শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্নেল: কতটা উপন্যাস আর কতটা ইতিহাস!

অ+ অ-

শাহাদুজ্জামান যখন লিখতে গিয়েছেন তার তো একটা রাজনীতি আছে। সেই রাজনীতির প্রতিফলন তো থাকবেই কম বা বেশি। উনি সেই রাজনীতি করেছেন। কিন্তু যতটা সম্ভব চক্ষুলজ্জা রাখ-ঢাক এগুলো রেখে করেছেন। মূলধারার ইতিহাসের মতো কাউকে বেমালুম গিলে ফেলেননি। ফলে উনসত্তর থেকে ছিয়াত্তরের ইতিহাস পড়ার জন্য আমার মনে হয় ক্রাচের কর্নেল একটা ভালো বই...

প্রথমে শাহাদুজ্জামান সম্পর্কে একটু বলা দরকার। এমন না যে শাহাদুজ্জামান আমাদের আলোচনার ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠা পাবেন বা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন। শাহাদুজ্জামান ইতোমধ্যে ঢাকায় একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। আমার দৃষ্টিতে তিনি নানা অর্থে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তিনি ঢাকার শিক্ষিত লেখকশিক্ষিত লেখক বলতে এমন বোঝাচ্ছি না যে, তিনি বড় বড় প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন বা অনেক বইপত্র পড়েছেন। শিক্ষিত লেখক বলতে বোঝাতে চাইছি যে, একজন লেখকের তার কমিউনিটি সম্পর্কে, চারপাশ সম্পর্কে, সমকালীন বিশ্ব ও জীবনজগত সম্পর্কে যে-যে ধরনের সচেতনতা লাগে সেই সেই ধরনের সচেতনতা নিয়ে তিনি লিখতে বসেছেন। তাঁর লেখার মধ্যে এইসব সচেতনতা খুবই লক্ষ করা যায়। বিচিত্র বিষয়ে তাঁর আগ্রহ। এই আগ্রহের প্রতিফলন তাঁর বিচিত্র লেখালেখির মধ্যে দেখা যায়। আমার বিশেষ আগ্রহ তাঁর রাজনীতি সচেতনতার প্রতি। রাজনীতি সম্পর্কে সচেতনতা তাঁর ছোটগল্প থেকে শুরু করে সব ধরনের লেখার মধ্যেই পাওয়া যায়। এই রাজনীতি সচেতনতা থেকেই সম্ভবত তিনি ক্রাচের কর্নেল না-লিখে পারেননি। কারণ যিনি বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে সচেতন তাকে আসলে এই বিষয়টা নিয়েই ডিল করার কথা।

বিষয়টা কী? এক অর্থে বিষয়টা বাংলাদেশের উনসত্তর থেকে ছিয়াত্তর সময়পর্ব। এটা আমরা বলি যে, ষাটের দশক আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য, বাংলাদেশ জন্ম নেওয়ার প্রস্তুতির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। কিন্তু উনসত্তর থেকে ছিয়াত্তর অথবা আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বাহাত্তর থেকে ছিয়াত্তর তার চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ না। আমাদের দেশে বাহাত্তর থেকে ছিয়াত্তর এই সময়ের ইতিহাসে সাধারণত কেউ হাত দেন না। কথা বলতে চান না। আর সাহিত্য তো দূরের কথা। এই সময় নিয়ে সচেতনসাহিত্য অধিকাংশেই করতে চান না, কারণ এই সময়টা খুব অস্বস্তিকর। শাহাদুজ্জামান এইরকম একটা বিষয় ও সময় নিয়ে, আমি বলব একটা ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় ও সময় নিয়ে ক্রাচের কর্নেল লিখেছেন। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং সাহসী ব্যাপার বটে। এর মধ্য দিয়ে শাহাদুজ্জামানের রাজনৈতিক সচেতনতা ও বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-শুভাকাঙ্ক্ষাও প্রকাশিত হয়েছে বলে আমি মনে করি।

ক্রাচের কর্নেল কী নিয়ে লেখা? আগেই বলেছি, ক্রাচের কর্নেল উনসত্তর থেকে ছিয়াত্তর পর্যন্ত এই সময়ের ইতিহাস নিয়ে লেখা। আরও যদি একটু পিছনে যাই তাহলে বলব, সাতচল্লিশ থেকে ছিয়াত্তর পর্যন্ত এই সময়ের ইতিহাস নিয়ে লেখা। সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন বা পঁয়ষট্টি, ছেষট্টি এই সময়গুলো কম এসেছে। কিন্তু এই সময়গুলো প্রসঙ্গত নানাভাবে এসেছে। আর যদি পরের কথা বলি, তাহলে বলব যে, উনি আসলে ছিয়াত্তরের পরের ইতিহাসও লিখেছেন।

ছিয়াত্তরের পরের ইতিহাস ক্যামনেএই প্রশ্ন উঠতেই পারে। কারণ, কর্নেল তাহেরের মৃত্যুর ভেতর দিয়ে এই উপন্যাসটা শেষ হয়েছে। তাহের তো ১৯৭৬ সালে ফাঁসির আদেশের মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করেন। তাহলে ছিয়াত্তরের পরের ইতিহাস শাহাদুজ্জামান এই বইয়ে কীভাবে ধরলেন! আসলে ছিয়াত্তরের পরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে-খাসলত দাঁড়িয়েছে সেইসব ইঙ্গিত, সেইসব বাস্তবতা, তার একটা পাটাতন আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন শাহাদুজ্জামান এই উপন্যাসের মধ্যে। ছিয়াত্তর পর্যন্ত সময়ের ভেতরে থেকেই পরের সময়কে খোঁচাখুঁচি করার চেষ্টা করেছেন। ফলে এই উপন্যাস কোনো নিরীহ উপন্যাস না।

আমরা বাংলাদেশের ইতিহাস পড়তে গেলে সাধারণত কী দেখি? আমরা দেখি যে, বাংলাদেশের ইতিহাস যারা লিখতে যান শুধু তাদের নিজেদের ইতিহাসটাই তারা লেখেন। অন্য কেউ যেন আর নেই। অথবা থাকলেও প্রায় নেই এমন একটা ভাব। এই ইতিহাসকে কী বলা যায়! আমরা বলতে পারি আমরা-মামুরার ইতিহাস। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস মূলত আমরার আর মামুরার ইতিহাস। এর বাইরে যেন কিছু নাই। ভাষা আন্দোলন নিয়ে পড়তে যাই, যার যার ইতিহাসটা সেই সেই লিখেছে। এটাই হয়ত প্রথা। তবু চক্ষুলজ্জা বলে তো একটা কথা আছে! এসবের বাইরে কেউ যদি সবার ইতিহাস পড়তে চান তাহলে আমি বলব যে, শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্নেল ভালো।

ক্রাচের কর্নেল আসলে কী ধরনের রচনা সেই প্রসঙ্গে। আসলে কি এটা উপন্যাস নাকি ইতিহাসের বই? শাহাদুজ্জামান তাঁর বইয়ে বলেছেন, সাধারণভাবে দুই ধরনের ইতিহাসাশ্রিত উপন্যাস লক্ষ করি। এক ধরনের উপন্যাসে কালটি ঐতিহাসিক কিন্তু চরিত্রগুলো কাল্পনিক। আর দ্বিতীয় ধরনের উপন্যাস আছে কাল এবং চরিত্র দুইটাই বাস্তব। শাহাদুজ্জামান দাবি করছেন যে, আমার এই উপন্যাসটা দ্বিতীয় ধারার অর্থাৎ কাল এবং চরিত্র দুইটাই বাস্তব

কেউ কেউ হয়তো বলবেন যে, এইখানে এডিটিং আছে। এডিটিং মানে কেউ কেউ কম আছে, কেউ কেউ বেশি আছে। তা তো থাকবেই। শাহাদুজ্জামান যখন লিখতে গিয়েছেন তার তো একটা রাজনীতি আছে। সেই রাজনীতির প্রতিফলন তো থাকবেই কম বা বেশি। উনি সেই রাজনীতি করেছেন। কিন্তু যতটা সম্ভব চক্ষুলজ্জা রাখ-ঢাক এগুলো রেখে করেছেন। মূলধারার ইতিহাসের মতো কাউকে বেমালুম গিলে ফেলেননি। ফলে উনসত্তর থেকে ছিয়াত্তরের ইতিহাস পড়ার জন্য আমার মনে হয় ক্রাচের কর্নেল একটা ভালো বই।

এই বই পড়তে গিয়ে আমার কী অনুভূতি হয়েছিল সেটা একটু ছোট করে বলা যাক। আমি জানি না এটা শ্লীলতা ভঙ্গ করবে কিনা। করলে করুক। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটা ছোটগল্প আছে। ছোটগল্পের নাম উৎসব। সেই গল্পের মধ্যে বড়লোক বনে যাওয়া এক বন্ধু তার পুরান ঢাকার গরিব বন্ধুকে দাওয়াত দিয়েছে। বলেছেআয় আমার এখানে একটা অনুষ্ঠান; বিয়ের অনুষ্ঠান। তুই আয় দাওয়াত দিলাম তোরে। তো বড়লোক বন্ধু আসলে ছোটলোক বন্ধুকে ফুটানি দেখানোর জন্যই দাওয়াত দিয়েছে। আমার কী পরিস্থিতি হয়েছে এসে দেখে যাএইরকম একটা ব্যাপার-স্যাপার। সে গেছে। বড়লোক বন্ধুর দাওয়াতে গিয়ে তার খুব বেশি শনাক্তি নাই। সে দেখেছে এখানে বিচিত্র ধরনের মেয়ে মানুষ, বিচিত্র তাদের পোশাক-আশাক। পুরুষ মানুষরা সেগুলোর প্রতি খুবই আকৃষ্ট। গরিব বন্ধু দেখে যে, অনুষ্ঠানে মূলত যৌনানুভূতি, যৌন সম্পর্ক, আকাঙ্ক্ষা, স্পৃহা এগুলোই প্রধান। এই উৎসব। দাওয়াত খেয়ে সে গেছে বাড়ি। বাড়ি হল তার পুরান ঢাকায় চিপা গলির মধ্যে। রাতে যখন সে স্ত্রীর সাথে মিলিত হতে যায় তার আর ভাল্লাগে না। খালি ধানমন্ডির সেই বড়লোক মেয়েমানুষদের কথা মনে পড়ে। এর মধ্যে গলির মোড়ে সে শোনে এক হল্লার শব্দ, সাথে হাততালি আর বিচিত্র উৎসাহব্যঞ্জক ধ্বনি। কী হয়েছে? বারান্দায় গলা বাড়ায়ে এক পিচ্চিকে জিজ্ঞাসা করে। গভীর রাতে দুই কুকুর সংগমে রত হয়েছে। সেটা নিয়ে মহল্লার পোলাপান চিৎকার চেঁচামেচি হইচই করে একটা উৎসব তৈরি করেছে। বুঝাই যাচ্ছে, ওই উৎসবের সাথে এই উৎসবের একটা সিমিলারিটি টানার চেষ্টা করেছেন ইলিয়াস। তো এই ভদ্রলোক জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলছে একজনের নাম ধরে ডেকে শামিম না কি যেন নাম। বলছে ওই শামিম কী হইচে রে...। তখন শামিম হাতে তালি দিচ্ছে আর বলছে চাচা! ধামাধাম মাস্তকালান্দার। তো বাংলাদেশের একাত্তর থেকে ছিয়াত্তর এই সময়ের ইতিহাস ক্রাচের কর্নেল বইয়ে পড়ে আমার মনে হয়েছে ওই শব্দগুচ্ছ ধামাধাম মাস্তকালান্দার। মানে বাংলাদেশ একটা রাষ্ট্র। সদ্য স্বাধীন হয়েছে। সেই রাষ্ট্র নিয়ে বিচিত্র ধরনের মানুষের আকাঙ্ক্ষা, টানাহেঁচড়া, খাবলাখাবলি। এই ব্যাপারগুলো শাহাদুজ্জামান খুব সাহসিকতার সাথে ক্রাচের কর্নেলে তুলে ধরতে পেরেছেন বলে আমি মনে করি। একতরফা কিছু করেননি। করলে সেটাকে বলা যায় বাংলাদেশ তরফা। বাংলাদেশের তরফ থেকে তিনি ওই সময়টাকে দেখছেন। এই জন্য এই বই খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ রাষ্ট্র নিয়ে, সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র, নিয়ে একটা জাতির এই কামড়াকামড়ি বোঝাটা খুব জরুরি। কারণ, এর ভেতর দিয়েই পরের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নিয়তি নির্ধারিত হয়েছে। এই ইঙ্গিতের জন্যও শাহাদুজ্জামানের এই বই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।

ক্রাচের কর্নেল উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র তাহের। কিন্তু এর বিষয়বস্তু যে রাজনৈতিক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যেহেতু বিষয়বস্তু রাজনীতি সেহেতু লেখকের একটা পজিশন নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। এই যে বিচিত্র মত-পথ, এসব মত-পথের বাঙালিরা যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে, দেশ স্বাধীন করছে, তারপর নানা ধরনের কামড়াকামড়ি-হুমড়োহুমড়ি করছেএর মধ্যে শাহাদুজ্জামানের পজিশন কী সেটা জানাটা জরুরি। কেউ কেউ বলবেন, বামপন্থা পজিশন। আমি বলব না। এই বইয়ে শাহাদুজ্জামানের অবস্থানকে বলা যায়, বাঙালি জাতীয়তাবাদী পজিশন। কিন্তু এই বাঙালি জাতীয়তাবাদী পজিশনটা খানিকটা ক্রিটিক্যাল; সরল নয়। বলা যায়, ক্রাচের কর্নেলে শাহাদুজ্জামানের রাজনৈতিক পজিশন ক্রিটিক্যাল বাঙালি জাতীয়তাবাদী। কিংবা বলা যায়, বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাথে বাম রাজনীতির, বাম চেতনার যতটুকু মিশেল থাকলে তাকে একটু বেশি প্রগতিশীল বলা যায় শাহাদুজ্জামানের পজিশন আমার কাছে এই উপন্যাসে তাই বলে মনে হয়েছে।

সেটা কীভাবে বুঝি? সেটা বেশ কিছুভাবে বুঝি। বাঙালিত্ব নিয়ে সাতচল্লিশ পরবর্তী সময় থেকে বরাবরই অহংকার করেছেন শাহাদুজ্জামান। এই অহংকার মোটামুটি একাত্তর পর্যন্ত বেশ জোরেশোরে জারি রেখেছেন। একাত্তর পর্যন্ত সংগত কারণেই তাহের চরিত্রকে ব্যাপকভাবে শাসন করেছে বাঙালিত্বের শ্লাঘা। স্বাধীনতার পরে অবশ্য লেখক বাঙালি বাঙালি খুব কম করেছেন। নিশ্চয়ই ওই সময়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে খুব কন্সার্ন থাকার কারণে এমনটি হয়েছে। দেশ স্বাধীনের পরে তিনি বোধ হয় এই বিষয়ে একটু দমিত হয়ে গেছেন। হয়ত আহতও বোধ করে থাকতে পারেন। এই সময়ের ইতিহাস তো বাঙালি জন্য শ্লাঘার নয় বরং লজ্জার। ক্রাচের কর্নেলে বাঙালিত্বের বিষয়টা অনেক বিচিত্রভাবে বিচিত্র সময় কর্নেল তাহেরকে দিয়ে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন ঔপন্যাসিক। আপনারা যারা পড়বেন বা পড়েছেন তারা ভেতরে দেখবেন পাকিস্তানি আর্মিদের সরাসরি বিভিন্ন সভায় বলছেন যে, বাঙালি এই পারে বাঙালি ওই পারে, বাঙালিদের এই যোগ্যতা আছে ওই যোগ্যতা আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। উনিশ শ পঁয়ষট্টি সালে যে পাক-ভারত যুদ্ধ সেখানে তাহেরের যে-বীরত্ব সেটাকে বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন শাহাদুজ্জামান। এসব জায়গায় অনেক সময় শাহাদুজ্জামান বেশ অত্যুৎসাহী। এত অত্যুৎসাহী যে, তা অনেক সময় ঔপন্যাসিকোচিত সংযমকে অতিক্রম করে যায়। এইসব থেকে খুব সহজেই শাহাদুজ্জামানের রাজনৈতিক অবস্থান বোঝা যায়।

আমরা সাধারণ ইতিহাসে পাই যে, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ছাত্র-শিক্ষকদের দ্বারা। বড় বড় লিডারদের দ্বারা। কিন্তু ইলিয়াস বলছেন, না এখানে হাড্ডি খিজির একজন নায়ক। ব্যঙ্গ করে মধ্যবিত্তকে বলছেন, আপনার নায়ক যায়া দেখেনগা চিলেকোঠার উপরে বসে আছে আর পর্ণ-পত্রিকা দেখতেছে। শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্নেলে এইরকম কোনো ঘটনা ঘটলে হয়ত এটি অধিকতর উপন্যাস হয়ে উঠত। কারণ এই সম্ভাবনার সব শর্তই ক্রাচের কর্নেলে এবং এর ঔপন্যাসিকের চৈতন্যে হাজির ছিল।

আর একটা জিনিস দিয়ে বুঝি শাহাদুজ্জামানের অবস্থান। সেটা হচ্ছে, জিন্নাহকে নিয়ে শাহাদুজ্জামানের বাঁকা বাঁকা উক্তি। এটা দিয়ে বুঝি তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহাবয়ান সম্পর্কে খুব কন্সার্ন। কী রকম? ইতিহাসের এই ইন্টারপ্রিটেশনটা নিয়ে আমি আমার পর্যবেক্ষণটা একটু বলি। শাহাদুজ্জামানকে লক্ষ্য করি যে, কোন প্রকার ক্রিটিক্যাল এনগেইজমেন্ট ছাড়াই তিনি বাঙালিত্বের বিপরীতে জিন্নাহকে দাঁড় করাচ্ছেন। দেশভাগ যে-জিন্নাহর দুষ্কর্মের ফল সেই থিসিস শাহাদুজ্জামান দিচ্ছেন। বলছেন যে, জিন্নাহ নিজে নামাজ পড়ে না কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে সে দেশ ভাগ করে দিল এবং এবং অবশ্যই খারাপ হলো। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মনে হয় যেন-বা সাতচল্লিশ এর আগেই এই বাঙালি জনগোষ্ঠী অবিভক্ত ভারতে ভালো ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে বাঙালির কোনো সংগ্রাম বা বঞ্চনার বোধ ছিল না। দেশভাগ না হলে ভালো হতো সেটা এক প্রশ্ন। কিন্তু দেশভাগের আগে যেন-বা ভালো ছিল; জিন্নাহ এসে সর্বনাশটা করে দিয়েছেএটা খুবই প্রচল একটা হিস্ট্রি। কারণ এই কথা যদি আপনাকে বলতে হয় যে, জিন্নাহ এসে পয়মালিটা করেছে তাহলে আগের ইতিহাসেও আপনাকে একটু ঢুঁ মারতে হবে। তা না হলে পরের ব্যাপারটা যুক্তিযুক্ত হয় না। একইসাথে দেশভাগের পক্ষে পূর্ববাংলার মানুষের গণ সমর্থনেরও কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। তাছাড়া একথাও মনে রাখতে হবে যে, দেশভাগের রাজনীতির ইতিহাস সাতচল্লিশ থেকে শুরু হয়নি। ইতিহাস আরো আগে থেকে শুরু হয়েছে। শাহাদুজ্জামান ক্রাচের কর্নেল-এ এই ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়েছেন। ব্যাপারটা একটু গোলমেলে মনে হয়েছে আমার কাছে। আমি যদি সাতচল্লিশ থেকে ইতিহাস শুরু করি, সাতচল্লিশের আগে থেকেই শুরু না করি, তাহলে সাতচল্লিশ এর পরে পাকিস্তানের সাথে আমার কী সমস্যা হল কী কারণে আমি আবার আরেকটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত হলাম সেগুলো আমি বুঝতে পারব না। আমার সেই তাকতটা প্রমাণিত হবে না। ফলে এই হিস্ট্রি প্রশ্নহীন হিস্ট্রি। সাতচল্লিশ থেকে হঠাৎ হিস্ট্রি শুরু আমার কাছে গোলমেলে মনে হয়। শাহাদুজ্জামান ব্যাপারটা বোঝেন না, তা না। তিনি সবই জানেন এবং বোঝেন। আমি শুরুতেই বলেছি, শাহাদুজ্জামান বাংলাদেশের অত্যন্ত প্রস্তুত এবং শিক্ষিত লেখকদের একজন। তবে যে তিনি ক্রাচের কর্নেলে এই কাজটি করলেন! এর উত্তর, ওই যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী বা প্রগতিশীল পজিশন। ঔপন্যাসিক উপন্যাসে যে-পজিশনটা নিয়েছেন সেই পজিশনই তাঁকে ইতিহাসের এই ন্যারেটিভের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে বলে মনে করি।

আরেকটা বিষয়ের ওপর আলো ফেলা দরকার। বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। শাহাদুজ্জামান একটা উপন্যাস লেখার জন্যে এত মানুষ থাকতে তাহেরকে কেন বেছে নিলেন। উপন্যাস লেখার জন্য আরো চরিত্র নিশ্চয়ই বাংলার বুকে আছে। ওই যে বললাম, ক্রিটিক্যাল বাঙালি জাতীয়তাবাদিতার সাথে বামের সংমিশ্রণ এবং স্বাধীনতা পরবর্তী যে-রাষ্ট্রের গতিবিধি সেই গতিবিধি বিষয়ে অসন্তুষ্টিএটাই বোধ হয় শাহাদুজ্জামানকে তাহেরের মত একজন লোককে বেছে নিতে ভূমিকা পালন করেছে। কেন? কারণ তাহের মনে করতেন যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় হঠাৎ করে ভারতের যে-অংশগ্রহণ সে-অংশগ্রহণটা হওয়া দরকার ছিল পেছনের সারিতে থেকে। আমাদের যুদ্ধটা আমাদেরই করা দরকার। এইজন্যে বিচ্ছিন্নভাবে সাধারণ মানুষ যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে তাহের তাঁর এগারো নম্বর সেক্টরের মধ্যে তাদের খুঁজে খুঁজে বের করেছেন। সেই কুড়িগ্রামে গিয়ে কাউকে ধন্যবাদ দিয়ে এসেছেন, কাউকে উৎসাহ দিয়ে এসেছেন। অন্তত ক্রাচের কর্নেল-এর তাহেরকে সেভাবেই আমরা পেয়েছি। গ্রন্থে দেখি যে,  সাধারণ বাঙালির অংশগ্রহণে চলমান জনযুদ্ধের প্রতি তাহেরের একটা বিশেষ আগ্রহ ছিল। ফলে তাহের নিজের মতো করে নতুন সমাজবিন্যাসের যে-রাষ্ট্র সেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। অথবা বলা যায় স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই আকাঙ্ক্ষা বোধ হয় শাহাদুজ্জামানের সাথে খুব ভালভাবে মিলমিশ খায়। এই কারণে বোধ করি শাহাদুজ্জামান তাহেরকেই বেছে নিয়ে থাকতে পারেন। শাহাদুজ্জামানের মানস-ঝোকটা এই উপন্যাসের মধ্যে বুঝতে খুব একটা সমস্যা হয় না। যদিও শাহাদুজ্জামান অধিকাংশ জায়গায় খুব নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করেছেন অথবা নির্লিপ্ততার ভান করেছেন। কারণ শাহাদুজ্জামান জানেন তিনি এক বিপজ্জনক ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন। তার এই ঝোকটা আরেকটা জায়গায় বুঝি যখন তিনি মুক্তিযুদ্ধকে তাহেরের মুখ দিয়ে বারবার জনযুদ্ধ বলার চেষ্টা করছেন। আমরা মুক্তিযুদ্ধের যে-মেইনস্ট্রিম ইতিহাস পাই সেই ইতিহাসের মধ্যে আপনারা কান পেতে থাকলে দেখবেন সাধারণ মানুষের কোলাহল ধ্বনি-প্রতিধ্বনি খুব কম পাওয়া যায়। যেন-বা এটা রাজ রাজড়াদের ইতিহাস, বড়দের ইতিহাস। বড়রা লিখেছে, এখানে সাধারণ মানুষের ফ্লেভারটা দেখবেন বরাবরই একটু কম। কিন্তু শাহাদুজ্জামান এবং তাঁর প্রতিনিধি তাহের এই বিষয়ে খুবই আগ্রহী এবং সচেতন। আমি ছোট্ট একটা উদ্ধৃতি দিতে চাই। যুদ্ধ হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে। সেখানে তাহের বলছেন, মনে রেখো মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে গণমানুষের যুদ্ধ, রাজা রাজড়াদের যুদ্ধ না। খুব স্পষ্ট কথা। এই ইতিহাস শাহাদুজ্জামান আকারে ইঙ্গিতে, ঠারেঠোরে নির্মাণ করার চেষ্টা করেছেন। এজন্যই তিনি তাহেরের ওপর ভর করেছেন বলে মনে হয়। আমরা এই উপন্যাসের মধ্যে ব্যাপকভাবে দেখব গেরিলাযুদ্ধের প্রতি শাহাদুজ্জামানের একটা বিশেষ আগ্রহ। কর্নেল তাহেরকে দিয়ে তিনি এই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। গেরিলাযুদ্ধ নিয়ে দেখবেন বাংলাদেশের খুব কম ঔপন্যাসিক, খুব কম সাহিত্যিক কথা বলেছেন। আমরা হুমায়ূন আহমেদকে দেখব গেরিলাযুদ্ধের প্রতি বিশেষ আগ্রহশীল হতে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক তাঁর খুব কম উপন্যাস পাওয়া যাবে যেটায় তিনি গেরিলাযুদ্ধের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেননি। শাহাদুজ্জামানও বাংলাদেশের সেই বিরল সাহিত্যিক যাঁর এইদিকে ব্যাপক আগ্রহ আছে বলেই মনে করি।

এতক্ষণ ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে কিছু কথা বলা গেল। এইবার আসা যাক ক্রাচের কর্নেল আসলে কী ধরনের রচনা সেই প্রসঙ্গে। আসলে কি এটা উপন্যাস নাকি ইতিহাসের বই? শাহাদুজ্জামান তাঁর বইয়ে বলেছেন, সাধারণভাবে দুই ধরনের ইতিহাসাশ্রিত উপন্যাস লক্ষ করি। এক ধরনের উপন্যাসে কালটি ঐতিহাসিক কিন্তু চরিত্রগুলো কাল্পনিক। আর দ্বিতীয় ধরনের উপন্যাস আছে কাল এবং চরিত্র দুইটাই বাস্তব। শাহাদুজ্জামান দাবি করছেন যে, আমার এই উপন্যাসটা দ্বিতীয় ধারার অর্থাৎ কাল এবং চরিত্র দুইটাই বাস্তব। এই জায়গায় আমি একটু কথা বলতে চাই। আসলে উপন্যাস তো বাস্তব না। উপন্যাস তো আর্ট পিস্। এটা বাস্তবের অনুকরণ। যখন বাস্তব কোনো শিল্পে-সাহিত্যে ঢোকে তখন তা আর বাস্তব থাকে না। ওইটা আসলে রূপান্তরিত হয়ে যায়। রূপান্তরিত হওয়ার কারণে ওই শিল্পে শিল্পীর নিজস্ব নানা চিন্তার অনুপ্রবেশ ঘটে। অমিতাভ রেজা চৌধুরী বাংলাদেশের অন্যতম চলচ্চিত্র নির্মাতা। তিনি সিনেমা বানান। তিনি নিশ্চয়ই আরও ভাল বলতে পারবেন। অমিতাভ যখন একটা উপন্যাস থেকে সিনেমা বানাতে যাবেন তখন সেটা সিনেমা হবে, উপন্যাস হবে না। ওইটা তখন হবে অমিতাভ রেজার সিনেমা; ঔপন্যাসিকের উপন্যাস নয়। ফলে আমি যখন উপন্যাস লিখছি তখন এটা আসলে বাস্তব না। এটা হল আমার কথা। ফলে ক্রাচের কর্নেল আমি পড়তে গিয়ে দেখি আসলে এটা এত বাস্তব যে, আমি উপন্যাস হিসেবে নিতে প্রায় হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলাম। শাহাদুজ্জামান যেসব বই থেকে বিচিত্র ধরনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন, যে-রেফারেন্সগুলো বইয়ের শেষে দিয়ে দিয়েছেন সেসবের অনেক বই আমার পড়া। আমি দেখেছি শাহাদুজ্জামান যথাসম্ভব বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করেছেন ওইসব উৎসের প্রতি। এত বিশ্বস্ত না থাকলেও পারতেন। এই অতি বিশ্বস্ততার কারণে ঔপন্যাসিক শাহাদুজ্জামানের তাহেরকে বের করতে অনেক কষ্ট হয়েছে। উৎস থেকে নেওয়া তাহেরকে হজম করতে তিনি নানাঘটনার জাল বিস্তার করেছেন। মাঝেমধ্যে ইতিহাসের বিচিত্র কাহিনির ডালপালার মাঝে ঢুকে গিয়েছেন এমনভাবে যে, কখনো সখনো আমার মনে হয়েছে তাহের কোথায় গেল! লেখক যদি তাহেরের প্রতি আরো কন্সেন্ট্রেশন দিতেন, কঙ্কালকাঠামোটা রেখে তাহেরকে শুধু যদি নির্মাণ করতে চাইতেন সেটা বোধ করি উপন্যাস এবং শাহাদুজ্জামান উভয়ের জন্যেই ভালো হতো। কারণ শাহাদুজ্জামান এই উপন্যাসে তো বোধ-বোধি আর বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রশ্নে অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী। যেমন উচ্চাকাঙ্ক্ষী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসে।

ক্রাচের কর্নেলে ঔপন্যাসিক ঈশ্বরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি যাকে যেভাবে ইচ্ছা পরিচালনা করেছেন। তাঁর অঙ্গুলি-হেলনে সব ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু উপন্যাসের মধ্যে আমরা দেখি ঔপন্যাসিকের ঔপন্যাসিকত্ব বেশ কম। তিনি সুযোগ যেন নিচ্ছেন আবার নিচ্ছেন না। হয়তো শাহাদুজ্জামানের উদ্দেশ্য এটাই ছিল।

চিলেকোঠার সেপাইয়ের প্রসঙ্গ কেন আসছে? এই জন্য আসছে যে, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের হিস্ট্রি নিয়েই উপন্যাসটা লেখা। কিন্তু আখতারুজ্জামান ইলিয়াস অনেকদূর পর্যন্ত স্বাধীনতা নিয়েছেন। ব্যক্তিগত অভিপ্রায় সম্পর্কে ইলিয়াস এত বেশি সচেতন ছিলেন, অভিপ্রায়কে এত বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন যে, তিনি আসলে ইতিহাসের পাঠটাই উল্টে দিতে পেরেছেন। সম্পূর্ণ উল্টে দিতে পেরেছেন। আমরা সাধারণ ইতিহাসে পাই যে, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ঘটেছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ছাত্র-শিক্ষকদের দ্বারা। বড় বড় লিডারদের দ্বারা। কিন্তু ইলিয়াস বলছেন, না এখানে হাড্ডি খিজির একজন নায়ক। ব্যঙ্গ করে মধ্যবিত্তকে বলছেন, আপনার নায়ক যায়া দেখেনগা চিলেকোঠার উপরে বসে আছে আর পর্ণ-পত্রিকা দেখতেছে। শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্নেলে এইরকম কোনো ঘটনা ঘটলে হয়ত এটি অধিকতর উপন্যাস হয়ে উঠত। কারণ এই সম্ভাবনার সব শর্তই ক্রাচের কর্নেলে এবং এর ঔপন্যাসিকের চৈতন্যে হাজির ছিল।

ক্রাচের কর্নেলে ঔপন্যাসিক ঈশ্বরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি যাকে যেভাবে ইচ্ছা পরিচালনা করেছেন। তাঁর অঙ্গুলি-হেলনে সব ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু উপন্যাসের মধ্যে আমরা দেখি ঔপন্যাসিকের ঔপন্যাসিকত্ব বেশ কম। তিনি সুযোগ যেন নিচ্ছেন আবার নিচ্ছেন না। হয়তো শাহাদুজ্জামানের উদ্দেশ্য এটাই ছিল। হতে পারে। কারণ তিনি বাংলাদেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ ছোটগল্পকার। একজন বড় মাপের আর্টিস্ট। তাঁর হাতে একটা চমৎকার ভাষা আছে; প্রায় অনন্য একটা ভাষা। ফলে তিনি কেন এই সুযোগটা নেবেন না। নেয়ারই কথা। হয়তো তিনি ঐ পথে যেতে চাননি। ডকুমেন্টেশন করতে চাইছেন।

এই মনোভঙ্গির প্রভাব পড়েছে ক্রাচের কর্নেলের ভাষায় এবং অন্যান্য জায়গায়। ওই ডকুমেন্টেশনের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার আগ্রহের কারণে ভাষায় মননশীলতার ছোঁয়া বেশি। ইতিহাসের গন্ধটা মাছের আঁশটে গন্ধের মতো গভীরভাবে লেগে আছে ভাষার গায়ে। উপন্যাসের ভাষা বিশেষ পরিস্থিতির চাপে বাস্তব থেকে ছিঁটকে বাইরে চলে যায়। বাইরে গিয়ে ভাষা ও বিষয়ের একটা নতুন রূপকল্প দাঁড়ায়। ভাষার একটা নতুন ধরন দাঁড়ায়; নতুন ধাঁচ দাঁড়ায়। সেই ধাঁচটা এই উপন্যাসের মধ্যে আমরা কম দেখি। অর্থাৎ সাধারণ ভাষা উপন্যাসের ভাষায় যে রূপান্তরিত হওয়ার একটা ব্যাপার আছে, কনভার্ট হওয়ার ব্যাপার আছে সেই কনভার্শনটা এই উপন্যাসের ভাষার মধ্যে আমরা কম লক্ষ করি। একইভাবে চরিত্রের কনভার্শনও কম হয়েছে; এক্সেপ্ট কর্নেল তাহের। তবে তাহেরের কনভার্শনটাও বেশ কম হয়েছে বলেই মনে হয়; খুব ক্ষীণ। কারণ কর্নেল তাহেরকে আঁকতে গিয়ে শাহাদুজ্জামান ডকুমেন্টেশনের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখিয়েছেন। একথা আগেও বলেছি। বিচিত্র সাক্ষাৎকার বা বিভিন্ন সোর্সের গুরুত্ব দিতে গিয়ে উপন্যাস নিজস্ব ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে অনেক জায়গায় সরে গিয়েছে। ফলে তাহেরের নির্মাণ কাজটা জায়গায় জায়গায় বালুচরে আটকে গেছে।

তাহেরের নির্মাণ যা-ও বা হয়েছে তা মূলত একাত্তরের আগের তাহেরের ক্ষেত্রে হয়েছে। এই নির্মাণে ঔপন্যাসিক উৎস হিসেবে বোধ করি তাহেরের পরিবারের সাক্ষাৎকার ও স্মৃতিচারণে বেশি ভর করেছেন। এই সাক্ষাৎকার ও স্মৃতি যারা দিয়েছেন ও চারণ করেছেন তাদের মধ্যেও সম্ভবত এক ধরনের নির্মাণপ্রক্রিয়া কাজ করেছে। ক্রাচের কর্নেল উপন্যাসে একাত্তরের আগের যে-তাহেরকে আমরা দেখি সেই তাহেরের কর্মকাণ্ড অনেক সময় বিশ্বাস ও বাস্তবের সীমারেখা অতিক্রম করে যায়। এইক্ষেত্রে একাত্তরের পরের তাহেরের মাহাত্ম্য আগের তাহেরের ওপর আরোপিত হয়ে থাকতে পারে। এটা দুই তরফে ঘটতে পারে; ঔপন্যাসিক ও পরিবার পরিজন উভয় তরফ থেকেই ঘটতে পারে। এটা আমার একটা হাইপোথিসিস। কারণ ইতিহাস তো আসলে অতীতের হয় না বর্তমানেরই হয়। কনটেম্পরারি হিস্ট্রিতে তাহেরের যে-মাহাত্ম্য তৈরি হয়েছে তাই আগের তাহেরের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে। একারণেই কি একাত্তরের আগের তাহের অধিক মেলোড্রামাটিক! একারণেই বোধ করি একাত্তরের পরের তাহের যতটা সজীব-সপ্রাণ আগের তাহের ততটা না। আসলে শাহাদুজ্জামান ক্রাচের কর্নেলকে যতটুকু উপন্যাস করতে চেয়েছেন ততটুকুই রূপান্তর হয়েছে তাহের ও তৎসংশ্লিষ্ট ইতিহাসের।

তবে একথা বলতেই হবে যে, উপন্যাসে শাহাদুজ্জামান যেসব জায়গায় ঔপন্যাসিকোচিত স্বাধীনতা নিয়েছেন সেসব জায়গায় তিনি বাঁশের কঞ্চির মতো অবাধ্য হয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠেছেন। এ-প্রসঙ্গে লক্ষ করা যেতে পারে উপন্যাসের না প্রেমিক না বিপ্লবী উপশিরোনামের অংশ। লুৎফা ও তাহের ইংল্যান্ডে হানিমুনে যাচ্ছে। ওই জায়গার বর্ণনা দেখে টের পাওয়া যায় এবং আফসোসও লাগেআহা! এই স্বাধীনতা যদি শাহাদুজ্জামান বিভিন্ন জায়গায় আরো নিতেন তাহলে কতই না ভালো হতো! তবে ইতিহাসকে বিচিত্র জায়গা থেকে নিয়ে তিনি যেই তাহেরকে নির্মাণ করলেন এবং এই উপন্যাসটা সাজালেনএই নির্মাণ এবং সজ্জার মধ্যে যে-ক্রাফটসম্যানশিপ দেখালেন তা অসাধারণ। ইতিহাস প্রায় অনুরূপ রেখে ক্রাফটসমানশিপের দিকে নজর দেয়া খুব কঠিন। এই ব্যাপারে বিশেষভাবে শাহাদুজ্জামানকেকে কৃতিত্ব দিতেই হবে।

 

নোট

লেখাটি সংবিৎ কর্তৃক আয়োজিত শাহাদুজ্জামানের বিহ্বল ও বৈচিত্র্যময় সাহিত্যকর্ম পর্যালোচনা শীর্ষক অনলাইন আলোচনায় আমার দেওয়া বক্তৃতার পরিমার্জিত ও সংক্ষিপ্ত রূপ। আলোচনা অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর শাহাদুজ্জামানের ৬১তম জন্মদিনকে উপলক্ষ্য করে। ওই অনুষ্ঠানে সহআলোচক হিসেবে ছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সায়েমা খাতুন ও ইংল্যান্ডের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক মো. ইলিয়াছ কামাল রিসাত। সংবিৎ-এর অনুষ্ঠানে দেওয়া আমার বক্তৃতাকে শ্রুতি থেকে লেখায় রূপান্তর করেছে রাজ্জাক রুবেলের গ্রন্থিক প্রকাশন। এই ফাঁকে রাজ্জাক রুবেল ও তাঁর প্রকাশনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাখলাম।