সাহিত্যে মেয়েলিপনা কি দোষের?
নারীদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করবার সময় প্রায়ই একটি কথা শোনা যায়, অমুকের গল্পগুলো মেয়েলিপনা দোষে দুষ্ট নয়! অমুকের লেখা পড়ে মনেই হয় না যে এটা কোন মেয়ের লেখা। এমন মন্তব্য পড়লে বা শুনলে কেন যেন থমকে যাই। মেয়েলিপনা তাহলে কি দোষের? ‘মেয়েদের’ মত চলা, ‘মেয়েদের’ মত লেখা, ‘মেয়েদের’ মত ভাবনা নিয়ে সমাজে পরিহাস ও সমালোচনার অন্ত নেই। কারও যদি আত্নবিশ্বাস ও সাহস একটু কম হয়, বলা হয়-মেয়েদের মত চুড়ি পরে হাঁটো গিয়ে! যেন পৃথিবীর সব মেয়েরই সাহস কম আর সকল পুরুষই সিংহপুরুষ। আমাদের এক বন্ধু ছিল খুব গোছানো, তার শোবার ঘর খুব সাজানো গোছানো থাকত, ড্রেসিংটেবিলে গুছিয়ে রাখত পারফিউমের সুন্দর বোতল; ক্লাসের অন্য ছেলেরা বলত সে নাকি খুবই মেয়েলি, একেবারে মেয়েদের মত! সেই সম্মিলিত হাসাহাসিতে আমরা মেয়েরাও যুক্ত হতাম। যেন গুছিয়ে রাখা, সাজিয়ে রাখা একটা অপরাধ, যেন মেয়েদের মত হওয়া খুবই লজ্জাকর একটা ব্যাপার। এই যে এই সময়ে ছেলেরাও গোলাপি পোশাক পরে বারবি সিনেমা দেখতে যাচ্ছে বলে অনেক হাসাহাসি হচ্ছে, যেন ছেলেদের রঙিন পোশাক পরা মানে অধঃপাতে যাওয়া। অনেক স্মার্ট নারী পুরুষকেও এই মেয়েদের রং গোলাপি আর ছেলেদের রং নীল জাতীয় হাস্যকর বোধে বিশ্বাসে ভুগতে দেখি। ভেবে দেখুন, ষাট সত্তরের দশকে ঢাকার রাজপথে শিল্পী শামীম সিকদারের ছোট করে ছাঁটা চুল আর শার্ট প্যান্টের অ্যাটায়ার বুদ্ধিজীবী ও সুশীলদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, কিন্তু একই সময়ে সুলতানের দীর্ঘ চুল আর শাড়ি পরার ব্যাপারটা তারা মেনে নিতে পারেননি। কারণ একজন নারী পুরুষকে অনুকরণ করতে পারেন বটে, কারণ পুরুষেরা অনুকরণীয়, মহান, উচ্চস্থানে অভিষিক্ত, কিন্তু নারীদেরকে অনুসরণ করা কি পুরুষের মানায়?
তাহলে এই সব কিছু দেখে-শুনে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে মেয়েলিপনা বা মেয়েলি বিষয়টা খুবই খারাপ জিনিস। সাহিত্যে বা জীবনে যে মেয়েরা মেয়েলিপনার উর্দ্ধে উঠতে পারেন তারাই কেবল পুরুষদের সমকক্ষ হবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন, একমাত্র তারাই পাতে নেবার মত। আর এদিকে পুরুষালিপনার সব কিছুই খুব ভাল। এই যে মেয়েরা পুরুষদের মত সিগ্রেট খায় না, রাস্তায় প্যান্ট খুলে পেশাব করে না, সুন্দর পুরুষ দেখলে শিস দেয় না, বাসে বা ভিড়ে পাশের পুরুষকে টিপে দেয় না—এসব তাহলে মেয়েদের যথেষ্ট উন্নত প্রজাতির মানুষ করে তোলে না। উল্টো দিকে যদি কোন মেয়ে ঘর সাজাতে ভালবাসে, ফুলদানিতে ফুল রাখে, নিজেকে সুন্দর করে সাজায়, পেডিকিউর-মেনিকিউর করে, আলমারিতে কাপড় গুছিয়ে রাখে সুন্দর করে, তাহলে সে ব্যাকডেটেড, আনস্মার্ট, বড্ড বেশি বেশি মেয়েলি। এই যে আমাদের নানি-দাদিরা চমৎকার সেলাই ফোঁড় করতেন, রুমালে ফুল তুলতেন, উল কি কুরশিকাঁটা বুনতেন, অসাধারণ রান্না করতেন, আচার বানাতেন—এগুলো নিয়ে অনেক স্মার্ট মেয়েরা হাসাহাসি করে। এগুলো আবার সুন্দর বা ভাল গুণ হল কবে? এগুলো মেয়েলিপনা। আর মেয়েলিপনা মানেই হাস্যকর।
এখন দেখা যাক সাহিত্যে মেয়েলিপনা বলতে আমরা কি বুঝি? মেয়েদের কাহিনী লেখা কি মেয়েলিপনা? মেয়েদের অনুভূতি, ঈর্ষা, বেদনা, ঘরের আর মনের ভেতরকার গল্প, দাম্পত্য, মেয়েদের বন্ধুত্ব, ঝগড়া বিবাদ—এগুলো মেয়েলি গল্প? তাহলে বলতে হয় বাংলায় সবচেয়ে বেশি মেয়েলি গল্প লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। শরৎচন্দ্র তো বটেই, বিভূতিভূষণের সাহিত্যও তথাকথিত ‘মেয়েলি’ দোষে দুষ্ট। সর্বজয়া ও ইন্দিরা ঠাকরুনের সম্পর্কটি একজন নারী সাহিত্যিকের পক্ষেও এত নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা শক্ত। আর হুমায়ুন আহমেদও তো মূলত মেয়েদের মন আর আবেগ নিয়েই খেলে সফল হয়েছেন, আর তাঁকে অনুসরণকারী পুরুষ লেখকের সংখ্যা এখনও কম নয়।
বলুন তো এই ভাবে আমাদের কে ভাবতে শিখাল যে মেয়েলিপনা মানেই দোষের, আর পুরুষালি সব কিছুই ভাল? আপনার নারীত্ব, আপনার স্বভাব প্রকৃতি, চাল চলন, আচরণ যে আসলে লজ্জার বিষয়, পরিহাসের বিষয়, আপনি যে হীনতর প্রজাতির মানুষ এই শিক্ষা আপনাকে কে দিল? দিয়েছে পুরুষতন্ত্রই। পুরুষতন্ত্রই শিখিয়েছে ঘরের কাজ করা বা সন্তান পালন করা ফালতু কাজ, চুড়ি পরা বা গয়না পরা মানে ভীরুতার লক্ষণ, সাজ সজ্জা বা গৃহসজ্জার মধ্যে মহৎ কিছু নেই, মেয়েদের আবেগ হল দুর্বলতা, আর মেয়েদের আড্ডা মানেই শাড়ি চুড়ির গল্প—যেন পুরুষেরা সারাক্ষণ শেক্সপীয়ার আর আইনস্টাইন নিয়ে কথা বলে, যেন পুরুষদের আড্ডায় কখনোই পরচর্চা, পরনিন্দা করা হয় না!
মুশকিল হল পুরুষতন্ত্রের এই ফাঁদে খুশিমনে মেয়েরাও পা দিয়ে বসে আছে। একদিন টেলিভিশনে শুনি এক নারী সঞ্চালক আরেক নারী সাহিত্যিককে প্রশ্ন করছেন—এই যে নারীবাদ, নারীদের গল্প থেকে নারীদের সাহিত্যকর্ম বের হতে পারল না... ইত্যাদি ইত্যাদি, যেন নারীদের গল্প একটি খুবই মেয়েলি বিষয়, এবং ব্রাত্য বিষয়ও বটে। এমনকি একজন নারী লেখককেও একদিন শুনি অন্য একজন নারী লেখক সম্পর্কে মন্তব্য করছেন যে, ওনার লেখা মা ভাবি শাশুড়ির জীবনকে ঘিরে, এর ওপর আর উঠতে পারেনি, যেন মা ভাবি শাশুড়িরা এই সমাজের কেউ নন, তারা সমাজের বাইরের মানুষ, লেখার যোগ্য বিষয়ই নন। শ্রেণী হিসেবে এই অধঃস্তনতা মেয়েরাও সানন্দে মেনে নিয়েছে। তাই শিক্ষিত ও স্মার্ট মেয়েরা সব ধরণের মেয়েলিপনা ছেড়ে নিজের শ্রেনী থেকে ওপরে উঠতে সচেষ্ট। এমনকি নারী সাহিত্যিকরাও। তাদের লেখার ধরন যেন কোনভাবেই মেয়েলি না হয় সেদিকে তারা খুবই সতর্ক।
নারীদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করবার সময় প্রায়ই একটি কথা শোনা যায়, অমুকের গল্পগুলো মেয়েলিপনা দোষে দুষ্ট নয়! অমুকের লেখা পড়ে মনেই হয় না যে এটা কোন মেয়ের লেখা। এমন মন্তব্য পড়লে বা শুনলে কেন যেন থমকে যাই। মেয়েলিপনা তাহলে কি দোষের? ‘মেয়েদের’ মত চলা, ‘মেয়েদের’ মত লেখা, ‘মেয়েদের’ মত ভাবনা নিয়ে সমাজে পরিহাস ও সমালোচনার অন্ত নেই। কারও যদি আত্নবিশ্বাস ও সাহস একটু কম হয়, বলা হয়-মেয়েদের মত চুড়ি পরে হাঁটো গিয়ে! যেন পৃথিবীর সব মেয়েরই সাহস কম আর সকল পুরুষই সিংহপুরুষ।
এখন দেখা যাক সাহিত্যে মেয়েলিপনা বলতে আমরা কি বুঝি? মেয়েদের কাহিনী লেখা কি মেয়েলিপনা? মেয়েদের অনুভূতি, ঈর্ষা, বেদনা, ঘরের আর মনের ভেতরকার গল্প, দাম্পত্য, মেয়েদের বন্ধুত্ব, ঝগড়া বিবাদ—এগুলো মেয়েলি গল্প? তাহলে বলতে হয় বাংলায় সবচেয়ে বেশি মেয়েলি গল্প লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। শরৎচন্দ্র তো বটেই, বিভূতিভূষণের সাহিত্যও তথাকথিত ‘মেয়েলি’ দোষে দুষ্ট। সর্বজয়া ও ইন্দিরা ঠাকরুনের সম্পর্কটি একজন নারী সাহিত্যিকের পক্ষেও এত নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা শক্ত। আর হুমায়ুন আহমেদও তো মূলত মেয়েদের মন আর আবেগ নিয়েই খেলে সফল হয়েছেন, আর তাঁকে অনুসরণকারী পুরুষ লেখকের সংখ্যা এখনও কম নয়। অথচ পুরুষ সাহিত্যিকদের কখনো শুনতে হয়নি যে তাদের লেখা মেয়েলি নাকি পুরুষালি। তাদের লেখা ‘লেখা’ই, আর কিছু নয়। কিন্তু মেয়েদের লেখা হয় মেয়েলি লেখা, নয়তো তার একটু ওপরে, মেয়েলিপনা দোষ কাটিয়ে উঠছে এমন!
অথচ এই বাংলায় চন্দ্রাবতী যখন রামায়ণ লিখেছেন তখন গোটা থিমটাই পালটে তাকে আরও আধুনিক করে তুলেছেন। বেগম রোকেয়া লিখেছেন দুর্দান্ত স্মার্ট সব গদ্য, ‘সুলতানার স্বপ্ন’র মত বাংলায় প্রথম ফ্যান্টাসি বা কল্পগল্প, সেও তো মেয়েদেরকে নিয়েই। রোমেনা আফাজের মত থ্রিলার লেখকও পেয়েছি আমরা সেই কবেই। বেগম সুফিয়া কামালকে মেয়েলি বলবেন? কিন্তু এমন মেয়েলি হওয়া আপনাদের বস্তাপচা চিত্রনাট্য আর ন্যাকা উপন্যাসের চেয়ে ঢের ভাল। দীপাবলি বা জয়িতা যে নারীবাদ শিখিয়েছে আপনাদের, তার চেয়ে ঘোর বাস্তব, ঘোর কঠিন নারীবাদ আপনি শিখবেন আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজিতে, সেই মা মাসিদের গল্পের মধ্যেই।
আপনার লেখা মোটেই মেয়েলি নয়—এই মন্তব্য শুনলে তাই আমার গা জ্বালা করে। আমি মেয়েলি লেখাই লিখতে চাই আজীবন, লিখতে চাই নারীদের গল্পই, সাহিত্যে পুরুষপনার প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই! জয় হোক মেয়েলিপনার।
চমৎকার একটা লেখা।
সাথী চৌধুরী
সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪ ১৭:২৫
চমৎকার একটা লেখা।
সাথী চৌধুরী
সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪ ১৭:২৭
চমৎকার একটা লেখা।
সাথী চৌধুরী
সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪ ১৭:২৮
চমৎকার একটা লেখা।
সাথী চৌধুরী
সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪ ১৭:২৯
চমৎকার একটা লেখা।
সাথী চৌধুরী
সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪ ১৭:৫৯
চমৎকার একটা লেখা।
সাথী চৌধুরী
সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪ ১৭:২৪