নির্ঝরের কবিতায় আত্মজিজ্ঞাসা
এনামুল করিম নির্ঝরের চৌদ্দ গোষ্ঠীর উদ্ধার পর্ব প্রকাশিত হয়েছিল ২১ বছর আগে। বইটির প্রথম প্রকাশক ছিলেন কথাসাহিত্যিক শামসুল কবীর। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি বইমেলায় বইটি পুনর্প্রকাশ করেছে বৈতরণী। প্রচ্ছদ করেছেন আনিসুজ্জামান সোহেল। তিন ফর্মার বইটির গায়ের মূল্য ২৫০ টাকা।
চৌদ্দ গোষ্ঠীর উদ্ধার পর্ব বইয়ের নাম ভূমিকার দীর্ঘ কবিতাটির সঙ্গে রয়েছে আরও ২৩টি সুস্বাদু কবিতা। নির্ঝরের শিল্প জীবন শুরু কবিতার হাত দিয়ে। তবে সেভাবে পরে আর নিজে কবিতায় সক্রিয় থাকেননি। হয়ে উঠেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় স্থপতি। অবশ্য ব্যস্ততার মাঝেও লেখালেখিতে সম্পৃক্ত থেকেছেন। চলচ্চিত্র ও আলোকচিত্রের মতো শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমেও রেখেছেন নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর।
এনামুল করিম নির্ঝর নিয়মিত কবিতায় উপস্থিত থাকলে বাংলা কবিতার পাঠক আরও সমৃদ্ধ কবিতা পেত, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। নিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থেই এমন আশ্বাস তিনি দিয়েছিলেন। ৬০ ও ৭০ দশকের জনপ্রিয়তা ছেড়ে আশির দশকের কাব্যভাষা যে নতুন পথের সন্ধানে ছিল সেখানে নির্ঝরের কবিতাও হয়ে ওঠতে পারত উদাহরণ।
চৌদ্দ গোষ্ঠীর উদ্ধার পর্বে ফুটে উঠেছে কবির প্রাথমিক যৌবনকে আবিষ্কারের অভিযান। প্রেমের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবন দর্শনের প্রতিচ্ছবি আঁকতে চেয়েছেন তিনি। জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিন পঙ্ক্তিতে, ‘পথের ভিখিরি নির্লিপ্ত ভিখিরি সাদা গোল থালার ভেতর/পূর্ণিমার স্বাদ খোঁজে; একমুঠো চাল আর/ দুটো সিকি চাকচিক্য ছড়িয়ে হারায় ইলিশের মতো।’
নির্ঝর তাঁর কবিতার পরতে পরতে নিজেকে যেমন প্রশ্নের মুখোমুখি করেছেন তেমনি পাঠককে ভাবালুতায় নয় ডোবাতে চেয়েছেন আত্মজিজ্ঞাসায়। বইয়ের শেষ কবিতা চৌদ্দ গোষ্ঠীর উদ্ধার পর্বের শুরুতে তিনি লিখেছেন, ‘পিঠের চামড়া তুলে দু-একটা ক্ষতচিহ্ন আঁকলে বুঝবে/করুণার লেশমাত্র চিহ্ন নেই কোথাও এখন,/বেপরোয়াভাবে সর্বনাশ আসে যায় নির্বিঘ্নে সর্বত্র।’
চিন্তার বহুরৈখিকতা ও শব্দের পেলবতার কারণে দীর্ঘ এই কবিতা অবশ্য পাঠককে কোথাও একটুকু ক্লান্তি দেবে না। বরং মুখোমুখি করবে জীবনের সুন্দর ও বীভৎসতার দুই বৈপরিত্য দিক। ফ্রয়েডীয় চেতনাকে উপজীব্য করে সমাজের করুণ মুখ তিনি এঁকেছেনে এভাবে, ‘শুয়োর, কুত্তা, নিমক হারাম, পাঁঠা/পতিতালয়ের যেকোনো একজনই তো আমার যোগ্য মাতা।’ এরপর আরও কয়েকলাইন পেরিয়ে যেন তিনি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার মতো বলছেন, ‘হে হারামি পিতার সুযোগ্য পুত্র,/চর্মরোগ তোমার হবেই, হবেই তো।/পঁচে গেলে, ধুঁকে ধুঁকে মরতেও পারো,/এই পবিত্র বাতাস শ্বাসরুদ্ধকর মনে হবে/।’
প্রথম বই হলেও চৌদ্দ গোষ্ঠীর উদ্ধার পর্ব কাঁচা হাতের লেখা নয়। বরং জীবনের গভীরতা ও চেতনার উদ্ভাস পরিলক্ষিত।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন