লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [শেষ পর্ব]

অ+ অ-

 

পড়ুন লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [ত্রয়োদশ পর্ব]

লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [শেষ পর্ব]

 

শিউলির সাথে পরিচয়ের পর আট মাস তের দিন পার হলো আজ। এর মধ্যে তার হাজবেন্ডের শরীরের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। এখন ডাক্তারদের একমাত্র লক্ষ্য হলো মৃত্যুর আগে লোকটার শারীরিক যন্ত্রণা যতটা কমিয়ে রাখা যায় তার ব্যবস্থা করা। ক্রমাগত রাত জাগতে জাগতে শিউলির চেহারা রুক্ষ হয়ে গেছে। ওর মেজাজও খিটখিটে হয়েছে। ফ্যামেলির লোকের সাথে খারাপ ব্যবহার করছে, দোকানদারকে ধমকাচ্ছে অকারণে, দারোয়ানকে বকছে। আমার সাথে ফোনে কথা বলার সময়ও খেয়াল করেছি আশেপাশের সবাইকে বকাবাদ্য করছে।

আজকের দিনটা খুব ঝকঝকে। শিউলি  আর আমি বেরিয়েছি ওর বাসার জন্য কিছু কাচাবাজারে করার উদ্দেশ্যে। কড়া রোদ চারপাশের সবকিছুকে সজীব করে দিয়েছে। সবজির ভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে গামছা দিয়ে গায়ে হাওয়া করছে ঘর্মাক্ত তরকারিওয়ালারা। রিকশাচালকেরা দল বেঁধে টেস্টিস্যালাইন খাচ্ছে। ছায়ায় বসে কুকুরেরা লম্বা জিব বের করে হাপাচ্ছে। এই পড়ন্ত দুপুর এত আলসেমিভরা যে একটা বেড়াল কুকুরগুলোর সামনে দিয়ে হেঁটে গেল কিন্তু কুকুরেরা তাকে ধাওয়া করা তো দূরের ব্যাপার একটা ঘেউ পর্যন্ত করল না।

শিউলিদের রান্না খাওয়ার ঠিক নেই ইদানিং। সবকিছু এলোমেলো। রাতে দেরি করে ঘুমায়। সকালে দেরি করে ওঠে ওরা। কোনো কোনো দিন নাস্তা করে না। কোনো কোনো দিন পাউরুটি অথবা ফল দিয়ে চালিয়ে দেয়। একটা ছেলে নার্স আছে সকালে শিউলির বরের সব কাজকর্ম সে-ই করে। পোশাক বদলে দেয়, খাওয়ায়, শেভ করিয়ে দেয়, রাথরুমে করায়। আমি এই সেবাটা সম্পর্কে জানতাম না, দেখলাম বড় ক্লিনিকগুলোতে এই ব্যবস্থা আছে। কেউ চাইলে প্রশিক্ষিত নার্স নিয়ে যেতে পারে বাসায়। নির্দিষ্ট কিছুদিন রাখতে পারে। এদের খুব বিশ্বস্ত হতে হয়। যে ছেলেটা এখন আছে তার ব্যবহার খুব ভালো। রোগীর কখন কী লাগবে সেটা প্রায় মুখস্থ। 

আমি ওর বাসায় এসেছি দুপুরের আগে। ইদানিং খুব একাকীত্বে ভোগে শিউলি। বিশেষ করে দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যার পর অব্দি। আর ওই সময়টার একাকীত্বকে ও ঘৃণা করে। বরের সঙ্গে কথা বলতে পারে না, কারণ সে আর কথা বলার অবস্থায় নেই, প্রচুর হ্যালুসিনেশন হয় তার, একা একাই বিড়বিড় করে সে। যখন ভয় পায়, অথবা শরীরের ব্যথা বেড়ে যায় খুব, তখনই কেবল অস্ফুট চিৎকার করে ওঠে। ও তখন তার কাছে গিয়ে নানা কথা বলে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। তখন লোকটার প্রতি ওর ভালোবাসাটা বোঝা যায়। এই দুমাসে শিউলির একাকীত্ব কাটাতে বেশ কয়েকবার আমাকে এই বাসায় আসতে হয়েছে। ও নাছোড়বান্দা, যত কাজই থাকুক আমাকে যেতে হয়। আমার বাসা থেকে ওর বাসার দূরত্ব অনেক, আমি যেতে চাই না প্রায়ই। আলসেমি লাগে। ও তখন মজাদার খাবারের লোভ দেখায়, মদ খাওয়ার লোভ দেখায়, বইয়ের লোভ দেখায়। ওর ছেলমানুষিতে আমি হাসি, কিন্তু আমার খুব মায়া লাগে ওর জন্য। লোভ দেখানোতে কাজ না হলে কান্নাকাটি করে। ফলে সবসময় না গিয়ে পারা যায় না। এ ছাড়া ফোনে আমরা প্রচুর কথা বলি, মেসেঞ্জারেও প্রায় সারাদিন কথা বলি।

অনেকদিন হলো লিনু যশোর চলে গেছে। এর মধ্যে আরেকদিন সে আমার বাসায় এসেছিল। তার সাথে আমার সম্পর্কের ইতি ঘটেছে। আনুষ্ঠানিক কিছু না হলেও এসব বোঝা যায়। লিনুর মতো মেয়েরা এই ধরনের প্রতিশ্রুতিহীন সম্পর্কে থাকতে চায় না সম্ভবত। আমি দেখেছি, তারা সবসময় নির্ভরতা খোঁজে পুরুষের কাছে। সেই নির্ভরতা মানসিক, শারিরীক ছাড়াও অন্যান্য অনেক বিষয়ে হতে পারে। নির্ভর করার মতো কোনো কিছু সম্ভবত আমার ভেতরে খুঁজে পায়নি লিনু। ফলে, তাকে আজ হোক কাল হোক সরে যেতেই হতো। আর আমি, এমন যাওয়া-আসায় অনেকদিন ধরেই অভ্যস্ত। 

যা হোক, এখন আমার জীবন শিউলিময় হয়ে আছে। আমি বাসায় এলে ওর ছেলের সঙ্গে খেলি, টুকটাক কাজে হেল্প করি, টিভি দেখি আর মাঝে মাঝে বই পড়ে সময় কাটাই। ওর বইয়ের সংগ্রহ বেশ ভালো। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ঊঁচু দুটো বিশাল সাইজের আলমারি ভরা বই। সমকালীন লেখকদের অনেকের সঙ্গে ওর জানাশোনা থাকায় তাদের বইও আছে। তেমনি ক্লাসিকের সংগ্রহও কম না। আমি সচারচর মানুষের বাসায় যাই না। কিন্তু ওর এখানে এলে অন্যের বাসায় এসেছি বলে মনে হয় না। অথবা ও সেটা মনে করতে দেয় না। সুতরাং আমার কাছেও জায়গাটা দিন দিন আরামদায়ক হয়ে উঠছে।

তবে ও আমাকে শারীরিকভাবে ঘনিষ্ট হতে দেয়নি। আমাদের প্রেমটা এখনও শুধু মানসিক। যদিও সে প্রায়শই বলে শারীরিক বিষয়টার জন্য সে মরে যাচ্ছে। কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছে না। রীতিমত কষ্ট হয় প্রতি রাতে। কিন্তু তবু ও আমাকে গ্রহণ করছে না। একদিন জোর করে দেয়লের সঙ্গে ঠেসে ধরে চুমু খেতে চেয়েছিলাম, শরীরের সব শক্তি দিয়ে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছে। ফিসফিস করে অথচ দৃঢ় স্বরে বলেছে, পাশের রুমে লোকটা এখনও শ্বাস নিচ্ছে। তারপর মনে হয়েছিল এই বাসায় যেকোনো ধরনের শারীরিক টাচ ও এ সময়ে মানতে পারবে না। যা হোক, এরপর আমি আর ওর সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করিনি। আমার চেয়ে দরকারটা ওর বেশি হওয়ার কথা, ফলে ও-ই যখন চাইছে না, তখন চেষ্টা না করাই উচিত হবে ভেবেছি। তা ছাড়া এত ভদ্রভাবে শিউলি প্রত্যাখান করে যে, তার ওপরে কথা খাটে না।

তিন রুমের ফ্লাট ওর নিজের। ও মাঝে মাঝে  গর্ব করে বলে, এই শহরে আমি আমার বাবার ফ্লাটেও থাকি না, বরের ফ্লাটেও না। আমি নিজের ফ্লাটে থাকি। ওর কথায় গর্বের সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের খোঁচাও থাকে। ও নিজের পয়সায় ফ্লাট কিনেছে আর আমি ভাড়া বাসায় থাকিসেটাই বোঝাতে চায় হয়তো। ও যখন এমন করে বলে, নিজেকে ছোট মনে হয়। ও প্রায়ই এমন সব কথা বলে। কিন্তু ওর বাসায় গেলে এসব কথা একদম তোলে না। ও এত ভদ্র না, কিন্তু বাসায় গেলে আমার সঙ্গে খুব ভদ্র আচরণ করে। সম্ভবত আমার একরোখা চরিত্র সম্পর্কে ও সচেতন। ও হয়তো বোঝে বাসায় গিয়ে অপমানিত বোধ করলে ও আর কোনোদিন আমাকে ওর বাসায় নিতে পারবে না। অন্যসময় অবশ্য নিজের ফ্লাটের কথা তুলে সে আমাকে তাতিয়ে দিতে চায়। হয়তো ও চায় আমি উদ্যোমী হই, বৈষয়িক হই আরও একটু, কিছু টাকাপয়সা বা সম্পত্তির ব্যবস্থা করি ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু এসবে আমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাই না। বরং ওর দক্ষতা আর বাস্তব বুদ্ধির প্রশংসা করি। ওর উদ্দেশ্য সফল হয় না বলে ও তাতে দ্বিগুণ জ্বলে ওঠে।

বাসায় ওর বরের রুম আর ওর রুম পাশাপাশি। তিন নম্বর বেডরুমটা একটু দূরে, ড্রয়িং-ডাইনিং পার হয়ে। অর্থাৎ অন্য পাশে। ছেলেটা সেখানেই থাকে দিনভর। ট্যাব আর খেলনা নিয়ে নিজের মনে খেলে। ও বুঝতে পারে বাবাকে ডিসটার্ব করা ঠিক হবে না, মাকেও জ্বালায় না সে। ছোটরা অনেক কিছু বুঝতে পারে। ছেলেটা রাতে শুধু মায়ের সাথে ঘুমোয়। ও কেমন একলা, চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। অনেকটা বড় মানুষের মতো। মাঝে মাঝে বাবা বলে ডাকে বটে, কিন্তু সাড়া না পেয়ে বিষন্ন মুখে ফিরে যায়। একদিন দেখেছি ও ওর বাবার হাত ধরে টানছে। হয়তো স্পর্শই চেয়েছিল সে। ওর বাবার তখন শারীরিক যন্ত্রণা হচ্ছিল সম্ভবত, সে তাকে ধমক দেয়। ছেলেটা বিষণ্ন মুখ করে নিজের ঘরে চলে যায়। আমার সাথেও ওর ভালো সম্পর্ক। আমাকে দেখলে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। আমি ওর সঙ্গে বল, বেলনু, গাড়ি এসব নিয়ে খেলি। এত শান্ত বাচ্চা যে ওর চুপচাপ অবস্থাটা আরো করুণ লাগে। বাচ্চাদের এমন শান্ত থাকা মানায় না। ওর শৈশব কেটে যাবে বাবাকে ছাড়া। ওর দিকে তাকালে আমার কেবল এই কথা মনে হয়।

আমি আর শিউলি যখন বসি, তখন শিউলির বেডরুমেই আড্ডা দিই। আর ওর বন্ধুরা এলে, যাদের কেউ কেউ এখন আমারও বন্ধু, ড্রয়িংরুমে বসি। ও আমাকে আগেই ওর বরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। মাঝের কয়েকটা দিন তার সেন্স ছিল। খুব ভদ্রলোক মনে হলো মিনিটখানেকের কথায়। কিন্তু আমার খুব অপরাধবোধ হচ্ছিল তার সামনে। কত যে সংস্কার আমাদের! নারী যে তার বরের সম্পত্তি সেটাই হয়তো মনের মধ্যে খুঁটি গেড়ে বসে আছে। তাকে পৃথক মানুষ ভাবতে পারলে অপরাধবোধটা হওয়ার কথা না। শিউলি তখন ওর বরকে বলেছে একটা প্রকাশনার কাজে মাঝে মাঝেই আমি আসব, আমরা একসঙ্গে বসে কাজ করব। ভদ্রলোক মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল। একটু বোধ হয় হেসেও ছিল তখন ঠোঁটের কোণা দিয়ে। অথবা ওটা আমার ভ্রম। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে হয় সেদিন সে হেসেছিল এবং তা ছিল বিদ্রুপের হাসি। যেন সে আমাদের গোপন অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছিল। ওর বরের ঘরের দরজাটা সবসময় খোলা থাকে। ইমার্জেন্সি কিছু হলে যাতে বাইরে থেকে খেয়াল করা যায় এজন্য এই ব্যবস্থা।  আড্ডা মাঝে মাঝে উচ্চগ্রামে চলে গেলে কেউ না কেউ মনে করিয়ে দেয় ঘরে একজন মরণাপন্ন রোগী আছে। কিছুক্ষণ আমরা নিম্নকণ্ঠ হই বটে, কিন্তু আবারও দ্রুতই উচ্চগ্রামে চলে যায় কলরব। মানুষের স্বভাবই এমন। শোকে পাথর হয়ে থাকলে পৃথিবী চলে না। মৃত মানুষের জন্য জীবিতেরা প্রতিদিন কাঁদে না। একদিন তাদের কান্না থামে, তারা আবার হাসে, তারপর একসময় ভুলে যায় শোক। এই স্বভাব না থাকলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত। হুইলচেয়ারে বসে লোকটা করুণ মুখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।

আজ সকাল থেকে শিউলির মাইগ্রেনে ব্যথা ছিল। এখন চলে গেছে। ও ওর বেডরুমের সাথে লাগোয়া বাথরুমে চলে গেছে গোসলের জন্য। আমাকে টাওয়েল আর একটা ট্রাউজার দিল। ট্রাউজারটা ওর হাজবেন্ডের জন্য কিনেছিল। বেচারা আর পরতে পারেনি। এখন আমি ওর বাসায় গেলে এটা পরি। কৈশোরে এক কাজিনের জন্য কিনে রাখা একটা নতুন টিশার্ট আমাকে পরতে হয়েছিল সে মারা গিয়েছিল বলে। এই ট্রাউজারটা পরার সময় সেই কথাটা বারবার মনে পড়ে। আমি কি মৃত মানুষের জিনসপত্র পরে ঘুরে বেড়াব এই জীবিতদের দুনিয়ায়? মৃতেরা এভাবে নানা অনুষঙ্গ হয়ে আমাদের সাথে থাকে প্রতিদিন। গোসল সেরে দেখি শিউলির রুমের দরোজা বন্ধ। ভেজা টাওয়েলটা ওর ব্যালকনিতে মেলে দিয়ে আমি সোফায় বসলাম। টিভিতে পুরনো একটা খেলা দেখাচ্ছে লিভারপুল আর রিয়াল মাদ্রিদের। খুবই উত্তেজনাপূর্ণ খেলা। শিউলির বাচ্চাটা তার নিজের রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে। ও দুপুরের পর ঘুমোলে সন্ধ্যার আগে ছাড়া ওঠে না। নার্সটা বাসায় নেই, সন্ধ্যার আগে আর আসবে না। শিউলির কাছ থেকে ছুটি নেয়ে কী যেন একটা কাজে গেছে। আমি আলমারি থেকে হেরম্যান হেসের সিদ্ধার্থ বইটা নামিয়ে নিয়েছি। খেলা শেষ হলেই পড়তে বসব। এত উত্তেজনাপূর্ণ খেলা যে চোখ সরানো যাচ্ছে না। তবুও বাসাটাকে খুব বিমর্ষ লাগছে। দুপুরের পর এমনিতেও কেমন বিষণ্ন লাগতে থাকে মানুষের।

কিন্তু বিষণ্নতা দীর্ঘস্থায়ী হলো না আজ। হুট করে শিউলির রুমের দরোজা খুলে গেল। বাতাসের সাথে একরাশ সুগন্ধী নাকে এসে লাগল। টকটকে লাল শাড়ি পরে দারুণ সেজেছে শিউলি। ব্লাউজ না থাকায় স্তনের একটা অংশ দৃশ্যমান। আমার মনে পড়ল অনেক আগের এক টাকার নোটে ব্লাউজহীন, শুধু শাড়ি পরা একটা মেয়ের ছবি ছিল। পরে, ব্লাউজ না থাকার কারণেই হয়তো সেই ছবি বদলে হরিণের ছবি দিয়ে ছাপানো হয় এক টাকার নোট। শিউলি দীর্ঘক্ষণ মেক-আপ নিয়েছে বোঝা যাচ্ছে। গাঢ় লিপিস্টিক দিয়েছে ঠোঁটে। চোখে মোটা কাজল, ম্যাচিং করে আইশ্যাডো। ওর কোমরের মারাত্মক খাঁজটা যাতে কামনাদীপ্তভাবে দৃশ্যমান হয় সেভাবে দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়। বুকগুলো শাড়ির ওপর দিয়ে ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। চোখে মুখে ছেনালির শত শত ফুল ফুটে আছে। আমার খুব বিভ্রান্ত লাগছে এখন। ও চোখ দিয়ে একটা ইশারা করল। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। যেন না এসে আমার আর কোনো উপায় ছিল না। দাঁড়িয়ে দীর্ঘ চুমু খেলাম ওকে। ও দারুণ সাড়া দিল এবার। এই প্রথমবার। ওর কম্পমান শরীর আমাকে ভীষণ উত্তেজিত করে তুলল।

যে শিউলি এত সংস্কার নিয়ে বারবার আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিল সে এভাবে ধরা দেবে তা আমার প্রত্যাশিত ছিল না। ভেবেছিলাম আমাকে আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে আমাকে। এখন আমিও ওর মতো কিছুটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে, শারীরিক সম্পর্কে গেলে লোকটার কিছু একটা হয়ে যাবে। সে জন্য অপেক্ষা করাটাকে আমি মেনে নিয়েছিলাম। মেনে নিয়েছিলাম একটা মানবিক ও প্লেটোনিক সম্পর্কের বন্ধুত্বপূর্ণ রসায়ন। মানুষ শুধু শরীর নিয়ে বাঁচে না, তার মনও আছে। যদিও আমার ধারণা আমি অনেক বেশি শারীরিক মানুষ। কিন্তু ওর মতামতের অমর্যাদা করতে চাইনি।

পরিপাটি করে সাজানো বিছানাটা মুহূর্তে এলোমেলো হয়ে গেল। পেছনে দরোজা খোলা পড়ে রইল। জানলার খোলা পাল্লাগুলো সজোরে ধাক্কা খেতে লাগল বাতাসে। মনে হলো বাতাস যেন আমাদের ব্যাপারটা নিয়ে প্রতিবাদে মাথা ঝাকাচ্ছে। শিউলির হয়তো মনে হয়েছে উল্টো কিছুবাতাসের আলোড়ন তাকে উত্তেজিত করে থাকতে পারে তখন। কিন্তু আমার ওসব দেখার দায় নেই। বাতাসের প্রতিবাদ সত্ত্বেও উত্তেজনা সর্বত্র বিদ্যমান। ঘরের ভেতরে বাইরের মতো আলো। এত আলো যে সবকিছু অন্যরকম দেখাচ্ছে। আমি প্রথমবারের মতো খেয়াল করে দেখলাম যে, আলো কম থাকলে যেমন অনেককিছু দেখতে অসুবিধা হয়, তেমনি এমন ঝলমলে আলোয়ও সবকিছু ভালো করে দেখা যায় না, দৃশ্যগুলো কেমন লেপটে যায় একে অপরের সাথে, আলাদা করা যায় না। আমি ওর শাড়িটা খুলে ছুঁড়ে দিলাম। অনেকক্ষণ শূন্যে ভেসে থেকে সেটা গিয়ে পড়ল মেঝেতে। খুব পাতলা আর হালকা রেশমের মতো মনে হলো শাড়িটাকে, যেন খুলে যাওয়ার এই মুহূর্তটির জন্যই তা তৈরি করেছিল রূপগঞ্জ, পাবনা বা রাঙামাটির কোনো এক তরুণ তাতী। সে যখন ওটা বানাচ্ছিল, তখন কি এই দৃশ্যের কথা তার মনে চকিতে উঁকি দিয়ে গিয়েছিল? সে কি জেগে উঠেছিল কামনায়? শিউলির বাদামী ত্বকের লাবণ্য প্রকট দৃশ্যমান হলো তখন। অনেক আলোয় তা তখন অন্যরকম মোহনীয় লাগছিল। বাদামী মাটির রং মনে হলো একবার, আরেকবার সফেদা ফলের ত্বকের মতো, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল। তুলোর মেঘের মতো শিউলির কোমল ভেতরে প্রবেশ করলাম আমি। শিউলির মুখটা একটু কেঁপে উঠল প্রথমে, তারপর স্থির। যেভাবে একটা বৃষ্টির ফোটা কদমের একটা পাতাকে নড়িয়ে দিয়ে ঝরে পড়ে, সেরকম। ও মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে। সেই চোখগুলো তখন দিঘী, সেখানে গভীরতার এক নীরব অহংকার ফুটে আছে। বেতের লতা যেমন ঝোপের ভেতর মানুষকে আটকে ফেলে, তেমনি সে তার ধারালো নখসমেত  দুহাত দিয়ে আমার পিঠ খামচে ধরল। পিঠের মাংস কেটে বসে যাচ্ছে ওর নখ। সেই নখ চিলেরও হতে পারে।

এই বিছানার ওপরে অনন্ত শূণ্যতার দিকে তলিয়ে যেতে লাগলাম আমরা দুজন। অন্তহীন কোমল মেঘের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়ার মতো অনুভূতি যেন আমাদের শরীরে। আমি ওর ভেতরে ডুবে যাচ্ছি। অনেক উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়লে যেমন ভারহীন মনে হয় নিজেকে, তেমনই যেন আমার শরীর। ফ্যান চলছে, জানলা দিয়ে বাতাসের ঝাপটা আসছেপর্দগুলো উড়ে চলে যেতে চাইছে কোথাও, তবু টপটপ করে আমার মুখের, বুকের ঘাম ঝরে পড়ছে ওর চুল, নাক, স্তনের ওপর। শেষ রাতের দিকে শিশির যেভাবে খানিকটা দ্রুত লয়ে পড়ে টিনের চালের ওপর, সেরকম। ও দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে। লিপিস্টিকের লাল ছড়িয়ে পড়েছে ঠোঁটের চারপাশের এলাকায়। আমি টের পাচ্ছি ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে সে। আর আমি এক বুনো শুয়োরের পিঞ্জরে ধারলো খঞ্জর ঢুকিয়ে তাকে সজোরে ঠেসে রেখেছি বিছানায়। সুতরাং মৃত্যুর আগে সর্বশক্তি দিয়ে উঠে পড়তে চাইছে সে। বিছানাটা কাঁপছে যেন দীর্ঘ ভূমিকম্প চলছে এক নির্দিষ্ট লয়ে। ঘন শ্বাস আর মৃদু চাপা গোঙ্গানির শব্দ আসছে শিউলির কণ্ঠ থেকে। পাশের ঘরে ওর বর। হয়তো অচেতন প্রায়, হয়তো এসবের কিছু বোঝার মতো চেতনা তার নেই। কিন্তু, আমার চেতনায় সে অস্তিত্ববান। এই অস্তিত্ব রাত্রির ট্রেনের গতির মতো, আছে আবার নেই। শিউলির স্পর্ধিত উদ্যোগ এবং আমাকেও সেই ফাঁদে টেনে আনার জন্য আমার ওর ওপর রাগ লাগছিল। ঘটনাটা আমরা অন্য কোথাও ঘটাতে পারতাম। যেখানে ফুলশয্যা না হোক, অন্তত নিরুপদ্রব মিলিত হবার চারটি দেয়াল থাকতো। কিছুক্ষণ পর ও দুপা দিয়ে আঁকড়ে ধরল আমার কোমর। মনে হলো এই অন্তহীন সঙ্গম শেষ না হলে ও আর আমাকে মুক্তি দেবে না। যেভাবে বাঘ মৃগের গলায় গেঁথে দেয় তার তীক্ষ্ণ দাঁত তেমনই। জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রের মতো ওর পাওনাটা ও আদায় করে নিতে চাইছে। ওর চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্য আমার চেনা। ওর মধ্যে এক নিষ্ঠুর রূপও আছে। ওর চেহারায় সেটা ফুটে ওঠে মাঝে মাঝে। ও যখন প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভাবে, তখন সেই ভয়ংকর চেহারাটা ধরা পড়ে। ও এমন এমন সব নিষ্ঠুরতা করতে পারে, যা আমি ভাবতেও পারি না। পরস্পরের শরীরের এই দীর্ঘস্থায়ী সঞ্চালন আমাদের ক্লান্ত করে তুলেছে অনেকক্ষণ হলো। উন্মত্ততা একেবারে শেষের দিকে এলে ও আমাকে বলল ওর মুখটা চেপে ধরার জন্য। আমি কথাটা অত পাত্তা দিলাম না, কেননা এখন আমার নিষ্ঠুরতা করতে ইচ্ছে করছে না, সবসময় মানুষের জান্তব হতে ভালো লাগে না। ও স্খলিত হচ্ছিল তখন, নিঃশ্বাস ও শরীরের গতি থেকে আমি সেটা বুঝতে পারছিলাম। হঠাৎ ভীষণ জোরে শিৎকার করে উঠে পা দুটো আমার কোমর থেকে ছাড়িয়ে, পিঠ থেকে একটা হাত সজোরে ছুঁড়ে দিয়ে শিউলি নিস্তেজ হলো বিছানায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওর হাতটা গিয়ে পড়ল বিছানার প্রান্তে থাকা ছোট সাইড টেবিলের ওপর রাখা কাচের জগে। জগ উল্টে নিচে পড়ে ভেঙ্গে গেল। সম্ভবত ডালিম অথবা তরমুজের রস ছিল ওটাতে। মনে হলো রক্তে ভেসে যাচ্ছে সারা ঘর। রক্তের মধ্যে রবফের মতো কয়েক টুকরো কাঁচ থেকে ঠিকরে আলো বেরুচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে, আশ্চর্যজনকভাবে পাশের ঘর থেকেও একটা আর্তনাদের সাথে কানে এল ভারী কোনো কিছু পতনের শব্দ। ঘটনাগুলো কেমন যেন একসঙ্গে ঘটে গেল পরপর, চোখের পলকেই, কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই।

শিউলি দ্রুত একটা স্কার্ট আর টিশার্ট গায়ে গলিয়ে ভাঙা কাচের টুকরোর ভেতর দিয়ে দৌঁড় দিল পাশের ঘরে। বুঝতে পারলাম কাঁচে পা কাটল ওর, কেননা ধরালো কিছু মাংসের ভেতর ঢুকে যাওয়ার সুক্ষ্ণ শব্দ পেলাম আমি। পেছন পেছন গেলাম তখনই।  দেখি, লোকটা মেঝেতে পড়ে আছে, কিছু একটা বলতে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় হা করা মুখ, প্রাণহীন। 

সমাপ্ত