অমীমাংসিত আলো-আঁধারির ভেতর
সমগ্র রচনা-১
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ
প্রকাশক: অনুভব
প্রকাশকাল: ২০২৩
মূল্য: ৭০০ টাকা
নব্বইয়ের দশকের প্রায় মধ্যবর্তী, দূর মফস্বলের পিচুটি চোখে আটকে আলাভোলা, একইসঙ্গে অন্তর্মুখি এবং সদ্য কৈশোর পেরুনো এই আমি ঢাকায় থিতু হবার চেষ্টা করছি। কলাভবনের করিডোরে তখন প্রব্রজ্যারত অধ্যাপকদের দেখে শ্রেণিকক্ষের আড়ালে মুখ লুকোনোর কাল তখনও। সাহিত্যের নক্ষত্রময় অনন্ত সৌরমণ্ডলীর দিকে চোখের লণ্ঠন উঁচিয়ে দেখবার গোপন এক দুঃসাহস জন্মেছিল। আমার মতো অর্বাচীনের হাতে এসে পৌঁছেছিল আগুনের বিপদ-আপদ। অভাবিত সেই গল্পগ্রন্থ। সেসব গল্পচিহ্ন ঝলসে উঠেছিল অগ্নিচুম্বনে। কয়েক বছর পর হাতে এলো লাশ নাই।
বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং বই পড়ার অভিজ্ঞতাশূন্য দু-একটি বই ছুঁয়ে টুকরো টুকরো রচনা পাঠের স্মৃতি হাতড়ে মনে করতে পারি শিল্পকলাতাত্ত্বিক এবং কথাসাহিত্যবোদ্ধারা বলছেন—আধুনিক ছোটগল্প অনেকটাই কবিতার কাছাকাছি। লাশ নাই প্রকাশ হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। ততদিনে কমলকুমার মজুমদারের গোলাপ সুন্দরী এবং কতিপয় গল্প পাঠের সুখকর এবং একইসঙ্গে বিস্ময় বিমুগ্ধতায় আচ্ছন্ন ছিলাম। আর সমকালীন বাংলাদেশের গল্পের কথাসাহিত্যের ভুবনে মৃদু পদচারণ। মনে হল—আগুনের বিপদ-আপদ বা লাশ নাই—আমাদের একটা দিশা দিচ্ছে। যেন আবেগের উষ্ণতা পেরিয়ে রক্তস্রোতে ছুঁতে চাইছে সেসব অক্ষর মিছিল। যেন আমরা এক-একটি দীর্ঘ কবিতার সাঁকো পার হচ্ছি। যেন আমাদের অনভ্যস্ত পাঠের অভিজ্ঞতা রক্তাক্ত হচ্ছে।
রক্ত ক্ষরণের মধ্যে আমরা আরেক তীব্র প্রতিষ্ঠানবিরোধী সুবিমল মিশ্রকে আবিষ্কার করি। গল্পের শরীর যে এত ভাস্কর্যময় হতে পারে, এত উন্মুক্ত, এত বন্ধনহীন, এত ছন্নছাড়া হতে পারে—তন্দ্রার উতরোল ঢেউ অতিক্রম করে আমাদের চৈতন্যে তার স্বেদ ও স্রোতস্বাদ উন্মীলিত হল।
অতঃপর দীর্ঘকাল সেসব রক্তচূর্ণ, স্বেদ, আলোছায়াময় গল্পরাশির ভুবনে আমাদের সতর্ক পদবীক্ষেপ ছিল। অতঃপর দীর্ঘকাল আচ্ছন্নতা অতিক্রম করে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ছায়া আবছায়া পড়ছি। পড়বার অভিজ্ঞতা হল। পড়তে পড়তে মনে পড়ল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে ফরাসি একদল সাহিত্যিকের কথা—নাতালি সারোৎ, মার্গারিৎ দুরাস, ক্লদ সিঁম—এদের রুপালি কলমে রূপময় হয়ে উঠেছিল নতুন এক উপন্যাসরীতি—লুভো রমাঁ বা নব্য উপন্যাস। যেখানে কাহিনি নয়, প্রধান হয়ে উঠেছে ভাষার সূত্র কারুকাজ, বাক্য বিন্যাসের অপ্রথাগত প্রণালি।
ডাব্লিউ বি ইয়েটস যেমন প্রথাগত গদ্য সম্পর্কে সতর্ক করেছেন, বলেছেন—ক্লিসে গদ্য হল আত্মার স্পর্শহীন বিশুদ্ধ সাংবাদিক অপভাষা। অর্থাৎ গদ্যকে হয়ে উঠতে হবে কবিতার অনুরূপ। আধুনিক কথাসাহিত্যের গদ্য হবে রূপক ও চিত্রকল্পময়। সরল, একরৈখিক সাহিত্যিক-গদ্যকে দিতে হবে নির্বাসন। গদ্যকে হয়ে উঠতে হবে অনুভব-সংবেদনময়, সম্প্রসারণক্ষম। তার মানে কাব্যক্রান্ত নয়, হতে হবে কাব্যিক। [বলা প্রয়োজন—কাব্যক্রান্ত এবং কাব্যিক—প্রপঞ্চ দুটি ব্যাখ্যা দাবি করে। আমরা প্রায়শই দুটি অনুষঙ্গের মধ্যে পার্থক্য বিস্মৃত হই, গোলমাল করে ফেলি।] সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ ছায়া আবছায়া উপন্যাসে আমাদের অনেকটাই সেই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাত্রার আহ্বান জানিয়েছেন। কাহিনি এখানে গৌণ। এই উপন্যাসের কেন্দ্রস্থ বিষয় মৃত্যু—জীবনানন্দ দাশ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অদ্বৈতমল্ল বর্মনের মৃত্যুর অভিঘাত। একজন কবি, পরবর্তী দুজন কথাসাহিত্যিক। তাঁরাও লিখতে চেয়েছিলেন কবিতা। লিখেও ছিলেন কিছু কবিতার কাতর পঙ্ক্তিমালা। আর জীবনানন্দের কথাসাহিত্য আবিষ্কার তো আমাদের সাম্প্রতিক বিস্ময়। এঁদের মৃত্যু ঔপন্যাসিক দেখেছেন কবিতা-নন্দনের আতশ কাঁচের ভেতর দিয়ে। রূপসী বাংলার বিপুল প্রাকৃতিকতা, তাঁর কবিতায় স্বেচ্ছামৃত্যুর বিষাদসংগীত, সেসব সংবেদনা ছাপিয়ে গেছে এই উপন্যাস্ত গৌণ কাহিনিতে। ঔপন্যাসিক কোথাও মীমাংসায় পৌঁছাতে চাননি। বরং একজন জীবনানন্দের মৃত্যু-বিষাদ-প্রেম-অপ্রাপনীয়তার মনোজাগতিক অভিযাত্রা, স্মৃতিসত্তার নৈরাশ্য, নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব—এসবই টুকরো টুকরো এপিসোডে এই উপন্যাসে বিন্যাস্ত। যদিও লেখক কবিতামন্দ্রিত বাক্যবলির অবিরাম স্রোতে-প্রতিস্রোতে, একাংশে তথ্য জানাচ্ছেন, কবির ডাক নাম মিলু, তাঁর বাবা, ঠাকুরদা—অর্থাৎ পারিবারিক ঘটনার মৃদু স্ফুরণ। রয়েছে শিক্ষক, বাল্য-কৈশোর-যৌবনের পরস্পরা। বর্ণনার ঝোঁকে আমরা পেয়ে যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অদ্বৈতমল্ল বর্মণ, সঞ্জয় ভট্টাচার্যদের। ফলে একজন নির্জন, নিঃসঙ্গ এবং অন্তর্যাপনস্বভাবী কবির মৃত্যুচিন্তা অথবা বাস্তবিকই অবধারিত এই সত্যটি অনুসন্ধানে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের আখ্যানে একটা সময়ের দৃশ্যাবলি সজীবতা পেয়েছে। কিন্তু ছায়া আবছায়া উপন্যাসটি কোনোভাবেই জীবনানন্দ, মানিক, অদ্বৈত বা এমন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের নিয়ে রচিত সাম্প্রতিকের অন্যান্য উপন্যাসাখ্যানের সঙ্গে মেলানো যাবে না। বিগত ত্রিশ/চল্লিশ বছর অথবা তারও অধিককাল জুড়ে বাংলাভাষার কথাসাহিত্যে জীবনীভিত্তিক এমন উপন্যাস বেশ কয়েকজন কথাসাহিত্যিক লিখেছেন। সেসব রচনার নাম উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন মনে করি। কথা হলো, সেসব কাহিনি রচনায় শৈল্পিক সংগঠন, ভাষাপ্রণালি সবকিছু থেকে ছায়া আবছায়া স্পষ্টতই দূরবর্তী। তবে মনে রাখা প্রয়োজন—তথ্য শিল্প নয়, সাংবাদিকতা। যেমন কমলকুমার মজুমদার তথ্য রূপান্তর করেছেন শিল্পকলায়। তিনি ‘জল’ গল্পে লিখেছেন—‘ফজল হয় ভালো লোক।’ এটি তথ্য। অতঃপর চরিত্রটির পরিপার্শ্ব, মনোজগৎ, উৎপ্রেক্ষাময় মানবসম্পর্ক বদলে যায় চিত্রকল্পময় ভাষার রূপদক্ষতায়। এমন সুপ্রচুর দৃষ্টান্ত প্রায় সব লেখকের রচনা থেকে উপস্থাপন করা যেতে পারে, যাঁরা ইতিহাসের রন্ধ্রপথে অনুপ্রবিষ্ট করিয়েছেন ব্যক্তির কল্পলোকের বস্তুবিভাবময় শিল্পসংবেদনা।
আমরা জানি গল্পহীন গল্পের কথা। এমনকি দীর্ঘ উপন্যাসেও নিটোল বা মনোরঞ্জক কাহিনি এড়িয়ে কেবল অনুভব-উপলব্ধির সম্প্রসারণ ঘটেছে—এমন উপাখ্যান রয়েছে। সেসবের ভেতর, গল্পহীনতার ছায়া-আবছায়ার মধ্যেও ঘটে চলে অনুভূতির তীব্র সঞ্চালন। একটি অনুভূতি থেকে অপর উপলব্ধির অন্তবর্তী শূন্যতায় সাঁকো নির্মাণ করে এমন অভাবিত চিত্রকল্পময় সব অনুষঙ্গ, যেসব স্তরায়ন প্রতীক্ষাপ্রবণ পাঠকের মনোজগতে সূচনা করে অপার আনন্দ। আমরা ছায়া আবছায়া উপন্যাসে উল্লিখিত তিন সাহিত্যিকের বিষাদময় মৃত্যুর ঘটনা পাই। একইসঙ্গে সেখানে উঠে এসেছে, আগেই উল্লিখিত, তাঁদের সঙ্গে পারিবারিক ও শিল্পচর্চাসূত্রে চেনা-অচেনা নানান ব্যক্তিবর্গ এবং বেশ দীর্ঘ একটি সময়ের প্রবাহ। ফলে তৎকালীন প্রচুর তথ্যের সমাবেশ ঘটেছে এই উপন্যাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। এ কারণে কোনো কোনো পাঠকের মনে কিছু প্রশ্নের উদয় হতে পারে। সেই অচেনা অজ্ঞাত পাঠকের সজাগ ও সতর্ক দৃষ্টিতে প্রশ্নগুলো বিন্যাস করা যেতে পারে এভাবে—এটি কি ডক্যুফিকশন? না কি প্রবন্ধ এবং ব্যক্তিগত জর্নালের সংমিশ্রণ? প্রবন্ধ হলে কোন চিন্তার সম্প্রকাশ লেখকের উদ্দিষ্ট? অথবা এটি প্রামাণ্যচিত্রের খসড়া? যদি উপন্যাস হয় তাহলে কেবল তথ্যের সমাবেশ কি সেই শর্ত পূরণ করে? কিংবা বলতে পারেন—জীবনানন্দ-মানিক-অদ্বৈতের সমকালীন এসব ঘটনা অনুরাগী পাঠক মাত্রই জানেন, তাহলে এই বই পড়বেন কেন? এটি কি হয়ে উঠতে পারত একজন জীবনানন্দ এবং তাঁর সময়ের রূপক?
‘আশির দশক এবং ছোটগল্পের কথকতা’ প্রবন্ধে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ বলেছেন, “ছোটোগল্পকে ‘ছোট’ চেতনা মনে করে দেখা যাচ্ছে না—মাল্টি মিনিংফুল ছোটোগল্প লিখিত দেখা যাচ্ছে প্রতিটি বাক্য গল্পের একই কাঠামোর ভেতর কীভাবে সার্বভৌম হয়ে পড়েছে—তাৎপর্য খচিত বিভিন্ন অর্থবহতা সৃষ্টি করছে, নির্বাচিত প্রতিটি শব্দ আভিধানিক অর্থের মধ্যে বন্দি থাকছে না—প্রতি শব্দের একেকটি বিষয়বস্তু হয়ে ওঠার তাগিদ দেখা দিচ্ছে—প্রতীক, অলংকার, ভাষার বহুমাত্রিক নব নব উদ্ভাবিত ব্যবহারে ছোটোগল্প আর নামটির সঙ্গে যে ছোটো মতো অনুভূতি পূর্বে প্রতিষ্ঠিত ছিল তার মধ্যে আর সীমাবদ্ধ থাকে না,...”
ছোটগল্প-বিষয়ক হলেও শিল্পকলা সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক দৃষ্টিভঙ্গি হেতু বক্তব্যটি উদ্ধৃত হল। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে, লেখক প্রবন্ধে যখন শিল্পের বহুমাত্রিকতার প্রসঙ্গে এমন চিন্তা হাজির করছেন, সেসব প্রতিধ্বনি কি তাঁর আলোচ্য উপন্যাসে উন্মোচিত?
অধিকাংশ পাঠক কি তাহলে একটি এক রৈখিক কাঠামোর মধ্যে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে? এই জিজ্ঞাসা মেনে নিয়েও বলতে হয়, এটা ঠিক যে উচ্চমার্গের কোনো শিল্পকলা সম্পর্কে আকস্মিকভাবে কোনো সিদ্ধান্তে বা মীমাংসায় উপনীত হওয়া যায় না। কেননা শিল্পকলা তো নিরন্তর নতুন নতুন তর্ক, রহস্য, দৃষ্টিকোণ সৃষ্টি করে। যদি লেখকের রচনা সংগ্রহের সূচিপত্রে এটিকে ‘উপন্যাস’ বলা হয়েছে। ফলে এই রচনা উপন্যাসের শর্তাবলি পূরণ করে কি না সে বিষয়ে কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য পরবর্তী প্রশ্নসমূহের এক ধরনের ব্যাখ্যা বা অনুসন্ধান চলতে পারে। অথবা এমন জিজ্ঞাসা সূচিত হবার নেপথ্য শূন্যতা উপলব্ধির প্রয়াস সম্পর্কে ভাবা যেতে পারে। অবশ্য কেউ দাবি করতেই পারেন, লেখককে শর্ত মেনে কেন লিখতে হবে? খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। তবে মনে রাখা দরকার, শিল্পকলা শেষ পর্যন্ত পাঠকের অনুভব ও উপলব্ধি সম্প্রসারিত করে। কাজেই প্রথাগত ব্যাকরণ বা কাঠামো বা আদর্শ অনুসরণের কোনো জবরদস্তি চলতে পারে না। স্মরণীয় হল রসাস্বাদন, পাঠকের মনোজগতে যা সূচিত করতে পারে আনন্দের নতুন স্পন্দন।
এই উপন্যাসের ভাষা, বাক্যের যে স্বাভাবিক বিন্যাস/শৃঙ্খলায় আমরা অভ্যস্ত, এখানে প্রায়শই সেই ব্যাকরণ মান্য করা হয়নি। বরং প্রচুর বাক্য রয়েছে, যেগুলো কবিতার কাছাকাছি। ঠিক কাব্যাক্রান্ত নয়, আবার কাব্যিক চেতনার অভাবিত কোনো নতুন স্পন্দন রয়েছে তাও ঠিক নয়। এই দুটো প্রপঞ্চের মাঝামাঝি একটি সাঁকো। লিখেছেন দীর্ঘ বাক্য। কখনো লিখেছেন স্বনির্মিত সমাসবদ্ধ পদের একটি একক বাক্য ও নিঃসঙ্গ অনুচ্ছেদ। এরূপ বাক্যরূপ ও নিঃসঙ্গ অনুচ্ছেদ যেমন:
‘মৃত্যু আসে নাই নীরবে—কাফন পরাবে বলে হ্যাঁচকা এক টান দেয় নাই; শেষযাত্রার এই এক উপলক্ষ্য করে তোলে নাই, বরং ঘণ্টাধ্বনি বাজছিল তখন, হানা দিয়েছিল মৃত্যু, ঘণ্টি বাজাতে বাজাতে— তবু তার কানে পৌঁছাল না, সন্ধ্যার বিষণ্নতায় সেই ট্রাম রাস্তায় কী করুণা তখন! কুসুমে, ইস্পাতে, রক্তে আগমন ও প্রত্যাবর্তন। হীম ও কুসুমের ভেতর যতটা কবিতা নিজেকে ছিন্ন করে এতকার সংবদল—পালাবদল কিংবা কালবদল করে চলেছিল—তার জন্য, সেই সব পাতালমুখী কবিতা আন্দাজের প্রস্তুতি জ্ঞানী সমাজের না থাকলেও—আহ্ তার যেন প্রস্তুত শরীরটা আয়োজন ছাড়া লড়িয়ে দিলো—মৃত্যুর সামনা-সামনি। অবশেষে তাই হলো—গোপন থাকল না মৃত্যু। চলে যাওয়া। ফিরে আসার আকুতি ভরা শেষযাত্রা, তবু যেন, চাঁদ ডুবে গেলে সূর্যের রশ্মির ভেতরে আরেকটা আগমনী হাওয়া মেঘ ও আঁকাজোকা।’
কোনো কোনো শব্দ তিনি নির্মাণ করেছেন। যেমন—চাক্ষিক, শোকশ্রীময়ী। উল্লেখ্য, একটি শব্দ বাক্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে দৃষ্টান্ত দিলে তা অনেক সময় সঠিক অর্থময়তা থেকে দূরে সরে যায়। অথবা শব্দটির ভিন্নার্থও তৈরি হবার সম্ভাবনা থাকে। জীবনানন্দের প্রচুর কবিতার পঙ্ক্তি অবলীলায় উপন্যাসটির গদ্যে গৃহীত হয়েছে। যেমন টি এস এলিয়ট আমাদের শিখিয়েছেন, কীভাবে পূর্ববর্তী কবিদের বাক্য বা বাক্যচূর্ণ কিংবা কবিতার উল্লেখযোগ্য ক্ষুদ্রাংশ নিজের কবিতার অংশ করে তুলতে হয়। কীভাবে ওই অংশটি উদ্ধৃতিযোগ্যতার চিহ্ন বিলুপ্ত করে আলংকারিক হয়ে উঠতে পারে এবং কীভাবে পূর্ববর্তী কবির স্মারণিক পঙ্ক্তির রূপান্তর ঘটানো সম্ভব। এটি হচ্ছে সৃষ্টিশীল পরাগায়ন। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ এই উপন্যাসে সেটি করবার চেষ্টা করেছেন। তাঁর বাক্যাবলি ও বাক্যচূর্ণে জলের মতো ঘুরে ঘুরে খেলা করে কখনো জীবনানন্দ, কখনো সুকান্ত, মানিক বা অদ্বৈতের কবিতা অথবা গদ্যাংশ। কিন্তু জীবনানন্দের স্মারণিক পঙ্ক্তির দৃশ্যমান কোনো রূপান্তর অনেকাংশেই ঘটেনি। তবে এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ একটি দৃষ্টান্ত।
বলা প্রয়োজন, কথাসাহিত্য একসময় ছিল আখ্যান প্রধান, বিস্তারময়। এখনও অনেকেই তেমন লিখছেন। কারো কারো রচনা সূত্র, সংকেতিত, প্রতীকী। সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের ছায়া আবছায়া ভাষার কারুকর্মে দৃষ্টি কাড়ে বৈকি। তবে তা সংকেতময় নয়, রূপকও তিনি সৃষ্টি করেননি। ফলে যে আন্তরজিজ্ঞাসা একটি মৃদু অগ্নিচুম্বনে এই উপন্যাসের সূচনায় সংকেতিত হয়েছে দ্রুতই তা তথ্যভারে নির্বাপিত। সেসব কুসুম কথামৃত অমীমাংসিত আলো-আঁধারির ভেতর লেগে রইল মূর্ছিত জ্যোৎস্নার মতো।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন