সুন্দরের মধ্যেও শয়তান থাকে: মিলান কুন্দেরা

অ+ অ-

 

মিলান কুন্দেরা

মিলান কুন্দেরার বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং [Book of Laughter and Forgetting] উপন্যাসের অনূদিত পাণ্ডুলিপি পাঠের পর সংক্ষিপ্তভাবে দুভাগে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় বিখ্যাত মার্কিন ঔপন্যাসিক ফিলিপ রথের। প্রথম আলাপ হয় যখন প্রথমবার কুন্দেরা লন্ডন যাচ্ছিলেন, অন্যটি তাঁর প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়। এই দুটি সফরই তিনি শুরু করেছিলেন ফ্রান্স থেকে, ১৯৭৫ সালে যখন তিনি ও তাঁর স্ত্রী রেনেতে অভিবাসী হিসেবে ছিলেন। সেখানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন তিনি। দুই বন্ধুর এই আলাপচারিতায়, কুন্দেরা বিক্ষিপ্তভাবে ফরাসিতে কথা চালিয়ে যান। তবে তাঁর অধিকাংশ কথা ছিল চেক ভাষায়। তাঁর স্ত্রী ভেরা দোভাষী ভূমিকায় ছিলেন। এই আলাপচারিতার চূড়ান্ত টেক্সটি [পাঠ] ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন পিটার কুসি। প্রতিধ্বনির জন্য এটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন কবি উপল বড়ুয়া। 

 

মিলান কুন্দেরা ও ফিলিপ রথ 

 

ফিলিপ রথ: আপনার কি মনে হয়, দুনিয়ার ধ্বংস আসন্ন?

মিলান কুন্দেরা: ‘আসন্ন’ বলতে কী বুঝাতে চাচ্ছেন সেটির ওপরে এটি নির্ভর করছে।

রথ: আগামীকাল বা পরশু।

কুন্দেরা: দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, এসব অনুভূতি বেশ পুরোনো।

রথ: তাহলে আমাদের চিন্তার কিছুই নেই। 

কুন্দেরা: পক্ষান্তরে, মানুষের মনে যদি যুগ যুগ ধরে কোনো ভয় থেকে থাকে তাহলে নিশ্চয় এর কোনো কারণ আছে।

রথ: যা হোক, আমার কাছে মনে হয়, এই চিন্তায় আপনার সাম্প্রতিক বইয়ের গল্পগুলোতে জায়গা পেয়েছে, এমনকি সেসব একটু হাস্যরসাত্মক প্রকৃতিরও।

কুন্দেরা: বালকের মতো কেউ যদি আমাকে বলেএকদিন তোমার দেশ দুনিয়া থেকে বিলীন হয়ে যাবে, এটা আমার কাছে ফালতু কথা মনে হবে, এমনকিছু আমি কল্পনাও করতে পারি না। মানুষ জানে সে মরণশীল। তবে সে এটা মেনে নেয় যে, তার জাতি [দেশ] অনন্ত জীবনের অধিকারী। তবে ১৯৬৮ সালে রুশ আক্রমণের পর, সব চেকই ভেবেছিল তার দেশকে ইউরোপ থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হতে পারে। ঠিক যেমন গত পাঁচ দশকে ৪০ মিলিয়ন ইউক্রেনীয় দুনিয়া থেকে নিঃশব্দে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অথবা লিথুনিয়ানরা। আপনি কি জানেন, ১৭শ শতকে লিথুনিয়া ইউরোপের শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল? আজ রাশিয়ানরা লিথুনিয়ানদের সংরক্ষণে রেখেছে অর্ধ বিলুপ্ত আদিবাসীদের মতো করে; বাইরের কেউ যাতে তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে না জানে সেভাবেই অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। আমি জানি না, আমার দেশের ভবিষ্যৎ কী। এটা নিশ্চিত যে, দেশটিকে ক্রমান্বয়ে তাদের সভ্যতার সঙ্গে একীভূত করে ফেলার জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করবে। কেউ জানে না তারা সফল হবে কিনা। তবে সম্ভাবনা আছে। এবং আকস্মিক উপলব্ধিতে এমন এক সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকে যা কারও জীবনবোধকে পুরোপুরি পাল্টে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। আজকাল ইউরোপকে ভঙ্গুর ও নশ্বর মনে হয়।

রথ: এ ছাড়াও কি পূর্ব ইউরোপ ও পশ্চিম ইউরোপের ভাগ্যের মূলগত পার্থক্য ভিন্ন নয়?

কুন্দেরা: সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ধারণা হিসেবে, পূর্ব ইউরোপ হলো রাশিয়া, যার মূল প্রোথিত বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যে। অস্ট্রিয়ার মতো বোহেমিয়া, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি কখনো পূর্ব ইউরোপের অংশ ছিল না। একদম শুরু থেকেই তারা পশ্চিমা সভ্যতার গোথিক, রেনেঁসা [পুনর্জাগরণ], সংস্কারবাদী আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। এখানেই, মধ্য ইউরোপে, আধুনিক সভ্যতা খুঁজে পেয়েছে তার মহত্ত্বম প্রেরণা; মনোবিশ্লেষণ, কাঠামোবাদ, ডোডেকাফোনি, বর্তুকের সঙ্গীত, কাফকা ও মুসিলের উপন্যাসের নতুন নন্দনতত্ত্ব। যুদ্ধ পরবর্তী রাশিয়ার সভ্যতা কর্তৃক মধ্য ইউরোপ [অন্তত এর প্রধান অংশ] দখলের কারণে পশ্চিমা সংস্কৃতি তার অভিকর্ষ শক্তি হারায়। আমাদের শতাব্দীতে এটি পশ্চিমা ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা, এবং মধ্য ইউরোপের ধ্বংসের মধ্য দিয়েই সমগ্র ইউরোপের ধ্বংসের শুরুকে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না।

রথ: প্রাগ বসন্তের সময়, আপনার উপন্যাস ঠাট্টা [The Joke] এবং আপনার গল্পসংকলন লাফেবল লাভস [Laughable Loves] ১ লাখ ৫০ হাজার কপি প্রকাশিত হয়েছিল। রুশ আক্রমণের পর আপনাকে ফিল্ম একাডেমির শিক্ষকতার পদ থেকে বরখাস্ত করা হয় এবং পাবলিক লাইব্রেরি থেকে আপনার সব বই সরিয়ে ফেলা হয়। সাত বছর পর আপনি এবং আপনার স্ত্রী গাড়িতে অল্প কিছু বই এবং কিছু কাপড়চোপড় নিয়ে ফ্রান্সে চলে আসেন, যেখানে আপনি বহুল পঠিত বিদেশি লেখক হিসেবে পরিচিতি পান। একজন প্রবাসী হিসেবে আপনার কেমন বোধ হয়?

কুন্দেরা: একজন লেখকের জন্য, বেশ কয়েকটি দেশে বসবাসের অভিজ্ঞতা বিশাল এক আশীর্বাদ। বিভিন্ন দিক থেকে দেখলে তবেই দুনিয়াটাকে বুঝতে পারবেন। আমার সাম্প্রতিক বই, এক বিশেষ পটভূমিতে রচিত, যেটি ফ্রান্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে: যেসব ঘটনা প্রাগে ঘটছে সেগুলো দেখা হচ্ছে পশ্চিম ইউরোপীয় দৃষ্টিতে, ফ্রান্সে যা ঘটছে সেসব দেখা হচ্ছে প্রাগের দৃষ্টিতে। এটা যেন দুই বিশ্বের মুখোমুখি যুদ্ধ। একপাশে আমার জন্মভূমি: যেখানে অর্ধ-শতাব্দীর মধ্যে গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, বিপ্লব, স্টালিনবাদী সন্ত্রাসের পাশাপাশি বিচ্ছিন্নতাবাদী স্টালিনবাদ, জার্মান ও রুশ দখলদারিত্ব, গণনির্বাসন, নিজ দেশে পশ্চিমের মৃত্যুর অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। এভাবেই দেশটি ইতিহাসের ভারে নিমজ্জমান এবং বিশ্বের দিকে তাকিয়ে আছে সংশয়াপূর্ণ দৃষ্টিতে। অন্য পাশে, ফ্রান্স: কয়েক শতাব্দী ধরে এটি ছিল বিশ্বের কেন্দ্র এবং এখন ভুগছে মহান ঐতিহাসিক ঘটনার অভাবে। এ কারণেই এর মৌলিক আদর্শবাদ ভঙ্গিমা প্রকাশ পাচ্ছে।

রথ: আপনি কি ফ্রান্সে একজন আগন্তুক হিসেবে বাস করছেন, এখানে সাংস্কৃতিকভাবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তো?

কুন্দেরা: আমি খুবই ফরাসি সংস্কৃতির অনুরাগী এবং এর প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে পুরোনো সাহিত্যের প্রতি। রেবেলেইস আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখক। এবং দিদেরত। আমার তাঁর জ্যাক লে ফাতালিস্তে খুবই পছন্দ, লরেন্স স্টার্নকেও ভালো লাগে। উপন্যাসের আকারে এসব সর্বকালের সেরা গবেষণা। এবং এসব গবেষণা, বলতে হয়, অসাধারণ, আনন্দে পরিপূর্ণ ছিল, যা ফরাসি সাহিত্য থেকে এখন হারিয়ে গেছে। স্টার্নে এবং দিদেরত বুঝেছিলেন, উপন্যাস একটি খেলা। তাঁরা উপন্যাসের মধ্যে রসবোধ আবিষ্কার করেছিলেন। যখন কোনো শিক্ষিত লোকের যুক্তি শুনি, উপন্যাসের সম্ভাবনা নিঃশেষিত, আমার তখন বিপরীত বোধ হয়। ইতিহাসের ধারায় উপন্যাস তার অনেক সম্ভাবনা হারিয়ে ফেলেছে। উদাহারণস্বরূপ, স্টার্নে এবং দিদেরোতের লেখার পর উপন্যাসের বিকাশের যে সম্ভাবনা ছিল, তা যোগ্য উত্তরসূরি পায়নি।

রথ: আপনার সাম্প্রতিক বইটিকে উপন্যাস বলা যায় না। তবে আপনি জানিয়েছেন, বৈচিত্র্যের বিচারে এটি উপন্যাস। তাহলে আমরা কি একে উপন্যাস বলব?

কুন্দেরা: আমার ব্যক্তিগত নান্দনিক রায়, এটি সত্যিই উপন্যাস। তবে এই মতামত অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। উপন্যাসের ফর্মের মধ্যে কিছু প্রচ্ছন্ন স্বাধীনতা রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট স্টেরিওটাইপড কাঠামোকে উপন্যাসের অলঙ্ঘনীয় বিষয় বিবেচনা করা ভুল।

রথ: তবু কিছু বিষয় নিশ্চয় এই স্বাধীনতাকে সীমিত করে এবং একটি উপন্যাসকে উপন্যাস করে তোলে।

কুন্দেরা: উপন্যাস হলো একটি দীর্ঘ সমন্বয়িক [সিনথেটিক] গদ্য। এটির ভিত্তি আবিষ্কৃত চরিত্র। কেবল এটুকুই সীমাবদ্ধতা। সিনথেটিক কথাটির মাধ্যমে সকল দিক থেকে ঔপন্যাসিক তার বিষয়কে সম্পূর্ণরূপে ধরার সম্ভাবনার যে আকাঙ্ক্ষা সেটি আমি বুঝাতে চেয়েছি। বিদ্রুপাত্মক রচনা, ঔপন্যাসিক আখ্যান, আত্মজৈবনিক ভাগ, ঐতিহাসিক সত্য, কল্পনার বিস্তৃতি: এসব হলো উপন্যাসের সিনথেটিক শক্তি। এ সবকিছুই সঙ্গীতের পলিফোনিক [বহুস্বর] স্বরের ন্যায় উপন্যাসকে একত্রিত করে। একটি বইয়ের প্রয়োজনীয়তা প্লট থেকে নয়, থিম থেকে উদ্ভূত। আমার সর্বশেষ বইয়ের থিম দুটি: হাস্যরস এবং ভুলে যাওয়া।

রথ: হাস্যরস সবসময় আপনার প্রিয়। আপনার বইগুলো হাস্যরসের মাধ্যমে হিউমার ও আইরনিকে উস্কে দেয়। আপনার চরিত্রগুলো তখনই বিষাদগ্রস্থ হয়ে ওঠে যখন তারা এমন জগতের সামনে পড়ে, যেখানে তাদের সেন্স অব হিউমার হারিয়ে ফেলে।

কুন্দেরা: স্টালিনীয় সন্ত্রাসবাদের সময় আমি হিউমারের মূল্য বুঝতে পারি। তখন আমার বয়স ছিল ২০। আমি এক ব্যক্তিকে চিনতাম যিনি স্টালিনবাদী নয়, যার হাসির জন্য তাকে ভয় পেতাম না। সেন্স অব হিউমার এক প্রকার বিশ্বাসযোগ্য চিহ্ন। সেই সময় থেকে আমি সেন্স অব হিউমার বর্জিত জগতকে ভয় পাই।

রথ: আপনার সর্বশেষ বইয়ে, একটি ছোট অধ্যায়ে দেবতার হাসির সঙ্গে শয়তানের হাসি তুলনা করেছেন। শয়তান হাসে কারণ ঈশ্বরের জগত তার কাছে অর্থহীন মনে হয়; দেবতা আনন্দের সঙ্গে হাসে কারণে ঈশ্বরের জগত তার কাছে অর্থপূর্ণ।

কুন্দেরা: হ্যাঁ, মানুষ হাসির মাধ্যমে মানসিক অবস্থার ভিন্ন দুই ধরনের আধিভৌতিক মনোভাব প্রকাশ করে। কারও টুপি নতুন খোঁড়া কোনো কবরে পড়ে যায়, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া তখন নিরর্থ হয়ে যায় এবং হাস্যরসের জন্ম হয়। প্রেমিক-প্রেমিকা সবুজ তৃণভূমির মধ্য দিয়ে হাত ধরে হাসতে হাসতে দৌড়ে যায়। তাদের হাসির মধ্যে কোনো কৌতুক বা হাস্যরস নেই, এটাই দেবতাদের হাসির প্রকাশ। দুই ধরনের হাসিই জীবনের আনন্দ থেকে আসে।

রথ: এখন যাকে আপনি দেবতার হাসি বলছেন সেটিকে আপনার আগের উপন্যাসগুলোতে জীবন দৃষ্টিভঙ্গির নতুন টার্ম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আপনার একটি বইয়ে স্টালিনবাদী সন্ত্রাসী যুগকে বলেছেন জল্লাদ ও কবিদের রাজত্ব।

কুন্দেরা: সমগ্রতা কেবল নরকই নয়, স্বর্গের স্বপ্নও। পৃথিবীর সেই পুরোনো নাটক, যেখানে সবাই সম্প্রীতির সঙ্গে বাস করবে, একজন আরেকজনের কাছে কিছু গোপন করবে না, সবাই এক বিশ্বাসে থাকবে। আন্দ্রে বেঁতও, এমন স্বর্গের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তিনি একটি কাচের ঘর সম্পর্কে বলেছিলেন যেখানে তিনি থাকতে চেয়েছিলেন। যদি সমগ্রতা এসব আদিরূপকে ধ্বংস না করত, যা আমাদের সবার ও ধর্মের গভীরে প্রোথিত, তা এত মানুষকে আকৃষ্ট করত না। বিশেষ করে এর অস্থিত্বের প্রাথমিক পর্যায়ে। যখন স্বর্গ বাস্তব হতে শুরু করে তখন অনেকে এর পথ রুদ্ধ করতে শুরু করে। তাই স্বর্গের শাসকদের উচিত ইডেনের পাশে একটি ছোট কয়েদ খানা নির্মাণ করা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কয়েদ খানা আরও বড় ও আরও নিখুঁত হতে থাকবে এবং স্বর্গ আরও ছোট থেকে ছোট ও দরিদ্র হতে থাকবে।

মিলান কুন্দেরা, ভেরোনিকা গেন ও ফিলিপ রথ © ছবি: ভেরা কুন্দেরা 

রথ: আপনার বইতে, মহান ফরাসি কবি এলুয়ার্দ স্বর্গ ও কয়েদখানার উর্ধ্বে ওঠে গান ধরেছেন। বইয়ে উল্লেখিত এই ইতিহাস কি সত্য?

কুন্দেরা: যুদ্ধের পরে, পল এলুয়ার্দ সুররিয়ালিজম ত্যাগ করেন এবং হয়ে ওঠেন বড় সার্বভৌমত্ববাদী প্রবক্তা। তিনি ভাতৃত্ব, শান্তি, ন্যায়বিচার, সুন্দর ভবিষ্যতের গান গেয়েছেন। তিনি কমরেডশিপের জন্য এবং বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে, বিষণ্নতার বদলে আনন্দের জন্য, নির্দোষদের জন্য এবং নিন্দুকদের বিরুদ্ধে গান গেয়েছেন। ১৯৫০ সালে যখন এই স্বর্গের শাসকেরা এলুয়ার্দের বন্ধু প্রাগের পরাবাস্তববাদী জালভিস কালান্দ্রাকে ফাঁসি দিয়েছিলেন, এলুয়ার্দ তখন তাঁর অতি-ব্যক্তিগত আদর্শের নিমিত্তে বন্ধুত্বের কথা ভুলে গিয়েছিলেন, এবং প্রকাশ্যে বন্ধুর ফাঁসির অনুমোদন দিয়েছিলেন। জল্লাদ যখন তাঁর বন্ধুকে হত্যা করছিল তখনও তিনি গান গাইছিলেন।

এবং শুধু কবি নয়, স্টালিনবাদী সন্ত্রাসের পুরো সময়টা ছিল সামগ্রিক বিকারের যুগ। সবকিছু বিস্মৃত হলেও মানুষ এখনও এসব বিষয় মনে রেখেছে। লোকজন বলে: বিপ্লব সুন্দর। তবে তার মধ্যে যে সন্ত্রাসেরও জন্ম হয় সেটিই অশুভ। তবে এসব সত্য নয়। সুন্দরের মধ্যেও শয়তান থাকে। স্বর্গের স্বপ্নের মধ্যে নরক। আমরা যদি নরকের সারমর্ম বুঝতে চাই, আমাদের অবশ্যই স্বর্গের সারমর্ম বুঝতে হবে, যেখান থেকে সে উদ্ভূত।

রথ: আপনার গদ্যের বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত দ্বন্দ্ব। এর অর্থ এই নয় যে, ব্যক্তিগত গল্পগুলো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত। বা রাজনৈতিক ঘটনা ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করে না। বরং আপনি ক্রমাগত দেখান যে, রাজনৈতিক ঘটনাবলী ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনা বা আইন দ্বারা পরিচালিত হয়। যেখানে আপনার গদ্য এক প্রকার রাজনৈতিক মনোবিশ্লেষণও। 

কুন্দেরা: মানুষের অধিবিদ্যা ব্যক্তি ক্ষেত্রের মতো সামষ্টিকভাবে একই। এই বইয়ের আরেকটি বিষয়বস্তুকে ধরা যাক: বিস্মরণ। এটা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের বিশাল এক সমস্যা। আত্মবিস্মৃতি হলো মৃত্যু। তাহলে এই আত্ম কি? এটা হলো সবকিছু মনে রাখার অংক। মৃত্যু নিয়ে আমাদের যে ভীতি, এটা অতীতকে হারানোর জন্য নয়। বিস্মরণ হলো মৃত্যুর এক রূপ যা আমাদের বর্তমান জীবনে নিহিত। এই আমার নায়িকার সমস্যা, যে তার প্রিয় মৃত স্বামীর স্মৃতি সংরক্ষণে মরিয়া। তবে রাজনীতিতে বিস্মরণ বিশাল এক সমস্যা। যখন কোনো পরাশক্তি জাতীয় চেতন থেকে ছোট দেশকে কব্জা করতে চায় তখন তারা পরিকল্পিত বিস্মরণ নীতি গ্রহণ করে। যেটা বর্তমানে বোহেমিয়া ঘটছে। সমকালীন চেক সাহিত্যে, যদিও এটার আর তেমন কোনো মূল্য নেই১২ বছর প্রকাশিত হয়নি। প্রয়াত ফ্রাঞ্জ কাফকাসহ ২০০ চেক লেখককে নিষিদ্ধ হয়েছে, ১৪৫ ঐতিহাসিককে তাদের পদ থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। ইতিহাস লেখা হয়েছে নতুনভাবে। স্মৃতিসৌধ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। যে জাতি তার অতীত ভুলে যায় সে নিজেকেও ভুলে যায়।

রথ: আপনার বইয়ের ষষ্ঠ অংশে প্রধান নায়িকা তামিনা একটি দ্বীপে পৌঁছায়, যেখানে শুধুই শিশুরা রযেছে। শেষদিকে তারা তাকে মেরে ফেলে। এটা কি কোনো স্বপ্ন, রূপকথা, না রূপক?

কুন্দেরা: রূপকের চেয়ে ভিনদেশি আমার কাছে কিছুই নেই, কোনো বিষয়বস্তুকে ব্যখ্যার জন্য লেখক গল্প আবিষ্কার করেন। সেটি হোক বাস্তবভিত্তিক বা কল্পনাপ্রসূত, সেটি নিজেদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ হতে হবে। পাঠক যেন তার লেখনি ও কাব্য শক্তিতে প্রলুব্ধ হয়। আমি সবসময় এই দৃশ্য দ্বারা তাড়িত হয়েছি, আমার জীবনের এক অধ্যায়ে বারবার স্বপ্ন দেখতাম: এক ব্যক্তি একদিন নিজেকে শিশুদের পৃথিবীকে আবিষ্কার করে, যেখান থেকে সে পালাতে পারে না। হঠাৎ শৈশবে, যা কিনা আমাদের কাছে প্রিয় ও আরাধ্য, সেটিই হয়ে ওঠে ভীতিজনক। ফাঁদের মতোন। এই গল্প রূপক নয়। তবে আমার বই বহুস্বরের, যেখানে অনেক গল্প পারস্পরিকভাবে ব্যাখ্যা করে, উদ্দীপ্ত করে, একে অপরের পরিপূরকও। এই বইয়ের মূল ঘটনা সামগ্রিকতাবাদের গল্প, যেটি লোকদের মানুষকে স্মৃতি থেকে বঞ্চিত করে এবং তাদের পুনরায় শিশুরাজ্যের অধিবাসী বানিয়ে ফেলে। সকল সমগ্রতাবাদ এটাই করে। হয়তো প্রযুক্তিগত যুগে এটাই হয়, যেখানে অবিশ্বাস, অতীতের প্রতি উদাসীনতা থাকে। একটি শিশুদের সমাজে একজন পূর্ণবয়স্ক যে স্মৃতি ও চিন্তার বৈপরিত্য অনুভব করে, শিশুদের দ্বীপে তামিনারও তেমনটা লেগেছিল।

রথ: আপনার প্রায় সব উপন্যাসে, বিশেষত সাম্প্রতিক বইয়ের সব অংশের সমাপ্তি দুর্দান্ত যৌন দৃশ্যের মাধ্যমে। এমনকি মা নামের মতো নির্মল অধ্যায়ের সমাপ্তি দীর্ঘ ত্রিমুখী যৌন দৃশ্যের মাধ্যমে, এটি প্রস্তাবনা ও উপসংসহারসহ। ঔপন্যাসিক হিসেবে আপনার কাছে যৌনতা কী?

কুন্দেরা: এ সময়ে, যৌনতা যখন আর নিষিদ্ধ বিষয় (ট্যাবু) নয়, তখন তার বর্ণনা ও যৌন স্বীকারোক্তি খুব বেশি ক্লান্তিকর/বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে। লরেন্স এমনকি হেনরি মিলার কীভাবে যৌনতার বর্ণনা দিতেন! তবু জর্জ বাতাইলের কামোত্তোজক বর্ণনা আমার মধ্যে আমার ওপর বেশ প্রভাব ফেলেছে। হয়তো এসব কাব্যিক নয়, দার্শনিক জায়গা থেকে হওয়ায়। আপনি ঠিক বলেছেন, আমি সবকিছু যৌন দৃশ্য দিয়ে শেষ করি। আমার মনে হয়, শারীরিক ভালোবাসা মানুষের চরিত্রের নানাদিক চূড়ান্তভাবে ফুটিয়ে তোলে। তামিনার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয় হুগো, যখন সে (তামিনা) নিদারুণভাবে তার মৃত স্বামীর হারানো স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করছিল। এই কামোদ্দীপক দৃশ্যেই গল্পের মূল বিষয়বস্তু ফুটে উঠেছে এবং এখানেই গল্পের গভীর সত্যটি স্থিত।

রথ: সপ্তম, অর্থাৎ শেষ অংশে আসলে যৌনতা ছাড়া আর কিছুই নেই। ষষ্ঠ অধ্যায়ে নায়িকার নাটকীয় মৃত্যু দিয়ে শেষ না করে কেন এই অংশ দিয়ে বইটি শেষ করা হলো?

কুন্দেরা: তামিনা মারা যায়। রূপকভাবে বলতে গেলে, তার মৃত্যু দেবতাদের হাসির মধ্যে। বইটির শেষ অংশে। এখানে সেই বিপরীতার্থক হাসি শোনা যায়, যখন কোনো বস্তু তার অর্থ হারিয়ে ফেলে। এখানে নির্দিষ্ট একটি কাল্পনিক বিভাজন রেখা রয়েছে যার বাইরে বিষয়গুলোকে নিরর্থ ও হাস্যকর লাগবে। একজন ব্যক্তি নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে: সকালে ওঠা, কাজে যাওয়া, কোনো কিছুর জন্য লড়াই করা, জন্মসূত্রে কোনো রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত হওয়া কি অর্থহীন নয়? যেসব মানুষ এই সীমান্তের খুব কাছাকাছি থাকে তারা সহজে অন্য পাশের হিসেবে নিজেকে দেখে। এই সীমানা সর্বত্র বিদ্যমান, মানুষে সব ক্ষেত্রে, এমনকি জৈবিক ও যৌনতাও। এবং সুনির্দিষ্টভাবে যেহেতু এটি জীবনের গভীরতম অংশ, যৌনতা সম্পর্কিত প্রশ্নটিও গভীরতম।

রথ: তাহলে কি আপনি হতাশার চরমে পৌঁছে গেছেন?

কুন্দেরা: আমি আশাবাদ ও হতাশাবাদ শব্দগুলো নিয়ে সাবধান থাকি। উপন্যাস কোনোকিছুই জাহির করে না; উপন্যাস আদতে অনুসন্ধান ও প্রশ্ন উত্থাপন করে। আমি জানি না, আমার দেশ ধ্বংস হবে কিনা এবং জানি না আমার চরিত্রগুলো ঠিক কিনা। আমি গল্প লিখি, পরস্পরকে মুখোমুখি করি এবং এর মাধ্যমে আমি প্রশ্ন করি। মানুষের মূর্খতা প্রকাশ পায়, যখন সে সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন করে। যখন দন কিহোতে পৃথিবী ঘুরতে বেরোলেন, তার চোখে সবকিছু রহস্যময় মনে হলো। এটাই প্রথম উপন্যাস যার থেকে পুরো ইউরোপের উপন্যাসের ইতিহাস সৃষ্টি হয়। ঔপন্যাসিক পাঠককে দুনিয়াটাকে একটি প্রশ্ন হিসেবে ভাবতে শেখায়। এই মনোভঙ্গিতে এক ধরনের প্রজ্ঞা ও সহিষ্ণুতা আছে। যে পৃথিবীতে নিশ্চিত সবকিছু সেখানে উপন্যাস মৃত। সমগ্র পৃথিবী, মার্ক্স-ইসলাম যা কিছুর ওপর ভিত্তি হোক না কেন, এটি প্রশ্নের নয়, বরং উত্তরের জগত। সেখানে উপন্যাসের কোনো স্থান নেই। যা হোক, আমার মনে হয়, এখনকার পুরো পৃথিবীর মানুষ বোঝার (উপলব্ধি) চেয়ে বিচার করতে বেশি পছন্দ করে। আর জিজ্ঞাসার চেয়ে উত্তর দিতে। যার কারণে মানুষের নিশ্চয়তার বোকামির হলাহলপূর্ণ সময়ে উপন্যাসের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না বললেই চলে।

কৃতজ্ঞতা: kundera.de