চর্ব্য চোষ্য [উনবিংশ পর্ব]
পড়ুন ► চর্ব্য চোষ্য [অষ্টাদশ পর্ব]
চর্ব্য চোষ্য [উনবিংশ পর্ব]
চেয়ারম্যানের পিএর সেলফোনে গুরুতর খবর আসল। ভাওয়াল টাওয়ারে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। টাওয়ার অচল।
‘কী ধরনের সমস্যা?’ চেয়ারম্যান প্রশ্ন করলেন বটে। পিএ উত্তর দেয়ার আগেই বাসায় ফিরতে বললেন।
চেয়ারম্যানের গাড়িবহর তখন শওকত সড়কের পাশে তেজগাঁও শিল্প এলাকা হয়ে মতিঝিলের পথে। বহরের একটা গাড়িতে নাশিতা একা। ল্যাপটপে কাজ করছে। বহরটা শিল্প এলাকা থেকে উত্তর দিকে মোড় নিল। সামনেই হাতির ঝিল লেক উদ্বোধনের অপেক্ষায়। চেয়ারম্যান লেক দেখতে চাইলেন।
বহু পুরনো এই লেকের লেজ একসময় খাল-বিল হয়ে বুড়িগঙ্গার সাথে মিশেছিল। একাত্তরের পর লেকের পাশ দিয়ে বস্তি গড়ে ওঠে। নোংরা, ঘিঞ্জি বস্তিতে পুরো লেক ঢেকে যায় কালে কালে। লেক ঘিরে নান্দনিক বিনোদন কেন্দ্র গড়ার প্রসঙ্গ তোলেন চেয়ারম্যানের এক বন্ধু।
চেয়ারম্যান বললেন, ‘দারুণ চিন্তা! তাতে গুলশানও সুন্দর হয়ে উঠবে।’
দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে যথেষ্ট তদবির-তোয়াজ শুরু করেন চেয়ারম্যান। কয়েকজন আমলা আর রাজনীতির নেতাকে পাঁচ তারা হোটেল সোনারগাঁওয়ে কয়েক দফা ভূরিভোজও করান। আলোচনার দোহাই দিয়ে। অবশ্য চেয়ারম্যান সব সময় পেছনে ছিলেন। ব্যবসার বাইরে কোনো কাজে তিনি সামনে যান না।
বাংলাদেশ জন্মের বিয়াল্লিশ বছরে এই একটাই সুন্দর জিনিস পেয়েছে ঢাকাবাসী। লেকপারের সুন্দর রাস্তা, টলমলে জল দেখলে মন ভাল হয়ে যেতে পারে। তবে চেয়ারম্যান দুশ্চিন্তায় পড়লেন। লেকের চারপাশে যে পরিমাণ মুখের পর মুখ আর গুদ! একটার পর আরেকটা। দশটা-পনেরটা করে খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে। লাখ লাখ খুঁটি হাতে হাত ধরে খাড়া খাড়া। সবাই অনবরত হাগছে মুতছে। আর চুদছে আর বিয়োচ্ছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? চেয়ারম্যানের হাসিও পায়, রাগও হয়। তারচেয়ে তিনি বরং পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন।
আন্দোলনের কারণে ঢাকার রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা। সকাল নয়টা থেকে সাভারসহ কয়েকটা এলাকা দিয়ে ঢাকায় বাস আসতে পারছে না। সড়ক অবরোধ করে রেখেছে শ্রমিকরা। পুলিশ লাঠিচার্জ করে অবরোধ হটানোর চেষ্টা করছে। ছয় দিন ধরে সময়-অসময় চলছে এই কাণ্ড। এ কারণে ঢাকার রাস্তাও কখনও বেশি ফাঁকা হচ্ছে কখনও অতিরিক্ত যানজটে পড়ছে। সরকার এখন পর্যন্ত কাজের কাজ কিছু করেনি। শুধু আশ্বাস দিয়ে কাজে ফিরতে বলেছে। যা তাদের অভ্যাস। নির্লজ্জের মত।
চেয়ারম্যান বেজায় রেগে গেলেন। তিনি নিজের সেলফোন থেকে এক বড় মন্ত্রীকে কল করলেন। ‘কেমন আছেন, মিস্টার মিনিস্টার?’
‘জি। ভাল আছি। আপনি ভাল আছেন, ভাই?’
‘কেমন করে ভাল থাকতে হয় শিখতে হবে। ছয় দিন ধরে শেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আপনি ত খবর নিলেন না। একদিন শুধু এক নাদান প্রতিমন্ত্রী গেল। তারপর—।’
এটুকু বললেই কাজ হয়ে যায়। মন্ত্রী বুঝতে পারেন শিল্পপতি কী বলছেন। মিনিট দুই কথা বলাবলির পর ফোন রাখলেন চেয়ারম্যান।
পত্রিকাঅলাদের ওপরও চেয়ারম্যানের খুব রাগ হল। বেটারা দৈনিক শুধু কয়েক লাইন পুলিশ-শ্রমিক ধাওয়া-ধায়ির খবর দিচ্ছে। এটা কোনো খবর হল?
চেয়ারম্যান পিএর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এডিটরদের সালাম দেন।’
পিএ পরপর তিনজন এডিটরকে ফোন করে বললেন, ‘চেয়ারম্যান সার সালাম দিয়েছেন।’
রাগে চেয়ারম্যানের মুখ ভার হয়ে উঠল। ঘাড় শক্ত হয়ে রইল। রাগের মধ্যে বেশিক্ষণ থাকা ভাল লক্ষণ না। রাগ হলেই দ্রুত স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করেন চেয়ারম্যান। পানি বা মিষ্টি খান। টিভি চ্যানেল সার্ফ করেন। রাস্তায় থাকলে আশপাশে তাকান।
গাড়িবহর তখন লেক সড়ক থেকে শওকত সড়কে উঠছে। সামনে গুলশানের দক্ষিণ সীমা। শুরুতেই গুলশান দক্ষিণ পার্ক। বেশ বড়। ভাল বটে। সোয়া তিন কিলো লম্বা গুলশানের উত্তর সীমায় আছে আরো ভাল, বড় দুটি পার্ক। গুলশান বিনোদন পার্ক আর শাহাবুদ্দিন পার্ক। গুলশানকে তিন পাশ দিয়ে ঘিরে রেখেছে প্রশস্ত লেক। দক্ষিণে হাতির ঝিল লেক। পশ্চিমে বনানী লেক আর পুবে আছে গুলশান লেক। বনানী লেক থেকে গুলশান লেকের দূরত্ব সব জায়গায় কমবেশি পৌনে এক কিলো সমভূমি। গুলশান ভূমি।
শওকত সড়কে গেলে আবার চেয়ারম্যানের মন খারাপ হয়। দক্ষিণ পার্ক আর লেক সামনে রেখে আরেক গুলশান গড়ে তোলার ইচ্ছা ছিল তার। সেখানে ভাওয়ালের অর্থায়নে একেকটা পার্কের মাঝখানে অনিন্দ্য একেকটা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স তৈরির স্বপ্ন ছিল। কিন্তু পঙ্গপাল এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সব ফাঁকা জায়গায় রাতারাতি গড়ে তুলল বহুতল কংক্রিটের বস্তি। চেয়ারম্যান তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন। কিছু করতে পারলেন না।
চেয়ারম্যান পিঠ টানটান করে দুই ঊরুর ওপর দুই হাত রাখলেন। আর হাঁটুর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলেন। যেন বোঝার চেষ্টা করছেন হাঁটুতে আর কতটুকু বল আছে।
আরো কিছুক্ষণ পর শওকত সড়ক ভাবনায় আসে তার।
শওকত সড়ক তাজ সড়কে জন্ম নিয়ে গুলশান এক নম্বর হয়ে দুই নম্বরের ওপর দিয়ে চলে গেছে। পাঁচ কিলো। পথে দুইবার নাম পাল্টে হয়েছে গুলশান এভিনিউ আর গুলশান নর্থ এভিনিউ। দুই এভিনিউর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা গুলশান দুই নম্বর গোল চত্বর থেকে বনানীর ওপর দিয়ে চলে গেছে কামাল এভিনিউ। এক কিলো। গুলশান এভিনিউর মতই কামাল এভিনিউর দুই পাশে বহস রীতির উঁচু উঁচু ভবন সম্মোহিত করার মত বিরাট। প্রায় সবই নিখুঁত, নান্দনিক। নানা রঙে ও ঢঙে খাড়া হয়ে আছে। একটা দাঁড়িয়ে আছে নাচের ভঙ্গিতে। আরেকটা ছবির জন্য পোজ দিচ্ছে। ঝড়ে যেন বেঁকে গেছে অন্য একটা।
এসব স্থাপনা এভিনিউ দুইটাকে সাজিয়ে তুলেছে। বিশেষ করে তুলেছে। দেশের মধ্যে ঝলমলে, নান্দনিক শহর বলতে এই দুই এভিনিউ।
এখন হাতির ঝিল লেক সামনে রেখে সোয়া কিলো শওকত সড়ক সাজাতে অংশ নেওয়ার জন্য চলছে জোর প্রতিযোগিতা। গুলশান-বনানীর মতই আসতে শুরু করেছে করপোরেট অফিস, বড় বড় কম্পানির সদর দপ্তর, বিশাল বিশাল দোকান, দামি দামি রেস্তোরাঁ। আসার জোগাড়যন্তর শেষ করেছে ইউরোপিয়ান পাঁচ তারা সুইসসোটেল। নতুন স্থাপনা যেমন হচ্ছে তেমনি পুরনো-ছোটগুলো বিলীন হয়ে বিরাট চেহারায় হাজির হচ্ছে। শুলশান এভিনিউর সঙ্গে শওকত সড়ককে একাকার করে ফেলছে।
এলাকাটা সবচেয়ে ধনীদের জন্য তৈরি হয়েছিল যে, সেই উদ্দেশ্য বজায় থাকছে।
এই প্রতিযোগিতা শুরু হয় মতিঝিলে। তার কপাল পোড়ায় যানজট। তখন চেয়ারম্যানের এক দোস্ত অফিস আর বাড়ি কাছাকাছি করার আইডিয়া দেয়। চেয়ারম্যান মুখ ভার করলেও অন্যরা হৈচৈ করে নেমে পড়ে। তারা তাদের সদর দপ্তর গুলশানে নিয়ে গেল। বনানী নিয়ে গেল। উত্তরা আর ধানমণ্ডি নিয়েছে কেউ কেউ।
চেয়ারম্যানও ভাওয়ালের সদর দপ্তর মতিঝিল থেকে সরিয়ে আনতে চান। তিনি যখন চিন্তাভাবনা শুরু করেন ততদিনে গুলশান এভিনিউর সব প্লট-বাড়ি অন্যরা কিনে ফেলেছে। কামাল এভিনিউতেও তাই। এখনও যা দু-একটা আছে তা আর মালিকরা বেচতে চাচ্ছে না। অগত্যা শওকত সড়ক। বড় একটা প্লট চেয়ারম্যান ইতিমধ্যেই কিনেছেন। কিছুক্ষণ আগে সেটাই দেখতে গেছিলেন। সেখানে তিনি সম্মোহিত করার মত বিরাট এক ভবন বানাতে চান যা দেখে অনেকে অস্তিত্ব ভুলে যাবে। চেয়ারম্যান নিজেও অনেকবার অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন বটে।
সদর দপ্তর সরিয়ে আনার পাশাপাশি চেয়ারম্যান আরো একধাপ পরিবর্তন চান। ভাওয়াল শিল্প পরিবারের জন্য তিনি একটা স্মার্ট ইংরেজি নাম চান। কনসালটেন্সি ফার্মকে দায়িত্ব দিয়েছেন ইতিমধ্যেই।
গাড়িবহর বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে চেয়ারম্যানের রাগ-ব্যথা পানি হয়ে গেল। তবে তিনি গাড়ি থেকে নামলেন না। এখন তার বাড়ি বসার মুড নেই। যখন যেখানে থাকার কথা তখন সেখানে না থাকলে তার মুড নষ্ট হয়ে যায়। চেয়ারম্যান বললেন, ‘হোটেল।’
হোটেল বললে তার লোকজন বোঝে হোটেল ওয়েস্টার্ন। কিন্তু আজ এখানে চেয়ারম্যানের ভক্তি হল না। হোটেল ওয়েস্টার্নকে একটা উঁচু গুদামের মত মনে হচ্ছে। কমনীয় বটে। এখন বরং মাটিতে দাঁড়িয়ে একটু খোলা আকাশ দেখতে পারলে ভাল লাগত। চেয়ারম্যান বললেন, ‘র্যাডিসন।’
ধানের গোলার মত দাঁড়িয়ে আছে র্যাডিসনের মূল ভবন। তার দুই পাশে দুই বাহুর মত দুইটা দোচালা স্থাপনা যাদের একটা থাকার ঘর আরেকটা রান্নাঘর যেন। সবই বহুতল বটে। বিলাসবহুল এসব ঘরে-গোলায় রয়েছে আরাম-আয়েশের সব প্রস্তুতি। গোলার সামনে বিরাট উঠোনে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা। তার পাশে একটা পুঁইশাকের মাচা যেন। মাচার নিচে বসার আয়োজন। বাড়ির পেছনে পুকুর আছে যথারীতি। পুকুরপাড়ে হলুদ ছাতা রাখা হয়েছে বৃষ্টিতে-রোদে আড্ডা দিতে।
গাড়ি থেকে নামতেই চেয়ারম্যানের আকাশ দেখা হয়ে গেল। আকাশ নিজেই তার চোখের সামনে। না হলে তিনি কি গুলশানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থুতনি উঁচু করে আকাশ দেখবেন নাকি।
এখানে আসলে চেয়ারম্যান বেশ আবেগী হন। নাশিতার দিকে তাকিয়ে লাজুক হেসে বললেন, ‘আমরা এমন একটা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স করতে পারি না?’
‘অবশ্যই পারি, সার!’
‘কোথায় করা যায়?’
‘গুলশান বা মতিঝিলে স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করা যায় এমন যেকোনো এলাকায় হতে পারে। বারিধারার পুব পাশে অনেক খালি জায়গা রয়েছে। গুলশান-বারিধারা থেকে মাত্র ছয়-সাত কিলোর মধ্যে আছে খাল, লেক, নদী। এসব এলাকায় অপরিকল্পিত স্থাপনা গড়ে উঠছে। লোকেরা কিনে কিনে রাখছে বেশি দামে বেচার জন্য। সরকারের এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। বেসরকারি উদ্যোগে ভাল অনেক কিছু হতে পারে।’
চেয়ারম্যান পুকুরপাড়ে গিয়ে বসলেন। পিএ এডিটরদের প্রথমে বাসায় আসতে বলেছিলেন। আবার ফোন করে হোটেলের কথা বলেছেন ইতিমধ্যেই।
মিনিট দশেকের মধ্যে এসে পড়লেন বনানীর এডিটর। আরো দশ মিনিটে আসলেন ধানমণ্ডির এডিটর আর উত্তরার এডিটর আসলেন তারও তিন মিনিট পরে।
গুলশান-বনানী-বারিধারার সঙ্গে ধানমণ্ডির নামও আসে দেশের সবচেয়ে দামি আবাসিক এলাকার তালিকায়। তারপরই উত্তরার নাম। পরিকল্পিত এসব আবাসিক এলাকার পথ দেখায় পাকিস্তানি সরকার। পাকিস্তানি আমলে তারা ঢাকায় অভিজাতশ্রেণি খুঁজতে গিয়ে দারুণ মর্মাহত হয়েছিল। পরে পথ খুঁজে বের করে। ঢাকায় ধনীলোক ছিল বটে। তারা ছিল ছড়ানো-ছিটানো। তাই গুলশান-বনানী-ধানমণ্ডি রচনার উদ্যোগ। তাদের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বাংলাদেশ সরকার রচনা করেছে উত্তরা। তারপর আরো ও সেসব ও আনুষঙ্গিক নীতি তাদের প্রধান কাজ হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত।
চেয়ারম্যান চিনি ছাড়া কালো কফিতে চুমুক দিলেন। ভাল লাগল না। মগটা কাচের টি-টেবিলে রেখে পরিচারকের দিকে তাকালেন তিনি। সামান্য একটু ঠোঁট নেড়ে বললেন, ‘পানসে!’
পরিচারক মগ নিয়ে চলে গেল। চেয়ারম্যান তার শামলা মুখটা পাথরের মূর্তির মত করে রাখলেন। বনানীর এডিটরের ভয় লাগে। উত্তরার এডিটর কাচুমাচু হয়ে থাকেন। কিন্তু ধানমণ্ডির এডিটর রসিক লোক। তিনি চেয়ারম্যানের দিকে ঝুঁকে বসলেন। কৌতুক মাখা হাসি হেসে বললেন, ‘ভাবি বকা দিয়েছে নাকি?’
চেয়ারম্যান জানেন এই এডিটরটা তাকে খুব একটা পাত্তা দেয় না। বন্ধু হয়ে থাকতে চায়। চেয়ারম্যান নিজেও অবশ্য বেশ কয়বার বন্ধু বলে পরিচয় দিয়েছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। কিন্তু এখন যে চেয়ারম্যানের মেজাজ নষ্ট হয়ে আছে তাও এই এডিটর আমলে নিচ্ছে না। হারামজাদা গাওরা আছে। মালটা খুব কাজের বটে। বাজারে তার বিকল্প নেই। থাকলেও খোঁজ মিলছে না। চেয়ারম্যান মৃদু একটু হাসি দিলেন। তিনি নিজে যে তীব্র কড়া কফিতে চুমুক দিলেন তেমনি আরো তিনটা দিতে বললেন। এই এডিটররা এসব মোটেও পছন্দ করেন না। চেয়ারম্যান জানেন। তিনি যখন কফি খান তখন তারা লাল পানি দিয়ে গ্রিল করা লবস্টার খান। এখন চেয়ারম্যান তাদের তীব্র কফিই গেলাতে চান। দেখ শালা কত্ত বড় ক—।
ধানমণ্ডির এডিটর কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘উয়াআও! ইয়ুমমি!’
চেয়ারম্যান আবার একটু হাসলেন। তারপর কাজের কথা। ‘কয়দিন ধরে আশুলিয়ার অধিকাংশ কারখানা সময়-অসময় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন পোশাক পরিষদ সব কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছে। যেখানে আমাদের দুর্বল অর্থনীতি—।’
এডিটররা গম্ভীর হয়ে বসলেন। এই এডিটররা অত্যন্ত মেধাবী। তারা জানেন এখন কী করতে হবে।
চেয়ারম্যান কফিতে লম্বা করে চুমুক দিলেন।
রসিক এডিটর হাসতে গিয়েও হাসলেন না। তিনি বরং বিদায় নিতে নিতে বললেন, ‘এভরিথিং—সব—দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে!’
এডিটররা নাশিতার সাথেও দুচার কথা বললেন। হাই-হ্যালো টাইপের কুশল জিজ্ঞাসা। নাশিতার সাথে তাদের আগে থেকেই কাজের সম্পর্ক রয়েছে। এডিটরদের সাথে চেয়ারম্যান কী ধরনের কথাবার্তা বলেন, কিভাবে বলেন, সে বিষয়ে তার কোনো ধারণা ছিল না।
চেয়ারম্যান নাশিতাকে বললেন, ‘আমার সাথে আজ আপনার আর কাজ নেই। সন্ধ্যায় মিটিং-সিটিং হতে পারে।’
‘জি, সার!’
এটিডররা চলে গেলে চেয়ারম্যান আরো বললেন, ‘যার সাথে বেশি কথা বলতে হয় তাকে নিয়ে আপনি বেশি কাজ করতে পারবেন না।’
‘থ্যাংক ইউ, সার।’
‘বেস্ট অব লাক!’
নাশিতা আইস কফির স্বচ্ছ নলে শেষ টান দিয়ে উঠে পড়ল। ট্রেতে যেমন এসেছিল তেমনি পড়ে থাকল সুঘ্রাণে ভুরভুর কেক-মিষ্টি। একটা মিষ্টি দেখতে একেবারে কুমড়ার মত। রঙিন কেক যার নিচেটা কালো কাপের মত। কাপের ওপর একটা লাল গোলাপ। তার ওপর যেন কালো জিলেপি। আছে ত্রিভুজ আকারের সুদৃশ্য কেক যার রয়েছে টকটকে লাল নীল হলুদ রঙের তিনটি স্তর। কেকগুলো যেমন নরম তেমনি হালকা। ছোঁয়া দিলে গলে পড়বে যেন। আর মাটির প্লেটে চকচকে সন্দেশ। তার ওপর ঘি জমে আছে যেন।
চেয়ারম্যান ‘হালকা কেক-মিষ্টি’ বললে এগুলো নিয়ে আসে সিনিয়র পরিচালক যারা তার সুপরিচিত। আজ এখনও বেশি সকাল রয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই সবাই নাশতা করেছেন। চেয়ারম্যান মনে করিয়ে দিলেও কারুর ভক্তি হয়নি।
সবাই চলে গেলে চেয়ারম্যান আবার কড়া কফিতে চুকচুক করে চুমু দিতে লাগলেন। আর চিন্তা করতে লাগলেন। এই সময় অফিসের কথা মনে পড়লে তিনি পুলিশমন্ত্রীকে ফোন করলেন। কিঞ্চিৎ হাই-হ্যালোর পর বললেন, ‘একদিন জেনারেটর বিগড়াল। পরদিন এসি। আজ আবার ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই লাইন অচল। হাউ ফানি!’
পুলিশমন্ত্রী আশ্বস্ত করলেন তিনি দেখবেন। তার মানে তিনি গোয়েন্দা পাঠাবেন।
আকাশ দেখা শেষ হলে চেয়ারম্যান আবার ওয়েস্টার্নে গেলেন। সেখানকার লবিতে, লাউঞ্জে বসলে বেশ লোকজন দেখা যায়। র্যাডিসন বেশি নিরিবিলি। ফাঁকা জায়গায় হওয়ায় ওখানে সাধারণত কাজের লোকজনই যায়।
ততক্ষণে সুখবর জন্মাতে শুরু করেছে। অনলাইন পত্রিকায় খবর এসেছে: শ্রমিকরা ধর্মঘটে। উৎপাদন বন্ধ। অর্থনীতি হুমকিতে। সরকার নির্বিকার। ইত্যাদি।
প্রধান মিডিয়াগুলোয় ধর্মঘটের খবর ক্রমেই বড় করে আসতে লাগল। থেকে থেকে প্রধান শিরোনাম দখল করল। শ্রমিক ধর্মঘটে জনজীবন বিপর্যস্ত। পুরো গাজীপুর আর নারায়ণগঞ্জ যানজটে অচল।
সন্ধ্যা নাগাদ ক্ষমতাসীন দলের প্রধান নেতারা সাংবাদিকদের সাথে কথা বললেন। বিষয়টা তারা অবিলম্বে দেখবেন বলে ঘোষণা দিলেন।
চেয়ারম্যানের মনে স্বস্তি ফিরল। তিনি ফুরফুরে মেজাজে লিফটে উঠলেন। রেস্টুরেন্ট লা অ্যাপ্পিটিটো ভিয়েন ম্যাংগিয়ানডোয় লম্বা লম্বা চিকন চালের মশলা ভাতে ইলিশ ভাজা আর হোয়াইট ওয়াইন দিয়ে হালকা বুদবুদ তুলে রান্না করা স্যামন মাছ। সাথে সবুজ ডাঁটাশাক, লালশাক গাজর শশা, কাঁচা পেঁয়াজ, কোমল পানীয়।
চামচ দিয়ে খাচ্ছেন চেয়ারম্যান। ইলিশের পেটির কাঁটা চেটে খাওয়ার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। এক বছর ধরে এমন হচ্ছে কিছু দিশি মাছ খেতে বসে।
ব্যাপারটা আসলে এই, বছর খানেক আগে পত্রিকার এক প্রতিবেদন পড়তে গিয়ে চেয়ারম্যানের মনে হল, প্রতিবার হিসু করার পর হাত ধোয়া উচিত। তখনই বিপত্তির শুরু। তিনি হিসেব করে দেখলেন যে, খাওয়া আর হাগু বাবদ দৈনিক অন্তত চারবার হাত ধুতে হয়। তারপর তিনি আরো হিসেব করে দেখলেন যে, হাগুর সময় ছাড়াও দৈনিক তিনি আরো অন্তত পাঁচবার হিসু করেন।
চেয়ারম্যান নয়বার হাত ধুতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠলেন। তখন তিনি ঘরে-বাইরে সব জায়গায় চামচ দিয়ে খাওয়া শুরু করেন। যাতে দৈনিক গড়ে অন্তত তিনবার হাত ধোয়ার ঝামেলা থেকে রক্ষা পান। তার আগে তিনি শুধু বিশেষ উপলক্ষে চামচ দিয়ে খেতেন।
ইলিশের পেটির কাঁটাটা তিনি কাঁটাচামচ দিয়ে ধরবেন কিনা চিন্তা করলেন কিছুক্ষণ। ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি একটা জবর সমাধান পেয়ে গেলেন।
হিসু করার সময় টিস্যু দিয়ে নুনু ধরলেই ত ঝামেলা চুকে যায়।
চেয়ারম্যান পরম সুখে হাত বাড়ালেন ইলিশের পেটির দিকে। তার মন-প্রাণ ফুরফুর করে উঠল। চামচের দিকে তিনি আর ঘুরেও তাকাবেন না। পাছে বিরক্তি লাগে।
► আসছে বিংশ পর্ব
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন