লাল দ্রাঘিমা || প্রথম পর্ব
উপন্যাস || লাল দ্রাঘিমা || প্রথম পর্ব
সকাল হলো তো, তবে কোথায়?
সোজাসাপ্টাভাবে এক সরকারি হাসপাতালের চতুর্থতলার পাবলিক টয়লেটের গন্ধের সুড়ঙ্গে। হাওয়ার বিচরণও অভিশাপ।
‘সবাই জানে কী হয়; এবং সবাই আসলেই জানে কোথায় কী সব হয়’—এমন মর্মান্তিক বাস্তবতা হাসপাতালটিতে বিরাজ করছে, মোটামুটি ১৬ বছর ধরে। নার্সদের চোখই তো নিষ্পাপ লাগে না, তাদেরকে বেশির ভাগ সময় দারোয়ান লাগে; কারণ, অধিকাংশই চেষ্টা করছে চেম্বারের দরজার সামনে থেকে রোগীদের সরাতে। প্রতিটি চেম্বার প্রত্যেক সরকারি ডাক্তারের সিংহাসন। কিন্তু এটা আসলে হিংস্রতা নয়, এটা চাকরি।
কিছুক্ষণ আগে অবশ্য একটা কেলেঙ্কারি হয়ে গেল। ডাক্তার চেম্বারে ঢুকবেন, এমন সময় এক ভোগান্তিকবলিত রোগী চিল্লায় বলল, ‘কিরে নমরুদ?’
ডাক্তার তখনই উল্টা ঘুরে চলে গেলেন। সেই থেকে আরও ৪৫ মিনিট চেম্বারের একাকিত্ব। ওদিকে রেজিস্ট্রেশন কাউন্টারের সামনে অপেক্ষারত রোগীদের মাঝে ডাক্তারের প্রতি ক্ষোভ ক্রমাগত বাড়ছে কিন্তু কাউন্টারের সামনে রোগীদের লাইনটার দৈর্ঘ্য শুধু লম্বা হচ্ছে। লাইনটাকে আর বিশ্বস্ত লাগছে না।
ডেঙ্গুর প্রকোপ যেন দুনিয়ার এই ছোট্ট দেশেই বাড়ছে; সূর্যের আলো হাসপাতালের রোগীদের বেডগুলোতে পৌঁছায়, সম্পূর্ণভাবে মিনিমাম। তারপরে যখন নিশি আসবে, প্রতিটি ইয়ন মাঝে মাঝে খুন হবার ইচ্ছায় জর্জরিত হয়। স্মরণ অন্য যে রোগীদের দিকে তাকাচ্ছে, প্রচণ্ড ঘুম আসছে। স্মরণ চোখ বন্ধ করেছে, পাশে কে যেন বলল, ‘বন্যা আসবে।’
চোখ খুলে দেখে, ভদ্রলোক লুঙ্গিপরা, এই রকম এক লুঙ্গি সম্ভবত স্মরণ তার মুসলমানির সময়ে পরেছিল। ভদ্রলোক আর স্মরণ বসে আছে একটা নিচু ভঙ্গুর টেবিলের ওপরে, টেবিলটি তো নিষ্পাপ; তবে সেও তো দুর্নীতির একজন সাক্ষী। ভদ্রলোকের উপস্থিতির প্রভাবের জন্য সকাল ১০টা ১৬ মিনিটে স্মরণের সেদ্ধ ডিমের কুসুম খাওয়ার খুব প্রেরণা দেখা দিল। তবে ওর মধ্যেই হুঁশের দুর্ভিক্ষ; কারণ, খেয়াল করে স্মরণ দেখল, ভদ্রলোক আসলে একজন ভদ্রমহিলা, লুঙ্গি আসলে ভদ্রমহিলার বোরকার নিচের অংশ, তিনি উঠে চলে গেলেন অস্বস্তিতে আর ততক্ষণে স্মরণের তন্দ্রা কেটে গেল। যাক, ওটা ছিল গৃহপালিত তন্দ্রা, যা কখনোই কারোর দৃষ্টিতে অপরাধ হতে পারে না।
বিল্ডিংয়ের মাঝ দিয়ে সিঁড়ির বাঁধ পেরোলে ডান সাইডে কয়েকটি ক্লাসরুম, ল্যাব, লাইব্রেরি। আরও কত কী। শুধু হাসপাতাল না, মেডিকেল কলেজও। ছেলে-মেয়ে সাদা অ্যাপ্রোন গায়ে হাসতে হাসতে বের হচ্ছে। স্মরণের মনে হলো, এরা ক্রুসেড; কারণ, একটি মেয়ে তো স্মরণের দিকে তাকালই মৃত প্যাঁচার দেহের অবজ্ঞা নিয়ে। কাচের দরজার পরশ দিয়ে স্মরণ দেখতে পেল, বয়ামে এক বান্দার খুলি রাখা।
ভোরবেলা স্মরণের মনে পড়ল ওর মায়ের কথা।
‘কিরে, আমি ওঠার আগে রুটি খেয়েছিস?’
‘না, রাতে।’
‘রাতে? তাহলে সব আলগা কেন?’
স্মরণ জানতে পারে, রুটি খেয়ে বিছানায় শোয়ার আগে সে কড়াইতে রাখা ভাজি, প্লেটে রাখা বাসি রুটি—এ রকম কিছুর ওপরেই ঢাকনা দেয়নি। ভাজি ফেলে দিয়ে মা অফিসে গেছেন।
স্মরণ ভাবতে লাগল, অবজ্ঞাকারী মেয়েটার কথা যেন ক্রুসেড। আবার মনে হয় মেয়েটাকে ক্রুসেড ভাবার দরকার কী? ছেলে ক্রুসেডরা বলে ধর্মীয় যুদ্ধ করত, আর মেয়ে ক্রুসেডরা ছিল রাঁধুনি, এই মেয়ে শুধু রাঁধুনি?
স্মরণের মন আস্তে আস্তে শান্ত হলো, অবজ্ঞা আর আমলে নিচ্ছিল না দেখে তার মন থেকে হিংস্র ধারালো দাঁত চলে যেতে লাগল। স্মরণ অবশেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছাল, অ্যাপ্রোন পরা হবু ডাক্তার মেয়েটি যে রাঁধুনি ছাড়া আরও বহুত কিছু হবে, সুন্দরী।
সময় চলে যায়, সিঁড়ি দিয়ে যত মানুষ ওপরে ওঠে, তাদের সবার বয়স ক্ষণিকে বাড়ে। যারা নিচে নামে, তাদের আবার বয়স কমে আর এভাবেই সব দর্শকের চারপাশে সময় কিলবিল করে; কেউ জানে না, বোঝে না, শোনে না।
স্মরণের সাথে ওর বাবার যখন হাসপাতালে আবার দেখা হলো, ভদ্রলোক মি. আনিস খোরশেদ গালিগালাজ করতে করতে এক্স-রে রুম থেকে বের হচ্ছিলেন। এক্স-রে শুরুর পূর্বঘটনায় রুমের দরজার উপরে লাগানো পর্দার রড ভেঙে ওনার গায়ে পড়েছে, তাইলে রাগ করা নরমাল না?
মি. খোরশেদ পাঞ্জাবি ঝাড়তে ঝাড়তে বলতে লাগলেন মি. ইসলামকে, ‘এই হইল অবস্থা, আর দোষ গভর্নমেন্টের? অডিট করছিলাম তো রিটায়ারমেন্টের আগে, বরাদ্দের অভাব আছে? সেই কোন এরিয়ায় যেখানে ইলেকট্রিসিটি নাই, ভালো বর্ডার সিকিউরিটি নাই, ভালো রাস্তা নাই, সে জন্য বৃষ্টির সিজনে নৌকায় চলা লাগে, সেই জায়গায় পর্যন্ত গভর্নমেন্ট সিলওয়ালা মেডিসিন পাঠিয়ে দেয়, আর এই শালারা পর্দার রডই ঠিক করে না, কেমনডা লাগে?
মি. ইসলাম অসীম অজান্তে নিজেকে পরজীবী ভাবেন অন্যান্য চাকরিজীবীর মধ্যে। স্থায়ী চাকরিই করেন, কিন্তু হাসপাতালের বহু পুরোনো কর্মচারীদের কাছে তিনি পিও; অন্যখান থেকে ধরে এনে এক্সট্রা ওয়ার্কার হিসেবে তাকে নিয়োগ করা হয়েছে, আপাতত কাউন্টারে বসেন। বদলি করলে কে জানে দেখা যাবে টেস্টিং সাইটে ফরম প্রদানের কাজে পাঠিয়ে দেবে আবার বেতনও অপ্রাপ্তবয়স্ক। উনি মি. খোরশেদের কথায় মাথা নাড়লেন।
স্মরণ চারপাশে তাকাল, যেসব অসহায়ত্ব চোখে পড়ল, সেগুলো তার সহ্য হলো না। সে আবার ফ্লোরে তাকাল, যদি কিছু না পাওয়া যায়। সে দেখল না, তবে হলো ফ্ল্যাশব্যাক। দুই দিন আগে মি. খোরশেদ কিছুটা সুস্থ ছিলেন। তিনি সুস্থতাকে ইদানীং দ্বিধাহীনভাবে আশীর্বাদ ভাবেন; যদিও তিনি কোনো প্রফেশনাল বক্তা নন, কিন্তু কথাবার্তার সময় শরীরের ওপর পরাবাস্তব জোর দিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন। ফলে প্রায়ই দেখা যায়, তিনি নিচের ঠোঁট অচেতনে কামড়ে ধরছেন, তা-ও কথা বলার সময়।
চেয়ারে হেলান দিয়ে তিনি শুরু করলেন, ‘শোন, আমার নানি ছিল অসুস্থ, আমি ক্লাস সিক্সে পড়তাম। বাপে ছিল ট্যুরে। এখন নানির দুই ছেলে। তারা সেই সময়কার ডাক্তার। তারা কেউ নানির খোঁজ রাখতেন না সেভাবে। বড়টা আবার যখন আসত, সব একেবারে দিয়ে যাইত, কিন্তু আবার দু-তিন বছর খবর নাই। কেন বল।’
‘আচ্ছা, আমিই বলি, জুয়া খেলত, তা-ও খেলত কলকাতায়, বুঝছোস? এই দেখ, চলাফেরার কারিশমা। ডাক্তারির ডিগ্রিও নিছে কলকাতার থেকে আবার জুয়াও খেলত কলকাতায় গিয়ে।
‘তো আমার মা চিঠি লিখছিল নানিকে যে চলে আসো। আমি চিকিৎসা করাব। তো ঢাকায় এনে মা ভর্তি করাল মিটফোর্ডে। ওই হাসপাতাল এখন নাই আরকি। মা আমাকে নিয়ে গেল, দেখলাম নানিকে। আসার সময় শুরু হইল বৃষ্টি। আর তখন তো এত কিছু ছিল না। আবার বলতে গেলে বিল্ডিংগুলোকে লাগত আহত; কারণ, জানালা থেকে শুরু করে সামান্য রংও ছিল একেবারে দুর্বল। মা বোরকা পরত, দাম ছিল আট টাকা, চাইলেই বাবা বোরকা কিনে দিতে পারত না; কারণ, বেতন আর কত দূর। তা-ও মা আমাকে যখন তার বোরকার নিচে নিছে, সেই টাইমটাতেই হাসপাতালটার দোতলার জানালার কাচ ভেঙে মায়ের গায়ে পড়ে আর সাথে সাথে শুরু হয় শিলাবৃষ্টি। মা তখন সেইখানেই দাঁড়িয়ে চিল্লানো শুরু করছিল যে সে মরলে মরুক, মানুষগুলো যেন এসে তার ছেলেকে বাঁচায়।
‘পরের দিনই খবর এলো, আমার নানা মারা গেছেন। নানির আর হইল না অপারেশন। এক মাস পর তিনি হয়ে গেলেন অন্ধ।’
প্যাথলজি বিভাগে মি. খোরশেদকে বিশ মিনিট তার অডিটর পেশার দিনগুলোর কিছু স্মরণীয় অভিযানের পুঁথি আওড়াতে হলো। ওখানকার এক স্যার মি. খোরশেদকে বললেন, ‘আপনারা কিন্তু বেশি কড়া হয়ে গেছিলেন।’
বিষয়টা হেসে উড়িয়ে দেওয়া সঙ্গত, কিন্তু স্মরণের বাবা তার সততা কেলাতে ভালোবাসেন। তিনি যত দূর পারলেন মধুসূদনের কাটখোট্টা সনেটের যশে বললেন, ‘আপনারা তো ধরা পড়ছেন দুই জায়গায়। এক জায়গাতেই এত বড় বাজেটের খরচ একেবারে গায়েব। ক্যারিয়ার কার দোহাইতে নষ্ট হয় বলেন?’
ব্লাড টেস্টের টাইমে মি. খোরশেদ আরেকটু গোঁয়ার্তুমি করলেন, সিস্টারের দিকে হেসে বললেন, ‘ভয় পায়েন না, আসেন’ বলে হাত গোটাতে লাগলেন কিন্তু ওদিকে সিস্টার খেপে গেলেন, সেটা তিনি বুঝলেন না আর সিস্টারও খেপবেন না কেন, তার অভিজ্ঞতা কি কম নাকি যে সে ভয় পাবেন? একভাবে তার ওপর মি. খোরশেদ হুদাই ‘ডাক্তার-রোগী’কেন্দ্রিক জোক খাটালেন, যা ছিল পরিত্যাজ্য।
চরম অস্বস্তির মধ্যেই স্মরণের মনে পড়ে গেল, দুই রাত আগের আরেক রাতের কথা। শিশির হুট করে ফোনে বলে উঠেছিল, ‘মনে আছে, তখন আমাদের মধ্যে তেমন কিছু ছিল না। আমরা শিল্পকলায় ছিলাম, আগে তুমি সব সময় আমাকে স্পর্শ করার পূর্বে পারমিশন নিতে, কিন্তু ওদিন পারমিশন নাওনি, নিজেই এসে আমার কানের কাছের চুল থেকে হাত দিয়ে শুকনো পাতা সরিয়ে দিয়েছিলে। আমি সেদিন থেকেই তোমার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছিলাম।’
স্মরণ তার সেই উদ্দেশ্যের স্পর্শ দিয়ে এবার মি. খোরশেদের গায়ে হাত রাখল আর উনি ছ্যাৎ করে উঠে বললেন, ‘গায়ে হাত দেস কেন? জানোস না পাঞ্জাবিটা ময়লা?’
আসছে ► দ্বিতীয় পর্ব
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন