হাজারু ধারুয়ার রাতদিন
একটা ট্রাক বিকট শব্দে ছুটে যায় কলকাতা শহরের রাস্তায়, চাকাগুলো অস্বাভাবিক দ্রুত ঘুরছে। আচমকা এই শব্দ ও গতি হাজারুকে ভীষণ সংকটের মুখে ফেলে দেয়, যেন ট্রাকটা তেড়ে আসছে তাকে লক্ষ্য করেই, দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য সে দৌড়তে থাকে, দৌড়তে দৌড়তে শহরের রাত পেরিয়ে ঢুকে পড়ে সূর্যকরোজ্জ্বল এক জঙ্গলে, প্রথমে সে খেয়ালই করে না কোথায় পৌঁছেছে, কিছু দূর দৌড়ে তবে খেয়াল হয় জঙ্গল, থামে সে, গাছের গুঁড়ি ধরে প্রবল হাঁপাতে হাঁপাতে বড় বড় শ্বাস নেয়, এতক্ষণের ভয়ার্ত মুখ যেন স্বস্তি পায়, শান্ত গাছপালার ডাল থেকে পাতাগুচ্ছ মৃদু বাতাসে দুলছে, যেন বা অভ্যর্থনা জানাচ্ছে তাকে, প্রবল ভয় থেকে ধীরে ধীরে নিষ্কৃতি পায় হাজারু, শুয়ে পড়ে ঝরা পাতার বিছানায়।
শুয়ে শুয়ে স্বস্তি নিয়ে সে দেখে ঘন ডালপালার চাঁদোয়া, শিরশির কাঁপতে থাকা পাতার সংগীত, পরস্পরের ভেতর আঁকড়ে ছড়িয়ে থাকা শাখাপ্রশাখা, পাতার শরীর বেয়ে নেমে আসা ধোঁয়া ধোঁয়া বাঁকা আলো-পথ, চাঁদোয়ার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে গতিশীল ঝিকিমিকি আর গাছের গা বেয়ে নেমে আসা পিঁপড়ের সারি।
কিন্তু আদতে সে শুয়ে আছে বড় রাস্তার পাশের এক অস্থায়ী শ্রমিক ঝুপড়ির ভেতর, আরও অনেকের সঙ্গে। গভীর রাত পর্যন্ত প্রবল ধোঁয়া ও ধুলোর মধ্যে রাস্তা সারাইয়ের কাজ করেছে সবাই, কাজ শেষে অস্থায়ী উনুনে নিজেরাই রান্না করে খেয়েছে এক তরকারি-ভাত, অক্লান্ত পরিশ্রমের পর গভীর ঘুমে মগ্ন এখন। কিন্তু এই স্বপ্নটা দেখে ঘুম ভেঙে গেছে হাজারুর, স্বপ্ন নাকি সত্যি এখনও ঠাহর করতে পারছে না, আসলে স্বপ্ন বলে মানতে চায়ছে না, যে বাস্তবতার ভেতর সে আছে তা যেন সত্যি না হয়- চায়ছে সে।
মাঝে মাঝে রাস্তায় ছুটে যাওয়া গাড়ির হেড লাইটের আলো আর শব্দ শরীর ছুঁয়ে যায় তার, যেন বা শাণিত চাকু ফালাফালা করে দেয় তাকে, আলো থেকে বাঁচতে হাতের পাতা দিয়ে ঢেকে নেয় চোখ আর শব্দের যন্ত্রণায় যেন বা তার আত্মা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে খান খান হয়ে ছিটকে পড়ে ঝুপড়িময়। কিছুক্ষণ এভাবেই সে শুয়ে থাকে চুপচাপ, জঙ্গলের ভেতর সুখময় স্মৃতির আবেশে।
সঙ্গীদের নাক ডাকার শব্দও ঘিরে থাকে তাকে। তাদের দিকে তাকিয়ে স্বস্তি খোঁজে। পাশে রাখা একটা বোতল থেকে জল খায় ঢকঢক। শব্দটা নিজের কানেই যেন বিসদৃশ ঠেকে। আবার সে শুয়ে পড়ে, এপাশ ওপাশ করে বার বার। শুয়ে শুয়েই ওপরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, হাত বাড়িয়ে যেন ধরতে চায় সেই আলো, সেই ঝিকিমিকি জঙ্গলের আহ্বান।
মাত্র কদিন হল রাস্তা সারাইয়ের কাজ করবে বলে সদ্য পরিচিত এক মধ্যস্থতাকারীর সঙ্গে শহরে এসে পৌঁছেছে হাজারু। লোকটি তাকে কাজে বহাল করে তার প্রাপ্য পারিশ্রমিকের একটা অংশ দাবি করে গেছে এবং সে অংশ লোকটি সরাসরি পেয়ে যাবে। কাটাকুটি করে হাজারুর ভাগে যা পড়বে প্রতিদিন দিয়ে দেওয়া হবে তাকে। এতকিছু কথার মধ্যে সে বুঝেছে অল্প, বেশিরভাগই বোঝেনি। কিন্তু তার দাবি কিছু নেই, কোনও কথাই সে বলেনি, শহরের পেটের মধ্যে ঢুকে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেছে।
যেদিকেই তাকায় হাজারু, দেখে কংক্রিট, কাচে মোড়া বিশাল বিশাল বাড়ি, চওড়া পিচের রাস্তা আর তার ওপর অনবরত ছুটে যাওয়া ছোট বড় গাড়ি। নিরন্তর ধোঁয়া খেতে খেতে তার শ্বাস ভারি হয়ে আসে, সারাদিন এবং রাতেও রাস্তার কাজকর্মের উৎপন্ন ধোঁয়া ও ধুলো তাকে আরও জীর্ণ করে দেয়। শহরের বাজার থেকে কেনা চাল, শাকসব্জি খেয়ে তার স্বাদ-কোরক যেন অসাড় হয়ে যেতে থাকে, স্বাদ গ্রন্থিও যেন তার মতোই ভীত হয়ে থাকে সারাক্ষণ। সারাক্ষণ একটা ভয় তাকে তাড়া করে, এই অনুভূতি থেকে যেন বা নিস্তার নেই। এক বিস্বাদ অনুভূতি নিয়ে এই শহরের বুক থেকে সে ছিটকে যাবে নাকি মানিয়ে নিতে পারবে সবকিছু- এই সংশয় তার অন্তর্গত বোধে ক্রমাগত খোঁচা দিতে থাকে।
সকাল সকাল ফুটপাথের ছাতু মাখার স্টল থেকে সঙ্গীদের সঙ্গে হাজারু কাঁচা পেঁয়াজ কুচি ও লঙ্কা দিয়ে ছাতুর মণ্ড খায়। খেতে খেতে থমকে গিয়ে থারমোকলের ছোট্ট প্লেটটা আঙুল দিয়ে অনুভব করে, অনুভব করতে করতে প্লেটের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মায়। মনে পড়ে যায় শালপাতায় খাওয়ার স্মৃতি। থারমোকলের প্লেট নয়, শালপাতার গায়ে সে আঙুল বোলায়। ছাতু খেতে খেতে দেখে রাস্তায় হেঁটে যাওয়া ব্যস্ত লোকজন, ছোট বড় গাড়ির অবিরাম স্রোত। দেখে বাচ্চা কোলে নিয়ে এক মেয়ে আর তার পাশে পাশে হেঁটে যাওয়া এক পুরুষ। খেতে খেতে চিবোনো বন্ধ করে তাদের অপলক দেখে। মনে পড়ে যায় নিজের বউ-বাচ্চাদের কথা।
শহরের কোলাহল কান থেকে হারিয়ে যায় তার। শোনে পাহাড় বেয়ে নেমে আসা কুলুকুলু ঝরনার শব্দ। সেই ঝরনার পাশে কৃষি ক্ষেতে কাজ করে তারা। রুক্ষ মাটি কুপিয়ে কুপিয়ে নরম করে, শস্য দানা ছড়িয়ে দেয় নরম মাটিতে। বাচ্চারা সাহায্য করে তাদের। কাজ শেষে সবাই মিলে শালপাতায় খাওয়ার একটু আগের স্মৃতিটা ফিরে আসে আবার। সঙ্গীদের ভোজপুরি বুলি আর হাসিতে সম্বিৎ ফেরে তার। আনমনা হয়ে ছাতুর মণ্ড খেতে থাকে। খেতে খেতে চারপাশের শব্দ বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন হয়ে ওঠে। তীব্র একটা হর্নের শব্দে চমকে ওঠে, মুখে তুলতে যাওয়া ছাতুর টুকরো পড়ে যায় মাটিতে, পড়ে যাওয়া ছাতুর দিকে অসহায় তাকিয়ে থাকে হাজারু।
খাওয়া শেষে দাম মিটিয়ে সঙ্গীদের অনুসরণ করে। জেব্রা ক্রসিং ধরে সঙ্গীদের সঙ্গে রাস্তা পার হতে গিয়ে পিছিয়ে পড়ে। চওড়া রাস্তায় কিছুটা এগিয়ে চলন্ত গাড়ি দেখে ভয় পেয়ে আবার পিছিয়ে আসে। তার মধ্যেই জ্বলে ওঠে সবুজ আলো। বোঝে না সে, যে রাস্তায় সে দাঁড়িয়ে সেদিকের গাড়িগুলো চলে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছে। সঙ্গীরা এগিয়ে গেছে দেখে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে সে রাস্তা পার হতে চায় আর এক চলন্ত গাড়ির সামনে পড়তে পড়তে বেঁচে যায়, কেননা এক পথচারী তার হাত ধরে নিরাপদ দিকে সরিয়ে নেয়।
গাড়িটা ব্রেক কষে জোরে আর চালক তার উদ্দেশে বাছা বাছা খিস্তি করতে করতে গাড়ি চালিয়ে দেয়। খিস্তির একটা শব্দও বুঝতে না পারলেও ধ্বনির অসহিষ্ণু টোন ও চালকের মুখভঙ্গি দেখে বোঝে সবকিছু এবং হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
রাস্তা পার হয়ে ওপারে চলে যাওয়া সঙ্গীরা হাত নেড়ে ডাকে। কিন্তু হাজারু এক পা এগোয় এবং পরক্ষণেই দু পা পিছিয়ে আসে। ভয়ে দিশেহারা হাজারু পর্যায়ক্রমে সঙ্গীদের দিকে এবং চলন্ত গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। রাস্তা পার হয়ে এসে এক সঙ্গী তাকে হাত ধরে নিয়ে যায় অপর পারে। সঙ্গীদের অনেকেই হাসাহাসি করে, ভোজপুরি বুলিতে করে রসিকতা।
কাজ শুরু হয়ে গেছে। সবাই তীব্র তৎপরতার সঙ্গে কাজ করে। হাজারু আপ্রাণ চেষ্টা করে সঙ্গীদের মতো কাজ করার। কিন্তু বার বার ভুল হয়। সঙ্গীদের দেখে দেখে অনুকরণ করার চেষ্টা করে, ব্যর্থ হয়। তার কাজের গতি শ্লথ। লেবার হেড অভিযোগ করে একে দিয়ে কাজ হবে না। মজুরি কমিয়ে দিতে চায়। একজন সঙ্গী তার কাছে এসে কাজ শেখানোর চেষ্টা করে। লেবার হেড সেই সঙ্গীকেই তিরস্কার করে, কাজ শেখাতে গিয়ে আরেকজনের কাজ বন্ধ থাকলে কিছুতেই প্রোজেক্ট এগোবে না, এই প্রোজেক্টের সময়সীমা আছে। এইসব ব্যর্থতা ও লেবার হেডের কথার ঝাঁঝে অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়ে হাজারু, কোনও ভাষাই তার আয়ত্বে নেই, শুধু ধ্বনির অভিঘাত তাকে বুঝিয়ে দেয় সবকিছু।
কিন্তু চেষ্টা করে আবার। পরপর কয়েক দিনের চেষ্টায় মোটামুটিভাবে কাজ শিখে নেয়। তবুও সঙ্গীদের মতো গতি আয়ত্ব করার সময় তার আসে না। লেবার হেডের তিরস্কার ও কাজ থেকে বহিষ্কারের হুমকি নিত্য নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়ায়। কাজ করতে করতে তাকে যেন গিলে নেয় এক ধোঁয়াশা, একটা ধুলো-ধোঁয়ার কুণ্ডলি ঘিরে ফেলে তাকে, চারপাশে পাক খেতে খেতে তাকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে যায়। ধোঁয়া-ধুলোর আবরণে আবছা তার শরীর শ্বাস নেওয়ার জন্য হাঁকপাঁক করে। তার দ্রুত ও ঘন ঘন কাশি ও শ্বাসের শব্দ আর ক্রম সঞ্চরমান অস্থির শরীর আবছা হয়ে জেগে থাকে ধোঁয়া-ধুলোর ভেতর।
বাতাসের শনশন সে শুনতে পায় আবছা, জঙ্গলের পাতার ভেতর আলোড়ন তোলে দমকা বাতাস। পাতা দুলিয়ে সরে সরে যায় বাতাসের হিল্লোল। একটা লেজ তোলা কাঠবিড়ালির পিছু পিছু গাছের গুঁড়ি বেয়ে উঠে যায় আরেক কাঠবিড়ালি। শান্ত অলস ভঙ্গীতে এইসব দেখতে দেখতে গাছের শুকনো পাতা কুড়িয়ে সে জমিয়ে রাখে বাঁশের ডালিতে। শুকনো পাতার ওপর অনেকের হেঁটে যাওয়া ও পাতা কুড়ানোর শব্দ সে শোনে, আচমকা। দেখে তার বউ ও বাচ্চারাও পাতা কুড়িয়ে রাখছে নিজের নিজের ডালিতে।
এক সহকর্মী কাজ থেকে মন সরিয়ে উদাস হয়ে থাকার জন্য ভোজপুরী বুলিতে তাকে বকে। সে সচেতন হয়ে আবার কাজে মন দেয়। তাদের সম্মিলিত কাজের শব্দ বিকট হয়ে বাজে তার কানে। তবু হাজারু জোর করেই নিজের কাজ চালিয়ে যায়। গরম পিচের তাপে অস্বস্তি বোধ হয় তার। পিচ গলানোর যন্ত্রটা দেখে বার বার। রবারের জুতো পরে রাস্তার ওপর সহকর্মীর ঢেলে দেওয়া গলানো পিচ টেনে টেনে সমতল করে। এই প্রক্রিয়া অন্যদের কাছে জলভাত হলেও সারা শরীর সঞ্চালন করে কোনমতে সে কাজ করে চলে। কাজে লেগে থাকার নিষ্ঠা প্রতিভাত হয় তার শরীর জুড়ে।
সদ্য ঢালা গরম পিচের অসম্ভব তাপ রাবারের জুতো ভেদ করে পায়ের নীচে আঘাত হানতে থাকে, আনমনে তাতে পা দিয়ে ফেলে কয়েক বার লাফিয়ে সরে যায় সে। তার অ্যানিমেশন চরিত্রর মতো লাফানো দেখে সঙ্গীরা হেসে ফেলে। সঙ্গীদের হাসিতে অপ্রস্তুত হয়ে সে তাড়াতাড়ি গরম পিচ টেনে টেনে সমতল করে, যেন দ্রুততা দিয়ে ঢেকে ফেলবে কাজের ভুলত্রুটি।
অনেক রাতে কাজ শেষ হলে সঙ্গীদের সঙ্গে হাজারু ফিরে আসে নিজেদের ডেরায়, সবার মতোই পিচ মাখা পোশাক খুলে ঝুলিয়ে রাখে দড়িতে, পরের দিন এটা পরেই যেতে হবে কাজে। সবার মতোই হাজারু কেরোসিন দিয়ে ঘঁষে ঘঁষে গায়ে লেগে থাকা পিচ তোলে, তারপর সাবানের মোড়ক থেকে সন্তর্পণে খোলে ব্যবহৃত হতে হতে ক্ষয়ে যাওয়া সাবান, অন্যদের মতোই তোলা জলে সাবান ঘঁষে ঘঁষে স্নান করে, বড় ড্রাম থেকে মগে করে জল তুলে গায়ে ঢালে, শরীর বেয়ে নামতে থাকে সাবানের ফেনা।
কয়েকজন শ্রমিক স্নান সেরেই তোলা উনুনে ভাত বসায়। কালিঝুলি মাখা বড় হাড়িতে ফুটন্ত জলে ঢেলে দেয় চাল। কয়েকজন সব্জি কাটতে ব্যস্ত। কজন অল্প বয়সী ছেলে স্নান করে এসে শুয়ে পড়েছে, কেউ মোবাইলে দেখছে নানান কিছু, কেউ শুনছে গান। হাজারু রান্নায় ব্যস্ত বন্ধুদের কাছে বসে বসে পেঁয়াজ ছাড়াচ্ছে। বড় কড়াইয়ে মুরগির মাংস রান্না হয়, সন্ধ্যাবেলার বাজার থেকে কিনে রেখেছিল কেউ। লেবার হেডকে খাওয়া খরচ তাড়াতাড়ি দেওয়ার জন্য বলে রেখেছে। এই খরচ দেওয়ার কথা কোম্পানির, কদিন দেরি হবে বলে নিজেরাই চাঁদা তুলে বাজার করছে এখন।
রান্না শেষে সবাই গোল হয়ে খেতে বসে। সবারই আছে একটা করে স্টিলের থালা, শুধু হাজারুর ছাড়া। একজন পরামর্শ দেয় থালা কিনে নিতে, হাজারু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়। আর একজন রসিকতা করে হাজারু এখানকার বাজার হাট চেনে না বলে। একজন জানায়, সে-ই হাজারুর থালা কিনে এনে দেবে। এখন সে খায় একটা গামলায়। এখানে কারোরই অতিরিক্ত কিছু নেই। রান্নার হাঁড়িকুঁড়ি কখনও কেনা হয়েছিল। নতুন কোনও শ্রমিক এলে তার থেকে এর একটা সামান্য খরচ ধরে নেওয়া হয়। হাজারুর কাছেও চেয়েছিল, কিন্তু তার অবস্থা দেখে সে অর্থ মকুব করেছে।
হাজারুর থালায় হাতা দিয়ে ভাত তুলে দেয় কেউ। তার মনে পড়ে চুড়ির রিনরিন। সে স্পষ্ট দেখতে পায় তার বউ-এর হাত বাঁশের হাতায় করে ভাত বেড়ে দিচ্ছে, তার থালা আর চুড়িগুলো পরস্পরকে মৃদু স্পর্শ করে শব্দ তুলছে রিনরিন। জঙ্গলের ভেতর এক গ্রামে নিজের ছোট্ট ঘরে সবাইকে নিয়ে খেতে বসেছে সে। বেশ আনন্দ করে খাচ্ছে সবাই। নিজের পাত থেকে শূয়রের মাংসের টুকরো হাজারু তুলে দিচ্ছে বউ ও ছেলেমেয়েদের পাতে, বউ চোখ পাকিয়ে হাড়ি থেকে মাংসের টুকরো তুলে দিচ্ছে তার থালায়, হাজারু মাংসের হাড়ি ভাল করে দেখে নিচ্ছে আর মাংস আছে কিনা।
হাজারু সহকর্মীদের সঙ্গে খাওয়া শেষ করে, তোলা জলে হাত ধুয়ে গামলাটা মেজে রাখে। নিজের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় শুয়ে পড়ে। ক্লান্তিতে নিজের নিজের বিছানায় ঘুমে ঢলে পড়ে সবাই। হাজারু বার বার পাশ ফেরে, রাস্তার গাড়ির আলো তাদের শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে চলে যায়। গাড়ির শব্দ কমে আসে। মাঝে মাঝে বড় বড় ট্রাক যায়। সেই শব্দে আবার মনে পড়ে স্বপ্নের কথা।
আবার বিশাল ট্রাক তাড়া করে তাকে, আবার সে দৌড়ায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। শহর পেরিয়ে পৌঁছে যায় জঙ্গলে। জঙ্গলে ফিরে স্বস্তি পায়। শুয়ে পড়ে পাতার বিছানায়। কিন্তু পাখি আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে নিস্তব্ধ জঙ্গলের ভেতর বিকট এক শব্দে সচকিত হয়ে ওঠে। ভয়ে সে উঠে বসে, চারপাশে তাকিয়ে শব্দের উৎস বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায়। তার শ্বাস আবার ঘন হয়ে ওঠে। শব্দটা তাকে ক্রমাগত আঘাত করতে থাকে। শব্দের অভিঘাতে সে ছুট লাগায় আবার।
আবার সে জঙ্গলে দৌড়াতে থাকে। কিন্তু শব্দটা যেন তাকে লক্ষ্য করেই তার অত্যন্ত কাছে চলে আসছে। দৌড়তে দৌড়তে গাছপালার ভেতর দিয়ে সে অবাক হয়ে দেখে বিশাল বিশাল কংক্রিটের থাম। পাহাড় কেটে, গাছ কেটে গড়ে উঠছে বড় বড় টাওয়ার। থমকে যায় সে।
শব্দটা কিছুতেই যায় না তাকে ছেড়ে। সে কানে হাত দিয়ে বসে পড়ে। দেখতে পায় নিজের গ্রাম থেকে পোঁটলা পুটলি নিয়ে চলে যাচ্ছে গ্রামবাসী। তাদের মধ্যে নিজেকেও দেখে, দেখে স্ত্রী ও সন্তানদের। প্রত্যেকটা মানুষের চোখে অশ্রু। সেও কাঁদছে।
বড় বড় টাওয়ার, থাম, তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি সব যেন তার দিকে তেড়ে আসে, স্বপ্নের ট্রাকটাও। চমকে ঘুম ভেঙে উঠে বসে বিছানায়, হাপরের মতো ওঠানামা করে বুক। সঙ্গীরা ঘুমায় নাক ডেকে। দু একটি গাড়ি ছুটে যায় রাস্তায়। পাশে রাখা বোতল নিয়ে ঢকঢক জল খায়।
মনে পড়ে যায় জঙ্গল থেকে উচ্ছেদ হওয়ার কথা। মনে পড়ে পাহাড় ভেঙে উন্নয়নের কাজ। একে একে সব মনে পড়ে যায়—ক্ষতিপূরণ, কাজ ও বাসস্থানের প্রতিশ্রুতি, বাসস্থানের জন্য নতুন জায়গা। আদতে কোনকিছুই জোটে না তাদের। বার বার মনে পড়ে স্ত্রী ও সন্তানদের। কি এক কঠিন সংকল্পে তার মুখের পেশিগুলো নড়াচড়া করে, দৃঢ় হয়ে ওঠে।
সকাল সকাল সে উঠে পড়ে। অস্থায়ী বাথরুম থেকে ঘুরে আসে। তারপর কাজের পোশাক পরে নেয়। সঙ্গীদের সঙ্গে একই ছাতুওয়ালার কাছে আবার সে ছাতু মাখা খায়। ছাতু পড়ে যায় না আজ। চওড়া রাস্তাটা সে নিজে নিজে পার হয়। ছুটে আসা গাড়ি কিছুতেই তাকে ভয় পাইয়ে দিতে পারে না। বরং ক্ষ্যাপা কুকুর তাড়ানোর মতো গাড়ি বিষয়ক ভয় সে নিজের ভেতর থেকে বেমালুম তাড়িয়ে দেয়। বড় বড় কাচের বাড়িগুলোর নীচ দিয়ে দৃঢ় পায়ে হেঁটে যায়। আজ সে সঙ্গীদের মতোই দ্রুত কাজ করে আর নিজের মজুরি বাড়িয়ে নেওয়ার তদ্বির করে লেবার হেডের কাছে। তার এই নতুন আর্জিতে হতবাক লেবার হেড চোখ বড় করে তাকিয়েই থাকে, তারপর হাসে, হাসিতে তার শ্লেষের ঝিলিক।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন