লেশেক কোলাকোওস্কির ‘ঈশ্বর কি সুখী?’

অ+ অ-

 

লেশেক কোলাকোওস্কি

লেশেক কোলাকোওস্কি (১৯২৭-২০০৯) একজন পোলিশ দার্শনিক ও তাত্ত্বিক। মার্ক্সবাদ এবং কমিউনিস্ট সরকারের সমালোচনার কারণে ১৯৬৮ সালে পোল্যান্ড থেকে নির্বাসিত হন। পরবতী জীবনের বেশির ভাগই অক্সফোর্ডে অধ্যাপনায় অতিবাহিত করেন। তবে নির্বাসনে থাকা অবস্থায়ও লেশেক কোয়াকোওস্কি পোল্যান্ডের বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলনকে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেন। তার উল্লেখযোগ্য বইইজ গড হ্যাপি, দ্য প্রেজেন্টস অফ মিথ, দ্য অ্যালিয়েনেশান অফ রিজন, মেইন কারেন্টস অফ মার্কসিজম, মার্কসিজম এন্ড বিয়োন্ড, হোয়াই ইজ দেয়ার সামথিং রাদার দ্যান নাথিং? ও মর্ডানিটি অন এন্ডলেস ট্রাইল। ২০০৯ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 

লেশেক কোলাকোওস্কির ঈশ্বর কি সুখী? || অনুবাদ: অরিত্র আহমেদ

 

সিদ্ধার্থ, অর্থাৎ বুদ্ধের প্রথম জীবনী থেকে আমরা জানতে পারি যে, এই পৃথিবীতে মানবজাতির হীন অবস্থা সম্পর্কে সিদ্ধার্থ দীর্ঘকাল সম্পূর্ণ অনবগত ছিলেন। রাজপুত্র হিসেবে, পার্থিব আনন্দ-ফূর্তি আর গান-বাজনায় পরিবেষ্টিত থেকে, তিনি সুখ-শান্তি ও বিলাস-বৈভবের মধ্যেই যৌবন অতিবাহিত করেন। দেবতারা তাকে আলোক-প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই তিনি তাঁর বিয়েশাদী সেরে ফেলেছিলেন। একদিন তিনি এক থুত্থুড়ে বুড়ো মানুষকে দেখলেন, তারপর দেখলেন এক মুমূর্ষু ব্যক্তির যন্ত্রণাভোগ, আর তারপর দেখলেন একটা লাশ। আর ঠিক তখনই, জীবনের পীড়াদায়ক যে দিকগুলো এতোকাল তাঁর চোখে ধরা দেয়নি, সেই বার্ধক্য, যন্ত্রণা ও মৃত্যুর অস্তিত্ব সম্পর্কে তিনি সচেতন হলেন। এবং পৃথিবী থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে তিনি সন্ন্যাসী হওয়ার ও নির্বাণের পথ খোঁজার সিদ্ধান্ত নিলেন।

আমাদের মনে হতে পারে যে, জীবনের সমূহ কর্কশ বাস্তবতা যতদিন তাঁর অজানা ছিলো, ততদিন তিনি সুখী ছিলেন; এবং জীবনের শেষ বেলায়, এক দীর্ঘ ও কষ্টসাধ্য পর্যটনের শেষে, সন্ধান পেয়েছিলেন পার্থিব অবস্থার অতীত এক সত্যিকার সুখের।

নির্বাণকে কি সুখ বলা যেতে পারে? এই নিবন্ধের লেখকের মতো যারা বৌদ্ধধর্মের আদি গ্রন্থগুলো মূল ভাষায় পড়তে পারেননি, তাদের পক্ষে আসলে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়: ওই গ্রন্থগুলোর অনুবাদে সুখ শব্দটি কোথাও পাওয়া যায় না। চৈতন্য কিংবা আত্মসত্তার মতো শব্দগুলো আধুনিক যুগের ভাষায় যে অর্থ বহন করে, সেই যুগেও সেই অর্থই বহন করতো কিনা, এ ব্যাপারেও নিশ্চিত হওয়া খুবই কঠিন। তবে, হতে পারে যে, পোলিশ দার্শনিক হেনরিক এলজেনবার্গ যেমন বলেছেন, এমন এক ধরনের সুখ আছে, যেটা কোনো কর্তাসত্তার উপর নির্ভরশীল নয় (happiness without a subject)-এক নিরেট সুখ, খাঁটি সুখ, কারো সুখী হওয়া বা না হওয়ার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। শুনতে অদ্ভুত লাগে। কিন্তু আমাদের ভাষা আসলে পরম বাস্তবতাকে বর্ণনা করার জন্য কখনোই যথেষ্ট নয়।

কোনো কোনো ধর্মতত্ত্ববিদের মতে, আমরা ঈশ্বরকে বর্ণনা করতে পারি কেবল অস্বীকৃতির (negation) মাধ্যমে: অর্থাৎ, তিনি কী, সেটা না বলে, তিনি কী নন, সেটা বলার মাধ্যমেই তাকে বর্ণনা করা সম্ভব। একইভাবে, নির্বাণ কী, সেটা হয়তো আমরা জানতে পারি না; আমরা শুধু বলতে পারি নির্বাণ কী নয়। কিন্তু কেবল অস্বীকৃতি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা কঠিন, এবং আমরা চাই আরো অনেক দূর যেতে। সুতরাং, নির্বাণ সম্পর্কে কিছু বলার অনুমতি পেয়েছি ধরে নিয়ে, আমরা বলবো যে, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন হচ্ছে: নির্বাণপ্রাপ্ত অবস্থায় একজন মানুষ কি তার চারপাশের জগৎ সম্পর্কে সচেতন থাকেন? যদি না থাকেনযদি পৃথিবীর এই জীবন থেকে তিনি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যানতাহলে তখন তিনি ঠিক কোন বাস্তবতার অংশীদার হন? আর যদি তিনি আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন না হন, সে ক্ষেত্রে এই জগতের অশুভ এবং যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট সম্পর্কে তিনি নির্বাণপ্রাপ্ত অবস্থায়ও সম্পূর্ণ সচেতন থাকবেন। কিন্তু, সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, একই সঙ্গে অশুভ ও দুঃখ-কষ্টের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত থাকা এবং নিখুঁতভাবে সুখী হওয়া কি তবে সম্ভব? 

এই একই প্রশ্ন ওঠে খ্রিস্টীয় স্বর্গের সুখী অধিবাসীদের ক্ষেত্রেও। ওই স্বর্গবাসীরা কি আমাদের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন? যদি তারা তা না হন- অর্থাৎ পার্থিব অস্তিত্বের হীনতা, পৃথিবীতে ঘটে চলা বিবিধ বিভীষিকা, পৃথিবীর বিভিন্ন নারকীয় দিক, এবং যাবতীয় অশুভ, যন্ত্রণা আর ভোগান্তি থেকে তারা যদি বিচ্ছিন্ন না হন, তাহলে সুখী হওয়া বলতে আমরা যেটা বুঝি, তারা সেটা হন কিভাবে? 

(এটা পরিস্কার করে বলে দেওয়া ভালো যে, সুখী (happy) হওয়া বলতে আমি এখানে মামুলি ধরনের কোনো খুশি হওয়া' কিংবা সন্তুষ্ট হওয়া' বোঝাচ্ছি না। অ্যারোপ্লেনে এই সিটটা পেয়ে কি আপনি খুশি? কিংবা এই স্যান্ডউইচ পেয়ে আমি খুব খুশি'- এই ধরনের কোনো খুশি হওয়া বা সুখী হওয়া এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। ইংরেজি হ্যাপি শব্দটার অর্থ অনেক ব্যাপক হলেও অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় শব্দটার অর্থ তুলনামূলকভাবে সংকীর্ণ। এই কারণেই একটা জার্মান প্রবাদ আছে যে, I am happy, aber glucklich bin ich nicht ( আমি খুশি ঠিকই, কিন্তু সুখী আমি নই)।)

বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টানউভয় ধর্মই আমাদেরকে বলছে যে, আত্মার পরম মুক্তির অর্থ হলো নিখুঁত প্রশান্তি: অর্থাৎ, আত্মার পরিপূর্ণ শান্তি। এবং এই নিখুঁত প্রশান্তি আসলে নিখুঁত অপরিবর্তনীয়তারই সমতুল্য। কিন্তু আমার আত্মা যদি অপরিবর্তনীয় অবস্থায় থাকে, তো কোনো কিছুই তাকে আর প্রভাবিত করতে পারবে না, এবং সে ক্ষেত্রে আমার এই সুখ একটা পাথরের সুখে পর্যবসিত হবে। আমরা কি তবে আসলেই বলতে চাই যে, একটা পাথরই হলো আত্মার মুক্তি ও নির্বাণের মূর্ত রূপ?

সহানুভূতি বোধ করতে পারা, অর্থাৎ অন্যের সুখে ও দুঃখে অংশগ্রহণ করাও যেহেতু সত্যিকার মানুষ হওয়ারই অংশ, সেহেতু যুবক সিদ্ধার্থ হয়তো সুখী হতে পারতেন, কিংবা, বলা যায়, তার সুখরূপী মায়াকে তিনি উপভোগ করতে পারতেন, কিন্তু সেটা পারতেন কেবলই তার অজ্ঞতার কারণে। ওই ধরনের সুখ আমাদের এই জগতে কেবল শিশুদের ক্ষেত্রেই সম্ভবপর, এবং তা-ও কেবল কিছু কিছু শিশুর ক্ষেত্রেই: যেমন, স্নেহশীল কোনো পরিবারে বাস করা পাঁচ বছরের কম বয়সের একটা শিশু, যার কোনো বৃহৎ দুঃখ কিংবা নিকটজনদের কারো মৃত্যু দেখার অভিজ্ঞতা নেই। আমি যে অর্থে সুখী হওয়ার কথা বলছি, কেবল এমন কোনো শিশুই হয়তো সেই অর্থে সুখী হতে পারে। কিন্তু বয়স পাঁচ বছর পার হওয়ার পর আমাদের সম্ভবত আর সুখী হওয়ার বয়স থাকে না, আমরা হয়তো একটু বেশিই বয়স্ক হয়ে যাই তখন। অবশ্য সাময়িক আনন্দ, কয়েক মুহূর্তের বিস্ময় ও ব্যাপক উন্মাদনা,  এমনকি ঈশ্বর ও মহাবিশ্বের সঙ্গে একাত্মতা বোধের পরম অনুভূতি আমরা পরেও লাভ করতে পারি, ভালোবাসা ও আনন্দকে জানতে পারি আমরা। কিন্তু, বিশুদ্ধ মরমী স্বভাবের খুব বিরল কিছু মানুষের কথা বাদ দিলে, অপরিবর্তনীয় এক অবস্থা হিসেবে সুখ আসলে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এ তো গেলো মানুষের কথা। ঐশী কোনো সত্তার ক্ষেত্রে কি সুখের এই ধারণা প্রযোজ্য? ঈশ্বর কি সুখী?

প্রশ্নটা অবান্তর নয়। আমাদের প্রথাগত ধারানুযায়ী, সুখ হলো মনের এক আবেগিক অবস্থা। কিন্তু ঈশ্বর কি আবেগের বশবতী? আমরা তো অহরহই শুনি যে ঈশ্বর তার সৃষ্টিকুলকে ভালোবাসেন; এবং ভালোবাসা তো, অন্তত মানুষের এই জগতে, এক ধরনের আবেগই। কিন্তু ভালোবাসা তখনই সুখের উৎস, যখন ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা মেলে; এবং ঈশ্বরের কিছু প্রজাই কেবল ঈশ্বরের ভালোবাসার প্রতিদানে ঈশ্বরকেও ভালোবাসে; সব প্রজা ঈশ্বরকে ভালোবাসে না: কেউ কেউ তার অস্তিত্বেই বিশ্বাস করে না, আবার কারো কারো দেখা যায় ঈশ্বরের থাকা বা না থাকায় কিছুই এসে যায় না, এবং অনেকে তো ঈশ্বরকে ঘৃণা করে, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখেও তার নিরাসক্ত থেকে যাওয়ার বিরুদ্ধে তারা অভিযোগ করে। যদি ঈশ্বর নিরাসক্ত না হন, বরং আমাদের মতোই আবেগের বশবর্তী হয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে মানুষের দুঃখ-দুর্দশার সাক্ষী হয়ে এক চিরস্থায়ী দুঃখবোধের মধ্যেই তাকে বাস করতে হবে। তিনি এসবের কারণ নন, তিনি চানও না এসব থাকুক, কিন্তু প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন বিভীষিকা ও নির্মমতা এবং যাবতীয় দুঃখ-দুর্দশার সামনে ঈশ্বর অসহায় হয়ে পড়েন।

অন্য দিকে, ঈশ্বর যদি সম্পূর্ণ অপরিবর্তনীয় হন, তো তিনি মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় তিনি বিচলিত হবেন না; অর্থাৎ, তিনি সম্পূর্ণ নিরাসক্ত হবেন। কিন্তু নিরাসক্ত হলে তিনি স্নেহশীল পিতা হবেন কীভাবে? আর যদি তিনি অপরিবর্তনীয় না হন, সে ক্ষেত্রে আমাদের দুঃখভোগে তিনিও অংশগ্রহণ করবেন, এবং দুঃখবোধ করবেন। অর্থাৎ, কোনো অবস্থাতেই, আমাদের বোধগম্য কোনো অর্থেই, ঈশ্বর সুখী নন।

এ কথা স্বীকার করে নিতেই হবে যে আমরা কোনো সত্যিকার ঐশী সত্তাকে উপলব্ধি করতে পারি নাসর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ এক সত্তা, যিনি নিজেতেই এবং নিজের ভেতর দিয়েই সবকিছু জানেন, কোনো কিছুই যার অজ্ঞাত নয়, এবং অশুভ ও দুঃখ-কষ্ট যাকে বিচলিত করতে পারে না, এমন এক সত্তাকে আমরা আসলে কখনোই বুঝে উঠতে পারি না।

খ্রিস্টানদের সত্যিকার ঈশ্বর, যীশু খ্রিস্ট, আমাদের বোধগম্য কোনো অর্থেই সুখী ছিলেন না। তিনি দেহধারণ করেছিলেন, ভোগ করেছিলেন যন্ত্রণা, অংশগ্রহণ করেছিলেন অন্যান্য মানুষের দুঃখভোগে, এবং মৃত্যুবরণ করেছিলেন ক্রুশকাঠে চড়ে।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, সুখ শব্দটা ঐশী সত্তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। প্রযোজ্য নয় মানুষের ক্ষেত্রেও। সেটা শুধু এই কারণে নয় যে আমরা দুঃখভোগ করি। সেটা এই কারণেও যে, এমনকি যদি কোনো নির্দিষ্ট সময়ে আমরা দুঃখভোগ না-ও করি, আর এমনকি যদি আমরা সময়ের অতীত এক প্রেমময় চিরায়ত বর্তমানে শারীরিক ও আত্মিক আনন্দ ও মুহূর্তের অভিজ্ঞতা লাভ করতেও পারি, তবুও অশুভের অস্তিত্ব এবং মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা আমরা কখনো ভুলতে পারি না। আমরা অন্যের দুঃখের শরিক হই; মৃত্যুর আশঙ্কা কিংবা জীবনের ব্যথা-বেদনাকে আমরা মুছে ফেলতে পারি না।

তাহলে কি শোপেনহাওয়ারের সেই ভয়ানক তত্ত্বই আমাদের মেনে নিতে হবে, যে, সকল আনন্দদায়ক অনুভূতি বিশুদ্ধভাবেই নেতিবাচক, অর্থাৎ, দুঃখের অনুপস্থিতিই আনন্দ? না, তার কোনো আবশ্যকতা নেই। এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই যে যা কিছু আমাদের ভালো লাগে- রতিসুখ, নান্দনিক সুখ, যাবতীয় শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সুখ, উৎকৃষ্ট সংলাপ, এবং বন্ধুদের ভালোবাসাসবই নেহাত বিশুদ্ধ অস্বীকৃতি (pure negation)। এসব অভিজ্ঞতা আমাদেরকে শক্তিশালী করে, আত্মিক দিক থেকে আমাদেরকে আরো সুস্থ করে তোলে। কিন্তু অশুভ কিংবা দুঃখ-কষ্টের ব্যাপারে তাদের আসলে কিছুই করার নেই।

এমন অনেক মানুষ অবশ্যই আছেন যারা সব দিক দিয়ে সফল বলেই নিজেদেরকে সুখী মনে করেন: তারা ধনী, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, কোনো কিছুর অভাব নেই তাদের, আশপাশের সবাই তাদেরকে সম্মান (কিংবা ভয়) করে। এই ধরনের মানুষেরা এটা বিশ্বাস করতেই পারেন যে, সুখ বলতে যা বোঝায়, তাদের জীবন আসলে সেটাই। কিন্তু এটা নিছক আত্ম-প্রতারণা; এবং এমনকি তারা নিজেরাও কালে কালে সত্যটা উপলব্ধি করেন। এবং সত্যটা হলো, তারাও আমাদের মতোই ব্যর্থ।

এখানে একটা আপত্তি উঠতে পারে। আমরা যদি উচ্চমার্গের বিশুদ্ধ জ্ঞান আত্মস্থ করে থাকি, তো আলেক্সান্ডার পোপের মতো আমরাও বিশ্বাস করতে পারি যে, যা কিছু হয়, ঠিকই হয়; কিংবা লিবনিজের তালে তাল মিলিয়ে বলতে পারি যে, যৌক্তিকভাবে সম্ভবপর সকল জগতের সেরা জগতেই আমরা বাস করছি। এবং বুদ্ধিগতভাবে এরকম কিছু মেনে নেওয়ার পাশাপাশি, অর্থাৎ ঈশ্বর যেহেতু সর্বক্ষণ দেখভাল করছেন, সেহেতু পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে চলেছে, সবই আসলে ঠিকই আছেএকথা মেনে নেওয়ার পাশাপাশি আমরা যদি আমাদের হৃদয় দিয়েও বুঝতে পারি যে, ঘটনা আসলে এটাই, এবং কার্যত আমাদের যাপিত জীবনে এই মহাবিশ্বের ঐশ্বর্য, শুভত্ব ও সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা লাভ করি, তখনো কি আমাদেরকে সুখী বলা যাবে না? উত্তর হচ্ছে: না, যাবে না।

সুখ এমন একটা জিনিস, যাকে আমরা কল্পনা করতে পারি, কিন্তু যার অভিজ্ঞতা আমরা লাভ করতে পারি না। যদি কল্পনা করি যে নরক আর নেই, এবং কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই সমস্ত মানুষকে ঈশ্বর পরিত্রাণ দিয়েছেন, এবং সবাই এখন স্বর্গীয় সুখ উপভোগ করছে, কারো কোনো অভাব নেই, সবাই সম্পূর্ণভাবে সন্তুষ্ট, আর মৃত্যু নেই, আর যন্ত্রণা নেই, সে ক্ষেত্রে কল্পনা করা যায় যে তাদের সুখ হলো প্রকৃত সুখ, এবং অতীতের সমস্ত দুঃখ ও ভোগান্তির কথা তারা ভুলে গেছে। এরকম একটা অবস্থা কল্পনা করা যেতেই পারে, কিন্তু বাস্তবে এমনটা কখনোই দেখা যায়নি। কখনোই না।