোর কথা উচ্চারণ করে না, উচ্চারণ করে সভ্যতার কথা আর তার ভিতর লুকিয়ে থাকা সময়ও।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন