‘সামাজিক’ ও ‘অসামাজিক’ মাইকেল মধুসূদন দত্ত

অ+ অ-

 

হুমায়ুন আজাদ মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমালোচনা করতে গিয়ে তাঁর এক প্রবন্ধের শিরোনাম দিয়েছেন এমন: মাইকেল মধুসূদন: প্রথম বিশ্বভিখারি ও ত্রাতা। শিরোনামটি নানা কারণে তাৎপর্যময়, গুরুত্বপূর্ণ মধুসূদনের সাহিত্যকর্ম বিচার-বিবেচনায়। আর আজাদ এই প্রবন্ধের শুরুতেই সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা বিষয়ক একটি প্রবন্ধের কয়েক লাইন হুবুহু তুলে দিয়েছেন: বিশ্বের সেই আদিম উর্বরতা আর আর নেই। এখন সারা ব্রহ্মাণ্ড খুঁজে বীজ সংগ্রহ না করলে কাব্যের কল্পতরু জন্মায় না। কিন্তু এই লেখায় মধুসূদনের আলাপ হবে, আর তার শিরোনামে সামাজিকঅসামাজিক’—এই দুটি শব্দ ব্যবহার করা হলো। কেন? সাহিত্য শব্দের আভিধানিক অর্থ সহিত বা সাথে। কার সাথে? যে সাহিত্য করছে, ঐ সাহিত্যিকের যাপিত জীবনের নিরিখে, যে দেশ-কাল-সমাজ ও সময় প্রবহমান থাকে, তার সাথে। সাহিত্য এ ভিন্ন নির্মাণ করা একটি অলৌকিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যে দেশ-কাল-সমাজ থাকার পরও একটি অলৌকিক বিষয় রয়েছে এই যুক্তি দেখিয়ে তা খারিজ করেছে আধুনিক যুগ, এই যুগের কুশীলবরা। আর একটি বড়ো অভিযোগএই দুই আমলের সাহিত্যের প্রকরণ-কৌশল নিয়ে।

অর্থাৎ সমকাল-সচেতনতা আর আধুনিক সাহিত্য প্রকরণএই দুটি একত্রে মধ্যযুগের সাহিত্য থেকে আধুনিক সাহিত্যকে আলাদা করেছে। কিন্তু মধুসূদন তাঁর কাব্যজগতে প্রকরণের আধুনিকতা রক্ষা করেছেন; কিন্তু সমকাল কীভাবে এসেছে? আদৌ কি তাঁর সাহিত্য সমকাল-সচেতন? যতোটা সজাগ ও সচেতন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা।

১৮৫৬ সনে মধুসূদন বেশ কিছুদিন বিদেশ-যাপন শেষে দেশে ফিরে আসলেন। এর এক বছর পরেই মধুসূদনের চোখের সামনেই ঘটে গেল তৎকালীন ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড়ো বিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহ। কিন্তু এরপরেও এই বিষয় নিয়ে তাঁর ভেতরে কোনো ধরনের বিকার দেখা গেল না। তিনি নিশ্চুপ। যদিও সেই সময়ে তাঁর সাথে সাথে আরও অনেক বুদ্ধিজীবীও ছিলেন নিশ্চুপ। সেই সময়ে অনেকেই এই বিদ্রোহকে দেখেছিলেন নিছকই হাঙ্গামা হিসেবে। এতো বড়ো ঘটনা ঘটে গেল, কিন্তু এই ঘটনার প্রভাবিত করার ক্ষমতা মধুসূদনকে প্রভাবিত করতে পারলো না। কেন? এ এক আর জরুরি প্রশ্ন। উত্তরও পাওয়া যায়; কেউ কেউ দিয়েছেন আজব তরিকায়। সে সব এখানে জরুরি নয়। জরুরি আরো কিছু। তাৎক্ষণিক বিষয় সাহিত্যের উপাদান হয় না মানি; কিন্তু এতো বড়ো প্রতিভার দ্বারা এক কলমও লেখা হবে না, তা মেনে নেওয়া বেশ কষ্টের। মধুসূদন যে সময়ে তাঁর জীবন যাপন করছেন সে আমলে কেবল সিপাহি বিদ্রোহ নয়, আরও অনেক সামাজিক পট-পরিবর্তনের উদাহরণ দেওয়া যাবে। এখানে একটি উদাহরণই দেওয়া হলো। কিন্তু পূর্বের কথাই আবার বলতে হচ্ছে: তাঁর ভেতরে কোনো ধরনের বিকার দেখা গেল না।

মধুসূদনের জীবন যেচে দেখা যায় যে, তিনি আশৈশব পাশ্চাত্যের প্রতি এক দুর্মর আকাঙ্ক্ষা পুষে রেখেছিলেন। বাংলা ভাষার বড়ো কবি না, তিনি হতে চেয়েছিলেন ইংরেজি ভাষার বড়ো কবি। তা হওয়ার জন্য করেননি এমন তো কিছু ছিল না। সাগরমন্থন, করে দিগ্বিদিক ঘুরে-ফিরে কবিতার মাল-মশলা তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অবাধ পুজো করেছেন। কিন্তু এই ব্যাপারটি [ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য] যে সামষ্টিক মানুষের যাপিত জীবনের ভেতর দিয়েই ব্যক্তি তৈরি করে, মধুসূদনের মতো এতো বড়ো মহৎ প্রতিভা কি তা ঠাহর করতে পারেননি? এছাড়া মধুসূদনদের যুগটাই আদতে রোমান্টিক সাহিত্য করার যুগ নয়। পরিপ্রেক্ষিতের সমস্ত সাক্ষ্য-সাবুদ তো এটাই প্রমাণ করে। আর এই যুগেই মধুসূদন আধুনিক হয়ে গেলেন! ঘোড়ার আগে গাড়ি চলে গেল যে!

কথা বেড়ে যাচ্ছে। আমরা সামাজিক আর অসামাজিক মাইকেল মধুসূদন দত্তকে খুঁজতে চেষ্টা করছি, সমকালের প্রসঙ্গে। সমকালের প্রশ্নে, পূর্বের উদাহরণে, কবিতায় মধুসূদন চূড়ান্তভাবে অসামাজিক। মধুসূদনের কবিতার ব্যাপারে যে আধুনিকতার ধুয়ো তোলা হয়, সেই ধুয়োর শক্তির জায়গা হলো, অধিকাংশ সমালোচকের মতে, মধুসূদন বাংলা কবিতার ফর্মের কিছু পরিবর্তন করেছেন। এ ভিন্ন মধুসূদন আর যা করেছেন, তা হলো, এই অঞ্চলের ক্লাসিক সাহিত্যের ভান্ডার ছেনে-কুঁদে তার কাহিনি নিয়ে নতুন করে সাজিয়েছেন। মানে রিভার্স করেছেন। আমি যে সময়ে এসে এই কথা বলছি, এখন বিষয়টি সহজ সরল, মানে চিন্তার বেলায়, কিন্তু তখন তো আর বিষয়টি এমনতরো সহজ বিষয় ছিল না। কবিতার সময় ও সমাজের বিষয়টি যদি আরো নানাভাবে বিবেচনা করা হয়, সে ক্ষেত্রেও মধুসূদনের চেয়ে বহুলাংশে গুরুত্বপূর্ণ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। নানা ক্রাইটেরিয়ার দড়ি বেঁধে গুপ্তকে আধুনিকতার বাইরে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার একটি বড়ো প্রয়াস সবসময়ই আমাদের সমালোচনা-সাহিত্যে চোখে পড়ে। কিন্তু অল্পস্বল্প ভাবনায়ই এই বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সামাজিক-অসামাজিক প্রসঙ্গ উঠলেই মধুসূদনের চেয়ে, কবিতার বেলায়, বেশি সামাজিক ঈশ্বর গুপ্ত।

ইংরেজ শাসনের প্রথমভাগেই এই কবির উদ্ভব ও বিকাশ; বিলুপ্তিও এই সময়কালে। সিপাহী বিদ্রোহের আগে-পাছে যে সময়, তার প্রায় পুরোটাই ঈশ্বর গুপ্ত নিজের জীবন-মানসের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে নিয়ে নিজের শব্দের কারিগরি বিদ্যায় কবিতা করে তুলেছেন। কিন্তু এর বিপরীতে প্রাচীন ও মধ্যযুগের দেশজ কবিতা-সাহিত্যের নিন্দে করে মধুসূদনরা যে সাহিত্যান্দোলনের যাত্রা শুরু করলেন, তা অনেকাংশেই মেকি হয়ে রইল।

কেবলই ক্লাসিক বিষয়-ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে মধুসূদন তৈরি করলেন অনুকরণে আর অনুসরণে নির্মিত, নামে আধুনিক, আর অসত্য আর অবাস্তব সক্রিয়তায় রোমান্টিক সাহিত্য। মধুসূদন যে কাব্যের জন্য বিখ্যাত, মেঘনাদবধ কাব্য, তার বিষয় ক্লাসিক সাহিত্য-নির্ভরতায় তৈরি। পুরোটাই। সিপাহী বিদ্রোহের শহীদদের রক্তের দাগ শুকোনোর আগেই তিনি এই কাব্য লিখলেন। যদিও সামাজিক স্তরবিন্যাসের হিসেবে এই কাব্যের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত প্রায় নেই। কারণ সামন্ত-সমাজ বিলীয়মান। কিন্তু ১৭৯৩-এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সামন্ত-সমাজকে নিয়েছে নতুন অবস্থানে। পুঁজি আর কৃষির দ্বৈত প্রযোজনায় চালু রয়েছে বাংলার অর্থনীতি। এই হিসেবে এই মহাকাব্যের প্রতি সামাজিক সমর্থন একেবারেই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া চলে না।

এই মহাকাব্য সম্পর্কে মধুসূদনের নিজেরও কিছু কথা ছিল। এই কাব্যের রস-উদ্যাপন, পুরাণ-প্রসঙ্গ, গ্রেকো-রোমান ক্লাাসিক সাহিত্যের প্রভাব আর ভাষাএইসব কিছুই যে সমকালকে ছুঁয়ে যেতে পারেনি, তা কাব্য-পাঠ আর কাব্যের বিষয়-অনুসন্ধানে স্পষ্ট হয়। তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য আর বীরাঙ্গনা কাব্যও এই বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু এইসব কাব্যে কিছুই নেই তা বলা একেবারেই উচিত হবে না। নতুন সময় হয়তোবা নেই, কিন্তু পশ্চিম-প্রভাবিত সাহিত্য-প্রকরণ দারুণভাবেই আছে। আর তাতেই তৎকালীন পশ্চিম-প্রভাবিত একটি খণ্ডিত শ্রেণির কাছে মধুসূদন কাব্যি করে বিশেষ হয়েছেন।

ব্যক্তি-অনুভূতির প্রসঙ্গ আসলেই মধুসূদনের সনেট-প্রকল্পের কথাই সবার আগে মনে পড়ে। এই বিষয় সবচেয়ে ভালো করে আছে চতুর্দশপদী কবিতাবলীতে। আধুনিক কবিতার সংজ্ঞায় যা যা থাকা দরকার, তার অনেকাংশই পুরা করেছে এই সনেটকল্প। এবং এই সনেটকল্পে এমন কয়েকটি কবিতা আছে, যা বাংলা অঞ্চলের ভৌগোলিক বিষয়াদি আর বাংলা ভাষার মাহত্ম্যকীর্তন নিয়ে লেখা। তবুও এই কথা বলতে হয়, সামগ্রিকভাবে মধুসূদনের কবিসত্তায় আষ্টেপিষ্টে মিশে আছে পশ্চিমের কবি আর কবিতার জমিন, জমিনে ফলানো কবিতা-ফসলের আকাঁড়া প্রভাব। যা কাটিয়ে উঠতে পারেননি কবি, কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত; যাঁর কবিতা পড়তে গিয়ে কেবলই মনে প্রশ্ন জাগেতিনি কতোটুকু বিশ্বভিখারি আর কতোটুকুইবা ত্রাতা। বাংলা কবিতার ত্রাতা হিসেবে তিনি কতোটুকু করেছেন, তা প্রশ্নের চিহ্নে রয়ে যায়; কিন্তু বিশ্বভিখারী হিসেবে মধুসূদন সার্থক।

এই কবিতা-যাত্রা বাদে মধুসূদনের অন্যান্য সাহিত্যকর্ম অনেকাংশেই সামাজিক, সমাজের নানা বিষয় নিয়ে লেখা, সম্পৃক্তও বটে। উনিশ শতকে কলকাতায় নাটকের উদ্ভব ও বিকাশের একটি বাণিজ্যিক ধারণা ছিলই। সেই ধারার সাথেই মধুসূদনের মিশে যেতে হয়েছে। ইংরেজ নাটকের ইতিহাস এই বাণিজ্যিকরণের প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করে না। ফলে তাঁর চারপাশে ঘটে যাওয়া নানান বিষয়-আশয় নিয়েই মধুসূদনের নাটক লিখতে হয়েছে; এক্ষেত্রে অবশ্য তিনি পারদর্শিতাও দেখিয়েছেন। তাঁর প্রহসন এই ধারার সবচেয়ে ভালো উদহারণ হবে। কিন্তু নাটক লিখতে গিয়েও বিষয় হিসেবে পুরাণ আর পুরোনো সংস্কৃত নাট্যরীতি তাঁকে বেশ ভালোভাবেই প্রভাবিত করেছে। ফলে এই ধারায়ও কবিতার মতো ক্লাসিক সাহিত্যের বিষয়-আশয় নিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন। ইংরেজিতে লেখা সাহিত্যে, অনুবাদে আর প্রবন্ধেও মাইকেল মধুসূদন সামাজিক আর অসামাজিকদুই ধারায়ই লিখেছেন।

অর্থাৎ, শেষে এই কথা বলা প্রয়োজন, কেবল আবেগ দিয়ে নয়, কিংবা প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য-পাঠের বিবেচনায়, মধুসূদনকে সামাজিক বা আধুনিক বলায় বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর সার্থকতা আছে। দেশ-কাল-সমাজের অন্তর্গত ও বহিরাগত প্রভাবে, এবং এরই সৃষ্ট বাস্তবতা অনেকক্ষেত্রেই সাহিত্যে বজায় রাখতে পারেননি মধুসূদন। ওপরের আলাপে তাই স্পষ্ট হলো। এই দোষ কেবল মধুসূদনের একার নয়। উনিশ শতকের ভাব-সংঘাত আর সমন্বয়মধুসূদনের ভেতরে এমন একটি সাহিত্য-মানস তৈরিতে বড়ো ভূমিকা পালন করেছিল। যা এই যুগে এড়িয়ে যাওয়া গেলেও ঐ যুগে এড়ানো সম্ভব হয়নি।