মীনাক্ষীদি ও জ্যোতিদাকে নিয়ে কিছু অমূল্য স্মৃতি
২০১৯ সালে নিউইয়র্কে লেখক হাসান ফেরদৌসের বাসভবনেও আবার আরেক দফা এই লেখক দম্পত্তির সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল। সেটিই ছিল তাদের সঙ্গে শেষ দেখা। অন্তত মীনাক্ষীদির সঙ্গে তো বটেই। হাসান ফেরদৌস ভাইয়ের বাসাতেও জমে উঠেছিল তুমুল আড্ডা। জ্যোতিদা আর মীনাক্ষীদি তারা দু’জনই আড্ডাবাজা মানুষ। যাহোক বিভিন্ন সময়ে জ্যোতিদা আর মীনাক্ষীদির সঙ্গে আলাপচারিতাগুলো একত্রে করে চুম্বক অংশ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। উদ্দেশ্য এই দুই মহৎ প্রাণের নানা রকম ভাবনা এবং জীবন দর্শনের ছোঁয়া পাওয়া এবং একই সঙ্গে মীনাক্ষীদির বাবা বিখ্যাত লেখক বুদ্ধদেব বসুরকেও খানিক আবিষ্কার করা।
বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক বুদ্ধদেব বসুর কন্যা মীনাক্ষী দত্ত। মীনাক্ষীদির পরিচয় শুধু কবি এবং সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর কন্যা নয়। তার পরিচয় তিনি নিজেই। মীনাক্ষী দত্তকে কে না চেনেন? ডক্টর জিভাগোর মতো তিনি বেশ কিছু ধ্রুপদি বইয়ের অনুবাদক। ‘অ্যালবাম থেকে কয়েকজন’ তার স্মৃতিচারণমুলক অসাধারণ একটি গ্রন্থ। ‘তুষার কুসুম’ তার একটি জনপ্রিয় স্মৃতিগদ্য। সেটি ছাপা হয়েছিল ‘কলকাতা’ সাহিত্য পাতায়। জ্যোতির্ময় দত্ত কবি, কথাসাহিত্যিক, অধ্যাপক এবং সাংবাদিক। কলকাতা থেকে ‘আাড়িয়ালখ খাঁ’ নামের সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। নিউইয়র্কের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, লেখক হাসান ফেরদৌসের বাড়িতে, নিউ ইয়র্ক বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে এবং জ্যোতিদাদের নিউ জার্সির বাড়িতেও বিভিন্ন সময় এই দম্পত্তির সঙ্গে দেখা হয়েছে, আড্ডা হয়েছে। সম্ভবত তাদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল ২০০৪ সালে নিউইয়র্ক বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের এক অনুষ্ঠানে। তারপর বিভিন্ন সময় এই অসাধারণ লেখক দম্পত্তির সাক্ষাৎ পেয়েছি, তাদের ভালোবাসা পেয়েছি। কলকাতা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে ভাল যোগাযোগও ছিল। তাদের নিয়ে অনেক স্মৃতি জমা আছে।
মনে পড়ে, ২০১৯ সালের এক সকালে লেখক হাসান ফেরদৌস জানালেন তিনি যাচ্ছেন নিউজার্সির হিলসবোরো শহরে কবি বুদ্ধদেব বসুর কন্যা মিনাক্ষী দত্ত এবং জ্যোতির্ময় দত্তের বাসভবনে। উদ্দেশ্য আড্ডা দেয়া এবং তাদের বিদায় দেয়া। জ্যোতিদা আর মীনাক্ষীদি আমেরিকার পাট চুকে চলে যাচ্ছেন কলকাতায়। সেখানেই তারা বাকি জীবন থাকবেন। এ ধরনের খবর শোনার পর মনটা এমনিতেই মুষড়ে ওঠে। কারণ কে জানে কবে আবার তাদের সঙ্গে দেখা হবে? আমি হাসান ভাইকে আমার হা-বোধক ইচ্ছার কথা জানিয়ে দিয়েই কাজে নেমে গেলাম। আর যথারীতি অন্যবারের মতো এবারও তাদের সঙ্গে কথোপকথন টুকে রাখার প্রস্তুতিও নিয়ে রাখলাম। যদিও এর আগেও বিভিন্ন সময়ে নেয়া তাদের সঙ্গে আলাপচারিতা নোটবন্দী করা হয়েছিল এবং কিছু কিছু অংশ বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। তারপরও আলাপ আর আড্ডার তৃষ্ণার কি শেষ আছে?
২০১৯ সালে নিউইয়র্কে লেখক হাসান ফেরদৌসের বাসভবনেও আবার আরেক দফা এই লেখক দম্পত্তির সঙ্গে আবার দেখা হয়েছিল। সেটিই ছিল তাদের সঙ্গে শেষ দেখা। অন্তত মীনাক্ষীদির সঙ্গে তো বটেই। হাসান ফেরদৌস ভাইয়ের বাসাতেও জমে উঠেছিল তুমুল আড্ডা। জ্যোতিদা আর মীনাক্ষীদি তারা দু’জনই আড্ডাবাজা মানুষ। যাহোক বিভিন্ন সময়ে জ্যোতিদা আর মীনাক্ষীদির সঙ্গে আলাপচারিতাগুলো একত্রে করে চুম্বক অংশ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। উদ্দেশ্য এই দুই মহৎ প্রাণের নানা রকম ভাবনা এবং জীবন দর্শনের ছোঁয়া পাওয়া এবং একই সঙ্গে মীনাক্ষীদির বাবা বিখ্যাত লেখক বুদ্ধদেব বসুরকেও খানিক আবিষ্কার করা।
জ্যোতিদা আর মীনাক্ষীদি নিউ জার্সিতে যে বাড়িটায় থাকতেন সেটি শহর থেকে কিছুটা ভেতরের দিকে। রাস্তায় মানুষজনের হৈ-হল্লা নেই, খুব আবাসিক এলাকা। দূর থেকেই বাড়িটার ভেতরের ঝলঝলে আলো চোখে পড়ছিল। গাড়িতে আমরা চারজন। আমি, লেখক হাসান ফেরদৌস, রানু ভাবি, লেখক আহমাদ মাযহার এবং অভিনয় শিল্পী শিরিন বকুল। লেখক আবেদীন কাদের তখন নিউ জার্সিতেই থাকেন। নিউ জার্সিতে তার বাড়ি থেকেই তিনি আমাদের আড্ডায় অংশ নিবেন এমনটাই ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল। ঠিক বুঝতে পারছিলাম, জ্যোতিদা এবং মীনাক্ষীদি তারা দু’জনেই আমাদের অপেক্ষায় বসে আছেন। বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই জ্যোতিদার সেই উচ্চকণ্ঠের হো হো করা হাসি গোটা বাড়ির চারদেয়ালে বাড়ি খেল। তিনি একটা রেড ওয়াইনের বোতল আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘আদনান, এটা খোল, গলা ভিজুক আগে। তারপর আড্ডা।’ আমি বোতল খুলতেই লাল টকটকে আঙুরের কোমনীয় রস আমাদের সবাইকে স্বাগত জানালো। বাঙালি আড্ডা হলে যা হয়। সবাই তখন নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করে দিলেন। তবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু জ্যোতিদা আর মীনাক্ষীদি।
মীনাক্ষী দত্তের সঙ্গে আহমাদ মাযহার ও লেখক
আপনিতো মনে প্রাণে একজন জাত বোহেমিয়ান। শুনেছি আপনি নৌকায় চড়ে বাংলা ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। একবার নাকি নৌকা করে শ্রীলঙ্কা যাওয়ার প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। কত কি কাণ্ড! একটু বলেন না!
জ্যোতিদা এমনিতেই আড্ডার মুডে আছেন। তার ওপর সেই পুরনো স্মৃতি আবার মনে করিয়ে দিতেই তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পরলেন। তিনি আমার চেয়ারের পেছনে এসে আমাকে দু’হাতে ধরলেন তারপর বলতে শুরু করলেন।
‘সত্যি কত কত গল্প! সাগর পথে কত বাঁধা! একবার একপাল হাঙরের পাল্লায় পরেছিলাম। আবার আরেকদিন তো বড় তিমির পিঠের ধাক্কায় আমরা উল্টে পরে যাই আরকি! যে কোন মুহূর্তেই আমাদের ডিঙিটা উল্টে যেত! কিন্তু কপাল ভালো ছিল। তিমিটা চলে গেল। কেন সে ফিরে গেল সে এক বড় রহস্য! তা না হলে ইহলীলা সাঙ্গ হতো নিশ্চয়ই! কিন্তু প্রকৃতির কাছে আমাদের হার মানতেই হয়। আমাদের ‘মণিমেখলা’ খুবই ক্ষতি হয়েছিল। শ্রীলঙ্কা আর যাওয়া হল না।
কত-কী কাণ্ড ঘটেছে আপনার জীবনে? একবার গান্ধীবাদের শখ চাপল! নিরামিষ খাওয়া শুরু করে দিলেন। রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটছেন! কোন খোঁজের সন্ধানে এই আত্মনিমজ্জন জ্যোতিদা?
জ্যোতিদা এই প্রশ্নের উত্তর দিবেন না বলেই হয়তো ফিক করে শুধু হেসে দিলেন। তারপর বললেন, ‘সেই সত্যকে এখনো খুঁজি, আদনান। এই খোঁজার কি শেষ আছে?
সেই সত্যটাকে খুঁজে পেয়েছেন জ্যোতিদা?
হ্যাঁ পেয়েছি। এই জগৎ সত্যি নয়। সত্যি নয় মোটেও! এই দেখার পেছনেও রয়েছে আরেক না দেখার খেলা। এই আলোর পেছনে রয়েছে আরেক নতুন আলোর নাচন!
আচ্ছা, আপনি নাকি অফিসেও খালি পায়ে যেতেন? কোন বাঁধা আসতো না?
কে দিবে বাধা? জ্যোতিদা আমার কথা শুনে আবার আরেকপ্রস্ত অট্টহাসি দিলেন। ‘কে দেবে বাধা? এটাই ছিল আমার চাকরির অন্যতম শর্ত। আমি জুতো পরবো না। তোমরা কী করবে, করো। একবার পত্রিকা থেকে বলেছিল অন্তত অফিসে যেন জুতো পরে আসি।’
কোন পত্রিকার কথা বলছেন, জ্যোতিদা?
হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড।
আচ্ছা। তারপর?
তারপর আর কী? আমি সোজা মানা করে দিলাম। জুতো আমি পড়তে পারবো না।
তাহলে এই নিয়ে কেউ কোন বিরূপ মন্তব্য বা কটাক্ষ করতো না?
করতো না মানে? আমি নিজের কানে শুনেছি। একদিন আমার সহকর্মী বরুণ সেনগুপ্ত বলেই ফেললেন, ‘এই যে খালিপদ এলেন।’ কিন্তু আমি কারো কথায় কোন গা করিনি।
ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকারটি নিয়েও তো সেই একই ঝামেলা ছিল! প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিতে আনন্দবাজার আর হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড আপনাকেই নির্বাচন করেছিল। কিন্তু সেখানেও আপনি গো ধরলেন জুতো পরে যাবেন না।
ঠিক বলেছ। অনেক দেন-দরবারের পর প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে বলে দিল, ‘জুতো পরতে হবে না, শয়নকক্ষে ব্যবহার করা হয় এমন একজোড়া স্লিপার কয়েক মিনিটের জন্যে পরলেই হবে।’ আমি তাতেই রাজি হয়েছিলাম।
লেখক হাসান ফেরদৌসের নিউইয়র্কের বাড়িতে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন জ্যোতির্ময় দত্ত এবং মীনাক্ষী দত্ত। তাদেরকে ঘিরে একটি আড্ডা। সামনের সারিতে বসে আছেন (বাম দিক থেকে) লেখক আবেদীন কাদের, লেখক হাসান ফেরদৌস, মীনাক্ষী দত্ত, জ্যোতির্ময় দত্ত, এবং রানু ফেরদৌস। পেছনের সারিতে আছেন বাম দিক থেকে তামান্না গাজি, অনিন্দ আতিক, ডাক্তার ফারুক আজম, লেখক, নসরাত আজাদ, মিম এবং আবৃত্তি শিল্পী সেমন্তী ওয়াহেদ।
জ্যোতিদা, আপানার জীবনের এই বিচিত্র অভিজ্ঞতাগুলো কোথাও কোন জার্নালে লিখে রেখেছেন?
কেন? অনেক কথাইতো আছে আমার স্মৃতিকথা ‘আমার নাইবা হলো পারে যাওয়া’ গ্রন্থটিতে।
এর মধ্যে হুট করে মীনাক্ষীদিও আমাদের কথায় যোগ দিলেন। মীনাক্ষীদি অসম্ভব গুণীজন এক মানুষ। একজন অপরিচিত মানুষকেও খুব তাড়াতাড়ি আপন করে নেয়ার শক্তি তার অনেক প্রবল। বুদ্ধদেব বসুর যথার্থ কন্যা বলে কথা। আমি যাকে সবসময় বলি ‘আপনিতো আমাদের বাংলাদেশের কইন্যা।’ এ কথা বললে মীনাক্ষীদি মুচকি হাসতেন। মীনাক্ষীদির সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে চলে এল কবি জীবনানন্দ দাশ প্রসঙ্গ। সম্পর্কে। তিনি বলেছিলেন জীবনানন্দ দাশ তাদের বাড়ির খুব কাছাকাছিই থাকতেন।
‘খুব চুপচাপ থাকতে পছন্দ করতেন। একদিনের কথা মনে আছে। আমরা সম্ভবত কোন নাটক বা এ ধরনের কোন কারণে পরিচিত অনেকের কাছ থেকেই চাঁদা ওঠাচ্ছি। জীবনানন্দ দাশ আমাকে তার বাড়ির সামনে ডেকে নিয়ে আমার হাতে ৫ টাকা ধরিয়ে দিলেন। তারপর আবার নিঃশব্দে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন। খুব চুপচাপ ছিলেন।’
শনিবারের চিঠিতে তো তাকে খুব সমালোচনা করতো। কেন সজনীকান্ত দাশ এভাবে জীবনানন্দের পেছন লেগেছিলেন?
মীনাক্ষীদির ঠোঁটে সেই চিরচেনা হাসি আবার ফুটে উঠলো। তিনি অনেকটা বাচ্চা মেয়েদের মতোই বলতে শুরু করলেন।
‘জানো নিশ্চয়ই। আমাদের বাঙালিদের দুটো দিক আছে। একটি হল—অতি ভক্তিতে তারা গদগদ প্রশংসায় ডুবে যায়। আর দ্বিতীয় হল—ঈর্ষা। বাঙালি খুব ঈর্ষাপরায়ন এক জাতি। শনিবারের চিঠিতে যারা রবীন্দ্রনাথের কুৎসা করতো, ঠিক তারাই আবার বুদ্ধদেব বসু বিদেশ গিয়ে নাকি রবীন্দ্রনাথের নিন্দা করেছেন এ ধরনের জঘন্য মিথ্যা ছড়াতো। এখন বুঝো! সেই একই লোকগুলো আবার জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় কেন ‘বরফকুচর মতো স্তন’ লিখলো সেই নিয়ে তাকে আক্রমণ করলো। এই সংস্কৃতি থেকে বাঙালি এখনো বের হতে পারেনি। তাই না?’
আচ্ছা দিদি, মীনাক্ষী নামটি কবিগুরুর দেয়া। তাই না?
হ্যাঁ।
কীভাবে রবীন্দ্রনাথ আপনার নামটি রেখেছিলেন সেই গল্পটা যদি বলেন।
‘আহা! এই গল্পটি কত বার বলেছি! মা-বাবা [বুদ্ধদেব বসু আর প্রতিভা বসু] প্রায় সময়ই কবিগুরুর ওখানে যেতেন। কখনো কখনো তার সাথে বেশ সময় ধরে থাকতেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। একদিন মা খুব লজ্জায় ইতঃস্তত করে কবিগুরুকে বললেন, ‘আমার মেয়ের একটা নাম দিন।’ কবি গুরু কিঞ্চিৎ অভিমান করে বলেছিলেন, ‘কেন তুমি তোমার কবি স্বামীর কাছে যাও। সেই একটা নাম রাখুক।’ কিন্তু আমার মা নাছোড়বান্দা। তিনি কবিগুরুকে জোর করে ধরলেন, ‘আপনাকেই নামটি দিতে হবে।’
তারপর কবি গুরু বললেন, নাম তো লেখাই আছে। এই বলে কবি গুরু একটা নোটবুকের পাতা দেখালেন। সেখানে লেখা রয়েছে—‘মীনাক্ষী।’
রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আপনার কোন স্মৃতি আছে?
‘তখন আমি খুব ছোট। রবীন্দ্রনাথ আমাকে একটা লজেন্স দিয়েছিলেন। এই স্মৃতিটি মনে বেশ মনে আছে। আরেকটা স্মৃতিও আছে। রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন। আমরা সবাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে গেছি। বাবা রবীন্দ্রনাথকে প্রণাম করলেন। এই প্রথম দেখলাম বাবা কাউকে প্রণাম করলেন। বাবা কখনোই কাউকে প্রণাম করতেন না।’
মীনাক্ষী দত্ত ও জ্যোতির্ময় দত্তের সঙ্গে হাসান ফেরদৌস, আহমাদ মাযহার, শিরিন বকুল ও লেখক
মীনাক্ষী দি, আপনার বাবা সম্পর্কে কিছু বলেন।
অসাধারণ মানুষ। নিজের বাবা বলে নয়। মনে প্রাণে অসম্ভব আধুনিক।
আর আপনার বাবার সবচেয়ে ভালো লেখা কোনটি? কন্যা হিসেবে কোন পক্ষপাতিত্ব আছে কি?
তার সব লেখাই শ্রেষ্ঠ আমার কাছে। মা আর বাবা দু’জনকে নিয়েই আমি গর্বিত। বাবা লেখালেখিতে মগ্ন থাকতেন। মা তার লেখালেখি নিয়ে থাকতেন। তবে বাবার খুব খেয়াল রাখতেন।
ঢাকার কোন স্মৃতি আপনার মনে আছে?
অবশ্যই। আমরাতো পূর্ব বঙ্গেরই মানুষ! তাই না! ঢাকার বকশীবাজারের বাড়িটার প্রচুর স্মৃতি এখনো মনে আছে। এখনো মনে আছে সেই বেলকনিটার কথা।
আপনার মার বিশেষ কোন স্মৃতি মনে পড়ে?
অসাধারণ এক মহিলা তিনি। সবকিছু সুন্দর করে সামলাতেন। লেখালেখি করতেন, ছবি আঁকতেন, সেলাই করতেন। রান্না করতেন।
বাংলাদেশের সাহিত্য কি পড়েন?
প্রশ্নটা কেড়ে নিলেন জ্যোতিদা। খুব পড়ি। শামসুর রাহমানের কবিতা তো অসাধারণ! আল মাহমুদের কবিতা আমাকে প্রচুর টানে। আর আছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। কী আসাধারণ তার গদ্য!
জ্যোতিদা, বিষয়টা আমরা জানি। আপনি আগেও একবার বলেছিলেন। তবু আবার শুনতে চাই। মীনাক্ষীদের প্রেমে যখন পড়লেন তখন কিভাবে সবকিছু সামলালেন? আপনি তো পড়াশুনা করেছেন দক্ষিণ ভারতে। বাংলার চেয়ে ইংরেজিতেই লিখতে এবং বলতে পছন্দ করতেন। শুনেছি একটা ইংরেজিতে লেখা প্রেমের কবিতা দিয়েছিলেন?
মীনাক্ষীর আশে-পাশে তখন অনেকেই ঘুরে বেড়ায়। আমি ভাবলাম বুদ্ধদেব বসুর কন্যা। একটা ইংরেজিতে প্রেমের কবিতা দেই। কিন্তু মীনাক্ষী বললেন ‘বাংলায় লিখে নিয়ে এসো’। ব্যাস। বুঝতে পারলাম, কাজটি এগোবে। বাক্য শেষ করতে করতেই তিনি মীনাক্ষীদির দিকে বাঁকা চোখে তাকালেন।
আমরা তখন এক চোট হেসে গড়াগড়ি খাই। এই ফাঁকে মীনাক্ষীদি রনে ভঙ্গ দিলেন চা বানানোর তাগিদে। আবার জ্যোতিদাকে একা-একা পেয়ে যাই। এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা প্রশ্ন করি।
জ্যোতিদা, ইদানিং অনেকেই আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্য রচনা করছেন। আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণ তথা মুখের ভাষায় সাহিত্য রচনা কি সম্ভব? তাছাড়া ইদানিং বাংলা ভাষার পিণ্ডি চটকানোর জন্য একদল লেখক সাহিত্যে প্রমিত ভাষা ব্যবহারের পরিবর্তে আঞ্চলিক শব্দ জুড়ে দেয়ার একটা রীতি শুরু করে দিয়েছেন তারই বা যৌক্তিকতা কতটুকু? এ বিষয়ে আপনার মতটা জানতে চাই।
না, না, না। আমি মনে করি সাহিত্যের ভাষা প্রমিত হওয়া খুবই জরুরি। শুধুমাত্র আঞ্চলিক শব্দ জুড়ে দিলেই চলবে না পাশাপাশি শব্দের যুৎসই ব্যবহার, সাহিত্যের রস এবং এর শৈল্পিক বিন্যাসের দিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। তবে সাহিত্যের ভাষায় আঞ্চলিক শব্দ জুড়ে দেওয়ার প্রবনতা নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে এ ধরনের প্রচেষ্টা টিকবে বলে মনে হয় না। শুধুমাত্র আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে সাহিত্য খুব বেশি একটা এগোতে পারে না। আগে সাহিত্য হওয়া চাই।
আমাদের বাংলা ভাষার সাথে প্রচুর বিদেশি শব্দ জুড়ে দিতেও একদল সকাল-বিকাল কাজ করে যাচ্ছে। যে ভাষার জন্য এতো ত্যাগ সেই বাংলা ভাষার ওপর এ ধরনের প্রচেষ্টাকে আপনারা কী চোখে দেখছেন?
লক্ষ্য করে দেখ, আমরা ছেলেবেলায় যে ভাষায় কথা বলেছি এখন সে ভাষা অনেক অংশেই বদলে গেছে। আমার কাছে কলকাতার ভাষাই এখন আর নিজের ভাষা বলে মনে হয় না। ভাষার অনেক পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে বাংলা ভাষার চেহারার এরকম পরিবর্তন মোটেই কোনো ভালো কথা নয়।
বাংলা ভাষা কি ভবিষ্যতে তাহলে বাংলাতে টিকে থাকবে বলে আপনারা মনে করেন?
ছেলেবেলায় আমাদের মজার একটা খেলা ছিল। কেউ যদি কথা বলতে যেয়ে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতো তাহলে তাকে নির্ঘাত জরিমানা করে তার কাছ থেকে এক টাকা নেওয়া হতো। এভাবে আমি মীনাক্ষীর কাছ থেকে প্রচুর টাকা পেতাম। ইদানিং আর সে রকমটা দেখা যায় না। একটা ভাষার সাথে আরেকটা ভাষার সংমিশ্রণে একটা খিচুড়ি ভাষা হোক, তা আমি কখনোই চাইবো না। যে কোনো ভাষার সাথে আরেকটা ভাষার মিশ্রণ হবেই তবে সেক্ষেত্রে ভাষার সৌন্দর্যটা কতটুকু থাকলো সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
মীনাক্ষীদি আবার চায়ের জন্য হাকডাক শুরু করে দিলেন। আমরা আপাতত আমাদের বাঙালি আড্ডাকে কিছু সময়ের জন্য মুড়িয়ে মীনাক্ষীদির তৈরি করা গরম চায়ের দিকে ধাবিত হলাম।
কে জানতো মীনাক্ষীদির এই হাকডাক চিরতরেই বন্ধ হয়ে যাবে? তার ভালোবাসা মিশ্রিত এই ডাক আর কোনদিনই শুনবো না, তার সঙ্গে আর কখনই দেখা হবে না! তিনি চলে গেলেন শীতের মিহি বরফের মতোই খুব ঠান্ডা শীতল কোন দেশে! কোন দেশে! যেখানেই মীনাক্ষীদি থাকুন, আনন্দে থাকুন।
ছবি © আহমাদ মাযহারের সৌজন্যে
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন