লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [প্রথম পর্ব]
‘মানুষের এমন কিছু কিছু জায়গা থাকতে হয়, যেখানে সে নিজেকে মেলে দিতে পারে’—আমি তাকে এই কথা বলেছিলাম একদিন। যা হোক, আমি না বললেও সে নিজে থেকে হয়তো বলতো তার জীবনের কথা, বেদনা ও অপ্রাপ্তির কথা, সাফল্যের কথা।
► প্রথম পর্ব
মেয়েটির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল শরতের এক বিষণ্ন সন্ধ্যায়। উদভ্রান্ত চোখ, রুক্ষ চুল, মুখের চামড়ায় দীর্ঘ ক্লান্তির ছাপ। যেন অনেক দিন নির্ঘুম। যেন প্রাণহীন। যেন ভালবাসাহীনতার ছায়া তার সর্বাঙ্গে। তবু, এসবের মধ্যেও তার চেহারায় কোনো এক গোপন আকর্ষণ ছিল, যা আমাকে টেনেছিল। সেই সন্ধ্যায়, আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে, সে চমৎকার কবিতা আবৃত্তি করেছিল শিল্পকলা একাডেমির মাঠে। আসলে ওই কবিতা শুনেই আমি তার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী হয়েছিলাম।মঞ্চ থেকে যখন নেমে আসছিল, আমি কিছু না ভেবেই তাকে বলি যে সে খুব সুন্দর আবৃত্তি করলেও কবিতা নির্বাচনে তার আরেকটু সতর্ক হওয়া উচিত। সে হাসে। এমনভাবে, যেন সম্মতি আছে আমার কথায়। উপরন্তু ওই হাসিটায় আরও নানাবিধ অর্থের ভেতর তার সঙ্গে হাঁটারও ইঙ্গিত ছিল হয়তোবা। যেন তার আরও কথা আছে এসব বিষয়ে। আমরা মাঠের এক কোণে গিয়ে বসি। সে এর মধ্যে তার সঙ্গীদের কাছ থেকে ইশারা, ইঙ্গিত আর ছোট ছোট বাক্যের মাধ্যমে সাময়িক বিদায় নিয়ে ফেলেছে। ওখানে বসেই তার সঙ্গে পরিচয়ের প্রাথমিক পর্বটি শেষ হয়। ভ্রাম্যমান চা ওয়ালার কাছ থেকে চা খেতে খেতে কথা বলি আমরা।
তার শহর এখান থেকে অনেক দূরে। কিন্তু এখন এ শহরের সে স্থায়ী বাসিন্দা। বিবাহিত, অসুখি এবংএক সন্তানের জননী। এসব কথা অবশ্য প্রথম সাক্ষাতেই আমি জানতে পারিনি, পরবর্তী দেখা হওয়ার সময়ে সে আমাকে তার সম্পর্কে ধীরে ধীরে জানায়। বেশিরভাগ মানুষই প্রথম দেখায় একটু গুটিয়ে থাকে, নাড়া পেলে শামুক যেমন করে গুটিয়ে নেয় তেমন, ব্যক্তিগত কথাগুলো প্রকাশ করে না। যদিও সেজন্য তাদেরকে দায়ী করা যায় না, কেননা ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তাই সম্ভবত একজন মানুষের সামগ্রিক সুরক্ষার জন্য সবচেয়ে জরুরি।
আবৃত্তিকারদের সম্পর্কে কবিদের একটা নাক সিঁটকানো ভাব থাকে অনেক সময়। কোথায় যেন পড়েছিলাম—কবিরা ধরেই নেয়, যে কবিতাগুলো আবৃত্তিযোগ্য সেগুলোই জগতের সবচেয়ে ফালতু কবিতা। তা ছাড়া, আবৃত্তি শিল্পীদের অনাবশ্যক আবেগ সময়ে সময়ে কবিদের বিব্রতও করে বৈকি। যদিও এ দুটো ধারণার সপক্ষে ও বিপক্ষে প্রচুর যুক্তি রয়েছে। যা-ই হোক, একজন কবি হিসেবে আবৃত্তি শিল্পীদের ওপর আমার কোনো বিরূপ ধারণা নেই। যেহেতু আমার কাজ আর তার কাজ কিছু মাত্রায় সম্পর্কিত হলেও বেশ আলাদা।
জানি না, ঠিক কী কারণে সে সেদিন আমার সঙ্গে হেঁটে এসে মাঠের কোণটাতে বসেছিল। তবে এরপর থেকে আমাদের দুজনার জীবনের অনেক কিছু পাল্টে যেতে থাকে। এর পরদিনও আমাদের দেখা হয়, তার পর দিন দেখা হয়, তার পরের দিনও। এভাবে বিরতিহীন নবম সাক্ষাতের পর আমরা একে অপরের প্রেমে পড়ে যাই। কিন্তু তা অনেকদিন পর্যন্ত আমরা কেউ কাউকে বলিনি। যদিও প্রথমদিকে সে বেশ দ্বিধাগ্রস্ত ছিল আমাদের সম্পর্কটি নিয়ে। কেননা, ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সে ছিল আমার চেয়ে আরো বেশি উজ্জ্বল, ধারালো ও সফল। উপরন্তু তখন তার জীবনে তখন এমন একটি ক্রান্তিকাল চলছিল যে, তার পাশে একজন প্রবল পুরুষের উপস্থিতি দরকার ছিল। যে তাকে সমূহ সংকট থেকে উদ্ধার করে রূপকথার রাজপুত্রের মতো জয় করে নেবে। যে তাকে আগলে রাখতে পারবে তার পুরুষসুলভ স্বভাব দিয়ে, অন্তত সে তাই চাচ্ছিল। ভাবনাটা মেয়েলি, আর মেয়েলি বলেই হয়তো সেটা তার জন্য যৌক্তিক। কিন্তু, আমার মধ্যে সেই উদ্যোগ অথবা চারিত্রিক দৃঢ়তার কোনোটাই ছিল না। কাঙ্ক্ষিত পুরুষের যে মূর্তিটি তার মনে ছিল [সম্ভবত সব মেয়ের মনেই থাকে], তার উচ্চতাই হবে কমপক্ষে ছয় ফুট, বৃষস্কন্ধ, গমগমে গলা ও সুঠাম শরীর আর ব্যক্তিত্বেও বেশ ভারী। আর আমার শারীরিক গঠন, কণ্ঠস্বর, উচ্চতা এসবই ছিল তার উল্টো। ফলে, আমার সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী প্রেমের সম্পর্কে যাবে কিনা এ নিয়ে বেশ সংকাটাপূর্ণ মানসিক অবস্থায় ছিল সে।
আমি দেখেছি, এসব ক্ষেত্রে যদি কাউকে প্ররোচিত করা হয়, তার ফল উল্টো হতে পারে। ফলে, আমি জানতাম, সম্পর্কটিকে প্রেমের দিকে নিতে হলে এক ধরনের নির্লিপ্তি আমার দিক থেকে থাকতে হবে। আমি তা-ই করি। অথবা, হয়তো অবচেতনে সেটা হয়। কেননা, এই নির্লিপ্তির অনেকটাই আমার স্বভাবগত। তার প্রবল পুরুষের আকাঙ্ক্ষা আমাকে জেদি করার চেয়ে বরং নির্লিপ্ত আর দৃশ্যমানভাবে উদ্যোমহীন করে দেয়। প্রেম বিষয়ক কথাবার্তা বলার চেয়ে আমরা সাংসারিক অথবা একাডেমিক কথাবার্তা বলতাম বেশিরভাগ সময়ে। কিংবা সাহিত্য বিষয়ক কথা। এসব বলতে বলতে তার আপাত গাম্ভীর্যপূর্ণ আচরণের ভেতরে একটা কোমল হৃদয় আমার কাছে প্রকাশিত হতে থাকে ক্রমশ। তার নিজস্ব অশান্তি আর জটিলতাগুলো আমার ভেতরে তার জন্য এক ধরনের মায়া তৈরি করে। তার অসহায়ত্ব সে ঢাকতে পারে না, যদিও সে এটা প্রকাশও করতে চাইতো না।
‘মানুষের এমন কিছু কিছু জায়গা থাকতে হয়, যেখানে সে নিজেকে মেলে দিতে পারে’—আমি তাকে এই কথা বলেছিলাম একদিন। যা হোক, আমি না বললেও সে নিজে থেকে হয়তো বলতো তার জীবনের কথা, বেদনা ও অপ্রাপ্তির কথা, সাফল্যের কথা। কেননা, খোলসের ভেতরে ঢুকে থাকা খুব কঠিন কাজ। আর দীর্ঘসময়ের জন্য তো তা প্রায় অসম্ভব। খুনির মধ্যেও যেভাবে থাকে বিষাদ, তেমনি তার কাঠিন্যের সমস্ত আবরণ একসময় খসে পড়তে থাকে। আমি ক্রমশই তার বিষাদিত আত্মার মধ্যে ঢুকে যেতে থাকি। যদিও সে সবসময় সচেতনভাবে চাইতো, তার সমস্যগুলো যাতে অন্যের মধ্যে প্রবাহিত না হয়, কেউ যাতে আক্রান্ত না হয়। এজন্য একটি দেয়াল সে তার চারপাশে তুলে রাখতো। কিন্তু, বিষয়টা এত সহজ নয়। হৃদয়ের সুগোপন গভীর থেকে কখনো কখনো উৎসারিত হয় এইসব বেদনা ধারা। আমাদের টুকরো টুকরো কথার প্রবাহের মধ্য থেকে আমি চিনে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম তার সত্ত্বার গভীরতর সীমানাটি। সেও হয়তো আমাকে চিনতে চাইছিল। অবশ্য সে ভাবত তার নিজের অত চেষ্টা করার দরকার নেই। মানুষ চেনার একটি সহজাত ক্ষমতা তার আছে। আমার তুলনায় অভিজ্ঞতায় শিউলি বেশ এগিয়ে ছিল। তাছাড়া স্থানীয়, জাতীয় এমন কি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ লোকেদের সঙ্গে বেশ জানাশোনা ছিল তার।
অন্যদিকে, নিজের পরিসরের চেনা মানুষগুলোর সঙ্গেও আমার দূরত্ব বাড়ছিল ক্রমশই। আর বিখ্যাত লোকেদের সামান্যতম অহংও আমি মেনে নিতে পারতাম না কখনো। নিজে যেচে আমি কোনো লোকের কাছে কখনোই যেতাম না, তা তিনি যতই বিখ্যাত বা ক্ষমতাধর ব্যক্তিই হন না কেন। এমনকি অফিসের বড় কর্তাদের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য ছিল। তাদের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হতেও আমার বাধতো না। এর ফলে এ ধরনের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের মাত্রাটা আমার একদম শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছিল। পেশাগত জীবনেও তার প্রভাব ছিল বেশ গভীর। যদিও আমি তা নিয়ে মোটেও ভাবিত ছিলাম না। আর ওর ব্যাপারটা ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। বড় আর গুণী মানুষদের সামনে এক ধরনের বিনয়াবত ভঙ্গি ছিল তার। হয়ত এটা হৃদয়গত, এমনই তার মানসিক গঠন। এটা আমার ভালো লাগতো। যদিও আমার নিজের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কখনোই আমি ঘটাতে পারতাম না। পারতাম না বলেই হয়তো ওর বিপরীতমূখী আচরণ ভালো লাগতো। ওর আচরণের কাছে আমার আচরণগুলোকে ভদ্রভাবে বলতে হলেও ম্যানারলেস কিংবা অসভ্য আচরণই বলতে হবে।
যা হোক, এ ধরনের বৈপরীত্য আমাদের প্রেমের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে কিনা এটা নিয়ে সে বেশ সংশয়ে ছিল প্রথম দিন থেকেই। কিন্তু বৈপরীত্যের মধ্যেই প্রকৃতপক্ষে সম্পর্কগুলো জমে ওঠে বলে বিশ্বাস ছিল আমার। আমি জানি, সম্পর্কে যদি সমস্য দেখা দেয় তাহলে পরস্পরের সাদৃশ্যপূর্ণ স্বভাবের কারণেই তা দেখা দেবে, বৈপরীত্যের জন্য নয়। আমি আমার এই বিশ্বাসের কথা তাকে বলিনি, কেবল সময়কে বয়ে যেতে দিয়েছি। কেননা, কী ঘটতে যাচ্ছে তা আমার অনুমিত ছিল। এ বিষয়ে আমার আত্মবিশ্বাসও ছিল প্রবল।
যদিও কেন যেন ওই টালটামাল সময়ে আমার মনে হতো, সে অন্য কোথাও যুক্ত হতে যাচ্ছে। হয়তো ওই সম্পর্কেও দ্বিধা ছিল ওর, যেমনটা আমার ক্ষেত্রে। যদিও আমি নিশ্চিত ছিলাম না এ ব্যাপারে, এটা তলিয়ে দেখার মতো তেমন আগ্রহও আমার ছিল না। স্বভাবগত নির্লিপ্তি অনেক অযথা কৌতুহল থেকে আমাকে প্রায়শই বাঁচিয়ে দেয়। যদিও মেয়েরা চায় সঙ্গে থাকা পুরুষেরা তাদের নিয়ে কৌতুহল দেখাক, তাদের নেইলপালিশের রং মনে রাখুক, চুলের ছাটের পরিবর্তনটা একবার তাকিয়ে দেখেই বুঝে ফেলুক আর নতুন কানের দুলে তাদের কেমন দেখায় তা অন্তত বলুক।
► আসছে দ্বিতীয় পর্ব
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন