পথপাশে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ
কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের সাথে প্রথম কবে দেখা হয়েছিল আজ আর মনে নেই। ১৯৯২-৯৩-এর কোনো এক সময়ে শাহবাগে তাকে দেখেছিলাম। আর তার আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তাঁকে দেখেছি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে। তাও অনেক অনেক দিন আগে; আশির দশকে, যখন পড়তাম স্কুলে। তখন জানতাম না তাঁর কবিতার খোঁজ। আমার তরূণ কবি বন্ধুদের সাথে পরিচয়ের পর থেকে মান্নান সৈয়দের কবিতার সাথে এক ঝলক, দু-ঝলক দেখা হতে লাগল। জানি না কেন তাঁর কবিতা পড়বার পর মনে এক ধরনের নির্লিপ্তির অনুভূতি হতো, জিভে স্বাদহীন স্বাদ—খুব স্পষ্ট কিছু নয়, দূরের পথের আবছা কুয়াশার মধ্যে অবগাহন। হয়তো কবির দেখবার চোখ ছিল যেমন নৈর্ব্যক্তিক, একটা অচেনা মাছের মতো বর্ণনাতীত, কবিতায়ও তিনি সে আগন্তুককে দেখবার প্রায় কাছাকাছি ভাবে প্রকাশ করতেন।
এই সিম্বলিস্ট উপস্থাপনা, ইমাজিনেটিভ ভাষা তাকে করে তুলেছে স্বতন্ত্র। যে কবি হতে চান সন্ধ্যা অথচ তখনও রয়ে যান অনাগত, আমাদের কল্পনার পৃথিবীর দ্রষ্টা হয়ে যেতে থাকেন মাইলের পর মাইল এবং কোথাও না যেয়ে। এই পরিভ্রমণ কাঁচা মাংসের ভূতে লুকোনো একটি আলপিন জ্যোৎস্নার মতো বিঁধে ফেলে কবিকে আর তিনি মানিক ফেলে কানাকড়ি কুড়োতে শুরু করেন, পেতে চান শিল্প থেকে আলাদা হওয়ার শ্রী-রুচি-সাহস। মান্নান সৈয়দ আমার কাছে প্রায় পুরোটাই একজন নাগরিক কবি, যে কবির শহরে আলো জ্বালিয়ে অনবরত হ্রেষা ঝেড়ে এঁকেবেঁকে আস্তে আস্তে চলছে গাড়িগুলেঅ, কুয়াশায় ইশারার মতো ঝরে পড়ছে হীরের চোখ। কবি এবং আগন্তুক দুজন চলে এসেছেন হাঁটতে হাঁটতে বহুদূরে যেখানে পায়রারা ছড়িয়ে ছড়িয়ে থাকে স্বপ্নের সিংহ দরোজায়।
আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের সম্পাদিত পত্রিকা আবহমানের প্রকাশনা অনুষ্ঠান। অনেকটা প্রস্তুতিহীনভাবেই চলে গেলাম। সাহিত্য সভা, অনুষ্ঠান আমাকে কখনো টানে না, বরং একটু অস্বস্তি হতে থাকে যখন কোনো কবি চিৎকার করে কথা বলতে থাকেন। কিন্তু স্যারের সাথে বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রিক যোগাযোগের কারণে এক ধরনের টান বোধ করলাম। অনুষ্ঠানে অনেকেই ছিলেন; কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি চঞ্চল আশরাফ, কথা সাহিত্যিক আব্দুস শাকুর, গল্পকার আহমেদ মোস্তফা কামাল, কবি অসীম সাহা প্রমুখ। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে চা খাওয়ার সময় দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে মান্নান সৈয়দ মৃদু হাসছেন, চোখে বহু দিনের পরিচিতর ছাপ। কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, কেমন অছেন মান্নান ভাই? তিনি সেদিন ছিলেন ক্লিন সেভড, ছাই রঙের কোট পড়া। শীতের রাত। বললেন আমি ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন? এখন আর শাহবাগে যান না? দেখি না কখনো।
বললাম, খুব কম যাই, আপনি? মান্নান ভাই জানালেন এখন আগের মতো হুটহাট কোথাও যাওয়া সম্ভব হয় না। বললেন আপনাকে আগে দেখতাম খুব আত্মমগ্ন হয়ে রাস্তা দিয়ে চলেছেন। আমি খুব অবাক হয়ে বললাম, আপনি তা লক্ষ্য করেছেন? কেন করব না? যা লক্ষ্যণীয় তা তো লক্ষ্য করতেই হবে। ওই দিন শীতের সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে মান্নান ভাইয়ের মধ্যকার তরুণ মানুষটির সাথে দেখা হল। এর পর মাঝে মাঝে কবিকে দেখতাম রিকশায় যাচ্ছেন। সব সময় একা। শাহবাগেও কয়েক বার দেখা হল। তিনি চায়ের দোকানের পাশে একা দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন। আবার কখনো কখনো আজিজ সুপার মার্কেটের সামনের ফুটপাতে বসে আছেন, পাশে তরুণ কবিরা। মান্নান ভাই তরুণদের পছন্দ করতেন, এটা তাঁর কথায় বোঝা যেত। যে কবি গোলাপ ফুলে কাঁটার উপর চড়ে বসেন তার যন্ত্রণা তো একজন ঝঞ্ঝারত কবির সাথেই তুলনীয়। তিনি চাইতেন কবিতা থাকুক অবিন্যস্ত, কর্দমাক্ত, কবিতার চোয়ালকে ব্লেডে ছেঁটে না দিয়ে তাকে একজন তরুণের মতো রূক্ষ দেখতে তিনি পছন্দ করতেন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ © ছবি: ফয়জুল লতিফ চৌধুরী
২
২০১০। জুলাই। মোহাম্মদপুরের অফিস থেকে শংকরে আম্মার বাসায় যাচ্ছিলাম, ওই দিন মন খুব বিধ্বস্ত ছিল। একটা হাল ভাঙা নৌকার মতো স্রোতের মধ্যে ছুটে চলছিলাম। ফিজিক্যাল কলেজের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বামে চোখ চলে গেল। একটা বেসরকারি হাসপাতাল। তার সামনের ফুটপাতে বসে আছেন মান্নান ভাই। মাথায় ক্যাপ। হঠাৎ কিছু না ভেবেই নেমে গেলাম রিকশা থেকে। মান্নান ভাই পথ পাশের ফুটপাতে বসে আছেন, একটা চেক শার্ট, মাফলার গলায়, খুব হেসে হেসে কারো সাথে মোবাইলে কথা বলছেন। আমি কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষায়। তিনি আমাকে দেখতে পেয়ে ইঙ্গিত করলেন অপেক্ষা করতে। বললেন আপনি কিছুক্ষণ থাকবেন তো? আমি হ্যাঁ বলাতে বললেন তাহলে কথাটা শেষ করে দেই। প্রথমেই ফুটপাতের চায়ের দোকানে নিয়ে গেলেন। চা চলবে তো? হুম। তারপর বলেন কি খবর? কিন্তু আমি আপনার নাম মনে করতে পারছি না। আমার নাম ভুলে গেছেন? কিন্তু কেউ তো ভোলে না। না বলেন, আমার ইদানিং এমন হচ্ছে। নভেরা। ওহ! দেখেন এখন কেমন মনে পড়ে গেল। মানান ভাই ওই দিন অনেক কথা বললেন। শরীর খুব খারাপ, জ্বরও ছিল। বললাম এর মধ্যে বাইরে বসে আছেন?
বললেন এর মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। তাই তো বলি কোনো বিশেষ বিষয়। তিনি মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে বললেন, সব কথা বলে দিলে তো আর কোনো রহস্য থাকবে না। আমি বললাম কেন রহস্য না তাকলে চলবে না জীবনে? তিনি আমার কথা শুনে জোড়ে জোড়ে হাসতে শুরু করলেন। বললাম আপনার অভিনয় দেখলাম নাটকে। মনে হল চরিত্রটা আপনার ট্রু কপি। তিনি আবারও হাসতে লাগলেন। বললেন জানেন আমি কিন্তু কবি হতে চাইনি, অভিনেতা হতে চেয়েছিলাম, আপনাকে একটা গোপন তথ্য ফাঁস করে দিলাম। মান্নান ভাইকে ওই দিন কথায় পেয়ে বসেছিল। বলে চলেন¬...আমার কাছে কোন বিষয়টা খুব ইমপর্টেন্ট হয়ে দেখা দেয় জানেন, এই যে বাংলা ভাগ হয়ে গেল। দুই ভাগ হয়ে গেল। আমরা তো ওদিক থেকেই এখানে আসলাম। কম কষ্ট আমাদের হয় নাই কিন্তু দেখবেন কখনো বলা হবে না এই কথা।
কেউ লিখবে না এখানে যারা এলো তাদের যুদ্ধটা। আপনারা তরুণরা তো কিছুই জানেন না। প্রতিটি রক্ত বিন্দুকে তৈরি করা হয়েছে। এর মূল্য কোথায়? এক সময়ে এই বিভাজন নিয়ে কথা বলা হতো এখন বলা হয় না। আর বলা হবেও না। কে বলবে? আমারা যারা প্রত্যক্ষ করেছি তারা তো সত্য স্টোরিটা জানি... তারাই নিশ্চুপ হয়ে গেছি। চা খাওয়ার সময ধূসর রঙের পাঞ্জাবি-পায়জামা পড়া, চোখে সুরমা দেযা, টুপি পড়া এক ভদ্রলোক কবির সামনে এসে দাঁড়ালেন, স্যার আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি? মান্নান ভাই বললেন, আরেকদিন বলি। ভদ্রলোক বললেন না শুধু একটা প্রশ্ন করেই চলে যাব।
আপনার কবিতায় নজরুলের প্রভাব দেখা যায়-কোনো একটা কবিতায় বিশেষ করে। কথাটা কি সত্যি? মান্নান ভাই হেসে এড়িয়ে যেতে চাইলেন—এটা তো জনপ্রিয় প্রশ্ন। আপনার অন্য কোনো প্রশ্ন থাকলে করেন, না হলে আজ বিদায়, পরে কখনো... ভদ্রলোক নাছোড়বান্দার মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন এবং চায়ের দাম দিতে চাইলেন, কিন্তু মান্নান ভাই তাকে বিরত করলেন। এর পর কবি বলে চললেন... লেখকদের প্রবাসী হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে। তিনি বললেন, লেখকরা, কবিরা যারা চলে যান এটা একরকম আত্ম-বিক্রি। নিজের আত্মাকে বিক্রি। প্রবাসে বসে ভিন্ন একটা জীবন, ভিন্ন একটা বাস্তবতায় দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণীর মর্যাদা নিয়ে বসবাস করার মধ্যে বশ্যতা স্বীকার করা ছাড়া আর কিছু নাই। আমি বললাম, কেন লেখকদেরতো কোনো দেশ, কাল নাই। তারা তো এসবের উর্ধ্বে। কবি বললেন, হ্যাঁ, একজন কবি বর্ডার লাইনের উর্ধ্বে। নিজেকে তেমন ভাবতে না পারলে সে তো লেখক হতে পারবে না। কিন্তু ব্যক্তিগত, বস্তুগত সুখ সুবিধার জন্য প্রবাসে সারা জীবন কাটিয়ে দেয়া, অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করা, নিজের দেশের মানুষের সুখ-দুঃখ থেকে দূরে বাস করার মধ্যে ব্যক্তিগত পাওয়া ছাড়া আর কিছু নাই।
কবি, লেখকরা নিজ জাতি, ভাষার জন্য কাজ করবে এরকমটা সব দেশের লেখক, কবিদের মধ্যেই রয়েছে। বরঞ্চ দেখেন যারা নিজ দেশ হতে বিতারিত হন সেই সব লেখক, কবিদের যন্ত্রণা কত ভয়াবহ হয়ে দেখা দেয়। নিজ সংস্কৃতি, সাহিত্য থেকে উপাদান সংগ্রহ করার আগ্রহ এখন অনেক কমে গেছে, আগের সাহিত্য পাঠ করা হয় না একেবারেই। তিনি আরো বললেন, আপনারা যারা নতুন লিখছেন তাদের অনেক কিছু জানা দরকার, নিজের দেশ, সংস্কৃতি, সাহিত্য... আপনারা তো অনেক কিছু জানেন না... এরপর আরো ঝাপসা হয়ে যাবে সব। জানতে চাইলাম এখন বাইরে আসেন প্রায়ই? তিনি বললেন, না না একেবারেই না। শরীর খুব খারাপ। মেয়ে বার বার ফোন করছে দেখছেন না? আমাকে বাইরে আসতেই দেয় না। এখন কথা বলতে পারি না অতো… দম থাকে না।
আনার সাথে অনেক দিন পর দেখা হলো। এখন এমন সময় আড্ডা দেয়া কঠিন। হবে না। শরীর খুব ভাল নাই। কিন্তু আপনি ভাল থাকবেন, লিখবেন। আরো অনেক কথাই বলেছিলেন সেদিন কবি মান্নান সৈয়দ, একজন বন্ধুর মতো, নিরাভরন, সাদাসিধে, একজন কবির সংবেদনশীলতার পুরোটাই ছিল তার কন্ঠে। তখন ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি ওই দিনটি ছিল কবির সাথে আমার শেষ দেখা। কবি পিয়াস মজিদ সন্ধ্যায় ফোন করে জানাল কবির শরীর খুব খারাপ, হয়তো নেই, আমি ওখানেই যাচ্ছি। তখনই টিভির স্ক্রিনে ভেসে উঠল... কবি চলে গেছেন... যত রাত বাড়তে লাগল একটা পরাবাস্তব অনুভূতি ছেকে ধরল মনকে। শহরে আগত একটা অচেনা মাছের চোখ সারারাত তাকিয়ে থাকল জানালার সার্শি গলে। বর্ণহীন কাচ চুইয়ে রাতের কালো রঙ প্রবেশ করতে থাকল মাথার মধ্যে। ছোট ছোট ফড়িং সব ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তার লাইটপোস্টের চারপাশে, ঝিম ধরা একটা রাত্রি। এই রকম সব রাত্রিতেই তৈরি হয় কবিতারা, টুকরো টুকরো মৃত্যু দিয়ে তৈরি সেসব শব্দের খেলা বিঁধে থাকে মস্তিষ্কের গোপন কুঠুরিতে।
কবি মান্নান সৈয়দের বিচ্ছেদ কবিতায় জারিনার এরোপ্লেন চোখের কোমলতা ভেদ করে চলে যায় আর সমস্ত আকাশ ব্যেপে ফেরেশতারা হাসতে থাকেন। কবিতায় লৌকিক জীবনের অনুষঙ্গের এমন লেপটে থাকা তাঁর কবিতাতে খুব স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে। কবিতাটির দ্বিতীয় অংশে ‘পড়ে থাকে বিশদ বরফ’—বাক্যটি পড়বার পর মেরু অঞ্চলের তুহিন হাওয়া বয়ে যায গোলাপী আত্মা ভেদ করে। এ শুধুই পরিভ্রমণ প্রেম থেকে মাৎসর্যে, আলো থেকে আলোকবর্ষে, শরীর থেকে অ-শরীরে। কবি মান্নান সৈয়দের কবি সত্তা তরমুজের ফালির মতো কেটে নেয় প্রকৃতি, মানুষ, নগর, যান্ত্রিকতাকে। আমরা যখন পাঠ করি তাঁর কবিতা, সেখান থেকে কোনো রক্তের স্রোতধারা টের পাই না। ঝিরঝিরে তুষার সব ঝরতে থাকে শিশুর চোখ হতে আর আমরাও হয়ে পড়ি বুড়ো ফোয়ারার মতো দ্রষ্টা। কবি তাঁর দেখবার চোখ দুটো খুলে দেন আমাদের দেখবার জন্য আর তাঁর মন তাও ঢুকে পড়ে পঞ্জরাস্থিতে। দেখতে থাকি শহরে এক অচেনা মাছ সন্তরণরত; ধোঁয়ার সমুদ্রে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন