একটি ভূত বিষয়ক গল্প
মা গল্প করতেন। গল্প করতে করতে নিশ্বাস ফেলতেন। এই নিশ্বাস ছিল মনের মণিকোঠায় আজন্ম লালিত ছেড়ে আসা ভূমির প্রতি তাঁর দীর্ঘশ্বাস!
আমরা ভাইবোনেরা মায়ের গল্প শুনতাম। সবচেয়ে বেশি শুনতাম এই আমি। ছোটো সন্তান হওয়ায় মায়ের গল্পের মনোযোগী শ্রোতা ছিলাম আমি। কত কথা বলতেন; কত গল্প করতেন আমার মা! তাঁর বাড়ির বিভিন্ন বিষয় আশয়ের সঙ্গে পরিচয় করাতে গিয়ে পরীর কথাও বলতেন! বলতেন, ‘আমরার বাড়ির বাঁশঝাড়োর একটা আগা থাকতো নারে! কেউ কোনোদিন দেখছে না! ইতা সব ওউ আমরার বাড়ির পরীয়ে বাঙ্গি [ভেঙ্গে] লেইতো। আর প্রকৃতির ডাকে কেউ সাড়া দিতে গভীর রাইত উঠলে দেখতো তাই [সে] বেটিয়ে ঝাড়ু দের। যদি তাই দেখি লেইছে তে তুমি বিপদো পড়ছো। তুমারে মামা মামা করি ডাক দিব। জবাব দিয়া ফিরিয়া চাইলে তুমি শ্যাষ। আর না চাইলে তাই আকুতি-মিনতি করি ডাক দিব। কইব, ‘মামা, ও মামা। একবার ফিরিয়া চাও বা। একবার। ও মামা।’ তুমি চাইলায় না, জবাব দিলায় না। সকালে উঠিয়া দেখলায় উঠানো এক কাউয়া মরি রইছে।’
বাবাও বলতেন। বলতেন, তাঁর গৃহ শিক্ষক একজন ছিলেন অশরীরী! বাবার বক্তব্য একটু ভিন্ন আঙ্গিকের হওয়ায় তাঁর বক্তব্য কোড করা সমীচীন মনে করছি না।
আমাদের ছেলেবেলার পরিবেশ-ই ছিল এরকম। চারদিকে ভূত-প্রেত-পেত্নি-পরী! এসব নিয়ে বেশ কথাও শোনা যেত। বন্ধুবান্ধব অনেকে-ই নিজের চোখে দেখে এসেছে বলে গালগল্প ছড়াতো চারদিকে! একটা ভীতির সঞ্চার হয়ে যেত চরাচরে!
এসবে একসময় বিশ্বাস করতাম না যে তা কিন্তু না। ভীতি মনে ঢুকেছিল সেই শৈশব থেকে-ই। ভয়ে ঘরের ভেতরে-ই একাকী দিনে কিংবা সন্ধ্যারাতে এঘর- ওঘর হতাম না। বাবা ধমক দিতেন। তারপর সাহস দিতেন। দিয়ে বলতেন, ‘খামোখা ডরাইস না রে। কোনো ডর নাই। সব মনোর [মনের] ডর।’ বাবার কথায় বুকে দম ফিরে আসত। সাহস সঞ্চয় করে ফের দাঁড়াতাম। এঘর-ওঘর হতাম।
অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটি কথা বলি এখন। আমাদের বাবা ছিলেন একজন মেধাবী পুরুষ। একসঙ্গে অনেকগুলো গুণের সমাবেশ দেখেছি আমি তাঁর স্বল্পায়ুর জীবনে। এই প্রসঙ্গে ভাষা বিষয়ক বাবার আরেকটি গুণের কথা আপনাদের শেয়ার না করে আমি আমার মনোজগতে শান্তি পাচ্ছি না। নিজ মাতৃভাষা আর ইংরেজি ভাষা ছাড়াও বেশ কয়েকটি ভাষার ওপর বেজায় দখল ছিল বাবার। বলতেও পারতেন অনবরত! সত্তরের দশকের মাঝামাঝি আমরা যখন বগুড়া শহর ছেড়ে-ছুড়ে স্থায়ীভাবে সিলেট শহরে চলে আসছি, সেই সময়ে ঢাকা-সিলেট রুটের ট্রেনে বাবাকে দেখেছিলাম একজন মণিপুরি ভদ্রলোকের সঙ্গে অনবরত মৈতৈ ভাষায় কথা বলতে। ভদ্রলোক হাসছিলেন আর কথা বলছিলেন। ভাবখানা এই, বাঙালি ভদ্রলোকও দেখি আমাদের মৈতৈ ভাষা জানেন!
যাইহোক, শেষ পর্যন্ত মণিপুর ভদ্রলোকটি বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন, এবং মাঝেমধ্যে হঠাৎ হঠাৎ আমাদের দৌলতখানায় ঢু মারতেন। বাবার সঙ্গে গল্প-গুজব করতেন! এই গল্প করতে করতেই একদিন বলে উঠলেন, ‘লস্করসাব, আমরার বাড়ি ইটা দুষী [অশরীরী উৎপাত আছে]। কোনো কুকুর আমরার বাড়িত বাঁচে না। মারি লায় [মেরে ফেলে]!’
এভাবে এসব বিভিন্ন কথা শুনতে শুনতে মিশ্র একটা ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠেছি। কিছু অভিজ্ঞতা নিজেরও হয়েছে। কিন্তু সেই সব অভিজ্ঞতায় ভূত-প্রেত-পরী নামের কোনো অশরীরীর সঙ্গে মুলাকাত কখনো হয়নি। কাজেই এসবে বিশ্বাস করি কীভাবে?
বন্ধু মকবুল প্রমাণে উঠেপড়ে লাগল। তার আগে আমার এই বন্ধু মকবুল সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। মকবুলের ছিল একচোখ, অর্থাৎ একচোখে সে দেখত। অন্য চোখটি নষ্ট ছিল। যে কারণে সে সবসময় কালো গগল্স ব্যবহার করত। আর দেখলেও মনে হয় ঠারেঠোরে দেখত। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত আমার সঙ্গে ছিল। তারপর করনিক হিসেবে একটি সরকারি স্কুলে ঢুকল। বিএ, এমএ, এলএলবি করল। আমিও পিওর সাইন্স নিয়ে বিএসসি পাশ করে বাড়ির পাশে-ই একটি হাই স্কুলে যোগদান করলাম। নতুন টিচার হওয়ায় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ক্লাস নিতে হতো; কষ্ট করতে হতো। আনন্দেই ক্লাস নিতাম। কষ্ট করতাম।
যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় ছিল রোববার হলিডে। মকবুল রোববার বিকেল হলে-ই সবকিছু ছেড়েছুড়ে আমার সকাশে আসত। তারপর সারাটা বিকেল সঙ্গে কাটিয়ে সন্ধে নাগাদ বাড়ি ফিরত। ওর বাড়ি ছিল হাওর পারে। খুব গর্ব করে বলত হাওর পারের সন্তান আমি।
‘তোরে কইলাম আমার বাড়িত থাকতে একরাইত। না, থাকলে না। আর কিছু না দেখোছ আমরার পুরান বাড়িত ভূত তো দেখবে; উপলব্ধি করবে। বিশ্বাস তো অইবো।’
বললাম, ‘ব্যাটা ছাগল!দেখা আর উপলব্ধি করা এক জিনিস না। দুই জিনিস।’ ‘আমি দুয়োটা কইছি। দেখবে আর উপলব্ধি করবে।’
অবশেষে এক রোববার সোমবার ছুটি থাকায় মকবুলের বাড়ি গেলাম। মকবুল-ই নিয়ে গেল। খালাম্মা খুব ভালো। বেশ যত্ন নিলেন।
মাহফুজাও কথা বলল। তখন মাহফুজা ইলেভেনে পড়ে। বাড়ি থেকে কলেজে যাওয়া-আসা করে। এত সুন্দর একটা মেয়ে মাহফুজা! তো প্রথম দর্শনেই আমি ওর প্রেমে পড়লাম। পরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ওকে জীবনসঙ্গিনী করেছি।
যাইহোক, একটা সময় বেশ খাওয়া-দাওয়া হলো। খালাম্মা নিজে উপস্থিত থেকে খাওয়ালেন। মাহফুজা সার্ভ করল।
তখন কিন্তু কারেন্টের বালাই নেই শহরতলীতে। আর গ্রামদেশ, আবার হাওর পার! একটু রাত হলেই সব নীরব; নিস্তব্ধ!
একটা সময় জিজ্ঞেস করলাম, ‘কইবে তোর ভূত?’
ও আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে চুপ থাকতে বলল। বুঝলাম সময় এখনও হয়নি। তারপর একটু রাত নিশুতি হতে-ই ও গাইগুই শুরু করল।
‘ইকবালরে যেইতে নিরে?’
আমার উত্তর দেয়ার আগে ও নিজেই উত্তর দিল।
বলল, ‘না, যাইস নারে ভাই। ই সময় কেউ যেইতো নারে আমরার পুরান বাড়িত। আমরার ছোটোভাই ওউ পুরান বাড়িত তাকি ফিরিয়া মুখো ফেনা উঠিয়া মরছে। আর আমরার বড়োচাচি বছর বছর পাগল অইন ওউ পুরান বাড়িত গিয়া।’
আমাকে দমিয়ে দিতে ও অনেক গালগল্প করল, অনেক কাহিনি শোনালো। কিন্তু যখন কিছুতেই আমাকে নিবৃত্ত করতে পারল না, তখন খালাম্মা আর মাহফুজাকে নিয়ে এল।
খালাম্মা বললেন, ‘বাবারে, আমি তুমারে যেইতে দিতাম নারে বাবা। ই পুরান বাড়িত দিনোও মানুষ যায় না, আর এখন তো রাইত!তুমার যদি কুনতা অয়, আমি কী জবাব দিমু তুমার মা-বাবার টাইনরে [কাছে রে] বাবা।’
মাহফুজাও একই কথার প্রতিধ্বনি করল।
আমার পারিবারিক শিক্ষা হলো আমি মুরুব্বি মানি। তাঁদের কথা শুনি। কাজেই আপাতত আর কথা বাড়ালাম না। নিশ্চুপ থাকলাম।
খালাম্মা আর মাহফুজা বাড়ির ভেতরে গেলেন।
তো যে কথা বলছিলাম, আমাদের সকলের ভেতর কিন্তু একটা জিজ্ঞাসু মন আছে। এবং সেই জিজ্ঞাসু মনের কাছে আমরা নিজেরা-ই প্রশ্ন করি, আবার নিজেরা-ই উত্তর দিই। তারপর স্থান-কাল-পাত্রভেদে উত্তর মিলিয়েও দেখি।
আমার জিজ্ঞাসু মন এবার প্রশ্ন করতে শুরু করল।
‘কিতারে ব্যাটা, কিতা উদ্দেশ্য নিয়া বন্ধুর বাড়িত আইসোত? প্রেম করতে নি?’
‘আলবত না। তবে ইচ্ছা আছে। অতো সুন্দর একটা মেয়ে!’
‘তে প্রেম কর। আর তো ভূত আছে উপলব্ধি করি লেইসোত; বিশ্বাস করি লেইসোত। চালাইয়া যা।’
বিদ্রোহ করলাম। স্থান-কাল-পাত্রভেদে উত্তর মিলিয়েও দেখলাম। কিন্তু মন মানল না। সিদ্ধান্ত নিলাম, যে কোনো উপায়ে সকলে ঘুমিয়ে পড়লে তারপর বের হব।
কিন্তু পারলাম না। শেষমেশ, মকবুল সঙ্গী হলো।
তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা অতিক্রম করে মিনিট দশেক হয়েছে। আমরা টর্চলাইট জ্বালিয়ে পুরান বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করছি হাত প্রায় ধরাধরি করে। হঠাৎ মকবুল আবার গাইগুই শুরু করল। ‘এই ইকবাল বাদ দে, বাদ দেরে ভাই। আর নায় তুই যা।’ বললাম, ‘ধ্যেত ব্যাটা আয়।’ না ও এলো না। টর্চ জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। টর্চের আলোয় বীরদর্পে এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ আমার চোখ স্থির হয়ে গেল চোখ জ্বল জ্বল করা চারটা চোখ দেখে। নিস্তব্ধ, অথচ চারটা চোখ এদিক-ওদিক করছে। সেই সময় আমার যে ভয় করেনি তা কিন্তু না। ভীষণ ভয় করছিল। মনে হয়েছিল তখন-ই দৌড় দিই। পিতৃপ্রদত্ত প্রাণটা বাঁচাই। পরে ভাবলাম আমার অনেক কাজ আছে। এ সময় আমাকে মরলে মানাবে না। কোনো সখও পূরণ হবে না। কাপুরুষ মরে বার বার, বীরপুরুষ একবার বলে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম মকবুল আছে কি নেই খেয়াল না করে। না, দেখি মকবুল আছে। এবং টর্চলাইট নিয়ে এগুচ্ছে।
পরে হায়রে কী হাসাহাসি! ঘটনা হচ্ছে ভাদ্র মাস হওয়ায় এই রাতের বেলায় দুই কুকুর পরস্পর সঙ্গমে মিলিত হয়ে আটকে গেছে।
তারপর তো কী আশ্চর্য মকবুল ঠিক হয়ে গেল। আমার মতো সেও অবিশ্বাসী হয়ে উঠল।
আর এখন তো সে অ্যাডভোকেট হয়ে রাজনীতি করে। রাজনীতি মানে একদম সর্বহারার রাজনীতি; কমিউনিস্ট পার্টি। কোনো বিশ্বাসে-ই সে নেই!
এদিকে আস্তে আস্তে সুরমারও অনেক জল গড়িয়েছে। পৌরসভা গেছে, সিটি কর্পোরেশন হয়েছে; চেয়ারম্যান বদলে মেয়র হয়েছে। বিভাগ হয়েছে। কত্তকিছু হয়েছে! এমনকি ওসমানি বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক হয়েছে।
আগেও বলেছি, এখনও আবার বলছি, শেষমেশ অনেক নাটক করে মাহফুজাও আমার হয়েছে। অ্যাডভোকেট হয়ে সে আমাকে আপন করেছে। কিন্তু বংশ পরম্পরায় অর্জিত সংস্কার মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি।
আমারও ভুল ছিল। প্রথমে যেটা করেছিলাম বিয়ের পর ওর কোর্ট মূল শহরে হওয়ায় ওর-ই সুবিধার্তে মূল শহরে বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম। বাসাটা ছিল রেললাইনের ধারে একটু নিরিবিলিতে। দুই বেডরুমের এই একটু সস্তা বাসায় দক্ষিণা হাওয়ার অবাধ বিচরণ ছিল। আর ছিল গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ।
বাসাটিতে বসবাস করার এক, দুই, তিন, চারদিন পর ও বলল, ‘বাসাটা তো দুষী। সন্ধ্যার পর তো তুমি তো থাক না, মেয়ে একটায় পাকঘরোর অনো [কাছে] মা, মা করি ডাকে। আমার জান উড়ি যায়।’
বললাম, ‘আশেপাশে কেউ হয়ত ডাকে। বালামতে খেয়াল করি দেকিও।’ ‘আরে না, সব খেয়াল করি দেখছি। কুনতা নাই।’
‘কুনতা নাই মানে!’
‘কুনতা নাই মানে কুনতা নাই। মিলি পাশের বাসা তাকি সবতা শুনিয়া আইয়া আমারে কইছে। ওউ দুইমাসোর মধ্যে তিন ভাড়াটিয়া বদলিছে। আমি নাই। তুমি থাকলে থাকো, আমি কাইল বাড়িত যেইরামগি।’
বললাম, ‘একটু সময় দেও। আমি পরখ করি দেখি।’
‘দেখো, হাজার বার দেখো। কুনো অসুবিধা নাই। কিন্তু আমি নাই। ওয়ার্ড ইজ ওয়ার্ড।’
যাইহোক, দিন কয়েক একাকী বসবাস করে শেষমেশ বাসা বদল করতে হলো আমাকে। এবার বাসা নিলাম তোপখানাতে। তোপখানা মানে সুরমার পারের ওই আবাসিক এলাকাতে।
পূর্বের রেললাইনের ধারের নিরিবিলি বাসা সম্পর্কে দু-এক কথা না বললেই নয়। বাসাটি ছিল ভাস্টেড ল্যান্ড অর্থাৎ শত্রুসম্পত্তি ভূক্ত। লোকাল কমিশনারের কুনজর পড়েছিল বাসাটির ওপর। তিনি বাসাটি দখল নিতে হরবোলা একটি ছেলেকে নিয়োগ দিয়েছিলেন, যে সন্ধের পর অতি সাবধানতার সঙ্গে কখনও বিড়ালের ডাক, কখনও কুকুরের ডাক আর কখনও মেয়েলি কণ্ঠে মা, মা করে ডাক পারত।
নতুন বাসায় কথা প্রসঙ্গে একদিন মাহফুজাকে কথাগুলো বলেছিলাম। মাহফুজা আগ্রহ দেখায়নি।
তোপখানার ওই বাসায় মাস দু-এক বেশ শান্তিতে-ই ছিলাম। মাহফুজা কোনো অভিযোগ করেনি। সকালে উঠে যথারীতি কোর্টে যেত, আর বিকেল হলে-ই ফিরে আসত। নতুন হলেও কোর্টে ভালো-ই পসরা জমিয়েছিল। আমিও স্কুল থেকে এসে সন্ধের দিকে বেরুতাম। নাইট কলেজে এলএলবি পড়তাম।
ততদিনে শীত জাকিয়ে বসেছে। আমাদের সিলেটের শীত বাব্বা এমনিতে জব্বর! মডেল স্কুলে এলএলবি ক্লাস করে আড্ডা-টাড্ডা মেরে প্রায় প্রতিদিন-ই নটা-দশটা নাগাদ ঘরে ফিরতাম। প্রথম প্রথম মাহফুজা কিছু না বললেও একটা সময় বকাঝকা শুরু করতে কোনো দ্বিধা করল না। ক্রমে-ই এর মাত্রা বাড়তে থাকলে ওর দেয়া টাইমফ্রেমের মধ্যে-ই ফিরতে চেষ্টা করতাম। বউ বলে কথা। বউয়ের কথা শুনতে হয়। তারপরও ব্যতিক্রম হয়ে যেত; ফিরতে দেরি হতো। এরূপ একদিন দেরি করে এসে দেখি বউ আমার কাঁদছে আর বিলাপ করছে। ‘আমি মরলে তুমি তো ভাগ্যবান। নতুন বিবি ঘরো আইবো। ভাগ্যবানের বউ মরে, অভাগার মরে গরু।...’—কত কথা বলছিল বউ।
বললাম, ‘লক্ষ্মী, কিতা অইছে?’
‘কাইল রাইত কিছু টের পাইছলায়নি?’
কিছু যে টের পাইনি তা কিন্তু না। কী একটা যেন চড় চড় করে মেঝেতে হাঁটছিল মিনিট দশেক। তারপর আবার বিরতি দিয়ে চড় চড় করছিল। তারপর তো ঘুমিয়ে-ই গেলাম। এক ঘুমে রাত পোহাল। কিন্তু বউকে তো এসবের সামান্যতমও হিন্টস দেয়া যাবে না। হিন্টস দিলেই আবার বাসা বদল করার হুজ্জত পোহাতে হবে। বাসা বদল করা কি চাট্টিখানি কথা!
বললাম, ‘না, কুনতা টের পাইছি না।’
‘মরার ঘুম ঘুমাইলে টের পাইতায় না; শুনতায় না। কাইল সারারাইত আমি ঘুমাইছি না। ওউ শুনো মেঝেত কে চড় চড় করে।’
হ্যাঁ, কিছু একটা যেন মেঝেতে চড় চড় করে হাঁটছে। একতলা বাসায় এটা আবার কী! আশ্চর্য হয়ে গেলাম। তন্ন তন্ন করে সবকিছু খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও কোনো কিছু পেলাম না। তবে আমাদের পাকঘরের নিচ দিয়ে একটি ড্রেন গেছে, এদিক দিয়ে হয়ত কোনো ইঁদুর ঢুকে এসব করছে। ইঁদুর তো গর্ত করতে পারে।
কিন্তু বউকে বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। দুদিন না ঘুমিয়ে পরদিন সকালে উঠে ও বাপের বাড়ি গেল। তারপর সপ্তাহ দিন বাদে বাড়ি ফিরল।
ভাড়া বাসায় আমাদের আর কখনো বসবাস করা হয়নি।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন