‘বিকৃত বীজ’ নিয়ে ফরিদা আখতারের বই
প্রাণ, প্রকৃতি আর জীব বৈচিত্র্যের বিকাশ, সংরক্ষণ, অধিকার নিয়ে বিকৃত বীজ শিরোনামের বই লিখেছেন গবেষক ও মানবাধিকারনেত্রী ফরিদা আখতার। বইটি প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী। বইতে আছে আধুনিক কৃষির অভিজ্ঞতা, বিকৃত বীজের বিস্তার ও সমস্যা, জিএমও’র বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কৌশল, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির ধারণায় বিকৃতির মতো গুরুতর বিষয়-আশয়। বাংলাদেশ কৃষি ও প্রাণ সম্পদে প্রাচুর্যপূর্ণ একটি দেশ। আমাদের রয়েছে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, লালন ও বিকাশের দীর্ঘ ঐতিহ্য সমৃদ্ধ জ্ঞানভাণ্ডার। কৃষি ও কৃষকের সংস্কৃতির মধ্যে চর্চিত হয়ে সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতায় ও প্রকৃতির পারস্পরিক সুষম বিন্যাসের ভেতর দিয়ে একটি উৎকৃষ্ট চাষাবাদ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে এ দেশে। মাটি আর অঞ্চলভেদে উপযুক্ত প্রজাতি নির্বাচন, নতুন জাতের উদ্ভাবন ও তাকে সংহত করে খাদ্য-পুষ্টিগুণ অনুযায়ী শস্য পঞ্জিকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখার যে ভারসাম্যপূর্ণ কৃষি ব্যবস্থা আমাদের পূর্বপুরুষদের হাতে সৃষ্টি হয়েছিল তাতে আজ মারাত্মক ছেদ পড়েছে।
বইতে বিশ্লেষিত হয়েছে, আধুনিক কৃষির নামে ষাটের দশকের ‘সবুজ বিপ্লবে’র মারফতে একদিকে রাসায়নিক উপকরণ, কীটনাশক ও অকৃতকৌশলের নির্বিচার প্রচলন মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস, পরিবেশের বিপর্যয়, পানি দূষণ করাসহ সর্বোপরি আমাদের নিজস্ব কৃষি ব্যবস্থাপনাকে ধ্বংসের সূচনা করে। অন্যদিকে জন-বিপ্লবের বরাত দিয়ে উচ্চ ফলনশীলতার দোহাই দিয়ে বিদেশি কোম্পানির বীজের বাজারে পরিণত করার আয়োজন সম্পন্ন করা হয়। খুব সহজে প্রোপাগান্ডার শিকার হয়ে, জনসংখ্যার ভয়ে আমরা নিজেদের বিপুল প্রাণ সম্পদ লুণ্ঠন, কৃষিকে গুটিকয়েক বিদেশি কোম্পানির মুনাফা কামানোর নিশানা বানিয়ে দিই। তাদের আধিপত্য ও বীজ ডাকাতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের এ বিষয়ে নীতি নির্ধারকদের কাজ।
লেখক ফরিদা আখতার বিকৃত বীজের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিছে প্রশ্ন তুলেছেন। বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, খাদ্য চাহিদা সংকটের অজুহাতে নতুন নতুন কৃৎকৌশলের বাহারি প্রচারণা দিয়ে শুধু মুনাফা ও একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েমের জন্য এমন কিছু প্রজাতির প্রচলনের চেষ্টা করা হয়েছে যা বৈজ্ঞানিকভাবে এখনো প্রতিষ্ঠিত নয়। বিশ্বের মধ্যে নানা প্রাণীর জিনের বৈশিষ্ট্য প্রবেশ করিয়ে তাতে যে গুনাগুন আরোপ করা হচ্ছে তা শেষ পর্যন্ত কি ফল দেয় ও পরিবেশে এবং মানব দেহের ওপর কি প্রভাব ফেলে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ ব্যাপার। জিন মিশ্রণের এই কারিগরিকে অনেক প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীই প্রাণ ও পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেন। আমাদের দেশে খাদ্যের সংকট ও নানান রোগবালাইয়ের কথা বলে এই ধরনের বিকৃত বীজের প্রচলনে কোম্পানিগুলো উঠে পড়ে লেগেছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা কারিগরি উদ্দেশ্য কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করা না।
বড় বড় কর্পোরেশনগুলো কৃষিকে তাদের বিনিয়োগ ও মুনাফার ক্ষেত্রে পরিণত করার জন্যই তাদের তৈরি জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্য-শস্য বাজারে নিয়ে আসতে চাইছে। বিজ্ঞান ও টেকনোলজি পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার বাইরে না। পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় খাদ্য ব্যবস্থার ওপর বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চায়। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জিএমও বা বিকৃত বীজ এবং বিশ্ব খাদ্য ব্যবস্থার চক্রে আমাদের মত দেশ—বিশেষত যে দেশ এখনো কৃষি নির্ভর ও প্রাণবৈচিত্রে সমৃদ্ধ তার জন্য বিশাল হুমকি হয়ে হাজির হয়েছে। তাই প্রাণের বিকৃতি ঘটাবার বিজ্ঞান ও কারিগরি সম্পর্কে আমাদের সম্যক জ্ঞান গড়ে তোলা খুবই জরুরী। আর সেই জরুরত থেকেই লেখক, গবেষক ও মানবাধিকারনেত্রী ফরিদা আখতার লিখেছেন এই বিকৃত বীজ বইটি। বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী রাজীব দত্ত। দাম রাখা হয়েছে ৪০০ টাকা।
এত পুরনো বইয়ের আলোচনা কি কারনে? সাম্প্রতিক অনেক বই প্রকাশিত হচ্ছে। বিষয়টি খুব প্রাসঙ্গিক, আমিও এ বিষয়ে কথা বলি। তবু পুরনো বইয়ের সমালোচনা না করাই উত্তম। আপনাদের উন্নতি কামনা করি।
আবু রায়হান মুহম্মদ খালিদ
জানুয়ারি ০৮, ২০২৪ ০৮:৪১