সাতটি তারার তিমির

অ+ অ-

 

|| এক ||

ওটা একটা দাওয়াত ছিল। ঢাকায়। শায়লার সেই দাওয়াতে যাওয়ার কথা ছিল না। সে তখন চাকরি ছেড়ে দিয়ে, নিজের চল্লিশ বছর বুঝে নেওয়ার আয়োজন করছিল। চল্লিশ তো কতজনেরই হয়, তারাও শায়লার মতো বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে ডিফিকাল্ট ক্যাচে ছক্কা ভণ্ডুল করার মতো জীবনকে ধরে ফেলে কিনা কে জানে! শায়লাও জানে না, চাইলেই জানতে পারত। তার চল্লিশ হয়েছে মানে তার বন্ধুদেরও হয়েছে, তাদের জিজ্ঞেস করলেই জানা যেত। কিন্তু এ্টা কীভাবে জিজ্ঞেস করা যায় যে, জীবনের ক্যাচ ধরেছিস কীনা? দেখা গেল সবার ক্যাচ মিস। তখন ক্যাচ মিসের গল্প শোনা লাগত। সেধে সেধে সে ওসব গল্প শুনতে চায়নি। ফলে ধরেই নিয়েছে এই ক্যাচ ধরার সফল ফিল্ডার সে একাই। অবশ্য পড়ুয়া হলে সে জীবনী পড়তে পারত, যারা জীবনী লিখেছেন তারা তাদের চল্লিশ নিয়ে কী করেছেন জানা যেত। কিন্তু জীবনী পড়তে ভাল লাগে না তার। তেমন পড়ুয়াই নয় সে। ভেবে দেখেছে, নিজের জীবন লিখতে গেলে শুধু দুখের কথা বাড়িয়ে বাড়িয়ে লিখতে ইচ্ছে করে, এক ওভারে সাত বল করার মত। ওয়াইডের গোলমাল মেলা সম্ভবই নয়। এটা হতে পারে যে, একজনের জীবন গবেষণা করে অন্য কেউ বা কয়েকজন লিখলে সেটা একটা ফেয়ার জীবনী হতে পারে, কিন্তু পাতানোও হতে পারে। নো বলের ফ্যাঁকড়া তো থাকবেই। ফলে জীবনী পড়ার রিস্ক নেয়নি সে। সে বরং নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে ডিসেম্বর মাসের মতো। যেমন করে দিন ছোট হয় মাত্র দুই ঘণ্টা, সেই দুই ঘণ্টা সকাল থেকে, নাকি দুপুর থেকে নাকি বিকেল থেকে কমে কেউ খেয়াল করে না। সেইভাবে সে নিজেকে সরিয়েছে পরিবার থেকে, কাজ থেকে। সরিয়ে বিরাট এক খালি মাঠের মতো সময় বের করেছে, যে মাঠে আর খেলা হয় না, বড় বড় ঘাস, যেন ফতুল্লা স্টেডিয়াম।

ওটা একটা দাওয়াত ছিল। যে দাওয়াতে শায়লার যাওয়ার কথা ছিল না। পরদিনের ট্রেনের টিকিট কাটা ছিল। জীবনে এত কম বেড়াতে গেছে সে, এখন ভেবে অবাক লাগে। এইটুকু একটা বাংলাদেশ তার প্রায় নব্বইভাগ দেখা হয়নি। এমন না যে ভ্রমণ খুব পছন্দ তার, তবু চল্লিশ বছর কেটে গেছে ছোট্ট একটা দেশের মাত্র দশভাগে। পুড়ো দুনিয়া তো বাদই। চল্লিশ বছর অনেক সময় আসলে। দশ বিশ ত্রিশ চল্লিশ, একেকটা দশক গেছে আর সামনের দশকে জীবন কেমন হবে, আগাম বোঝার চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু জীবন গেছে একেবারে সোজা, যেন চল্লিশ বছরে মাত্র বাইশ গজ। আচ্ছা এবার নিশ্চয়ই দাওয়াতের গল্পটা বলতে হবে, নাহলে সবাই বিরক্ত হয়ে যাবে। গল্প শুরু করতে একটু নার্ভাস লাগছে আসলে। এটা জীবনীবিরোধী গল্প হতে যাচ্ছে। খুঁটিনাটি তথ্যের এক্সট্রা রান দিতে ইচ্ছে করছে না, এক্সট্রা রানে বোলারের কলংক আছে কিন্তু ব্যাটারের ক্রেডিট নেই। ফলে এই গল্পে কোনো এক্সট্রা রান দেওয়া হবে না। রেফারি আর থার্ড আম্পায়ারের জন্য এই ম্যাচ আরামের। কিন্তু পাঁচশো শব্দ হয়ে এল প্রায়, গল্পে ঢুকতে হবে এবার। এ তো আর টেস্টম্যাচ নয় যে শুধু টিকে থাকলেই হয়। এটা ওয়ান ডে, বড়জোর প্রথম দশ ওভার হালকা চালে খেলা যায়, তাও সেটা শেষ দশ ওভারে পুষিয়ে দিতে হয়। এই গল্পের শেষ দশ ওভারে ঝড় উঠবে কীনা, এখনও ঠিক জানি না। হতে পারে চল্লিশ ওভারেই অল আউট। আবার হতে পারে পঞ্চাশ ওভার ব্যাট শেষে, প্রতিপক্ষের পঞ্চাশ ওভারও এসে যেতে পারে। সে সম্ভবনা কম যদিও। আর যদি টি টুয়েন্টি হয়ে ওঠে, তাহলে শুরুর ধানাইপানাই এডিট করে ফেলে দিতে হবে। অথবা বৃষ্টি নামিয়ে খেলাই পণ্ড করে দেওয়া যায়। এই যে কত অপশন, চল্লিশের পরেই কেবল শায়লা বুঝতে পেরেছে জীবনের অনেক অপশন। ফলে ওই দাওয়াতে শায়লা গেল। যে দাওয়াতে তার যাওয়ার কথাই নয়। গিয়ে দেখল ভালই গ্যাদারিং। এত গ্যাদারিং হবে জানলে হয়তো আসতই না সে। কিন্তু এসেই যখন পড়েছে, ঠিক করল, যারা এসেছে প্রত্যেকের মুখ দেখবে একবার করে। বিরাট হলঘর, পুরোটার দিকে একবারে তাকালে মনে হয় যেন, এলোমেলো দাঁড়িয়ে বা বসে আছে অনেক মানুষ, প্রত্যেকের মুখে অর্থহীন অভিব্যক্তি। কিন্তু একটু মন দিয়ে খেয়াল করলেই টের পাওয়া যায়, ছোট ছোট সার্কেল আসলে। আলাদা আলাদা গল্প চলছে, গল্প অনুসারেই অভিব্যক্তি সাঁটানো। শায়লা প্রথমেই ঘরটার উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম বোঝার চেষ্টা করল, খানিক পরে হাল ছেড়ে দিয়ে গোনার চেষ্টা করল, মোট কয়টা মাথা। নিজের উপর বিরক্ত হয়ে খাবারের লম্বা টেবিলের দিকে গিয়ে একটা জুসের গ্লাস তুলে নিল। নিজেকে বল্ল, চলো শায়লা, সবচেয়ে দূরের কোণা থেকে দেখা শুরু করা যাক। মনে মনে যে প্রত্যেকের মুখ দেখার বাহানা সেটা লোকে বুঝে ফেললে কেমন ব্যাকাত্যাড়া একটা ব্যাপার হবে ভেবে নিজেরই হাসি পেল। ঘরের কোণার দিকে হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করল, তার মতো দলছুট আরো আছে দুই একজন। কী করবে বুঝতে না পেরে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। একা একা লোকের মুখ দেখার চেয়ে দলছুটিয়াদের একটা দল পাকালে কেমন হয়, ভাবল একবার।

এটা এমন এক দাওয়াত, যেখানে হোস্ট ছাড়া কাউকেই চেনে না শায়লা। চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে হোস্টকে খুঁজল একবার। সে যে কোন ভিআইপি গ্যালারিতে বসে আছে কে জানে। সে তাই দলছুট একজনের দিকে এগিয়ে গেল। একসময় অচেনা মানুষের সাথে কথা বলায় কোনো জড়তা ছিল না তার। যে কোনো বিষয় নিয়ে যার তার সাথে গল্প জুড়ে দিতে পারত। আজকাল পারে না, তবু পুরোনো স্কিল ঝালাই করে নেওয়া যায়। এক পাশে একটা সুন্দর মেয়ে একা একা ফোনে ডুবে আছে। তাকে দেখে মনে হল, ভিড়েও একা হওয়া যায়। একদম কাছে গিয়ে হাই বলল শায়লা। চমকে তাকালো দলছুট মেয়েটা। নার্ভাস হয়ে হাসল, শায়লা বলল, বিরক্ত করলাম? মেয়েটা দুই দিকে মাথা নেড়ে বলল, না না বোর হচ্ছিলাম। শায়লা হেসে বলল, একটা মজার খেলা খেলবেন? মেয়েটা শায়লার দুষ্টুমিতে মজা পেল, ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন না করেই বলল, ওকে। শায়লা বলল, আসেন সবার মুখ দেখি একবার করে। মেয়েটা ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল। শায়লা বলল, আমার নাম শায়লা নাজনীন, ইলা বসাক নিজের নাম বলে হাসল। শায়লা খক খক হেসে বলল, ছোটবেলায় ইলা নামের একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম আমি। ইলা খিক খিক হাসি ফিরিয়ে দিয়ে বলল, আপনি হোমো নাকি? শায়লা বলল, আরে না না, চাইলেই দেখা করা যায় বলে। দেখা হওয়া নিয়ে হুদাই প্যারা ভাল লাগত না। হো হো করে আবার হাসল ইলা বসাক।

আরেকটু দূরে সুন্দর একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে একা। এর কানে হেডফোন, না জানি কী গান সে শোনে। শায়লা আর ইলা এগিয়ে গেল, দুই হ্যালো একসঙ্গে শুনে হেডফোন খুলে ফেলল আতিক। ঘুরে ঘুরে সবার মুখ দেখার প্রস্তাবে সেও রাজি হয়ে গেল। তিনচারটা জটলা ঘুরে মুখ দেখতে দেখতে ঢাকার জ্যাম, দেশের ভোট, ফেসবুকের ভাইরাল আর ব্যক্তিগত হা হা হি হি শুনে একটা ব্রেক নিল তারা। ইলা এক প্লেট কাবাব হাতে ফিরে এসে চোখ টিপে শায়লাকে জিজ্ঞেস করল, কয়টা মুখ মনে আছে? শায়লা বলল, ওই মেহেদী হাসানের মতো লোকটাকে ভুলতে পারছি না!

আতিক আর ইলা অবাক হয়ে একসাথে বলল, কোন মেহেদী হাসান?

শায়লা বলল, আরে উর্দু গজলের ওস্তাদ। চেনেই না দুইজনের কেউই।’ দুইজনকে এক কোনায় সরিয়ে নিয়ে নিজের ফোনে ইউটিউবে একটা গজল চালিয়ে নিজের হেডফোনের দুই মাথা দুইজনের কানে ফিট করে দিল। খানিক আগেও অপরিচিত ছিল যে দুজন এক ডিভাইসে গান শুনতে গিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়াল তারা। দুজনের চোখ শায়লার ফোনের স্ক্রিনে। শায়লা একটু দূরে দাঁড়িয়ে টিক্কা কাবাব সাবাড় করতে শুরু করল।

কয়েক মিনিট পরে কান খালি করে আতিক বলল, উর্দু ভাল বুঝি না কিন্তু লোকটার গলা একেবারে মেঘের মতো মোলায়েম।’ ইলা সম্মতির মাথা নেড়ে বলল, এখন বলেন কোন লোকটা? শায়লা প্রায় আঙ্গুল তুলেই দেখাতে যাচ্ছিল, নিজেকে থামিয়ে বলল, ওই যে কোণায় কালো ব্লেজার, লম্বা মতোন। তিনজনের ছয়টা চোখ তাকে দেখছে টের পেয়ে গেল, মেহেদী হাসানের জুনিয়র ভার্সন। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে সিধা প্রশ্ন করল—‘কাহিনী কী?

তিনজনেই সামান্য ভ্যাবাচ্যাকা। উদ্ধার ইলাই করল—‘না মানে ইয়ে শায়লা বলছিল, আপনি দেখতে মেহেদী হাসানের মতো। শায়লা ভেবেছিল সে-ও প্রশ্ন করবেকোন মেহেদী হাসান? কিন্তু তা হলো না। যেটা হলো সেটার জন্য তিনজনের কেউই প্রস্তুত ছিল না। যদি নিজের চোখে কিছু ঝাপসা দেখায় তাহলে বোঝা যায়, কিন্তু অন্যের চোখে নিজেকে ঝাপসা দেখালে সেটাও যে বোঝা যায়, এই প্রথম টের পেল শায়লা। দাঁড়িয়ে আছে মেহেদী হাসানের যুবক বয়সের মতো কেউ, তার চোখে ঝাপসা শায়লা, আতিক ও ইলা। ঝাপসা চোখ পেরিয়ে, তার চোখের ভেতর দিয়ে, মাথার ভেতর দিয়ে একবার ঘুরে এল শায়লা। খুব ভেঙে-চুরে যাচ্ছে সবকিছু, তার শব্দ শোনা যাচ্ছে। মিনিট পাঁচেক চলে গেল ধুলা উড়িয়ে। হাওয়া থেমে এলে দেখা গেল সেই চোখে কারও পায়ের ছাপ। ইলা একটু জোরেই বলল, আর ইউ ওকে? প্রায় ফিসফিস করে মেহেদী বলল, ইয়েস। শায়লা অপরাধীর মতো বলল, আমরা কী কোনোভাবে আপনাকে কষ্ট দিলাম? মেহেদী হাসান বলল,আমার নাম সত্যিই মেহেদী হাসান। আমার মা চেয়েছিলেন আমি এই রকম দেখতে হই। পুরো হইচই একটা ঘরের শুধু একটা কর্নারে কীভাবে নীরবতা নেমে আসতে পারে, সেটা জানে শুধু একটা ঘূর্ণিঝড়। মেহেদী হাসানের মুখের দিকে তাকিয়ে শায়লা বুঝতে চেষ্টা করল, সে কী আরো কিছু বলবে, নাকি এটুকুই?

পুরো ঘরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে এনেছে সবাই, তারা চারজন দাঁড়িয়ে আছে শুধু। হোস্ট মোজাম্মেল ভাই খেয়াল করে ছুটে এলেন—‘তোমরা খাও না ক্যান? শায়লা তাড়াতাড়ি বলল, এই তো ভাই কাবাব খেলাম, আপনি টেনশন নিয়েন না, খাচ্ছি আমরা। ইলাকে মেহেদীর কাছে রেখে আতিককে নিয়ে খাবারের টেবিলে গিয়ে দুই হাতে চারটা প্লেট নিয়ে এল। দাঁড়িয়েই খাচ্ছে সবাই। মেহেদী নিজের প্লেট নিল, কিন্তু মনে হচ্ছে খেতে পারবে না। খেতে খেতে কথা শুরু করল শায়লা, আমি কাল রংপুরে যাচ্ছি, কতদিন থাকবো ঠিক নাই। মেহেদী আপনি রংপুরে কাউকে চেনেন? মেহেদী বলল, ‘রংপুরে আমার এক খালা থাকেন।’ চারজনেই নিজেদের আধাখাওয়া প্লেট রেখে এসে হল রুমের বাইরে এসে দাঁড়াল। মেহেদী বলল, ‘বাংলাদেশে মেহেদী হাসানকে যারা চেনে, তাদের সাথে আমার হয়তো দেখা হয়নি কখনও, হলেও তারা খেয়াল করেনি আমাকে।’ শায়লার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনিই প্রথম বললেন যে, আমি মেহেদী হাসানের মতো দেখতে।’ শায়লার আবারও মনে হলো, সে কী আরও কিছু বলবে? কিন্তু চুপ করে গেল মেহেদী হাসান। আর গল্প এগোলো না।

 

|| দুই ||

বাসায় ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে ঘুমিয়ে গেল শায়লা। সকালে ট্রেনে উঠে মনে হল, কালকে তিনজনের কারোর ফোন নম্বর নেওয়া হয়নি। ফেসবুক নামও জিজ্ঞেস করা হয়নি। হয়তো মেহেদী ছেলেটার একটা গল্প ছিল, শোনা হলো না। ইলা আর আতিকও হারিয়ে যাবে। একটা দাওয়াতে তিনজন অচেনা মানুষের সাথে আলাপ হওয়া অদ্ভুতই।

ট্রেনের দুলুনিতে ঘুম এসে যাচ্ছিল, প্রায় বারো ঘণ্টার জার্নি, এখনই ঘুমিয়ে গেলে, ঘুম ভেঙে বাকি পথ কী করবে ভেবে, ফেসবুকে ঢুকল। ইলা বসাকের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেখে খুশি হলো। ভাবল, যাক একজনকে তবু পাওয়া গেল। এক্সেপ্ট করার সাথে সাথেই ইলার নকহেই আপনি হারিয়ে গেছেন ভেবে খারাপ লাগছিল, ফেসবুক খুব ভাল জিনিস আসলে। শায়লা হাসল হ্যাঁ ভালই। ইলা লিখল, মেহেদী ছেলেটা একটু অদ্ভুত না? ভুলতে পারছি না, ফেসবুকেও নেই। হেসে শায়লা লিখলপ্রেমে পড়েছেন?

ইলা বলল, আরে না না প্রেম না ঠিক, ফিরে থেকে মেহেদী হাসানের গানই শুনে যাচ্ছি।

আরো কিছুক্ষণ ফেসবুক স্ক্রল করে ঘুমিয়ে গেল শায়লা। ঘুম ভাঙল যমুনা ব্রিজে। ট্রেনের গতি কমে প্রায় জিরো। বৃষ্টি হচ্ছে, পিছল উঠানে রাধার মতো পা টিপে টিপে হাঁটছে ট্রেন। ব্রিজ পেরিয়ে ট্রেনের গতি বাড়লে ট্রেনের বিস্বাদ চা খেল, আরো কিছু খেতে হবে, এখনো খিদা পায়নি যদিও।

ফোন খুলে দেখল, বন্ধুর ছোটবোন টেক্সট করেছে, স্টেশনে নিতে আসবে। মোজাম্মেল ভাই টেস্কট করেছে, মেহেদী হাসান তোমার ফোন নম্বর চায়, দিমু? দুইজনকেই রিপ্লাই দিল শায়লা। প্রথমজনকে থ্যাংক ইউ, পরেরজনকেও দেন। দুটোই সমান স্বস্তিদায়ক। মেহেদী হাসান হারিয়ে যায়নি, শায়লাও অচেনা রংপুরে হারিয়ে যাবে না। দুনিয়ায় কিছুই হারায় না আসলে।

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে গেল রংপুর স্টেশনে নামতে নামতে। স্টেশনে নেমে দেখল, বন্ধুর ছোটবোন বিপাশা তার জনা দশেক বন্ধুবান্ধব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শায়লা হাসতে হাসতে বলল, পুরো রংপুর শহর জানে যে আমি আসতেছি? বিপাশা বলল, আরে আপা বিরাট সব প্ল্যান হইতেছে, অন্নেক মজা হবে। তারপরই মুখ ব্যাজার করে বলল, কাল ছুটি পাই নাই, পরশু থেকে তোমারে নিয়ে ঘুরব। কালকের দিন তুমি একলা ঘুরবা, পরশু থেকে পুরা টিম।

শায়লা হো হো করে হাসল, কালকে ঘুম।

বিপাশা আর শায়লাকে এগিয়ে দিয়ে চলে গেল বন্ধুর দল। বিপাশা বলল, আব্বা আম্মা গেছে রাজশাহী, বাসায় খালি তুমি আর আমি। মনে মনে খুশিই হল শায়লা। ক্লান্ত হয়ে গেছিল খুব, গোসল করে খেয়েই ঘুম। সকালে উঠে দেখল বিপাশা অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে, বলল, আপা তুমি আরো ঘুমাও, টেবিলে খাবার আছে, আর এইযে তালা চাবি, যদি বেরোও তালা দিয়ে যাইও।

বিপাশা বেরিয়ে গেলে উঠে পড়ল শায়লা, যথেষ্টই ঘুমিয়েছে। বাসা ঘুরে ঘুরে দেখল, নাস্তা করল। ফোন খুলে দেখল, টেক্সট—‘আপনার ইমেইল আইডি পেতে পারি?মেহেদী হাসান। নম্বর সেভ করে মেইল আইডি দিল। বাসায় তালা দিয়ে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করল। এলাকাটার নাম ডিসির মোড়, হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেল, জিলা স্কুল। আগেও দেখেছে শায়লা জিলা স্কুলগুলোর ক্যাম্পাস দারুণ হয়। পাশাপাশি দুটো বিরাট মাঠ, কতক্ষণ হেঁটে আবার সামনে হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে গেল সুরভী উদ্যান। নিজের মনেই বলল, বাহ পার্কটা ভাল। ঢুকে একটা সিমেন্টের বেঞ্চে বসল আরাম করে। ফোন বাজল তখনই। মেহেদী হাসান। হ্যালো বলেই শায়লা বলল, ভাল আছেন মেহেদী? আমরা ভেবেছিলাম আপনি বুঝি হারিয়েই গেলেন। মেহেদী বলল, আপনাকে একটা মেইল করেছি। শায়লা বলল, আচ্ছা পড়ব। কেটে গেল ফোন।

দুপুরে বাইরে খেয়ে খালি বাসায় ফিরে এল শায়লা। ল্যাপটপ বের করে মেইল খুলে বসল, ফোনেই পড়া যেত, লম্বা হবে ভেবে বড় স্ক্রিন। হ্যাঁ দীর্ঘ মেইলই।

 

|| তিন ||

প্রিয় শায়লা,

কেন যেন হঠাৎ আপনাকেই বলতে ইচ্ছে করল। কাল সারারাত ঘুম হলো না, আর এটা লিখলাম বসে বসে। যে সব কথা কাউকেই কোনোদিন বলিনি, আপনাকে বলা ঠিক হচ্ছে কিনা তাও বুঝতে পারছি না। একটাই আশার কথা যে, আপনি অপরিচিত, হয়তো কখনও আর দেখাই হবে না।

শায়লা, দেশভাগ নিয়ে যতগুলো ঝড় আছে, সবগুলোর প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমার পরিবার। আমার নানীআম্মার পরিবার রাজস্থান থেকে সাতচল্লিশে মাইগ্রেট করে করাচিতে। পরিবার বলতে নানীআম্মা আর তার দুইভাই শুধু। বাকিরা জবাই হয়েছিল! দেখেন কত সহজে বলে ফেলা গেল জবাই হয়েছিল। আমার নানা অবশ্য বাঙালি ছিলেন। দুইজনের কীভাবে দেখা হয়েছিল সে আরেক লম্বা কাহিনী। মানুষের ভাষা কত মিষ্টি হয়, আম্মাকে কথা বলতে দেখে বুঝেছি। বাংলায় উর্দু শব্দের মিশেল দিয়ে খুব সুন্দর করে কথা বলতেন। অপেক্ষার বদলে ইন্তেজার, অনুভবের বদলে এহসাস, আশার বদলে উমিদ বলতেন। অবশ্য আব্বার সামনে কখনও বলতেন না। আহ একটা গল্পের কত খাঁজ থাকে। আব্বা আম্মার সম্পর্ক নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। আমি শুধু আম্মার কথাই বলতে চাই। আম্মার জন্ম করাচিতে। বাংলাদেশে যখন আসেন, তখন তের বছরের কিশোরী। ফেলে আসা শৈশব একজন মানুষের কতটা জুড়ে থাকে, আর কখনও ফেরা যাবে না দিয়ে তা নির্ধারিত হয়।

আম্মার সঙ্গে পাকিস্তানের একমাত্র বন্ধন ছিলেন মেহেদী হাসান। প্রতিদিন তার গান শুনতেই হতো তাকে। রেকর্ড শুনতে না পারলে, নিজেই গাইতেন। আম্মার একটা খাতা ছিল, সেই খাতা ভর্তি গান লিখেছিলেন নিজের হাতে, উর্দুতে লিখে বাংলায় তরজমা। আমি যখন পেটে, তখন আম্মা রোজ জায়নামাজে বসে একটা জিনিসই চাইতেন, আমি যেন মেহেদী হাসানের মতো দেখতে হই। আমি জানি, মন চেহারা নির্ধারণ করে না, নানা বৈজ্ঞানিক হিসেব আছে। আপনি আমার আব্বাকে দেখলে বুঝতে পারতেন, আমি আব্বার মতই হয়েছি খানিক। কপাল বড়, কালো, লম্বা। আপনি হয়তো বিরক্ত হচ্ছেন, গুছিয়ে কিছুই লিখতে পারছি না।

ইতি

মেহেদী হাসান

ধুম করে শেষ হয়ে গেল চিঠি। শায়লার খানিক বিরক্ত লাগছে ঠিকই। একলা থাকবে বলে রংপুরে এসেছে। মেহেদী হাসান মাথা দখল করে আছে শুধু শুধু। আবার বিপাশাও এক দঙ্গল লোক দাওয়াত দিয়ে রেখেছে। হই হট্টগোল ভাল লাগছে না। এর চেয়ে কাউকে না জানিয়ে কোনো রেস্ট হাউজে উঠলেই ভাল হতো।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, সন্ধ্যা বিরক্তিকর হলে চশমা হারিয়ে ফেলার মতো তিতা লাগে সব। খানিক রাগ করেই ফোন হাতে নিল। মেহেদী হাসানকে একটা ধমক দিতে হবে, এসব গল্প তাকে কেন বলতে হবে? শায়লা তো শুনতে চায় নি। ফোন করেই ফেললফোন ধরেই মেহেদী হাসান বলল, আমি সত্যি স্যরি শায়লা, মেইল পাঠিয়েই বুঝতে পেরেছি কাজটা ঠিক হয় নি। শায়লার রাগ খানিক কমে গেল। বলল, বলেছেন যখন আর একটা কথা বলুন, আপনার খালা কোথায় থাকেন?

ফোন নম্বর আর ঠিকানা দিল মেহেদী হাসান।

শায়লার মনে হল, যে গল্পটা মেহেদী বলতে চায়, সেটা গল্পের ভেতরে থেকে বলা সহজ নয়। হয়তো গল্পটা বাইরে থেকে দেখা কেউ স্পষ্ট বলতে পারবে। কিন্তু এই খালা মেহেদীর মায়ের বড় না ছোট, মানে সে যখন বাংলাদেশে এসেছে তখন তার বয়স কত ছিল, কিংবা মেহেদীর মা বেঁচে আছেন কীনা এসব জানতে না পারলে শুধু শুধু আরেকজন অচেনা মানুষের সাথে দেখা করে কী হবে। কিন্তু শায়লা এই ঘটনায় আটকে গেছে, একটা গল্পের শুধু কয়েকটা রেখা দেখা যাচ্ছে, আর কয়েকটা রেখা আঁকতে পারলে গল্প টা একটা অবয়ব পায়।

ফলে সন্ধ্যর দিকে সুরাইয়া খানমকে ফোন করে দেখা করতে চাইল। সুরাইয়া খানম শুক্রবার বেলা এগারোটায় সময় দিয়ে সরবত-ই-ইন্তেজারের বাঁশি বাজালেন। পরের দুইদিন বিশাল দলবল নিয়ে রংপুর দিনাজপুর খুব ঘুরে বেড়ানো হল। কিন্তু শায়লার মাথা থেকে এক মুহূর্তের জন্য মেহেদী হাসান সরলো না, সুরাইয়া খানমও যখন তখন উঁকি দিয়ে গেল।

শুক্রবার দশটা না বাজতেই বেরিয়ে পড়ল, রিকশা ঠিক করে বিপাশা ভাল করে ঠিকানা বুঝিয়ে দিল। যেতে যেতে কিছু নিয়ে যাবে কি না, ফুল বা ফল ভাবল একবার। এটা ঢাকা নয়, ফুল ফলের দোকান কোথায় জানে না সে। আবার সে অত সামাজিকও নয়, অনাত্মীয়, অপরিচিত কারো সঙ্গে দেখা করতে গেলে খালি হাতে যাওয়া যায় কীনা তাও জানে না।

রাস্তার দুইপাশে দেখতে দেখতে এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা বইয়ের দোকান দেখে রিকশা থামালো শায়লা। দোকানে গিয়ে বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, দোকানির কী বই আপার জবাবে লাজুক হেসে বলল, কবিতার বই আছে কোনো? বিভিন্ন ক্লাসের নোট বই গাইড বই পেরিয়ে ভিতরের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিল দোকানি। হুমায়ুন, জাফর ইকবাল, সুনীল পেরিয়ে কয়েকটা রবীন্দ্র, নজরুল। প্রায় দেখাই যায় না নীচের দিক থেকে টেনে বের করল—‘সাতটি তারার তিমির। দোকানীর হাতে দিয়ে ধুলা মুছতে বলল। দাম মিটিয়ে রিকশায় গিয়ে বসল ফের। বাড়িটার সামনে গিয়ে যখন রিকশা দাঁড়ালো, ঠিক এগারোটা বাজে। বইয়ের দোকানের ছয়মিনিট বাদ দিলে বিপাশার বাসা থেকে সুরাইয়া বেগমের বাসার দুরত্ব তাহলে চুয়ান্ন মিনিট। ঠিক করা ভাড়ার চেয়ে দশ টাকা বেশি দিয়ে নেমে গেল।

 

|| চার ||

বাড়িটা সুন্দর, সুপারি গাছে ঘেরা। টিনের গেটে দুইবার শব্দ করলে খুলে গেল, বারো তেরো বছরের ফুল ফুল ফ্রক পরা একজনের পিছন পিছন উঠান পেরিয়ে, বারান্দা পেরিয়ে, আরেকটা ঘরের মধ্যে দিয়ে একটা বারান্দায় গিয়ে বসেন বলে চলে গেল মেয়েটি। ঘরটি ছাদওয়ালা পাকাই, কিন্তু বারান্দাটার ছাদ টিনের। মে মাসের গরমে টিনের চালে রোদ পড়ে তেতে আছে। ফ্যান দেখা যাচ্ছে না কোথাও। বারান্দায় একটা বড় ডাইনিং টেবিলের মতো টেবিল পাতা, দুইদিকে শুধু দুটি চেয়ার। টেবিলের উপরে সাদা একটা ক্লথ বিছানো, ধোয়া পরিস্কার, কিন্তু নতুন নয়। পুরো ক্লথ জুড়ে নীল সুতা দিয়ে লতাপাতা আঁকা। একটা চেয়ারে বসল শায়লা, গরমে দর দর করে ঘামছে। মিনিট সাতেক পরে বড় একটা ট্রে হাতে এলেন একজন, ট্রে নামিয়ে রাখলেন টেবিলে, হাল্কা হেসে বললেন, আমিই সুরাইয়া। চেয়ার ছেড়ে অনেকটা স্লো-মোশনে উঠে দাঁড়াল শায়লা। সে এটা আশা করেনি, এত সুন্দর এই মহিলা! সাদা ধবধবে সালোয়ার কামিজ আর নীল রঙের ওড়না পরে আছেন। মাথা ভর্তি আধাভেজা কালো-লাল চুলের বন্যা। নিজের হাতেই মাথায় মেহেদী লাগিয়েছেন, হাতও লাল হয়ে আছে, মেহেদী এত লাল হতে কখনও দেখেনি শায়লা।

বড় বড় কালো চোখে সুরমা বা কাজল, মুখে পান, ঠোঁটও লাল। শায়লাকে হাতের ইশারায় বসতে বলে নিজেও বসলেন। ট্রের দিকে ডান হাতের পাতা উল্টে দেখিয়ে দিলেন। ট্রে-তে বড় আকারের পাঁচটা গ্লাস। বিভিন্ন রঙের পাচ সরবত! এই তাহলে বিখ্যাত সরবতি ইন্তেজার। শায়লা দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল—‘কোনটা প্রথম?

তিনি গাঢ় খয়েরি রঙের বরফভাসা একটা গ্লাস দেখিয়ে দিলেন। শায়লা সেটাই নিয়ে চুমুক দিলমনে হল যেন মাথা থেকে পা পর্যন্ত শীতল একটা হিল্লোল বয়ে গেল। এতক্ষণের গরমে যে ঘামছিল, শরবতের খালি গ্লাস নামিয়ে মনে হল, নিজের ঘামে সুগন্ধি ছড়াচ্ছে।

শায়লা বলল, এই রকম গরম জায়গায় বসতে দিয়েছেন যেন শরবতের স্বাদ ঠিকঠাক পাই?

সুরাইয়া এবার জলতংগের মতো হেসে বললেন, আপনি আমার আম্মিজানের মতো বুদ্ধিমতি !

শায়লার হুরমুড়িয়ে মনে পড়ে গেল পরিবারের সবাই জবাই হয়ে গেছে, বোনকে নিয়ে পালাচ্ছে দুইভাই, মেহেদীর নানীআম্মা, সুরাইয়ার আম্মিজান! গলা কেমন শুকিয়ে এল, এই একটু আগেই বড় এক গ্লাস শরবত খেয়েছে তবু। শায়লা বলল, এবার কোনটা?দ্বিতীয় গ্লাস শরবত খেয়ে শায়লা বলল, আমি আপনার আম্মার কথা অল্প একটু জানি।

সুরাইয়া বললেন, এবার অন্দরে যাই। শরবতের ট্রে হাতে উঠে দাঁড়ালেন। এবার যেখানে বসা হল সেটা বৈঠকখানা। ধুম করে বারান্দার গরম কমে গেল, ফ্যান চলছে। শায়লা বলল, সব সরবত খেতে হবে? পেটে আর জায়গা নেই কিন্তু। তাদের পারিবারিক গল্পটা এই ভদ্রমহিলা বলবেন বলে মনে হচ্ছে না। তার ব্যক্তিত্ব এতটাই দেয়ালসুলভ যে নিজে থেকে না বললে শায়লার সাধ্য নেই অনুরোধ করে। মেহেদী খালাকে শায়লা সম্পর্কে কী বলেছে কে জানে। কিন্তু এতক্ষণে শায়লার মনে পড়ল, সাতটি তারার তিমিরের কথা। বইটা এগিয়ে দিয়ে লাজুক মুখে বলল, খালি হাতে আপনার কাছে আসতে ইচ্ছে করেনি।

হাত বাড়িয়ে বইটা নিলেন সুরাইয়া। বইটার কয়েকটা পাতা উল্টে পাশে নামিয়ে রাখলেন। যেন অনেকদূর থেকে বললেন, আপনি পরীক্ষায় পাশ করেছেন, গল্পটা এবার শুরু করা যাক।

 

|| পাঁচ ||

আমার আব্বা পাকিস্তানি বাঙালি, আম্মা উর্দুভাষী হিন্দুস্থানি। আরো নির্দিষ্ট করে বললে আব্বা ঢাকাই মুসলিম, আম্মা রাজস্থানি মুসলিম। আব্বা চাকরি সূত্রে আর আম্মা প্রাণ বাঁচাতে করাচি গিয়েছিলেন। সাতচল্লিশে আম্মার পনেরো, আব্বার সাতাশ। খুব সুন্দর দেখতে ছিলেন আমার আম্মিজান, তুলনায় আব্বা সাধারণ।শায়লার হঠাৎ মনে হল তিন প্রজন্মের গল্প শোনার ধৈর্য নেই তার। কেমন অস্থির লাগা শুরু হলো, আরেক গ্লাস সরবত হাতে নিল অস্থিরতা লুকাতে। মনে মনে বলল, এ কীসের মধ্যে এসে পড়লাম! সরবত শেষ করে ফেলল এক টানে।

সুরাইয়া কথা থামিয়েছেন আগেই, এবার হাত উঁচিয়ে বাথরুম দেখিয়ে দিলেন। তিন তিনটা বড় গ্লাস তরল খেলে বাথরুমে যেতে হয়, জানেন সুরাইয়া। বাথরুম করে মুখে, গলায়, ঘাড়ে পানি দিয়ে আধাভেজা হয়ে বেরিয়ে এসে দেখল সুরাইয়া নেই। বৈঠক খানার আগের জায়গায় বসে অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ। অস্থিরতা কমল না। ছুটে বেড়িয়ে যেতে পারলে ভাল লাগত, এমন বোধ হল।

খানিক পরে সেই ফুল ফুল ফ্রক পরা মেয়েটা এসে হাতে একটা ডায়রি দিয়ে বলল, নানীআম্মা আর আসবে না। ডায়রিটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল। বাইরে এসে খুব আরাম লাগল তার। আবার খুব অস্বস্তিও, ইশ এটা কেমন হল, সুরাইয়া বুঝেই গেলেন যে তার ধৈর্য নেই, এত আগ্রহ করে গল্পটা বলতে শুরু করেছিলেন!

ডায়রিটা হাতে নিয়ে তিস্তার দিকে যেতে যেতে শায়লা ভাবল, তিস্তার পারে বসেই পড়া যাক। আগের দিন দলবল নিয়ে তিস্তায় গিয়ে ঠিক করেছিল আবার আসতে হবে একা।

এটা অবাক ব্যাপারই, একজন পুরোপুরি অপরিচিত মানুষ কীভাবে বুঝে ফেলল যে, কথা শোনার চেয়ে পড়তে স্বস্তি লাগবে শায়লার। গঙ্গাচরা ব্রিজ পেরিয়ে ইজিবাইকের মতো যন্ত্রচালিত রিকশা থেকে নেমে, চড়ের নদী কিনারা ধরে হেঁটে হেঁটে একটা ছায়া ছায়া জায়গা খুঁজে পেতে অনেকক্ষণ লাগল। দুপুর হয়ে এসেছে, রোদে তেঁতে আছে বালু। তবু একটা ছায়া ছায়া জায়গা খুঁজে পাওয়া গেল। সুন্দর ফুরফুরে বাতাস, ঘণ্টা দুয়েক এখানে বসতে পারলে ভালই হয়। গুছিয়ে বসে ডায়রি খুলল শায়লা।

২২ এপ্রিল, ১৯৭২

আব্বা আম্মি আর আমরা দুইবোন আজ দুপুরে ঢাকা এসে পৌঁছেছি। হয়তো তিনদিন ধরে এলাম। সুমাইয়া বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়েই থাকল, কিন্তু আমি জেগেই ছিলাম, আম্মা বারবার বলছিল ঘুমাতে, কিন্তু আমার ঘুম আসছিল না। এরপরই উর্দুতে কয়েক লাইন। কী মুশকিল!

২৫ এপ্রিল, ১৯৭২

এখন থেকে আমাদের বাংলায় কথা বলতে, লিখতে, পড়তে হবে। আমাদের দেশ নাকি এখন বাংলাদেশ। আব্বা আমাদের দুইবোনকে ছোটবেলা থেকে অল্প অল্প বাংলা শিখিয়েছেন। আম্মাও শিখেছে ভালই। আব্বা বারবার বলতেন, পাকিস্তান টিকবে না। আমরা দুইবোন বাংলা, ইংলিশ, উর্দু, ফার্সি, আরবি সবই শিখছিলাম ঝড়ের বেগে। আব্বা প্রায়ই আম্মাকে বলতেন, আমার দুই মেয়ের বুদ্ধি মাশাল্লা তোমার মতো। আব্বা শেখাতেন বাংলা আর ইংলিশ, আম্মা উর্দু, এক হুজুর বাসায় এসে শেখাতেন আরবি আর ফার্সি।

স্কুলেও আমাদের দুইবোনের খুব সুনাম ছিল। আবার উর্দু, উফ! ফোন করল মেহেদীকে। ছটফটিয়ে বলল, মেহেদী, সুরাইয়া বেগমের ডায়রি আমার হাতে, বাংলা বুঝি, উর্দু তো বুঝি না! মেহেদী হাসতে হাসতে বলল, আপনার হাতে অজানা ভাষায় লেখা জীবন!

নিজের মনেই শায়লা বলল, কীসের মধ্যে পড়লাম! এই গল্প বৃষ্টি নামিয়ে পন্ড করে দেওয়া উচিত। মেহেদী বলল, উহু শায়লা, পণ্ড করবেন না। পণ্ড না করলে আবার যেতে হবে সুরাইয়ার দরবারে। এবার আর সরবত দিয়ে মেহমানদারি করবেন বলে মনে হয় না। প্রথমবার অতি সহজে যে বন্ধুত্ব হতে পারত, সেটা কঠিন হয়ে গেছে।

পরেরদিন সকালে আবার গেল ভয়ে ভয়ে। এবার বৈঠকখানা নয় অন্য একটা ঘরে নিয়ে গেলেন সুরাইয়া নিজে। এটা হয়তো পড়ার ঘর, আবার গানঘরও হতে পারে। দুই দিকে শেলফে বই, একদিকে একটা ইয়া বড় সেতার, সেতারের পায়ের কাছে হারমোনিয়াম। ঘরে আর কোনো আসবাব নেই। মেঝেতে একটা শতরঞ্জি পাতা। বইয়ের তাকে চোরা চোখ বুলিয়ে কবিতার রাজ্য পাওয়া গেল। এদের পালনকর্তা যে অন্তত পাঁচটা ভাষা জানেন তার প্রমাণ জ্বলজ্বল করছে বইয়ের তাকে। এতসব রেখে শায়লা প্রায় প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলআপনি রংপুরে এসে হাজির হলেন কীভাবে? একেবারে শেষমুহূর্তে আটকে দিতে পারল। পেরে খুব শান্তি হলো। সুরাইয়ার সঙ্গে কথা বলার যোগ্য নয় সেএকবার প্রমাণ হয়ে গেছে। আর ও পথে যাওয়া যাবে না।

হঠাৎ সুরাইয়া ব্যাকুল হয়ে শায়লার হাত ধরে বললেন, আপনি আজ না এলে, হেরে যেতাম আমি!

শায়লা কেমন কেঁপে উঠল! এক দমে বলে ফেলল, কাল চলে গিয়ে খুব খারাপ কাজ করেছি আমি, মাফ করে দিন, আজ কী যে ভয়ে ভয়ে এসেছি!

 

|| ছয় ||

সেতার কোলে নিয়ে বসলেন সুরাইয়া। হালকা নীল রঙের শতরঞ্জিতে পদ্মাসন হয়ে বসেছেন যেন স্বয়ং দেবী সরস্বতী। তারে আঙুল চলছে যেন পাতলা চুলে আম্মার আঙুল, আরামে চোখ বুজে আসছে শায়লার। সুরাইয়া সেতারে আঙুল না থামিয়েই চোখের ইশারায় কাছে ডেকে নিলেন। সুরাইয়ার হাঁটুর কাছে মাথা দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল শায়লা। এই সেই সম্মোহন, যে গল্প অবাধ্য শায়লা শোনেনি, সেই গল্পটা বলার জন্য এক টুকরো বেহেস্ত নামিয়ে এনেছেন সুরাইয়া। কী যে সুর তুলেছেন, শায়লার প্রতি রোমে কান্না জমে যাচ্ছে। একটু আগে যে ঘুম এসে যাচ্ছিল, সেটা কেটে গেছে, এখন আপাদমস্তক আরও কিছু শোনার জন্য তৃষ্ণার্ত।

সেতার থামল না, শব্দ মৃদু হলো, গল্প শুরু হলো। এত মৃদু কথা, তবু প্রতিটা শব্দ স্পষ্ট। আম্মিজানকে মহব্বত করতেন আব্বা, সে মহব্বতের সঙ্গে তুলনা করতে পারি এমন কোনো শব্দ আমি কোনো কবিতায় পাইনি। সমস্ত কবিতায় আমি এই-ই খুঁজি। আম্মিজানও ভালবাসতেন, সে ভালোবাসা, ভালোবাসার প্রতিদান নয়, সহজাত। জন্ম থেকে এই-ই দেখেছি, নতুন দেশে এসে সবকিছুই বদলে গেল। আব্বা, আমরা, তার সংসার, আশপাশ-সব। শুধু আম্মিজান অবিকল আগের মতো রয়ে গেলেন। নিজের শৈশবের জন্মভূমি ফেলে আরেক দেশে নতুন করে শিকড় বসিয়ে, আবার টেনে ছিড়ে তুলে আরেক দেশে শিকড় বসিয়ে অবিকল একরকম থাকা যায় না। কিন্তু আম্মিজান থেকে গেলেন। আমরা স্কুলে যেতে শুরু করলাম, আব্বা ব্যবসার সন্ধানে ঢাকা নামের শহর চষতে শুরু করলেন। বাংলা ইংলিশ ভালই জানতাম বলে আমাদের তেমন অসুবিধা হলো না। গরিব হয়ে গেছি বুঝতে পারতাম, সেসবে আমি তেমন কাহিল হতাম না। কিন্তু সুমাইয়া প্রায়ই বলত, বড় হলে আবার করাচি ফিরে যাবে।

শায়লার চোখ সুরাইয়ার মুখে নয়, কণ্ঠও তেমন ওঠানামা করছে না, সেতারও বাজছে, তবু টের পাওয়া যাচ্ছে, বলদে বদলে যাচ্ছে সুরাইয়ার অভিব্যক্তি। আর টের পাওয়া যাচ্ছে চুলে বিলি কেটে দেওয়া মায়ের নরম আঙুল।এমন সুর মেশানো গল্প সারাজীবন শোনা যায়।

আব্বার বদলে যাওয়া আমরা তেমন টের পেতাম না, কিন্তু আম্মিকে প্রতিদিন একটু একটু করে মলিন হতে দেখে বুঝতাম আব্বা আর আগের মতো নেই, কিংবা আম্মি বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন! স্কুলের শেষ পরীক্ষা দেওয়ার পর আব্বা আমাদের বিয়ের জন্য ছেলে খুঁজতে শুরু করলেন। একদিন আব্বাকে বলতে শুনলাম—‘বিবিজান তোমার মেয়েরা বড়োই সুন্দর আর বুদ্ধিমতি, যোগ্য ছেলে খুজে পাওয়া যাবে না, কিন্তু আমার ভয় করে বিবিজান! নতুন স্বাধীন হওয়া একটা দেশে অরাজকতার চূড়ান্ত অবস্থা আর আম্মির বিভিষীকাময় কিশোরী বেলা, সব মিলিয়ে তারা মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। মেয়েদের গলা কেটে ফেলার কষ্ট হচ্ছিল তাদের, আমরা দুইবোনেই সেটা বুঝতে পারছিলাম। একদিন দুইবোনের মাথা কোলে নিয়ে চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে আম্মি বললেন, তোমাদের দুই বোনের লেখাপড়া নিয়ে কত বড়বড় খোয়াব যে আমরা দেখেছিলাম, তোমরা চিন্তাও করতে পারবে না। কিন্তু আম্মিজানেরা লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়া তোমাদের হাতেই। প্রতিদিন কিছু না কিছু পড়বে। শাদী কি বাদ হয়তো মুশকিল হবে, তবু চেষ্টা করবে। আমি ওয়াদা করছি, যতোদিন বেঁচে থাকবো, তোমাদের হাতে বই পৌঁছাবে।

হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল যেন, প্রায় শোনা যায় না, এভাবে বললেন, কলেজে পড়া হলো না আমাদের। বিয়ে হয়ে গেল। আম্মি তার ওয়াদা মাফিক আমাদের হাতে বই পাঠাতে পারলেন না, মরে গেলেন।

সুরাইয়ার সেতারের সুর একটু যেন উঁচু হলো অথবা কথা থেমেছিল বলে সেতার স্পষ্ট হলো। এই গল্প সেতার ছাড়া শুনতে কেমন লাগত, একবার ভাববার চেষ্টা করল শায়লা। আচ্ছা একই গল্প রোদে আর ছায়ায়, আলোতে আর অন্ধকারে আলাদা শোনায় নাকি, একবার পরীক্ষা করে দেখতে হবে। কিন্তু সুরাইয়ার এই ঘরে যে বেহেস্ত আজ নেমে এসেছে, এখনও পর্যন্ত এই গল্পের নিষ্ঠুরতাগুলোও সুবাসিত লাগছে। কিন্তু এই আবহ হয়তো থাকবে না।

দুই বোনের বিয়ের পরের জীবন আশাভঙ্গের কীনা, সে আশঙ্কা মাঝেমাঝেই উকি দিচ্ছে শায়লার মনে। সুরাইয়ার বরফ শীতল হাত শায়লার মাথায়, সেতার থেমেছে। এই সেই হিরণ্ময় নিস্তব্ধতা!

 

|| সাত ||

ঘুম যখন ভাঙল, দিন না রাত বুঝতে পারল না শায়লা। মনে পড়ল, গল্পের দ্বিতীয় সেশনে দুইবোনের বিবাহিতবিভীষিকা শুনতে শুনতে কেঁদে ভাসাচ্ছিল সে। ফোঁপানোর শব্দ হেচকিতে বদলাতে শুরু করলে, সেতারী-গল্প রেখে উঠে গিয়েছিল সুরাইয়া। তার মুখে স্পষ্ট রাগ দেখেছিল কিনা এখন আর মনে পড়ছে না। মেঝে থেকে ওঠার চেষ্টাও করেনি শায়লা। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত দীর্ঘ ঘুমই ঘুমিয়েছে।

আগের দিন খেয়ালই করেনি, এই ঘরে কোনো জানালা নেই, দরজাটাই ছাদ পর্যন্ত উঁচু। লাগোয়া বাথরুমে হয়ে এসে দরজায় টান দিয়ে দেখল, বাইরে থেকে বন্ধ। ডাকাডাকি না করে বইপত্র নামিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে আবার রেখে দিল। পুরোনো বইগুলো ধরতেও ভয় লাগল, ঝুরঝুরিয়ে খুলে যাবে যেন, এমন নরম। খিদাতৃষ্ণা বোধ হলে, বাথরুমে গিয়ে পানি খেয়ে এসে, ব্যাগটা খুঁজল, নেই কোথাও। মনে করতে পারল না, ব্যাগটা নিয়ে এই ঘরে ঢুকেছিল, নাকি মূল দরজা দিয়ে ঢুকে এই ঘরে আসার আগে কোথাও রেখেছিল। কাকে ডাকবে এখন? ফুল ফুল ফ্রক পরা যে মেয়েটা প্রথমদিন দরজা খুলেছিল, তার নাম জিজ্ঞেস কথা হয়নি। সুরাইয়ার নাম ধরে ডাকবে একবার? আগে কখনো যাকে ডাকা হয়নি, তাকে কীভাবে ডাকা যায়? খালা ডাকা যায়? সুরাইয়া খালা কোথায় আপনি? গলা দিয়ে ফিসফিস আওয়াজ বেরোলো, নিজের কানেই পৌঁছে না এমন। দুটি বই মাথার নিচে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল প্রচণ্ড গরমে, ফ্যান চলছে না, ঘর অন্ধকার। হাতরে হাতরে বাথরুমে গিয়ে ছোট জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল, রাত আসলেই হয়েছে। বেড়িয়ে এসে ঘরের দরজায় জোরে জোরে শব্দ করল কিছুক্ষণ, দুবার সুরাইলা খালা বলে চিৎকার করার চেষ্টা করল, কেউ সাড়া দিলো না। আবার বাথরুমে ঢুকে ছোট জানালার কাছে এগিয়ে গিয়ে কেউ আছে এ এ ন, বলে চিৎকার করল। কিন্তু মনে হলো, পুরো এলাকায় কেউ নেই, কোথাও কোনো শব্দ নেই। আবার বই মাথায় ঘুমিয়ে গেল।

কয়দিন ধরে সে পানি খেয়েছে আর ঘুমিয়েছে, জানে না সে। বাথরুমের পানিও যেদিন শেষ হয়ে গেল, সেদিন সে আরেকবার নানা রকম শব্দ করার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। নিজেকেই একবার জিজ্ঞেস করল, মরে যাচ্ছ নাকি শায়লা? কবে মরবা?

 

|| আট ||

পুলিশ নিয়ে দরজা ভেঙ্গে বিপাশা যখন শায়লার কাছে গিয়ে হাজির হলো, তার দুদিন আগেই মরে গেছে শায়লা।