প্রতিধ্বনি ও অন্যান্য কবিতা
স্মার্টফোন ও সেলিব্রেটি কালচার
লক্ষ কোটি পঙ্গপালের ভিড়ে মাথা উঁচু করার চাইতে ভালো
জানালার পাশে বসে ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা। তাই সে
হেডফোনে শুনছিল আকাশের গম্ভীর কণ্ঠে কবিতা পাঠ
আর তারাদের কয়ার। এমনকি তার মৃত্যুর পরও
ছোটখাটো স্মরণসভায় যে মোমবাতিগুলো জ্বলছিল,
বাঁধানো ছবির মধ্যে থেকে সে দেখছিল ওদের শিখার নাচ।
আর সেখানে আমন্ত্রিত অতিথিরা একচোখে দেখছিল
বক্তাদের স্মৃতিচারণ আর অন্য চোখ ব্যস্ত রেখেছিল
তাদের হাতের ডিভাইসে। কেননা পৃথিবীর সব বন
কেটে ফেলা হচ্ছিলো বলে মৌমাছিরা মধু সঞ্চয়ের জন্য
কোনো মৌচাক তৈরি করতে পারছিল না। তাই সব
মধু ঘন হয়ে জমা হচ্ছিল মানুষের চোখের সামনে রাখা
স্মার্টফোনে। লক্ষ কোটি মৌমাছি জড়ো হওয়াতে
ফোনটাকে একটা অতিকায় মৌচাকের মতো লাগছিল।
যা তাদেরকে রাতারাতি পরিণত করেছিল মানুষ থেকে
সেলিব্রেটিতে। সবচেয়ে নির্জ্ঞান লোকটা সেজেছিল
মহান জ্ঞানী। জন্মান্ধ শোনাচ্ছিল আলোর বাণী।
সবচেয়ে কুরুচি যার সে হয়ে উঠেছিল শিল্পবোদ্ধা।
ভীতু পলাতকরা ভাব নিচ্ছিল বিশাল বিপ্লবী যোদ্ধা।
তাই লক্ষ কোটি পঙ্গপালের ভিড়ে মাথা উঁচু করার
চাইতে ভালো জানালার পাশে বসে ঝিঁঝিঁর ডাক
শোনা—এই ভেবে সে সময়কে সময়ের পথে চলতে দিয়ে
নিজেকে নিয়ে গিয়েছিল সময়ের বিপরীতে।
ডাইভার্সিটি
জন্ম থেকে বকুল বনে থাকতে থাকতে
বকুল ফুল জানতো না বকুল ছাড়া
অন্য কোন ফুল পৃথিবীতে আছে। একদিন
বকুল বন ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে বকুল ফুল তো অবাক!
ঝাঁক বেঁধে চলে মরাল—
শালিক, বক কিংবা কাক
সবার আছে নিজের নিজের সমাজ।
আর সব সমাজ মিলে মহাজাগতিক ঐক্যতান।
তুমি ভেবেছিলে এখানেই শেষ পথ।
কিন্তু শেষ হওয়া মানে অন্য শুরুর রথ।
পথ থেকে পথ জন্ম নিতে থাকে
আর মুছেও যায় কিছু পথের রেখা।
যেমন মুছে যায় অতীত ক্ষতের চিহ্নরা...
কোনো এক বন আছে যেখানে
সকল ভিন্নতা নিয়ে ফুল ফোটে।
কোনো এক আকাশ আছে
যেখানে সব পাখির আশ্রয় জোটে।
রাতে সেখানে জ্বলে বিপুল নক্ষত্ররাজি—
একা বনের একা বকুল না,
সত্য এই ডাইভার্সিটি।
তারাদের দিগ্বিজয়
এভাবে চলে যাওয়া হয়তো স্বার্থপরতা—
কিন্তু কিছু কিছু স্বার্থপরতা আসলে নিঃস্বার্থই।
যেমন নিঃস্বার্থ চলন্ত ট্রেনের সামনে থেকে
নিজেকে বাঁচানো বা হেঁটে যেতে যেতে
অনেক তাড়ার মধ্যে নদীর পাশে কিছুক্ষণ বসা।
কিংবা ঘাস দেখলে অকারণে জুতা খুলে
কিছুক্ষণ হাঁটি। এমন সব স্বার্থপরতা আমাকে টানে।
জানি আজ যে ধুলি চোখে গেল বলে বারবার
চোখ ধুচ্ছি, একদিন সেই এক বিন্দু ধুলি খুঁজবো
হৃদয়ের সলতেয় প্রদীপ জ্বেলে। সময় কতো না
রং বদলাতে জানে! আর জানে নৈঃশব্দ্যই
ভালো থাকা আনে। কতো অদ্ভুত রীতি দিয়ে
সাজানো এই পৃথিবী! সবুজ মাঠের পাশে
যে নিঃশ্বাস টানি, তা হয়তো ফিরে এসেছে
আফ্রিকার কোনো নিষিদ্ধ গ্রাম ঘুরে।
আজ রাতে কোনো বেদনাত্মক অনুভূতি নিতে
অস্বীকার করেছে হৃদয়। আজ মন শুধু
আনন্দময়। যদি আমার একটা শিশু সন্তান
থাকতো, তাহলে তাকে বুকে নিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে
সারারাত দেখতাম আকাশ ভরা তারাদের দিগ্বিজয়।
অগ্নিকুণ্ডের অক্ষর
কিছুই করি না তবু একটু একটু এগোই
দীর্ঘক্ষণ পর তাকিয়ে দেখি
কিছু দূর এগিয়ে গেছে কচ্ছপ
সবুজ গ্রামের পথে। হাল ছেড়ে মাঝ সাগরে
জেলে দেখে অদ্ভুত তারা খসার দৃশ্য।
যেমন একটা নকশি কাঁথা সেলাই করতে করতে
পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে শতবর্ষী বৃদ্ধা,
কিংবা খাবার খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়ে
নির্বাক শিশু, তেমন আনমনে হারিয়ে যাই।
পথ খুঁজে ফিরে আসে বিড়াল
দিগন্তের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে। কিন্তু তুমি থাকলে
হয়তো সবকিছু অন্যভাবে ঘটতো। মহাকাশেও
ফুটে থাকতো বসন্তকাল। একটা কবিতা হয়তো
এভাবেই লেখা হয়, কিছু অক্ষর কুড়িয়ে
কিছু শব্দ যোগ করে। তাই করে যাই—
দীর্ঘক্ষণ পর তাকিয়ে দেখি
কিছু দূর এগিয়ে গেছে কচ্ছপ।
কিছু দূর এগিয়ে আসি আমিও
অগ্নিকুণ্ডের অক্ষর দিয়ে লেখা কবিতা ছেড়ে।
মায়ানদী
নদী ভাঙা মানুষরা যেখানে যায়, সেখানেই নদীর গন্ধ মৌ মৌ করতে থাকে। তাদের প্রতিটা রোমকূপ থেকে জলীয় বাষ্পের মতো উড়ে উড়ে বের হয় নদীর গন্ধ। ধূপের কাঠির মতো বইতে থাকে সে গন্ধ বহুদূর পর্যন্ত। তাদের হাড়ি, কড়াই, গ্লাস, ঢাকনা সবকিছুতে লেগে থাকে মিঠা সে নদীর গন্ধ। এমনকি তাদের গবাদি পশুগুলোর গা থেকেও পাওয়া যায় গন্ধটা। এই মানুষগুলো আর তাদের ছানাপোনা, গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি—সবকিছুই বড্ড মায়াবী। কেননা তারা যে নদীর থেকে জন্ম নিয়েছিল, সেই নদীটা ছিল মায়ানদী। ধূধূ বালুচর পেরিয়ে যতো দূরে দূরে তারা চলে যায়, ততোদূর বাড়ে সেই নদীর পরিধি।
প্রতিধ্বনি
অন্ধ, ভবঘুরে পৃথিবীর ঘুমে আড়ষ্ট
চোখের কোণে কালো মুক্তার মতো জমেছিলো
নিকষ অন্ধকার। কারোই কিছু করার ছিলো না—
তাই সময়ের অর্থ বৃদ্ধ রোগীর পালসের মতো
হারিয়ে গিয়েছিলা অন্ধ ডাক্তারের হাত থেকে।
সমস্ত অন্ধকারের পলিশ উঠিয়ে তার
রোগীনি রক্ষিতা প্রসব করলো সূর্য কুসুম—
কিন্তু হায়! সূর্য নিজেই ছিল জন্মান্ধ...
শঙ্খের খোলসের ভিতর গড়াতে গড়াতে
আমি চিৎকার করে ডাকছিলাম তোমার নাম।
মহাকাল দিচ্ছিলো পাড়ি আমার হাত ধরে।
বেঁচে থাকা এমনই এক সংশয়—
কখনো জাগে সাহস, কখনো লাগে ভয়।
আমার চিৎকারের বীজ ভেঙে অনেকগুলো
প্রতিধ্বনির শিশু করছিলো জন্মকালীন কান্না।
সব শব্দ মিলিয়ে অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো প্রকৃত ধ্বনি—
তুমি হয়তো কাকে ডাকা হচ্ছে কোনদিনও বুঝতে পারোনি।
হে প্রিয়তম প্রতিধ্বনি! আমাকে অনুকরণ করা বন্ধ করোণ
আমার হাসি তোমার মধ্যেও হাসির উদ্রেক
কেন করে? আমার কান্না কেন সৃষ্টি করে তোমার
কৃত্রিম অশ্রুর সাগর? আমি রাগলে দাবানল লাগে
তোমার নির্জন বনে। আমি অভিনয় করে দূরে গেলে
তুমি সত্যি সত্যি নিরুদ্দেশে যাও আমাকে ছেড়ে।
আর ধ্বনি নিজের গান নিজে শুনতে পায় না বলে
কান পেতে রাখে প্রতিধ্বনির অবিশ্বস্ত দেয়ালে।
হেই মি: প্রতিধ্বনি!! গাও তোমার নিজের সুরে গান—
অন্যের কণ্ঠ নকল করার চমক দেখায়
সার্কাসে গানের পাখি। পাথরের বোবা গান
শোনে নদীর কলতান। হাতুড়ি, ছেনি, বাটালি দিয়ে
মৃত্যুর আঁতুড়ঘরে ঈশ্বর জন্ম দেয় জাতিশ্মর।
হও তোমার নিজের কণ্ঠ আবিষ্কার করার কলম্বাস—
ডোমের মতোন খুঁড়ে তোল মগজের অপচনশীল লাশ।
প্রতিদিন নতুন, প্রতিদিন আশ্বাস—
তোমাকে তোমার রূপে সাজাও বিবাহ বাসরে
আমি পড়তে পারি না প্রেমে আমারই পুনরাবৃত্তির কুচক্রে।
তারাদের দিগ্বিজয় কবিতাটি ভীষণ সুন্দর
হাসান
মে ১২, ২০২৩ ১০:৩৮