আত্মমগ্ন কনসার্ট ও দুনিয়াদারির খোয়াব
কবিতা কবির মানস চেতনার বিস্ফারিত স্বরের কাব্যিক চিৎকার। কবির মানস লোকের নিরন্তর দ্বন্দ্ব ও সংঘাত থেকে অনুভূতির উৎপত্তি। বলা যায় সৃষ্ট অন্তর্গূঢ় তুফান থেকে মস্তিষ্কে শব্দের সিগন্যাল পেতে থাকে কবি। অতঃপর ক্ষরিত সৃষ্ট বেদনা কিংবা অভিজ্ঞতা কবির মস্তিষ্কে সঙ্কেত দেয়। কবি যদি হয় ইজেল তুলির একাগ্র মনস্ক চিত্রী ও প্রচ্ছদের নিপুণ কারিগর, তাহলে জলও করাতের কোপে দুভাগ হতে পারে কখনো-সখনো। কবিতা সূর্যের সমকক্ষ অদৃশ্য একটি গ্রহ। যাবতীয় অক্ষাংশের ফায়সালা করে কবিতা শব্দের অগ্নিকুণ্ড নিয়ে ছুটে চলে দিগবিদিক।
চট্টগ্রাম জেলা শহরের এক নন্দদুলাল একা একা হেঁটে কুড়িয়ে পাওয়া পীবর অনুভূতিগুলো জড়ো করে রাত্রি-দিন। এবং তা-ই দিয়ে বিষণ্নতাকে মহীয়ান করেন অনবরত; তিনি আমাদেরই নিকটজন এ-ই শহরের শব্দবাদক চিত্রী বিখ্যাত প্রচ্ছদ শিল্পী কবি খালিদ আহসান। আমার মনে হয়েছে প্রচ্ছদের রঙতুলির রাতুল আড়ালে গভীর সক্ষম মূর্তমান এক কবি, খালিদ আহসান। কাঁধে সর্বদা একটা চামড়ার কালো ব্যাগ অথবা আভিজাত্যপূর্ণ চটের থলে নিয়ে ভীষণ নীরবে তিনি হেঁটে যেতেন জামাল খান চেরাগি পাহাড় থেকে আনন্দকিল্লা শিল্পকলা থেকে বাতিঘর এবং আরও অন্যান্য দরকারী অনন্তে। বেশিরভাগ সময়ে দূরের অথবা নিকটতম আসা-যাওয়ার বাহন রিক্সা। নিজের প্রাইভেট কার থাকা সত্ত্বেও রিক্সায় ঘুরতে-টুরতে পছন্দ ছিল বেশি। অন্যমনস্ক ঠোঁটে সিগার, দৃষ্টি সামনের দিকে স্থির। খালিদ আহসানের মধ্যে স্থিরতা খুব কম দেখেছি উপরোন্ত অস্থির প্রাজ্ঞজনের সৃষ্টিশীল কবির মুগ্ধ ব্যক্তিত্ব লক্ষ্যযোগ্য ছিল বেশি মাত্রায়। প্রকৃত শিল্পীর ক্যামেস্ট্রির সংমিশ্রণে কবি সত্তায় পরিণতি পেয়েছে শব্দের নিরিবিলি যাপনচিত্র। খালিদ ভাই স্বভাবে লাজুক নিবিড় নিবিষ্ট আড্ডারু।
সত্তরের শেষ দিকে খালিদ ভাইয়ের উত্থান প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবে। সে সময়ে দেশে হাতেগোনা কয়েকজনের একজন ব্যতিক্রমী প্রচ্ছদ শিল্পী তিনি। দাপটের সাথে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ এবং লব্ধ-প্রতিষ্ঠিত দেশের লেখক কবিদের বইয়ের দুর্দান্ত প্রচ্ছদ এঁকে চলেছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে প্রাপ্তি ঘটেছে বিবিধ পুরস্কার। প্রচ্ছদের জন্য জাতীয় পুরস্কারেও ভূষিত হন তিনি।
কবিতা চর্চা শুরু হয় সত্তরের শেষের দিক এসে। মাঝামাঝি সময়ে জনপ্রিয় কিছু গানও রচিত হয় তাঁর হাতে। বিশিষ্ট সুরকাররা সুরারোপ করে রচিত গানের কথায়। জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা নকীব খান অন্যতম একজন। শিল্পের এ-ই বিষয়টি আড়ালে-আবডালে থাকলেও কাছের বন্ধুরা জানতেন। কবিতা, প্রচ্ছদের কাজ এবং গান রচনার এই উদযাপনের ভেতরে অস্থিতিশীল এক প্রাণপুরুষের জন্ম জোছনার চেয়েও যেন অধিক আলোর সবোবর। খালিদ ভাই, ভূমিজাত নন্দনতত্ত্ব আগাগোড়া খাঁটি শৈলরাজ। মারাত্মক রকমের সজ্জন সদাশিব মানুষ। নিবেদিতপ্রাণ নিজস্ব পরগণার বাবুজি। প্রকাশিত ৯ টি গ্রন্থ জিজ্ঞাসু এক মৃদুমন্দ ধাক্কা দিয়ে পাঠক ও তাঁর কাব্যে বিপুল অখণ্ডতা সৃষ্টি করে । তাঁর কবিতা আত্মার সংগীত, বাজনার স্পন্দনে ভরপুর বিদীর্ণ এক অভিঘাত। তিনি কবিতার আবর্তনকে মাপেন দ্যুতি ব্যঞ্জনা দিয়ে, পরিধিকে শব্দের সারল্য দিয়ে নির্মাণ করেন। সহজবোধ্যতা ও অপরিমেয় সারল্য তাঁর কবিতার বিশেষ গুণ। পাশ্চাত্য সূর্যাস্তের ছায়া থেকে ধার করে প্রাচ্যর উদিত রোমান্টিকতা; কিন্তু স্থাপনে অতিশয় আলোর প্রতিবিম্ব—
তোমাকে দেখার আগে সূর্যোদয় দেখি
তারপর ঘুমাই ঠান্ডা বালিশে নরোম চুলে,
তোমাকে শেখার আগে পৃথিবীর পাঠশালা
আমাকে টেনেছে
আজ চৌধুরী হাটে যাবো, সেই রেলিং ঘেরা বারান্দা
পাশে শান্ত পুকুর। সেই আলুথালু নারিকেল বিথী—
চমৎকার দুপুরের আগে উদ্বিগ্নতা কাটে না—
কখন বাড়ি পৌঁছে কবিতা হবে
নবনীতা দেবসেন—
আমার তত প্রিয় নন এই কবি, যতটুকু অমর্ত্যসেন
কিছু নদী পেরিয়ে না এলে সমুদ্রের দেখাই মেলে না
তাই হলো গত পৌষমেলায়—বিশ্বভারতীর দরবারে
ভীড় হলো—তার মধ্যে সময় পেয়ে কিছুক্ষণ—
এ না হলে নোবেল বিজয়ী হন?
ও হো হো—
আমরা বঙ্গজাতি, আজকাল পদক আর
দুর্মূল্য স্মৃতিও চুরি করে নিতে শিখেছি,
এ লজ্জা কোথায় রাখি?
কোন ডালে বসবে আজ সূর্যোদয়ের পাখি?
সুপ্রভাতের বারান্দায়: তোমাকে, পানকৌড়িকে/২০০৮
চোখ তুলে তাকাতে ভয় করে?
সামনে কে বসে আছে,
এতো একটি আয়না দেখি
গভীর অচেনা পারদে ঠাস কাচ
এতো খোঁচা খেয়েও খাঁচা ভেঙ্গে পাখি উড়ে গেলো তবু
খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে—এতো দিব্য কান্তি হাসি মুখে
দরজার কপাট খোলা—
খোলা বাতাস
সবার জন্য—
তাকাতে ভয় করে?
নিজেকে দেখতে পাবে বলে?
…
বর্ষা এসে গেছে, দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি
এবার হাসো—
সত্য নির্মল শুদ্ধতম এক গানে।
আত্মদর্শন: তোমাকে, পানকৌড়িকে/২০০৮
সত্তরের শেষ দিকে খালিদ ভাইয়ের উত্থান প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবে। সে সময়ে দেশে হাতেগোনা কয়েকজনের একজন ব্যতিক্রমী প্রচ্ছদ শিল্পী তিনি। দাপটের সাথে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ এবং লব্ধ-প্রতিষ্ঠিত দেশের লেখক কবিদের বইয়ের দুর্দান্ত প্রচ্ছদ এঁকে চলেছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে প্রাপ্তি ঘটেছে বিবিধ পুরস্কার। প্রচ্ছদের জন্য জাতীয় পুরস্কারেও ভূষিত হন তিনি।
প্রথম উদ্ধৃত কবিতাটি একটি আখ্যানের পাঠশালা, একদম নিজের দেখা পৃথিবী। এ-ই কবিতা যতটা স্থানিক, নিকটবর্তী বৈশ্বিক প্রপঞ্চে প্রবেশ আরও বেশি অগ্রগামী। কবির খালি চোখে দৃষ্ট হয় ভারতবর্ষের দু'জন ব্যক্তিত্বের উত্থান পর্ব। কবি নবনীতা দেবসেন এবং বিশ্ব ভারতীয় গৌরবোজ্জ্বল বাঙালি অর্থনীতিবিদ সংস্কারক অমর্ত্য সেন, কে দেখেন বাস্তবানুগ অর্থবিজ্ঞানের যশ খ্যাতি দিয়ে।
অমর্ত্য সেন নিঃসন্দেহে বিশ্বমানবতার, ভারতবর্ষের গৌরব। দুর্ভিক্ষ মানব উন্নয়ন তত্ত্বে জনকল্যাণ অর্থনীতি এবং জন দরিদ্রের অন্তর্নিহিত কার্যকারণ বিষয়ে গবেষণা করে অর্থবিজ্ঞানে ব্যাংক সুইডেনের পুরস্কার লাভ করেন। আবার কীভাবে অস্বীকার করি, কবি ঔপন্যাসিক, শিশু সাহিত্যেক, শিক্ষাবিদ নবনীতা দেবসেনকে। তিনিও কোন অংশে কম যান না। তিনি ভারত বর্ষের সর্বোচ্চ তৃতীয় বেসামরিক পুরস্কার পদ্মশ্রী, সাহিত্য আকাদেমি এবং কমল কুমার মজুমদার পুরস্কারে ভূষিত হন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধদেব বসু ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্নেহাশীর্বাদপুষ্ট ছাত্রী ছিলেন নবনীতা দেবসেন। এই আখ্যানে এসেছে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পদক চুরি যাওয়া প্রসঙ্গে। কবির অকপট বলার ভঙ্গি, সংকোচহীন উপস্থাপন এবং ঘটে যাওয়া অর্বাচীনতা, বালখিল্যতা কবিকে কষ্ট দিয়েছে, পীড়িত হয়েছে কবি। চোখ যতদূর হেঁটে যায়, ততোদূর দেখতে পান কবি। বিশ্বভারতীকে অবলোকন করে দার্শনিক প্রতীতিতে। নিজেকে পরখ করে অসীম আয়নায় একেবারে বাধাবিঘ্নহীন। আয়না পারদঠাসা বিধায় আরও গভীর পর্যবেক্ষণ মূর্ত হয়ে ওঠে। আত্মদর্শন বস্তুর রূপ প্রত্যক্ষ করা ছাড়াও নিজেকে দেখার অভিলাষ মূর্ত হয়ে ওঠে। এ-ই কবিতায় কবি প্রতি পঙক্তি পরম্পরায় অনবরত অপরিসীম সত্য খোঁজার তাগিদ অনুভব করেছে, যা জাগতিক ও অন্তর্গূঢ় সত্যের খসড়া। আলো আছে যেখানে অবশিষ্ট শব্দের বঁড়শি গাঁথা জীবনও আছে সেখানে। এভাবে সমগ্র মানবজীবন কুয়াশার ঘেরাটোপে। কুয়াশার আবর্তনে জিজ্ঞাসা যখন স্থবির ম্যাড়মেড়ে, যখন আলোর স্কুল শিশিরে আচ্ছাদিত তখন কবি হয়ে ওঠেন একমুঠো আলোর অভিভাবক। শিল্পের তৃষ্ণার পরাগায়ণ, মুক্তির অভীক্ষা, কবি নিজেই ব্যক্ত করেন—
আমার কণ্ঠস্বরে বিন্দু বিন্দু কুয়াশা জমেছে
কাছে আসার জন্য চিৎকার—কে শোনে?
আমার তৃষ্ণার সমান জল পাবো শিল্পের চারণ ভূমিতে
সেখানে ঝাঁক ঝাঁক প্রশ্ন
উত্তর মেলাবার ভার একা আমার
…
অন্ধকার চিনে আলোকবর্ষ আলোয় আলো'।
কুয়াশা: ঝিঁঝির কনসার্ট/ ২০১৯
যেমন আরও একটি কবিতায়;
পূর্ণিমা প্লাবিত বিমানবন্দরে
তুমি নামলে
সেই আলোতে আমি তোমাকে দেখলাম
ভেসে যেতে।
চিবুকে চিক চিক আলো
লাবণ্যের গলিত অংশ
রানওয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে
প্রাণখানা বন্ধক রেখেছি সিন্দুকে
দিন আর রাত পালা করে
পাহারা দেয় তাকে
শস্যক্ষেত্র আন্দোলিত সন্ধ্যার বাতাসে
অনুকূল হাওয়া পেলে
আমিও চারিদিকে ছড়িয়ে যেতে পারি—
ডাল পালা বিস্তৃত করে
বিমানবন্দরে: ঝিঁঝির কনসার্ট/২০১৯
কী অসাধারণ কল্প-ইমেজ বিরুদ্ধ বাস্তবতায় নির্মিত হতে দেখি! লাবণ্যের গলিত অংশ রানওয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে। এ-ই দৃশ্যবোধ থেকে জন্ম নিচ্ছে অবিরাম পলায়নপর এক কাব্যসৌন্দর্য। অতঃপর ডালপালাসহ নিজে ছড়িয়ে পড়ার আড়ালে ঘনিষ্ঠ বিলীন হওয়ার প্রস্তুতি সিগনিফাইড হয় মস্তিষ্কের ভাবনাকেন্দ্রে। এই ব্যাকুল উদযাপন শুধু কবিতার নেয়ামত।
আমরা বাংলা কবিতায় রোমান্টিক চরিত্র বৈশিষ্ট্য বৈশ্বিক প্রপঞ্চে ধারণ করতে শিখেছি। রোমান্টিসিজম আক্রান্ত বিশ্বকবিতা পরিব্যাপ্ত ছিল দৃশ্যকলা, সংগীত, প্রকৃতির নয়নাভিরাম ঘুঙুর সুন্দরের আবর্তনে। সমস্যা সংকট এড়িয়ে বাস্তবতা বিবর্জিত এক ধরনের কল্প বাস্তবতা যা ভাবনাগ্রহে যুক্ত হয়ে ঘুমন্ত এলায়িত স্পর্শময় প্রপঞ্চ। সময়ের বহুবিধ হেরফেরে যুক্ত হতে থাকে মানবীয় নারী সৌন্দর্য। রোমান্টিকতা যদি ক্লাসিক আবহে উদ্ভাসিত হতো তাহলে অন্তত যুগের সৌন্দর্যবোধে সংমিশ্রণজাত নির্যাস রচিত হতো। ইউরোপে অষ্টাদশ শতকের সমাপ্তিপর্বে অধিকাংশ অঞ্চলগুলিতে ১৮০০ থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত রোমান্টিকতা অনুমান করা যায়। এর চর্চা ছিল আবেগ ও ব্যক্তিত্ববাদের উপর জোর দেওয়া। আমাদের ভারতবর্ষে রোমান্টিকতা দ্বিত্বতা নিয়ে উপস্থিত থেকে মনোস্নিগ্ধ সুতীব্র কল্পজোয়ার সৃষ্টির উল্লাসে মেতেছিল রবীন্দ্রনাথ এবং তৎপরবর্তীকালে সাহিত্য কবিতা। এটিও ঠিক যে এ-ই ভূগোলের মানুষের জীবন-যাপন সংস্কৃতি ইউরোপ থেকে আলাদা এবং সংঘবদ্ধ। ফলে, ভোরের প্রকৃতির সাথে নদী ও পাহাড় বেষ্টিত জনপদের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন পূরণে সর্বোপরি নারীপ্রেমের যাবতীয় রসায়নে, রোমান্টিকতার ভিন্ন আদল তৈরি হয়। এখানে প্রেম ভালোবাসা ও সামাজিক জাগরণে প্রেরণাদাত্রী ছিল নারী। এ-ই উপজীব্য সত্তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও মানবিকতার দর্শন রোমান্টিকতার অনন্যসাধারণ সংযোজন। রোমান্টিকতাকে পেলেপুষে পুষ্টি দিয়েছে এ উপমহাদেশের স্বাপ্নিক মধ্যবিত্ত মানুষেরা। আমাদের কবিতায় যুক্ত হয়েছে প্রকৃতির সাথে অদ্ভুত নারী সৌন্দর্যবোধ স্তুতি।
কবিতায় নীতি কথার কোনো স্থান নেই। নীতি কথা দিয়ে নৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক প্রপঞ্চ গড়ে ওঠে। নীতি ও আইন ধর্ম সুনির্দিষ্ট এক বৃত্ত যা খুব সহজভাবে অতিক্রম করা যায় না। আবার কিছু না বলাটাও অসচেতনতা, সীমাবদ্ধতা। কবি কি নির্দিষ্ট খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসার স্বপ্নযজ্ঞ রচনা করতে চান? শহরে কী পাখি এসে সঙ্গীত শোনাবে? করির কবিতায় দ্বিত্ব রীতির আভাস। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—Pure literature is there where lies inconsistency.
কবি খালিদ আহসান তার-ই অনুগামী এক কল্পবিলাসী কবি। ইংল্যান্ডে যেমন রোমান্টিক আন্দোলন খানিকটা স্থানীয় রীতি অনুযায়ী গড়ে উঠেছিল, এবং প্রকৃতিপ্রেম শ্রেষ্ঠ এই তকমা প্রচার করা শুরু করেছিল কিছুটা তার-ই ধারাবাহিকতায় এই উপমহাদেশে রোমান্টিসিজমের চর্চা। কবি খালিদ আহসান পাশ্চাত্য অনুগামী হয়ে আমূললগ্ন সৌন্দর্যবোধের অভূতপূর্ব এক আলোক প্রাপ্তির বীজ বপন করতে চান। তিনি সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের মতো কাব্য কর্ষক—
ঢালুর ওপর বসে
কেউ বাজাচ্ছে ভায়োলিন,
আমি কেবলই ছুরি দিয়ে কাটছি
লাভা সমেত জিহ্বা সমেত মুখ
নীতিকথা আমার জন্য নয়
আমার গলায় বকলেস—
ঘুরে ফিরে নির্দিষ্ট খাঁচা,
অন্ধকার ভেঙে আসছে
এক চিলতে আলো
এ শহরে গান গাওয়া পাখিদের
আজ প্রবেশ নিষেধ—
বকলেস: ঝিঁঝিঁর কনসার্ট/২০১৯
কবিতায় নীতি কথার কোনো স্থান নেই। নীতি কথা দিয়ে নৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক প্রপঞ্চ গড়ে ওঠে। নীতি ও আইন ধর্ম সুনির্দিষ্ট এক বৃত্ত যা খুব সহজভাবে অতিক্রম করা যায় না। আবার কিছু না বলাটাও অসচেতনতা, সীমাবদ্ধতা। কবি কি নির্দিষ্ট খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসার স্বপ্নযজ্ঞ রচনা করতে চান? শহরে কী পাখি এসে সঙ্গীত শোনাবে? করির কবিতায় দ্বিত্ব রীতির আভাস। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—Pure literature is there where lies inconsistency.
উল্লিখিত দুটো কবিতা গ্রন্থে কবিকে পাওয়া যায় সহজ বুনন কৌশলের সচল কবি হিসেবে। কোথাও কোথাও সাবলীল সাধারণ পঙ্ক্তি সৃজিত হয়ে গড়িয়েছে জীবনের দিকে। প্রাত্যহিক কথা বলার আবেগী ভাষাকে রাখঢাকহীন চেহেরায় উপস্থাপন করেছে। যেন পক্ষী-আবেগ মেঘের ভেতরে উড়ে জলের সন্ধানে…
তিনি শুধু একটা জায়গায় স্থিতধী হয়ে থাকতে চাননি, জলের ঘূর্ণির মতন একটা পরিবর্তিত বাঁকের মুখে এসে পড়েছিলেন। ‘কলম লিখেছে কবিতা আমি তার প্রথম শ্রোতা’ কবিতা বইয়ের প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সাল। ক্রমিক ধারাপাতে তিনি ৪০ টি কাব্যভাষ্য রচনা করেন টানা গদ্যে। অজস্র কথার সংগীত হয়ে কলমপ্রাণে সবটা কলমি কবিতা। চূর্ণবিচূর্ণ অনুভূতির রাগমালা নিয়ে প্রকাশিত এই গ্রন্থে চিত্রিত হয়েছে বিখ্যাত কবি চিত্রশিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রীর আঁকা ৬ টি অনবদ্য ছবি। পূর্ণেন্দু পত্রীর ছবির মধ্যে সর্বদা যা থাকে বিশেষ করে ড্রয়িং আর্টের মধ্যে, নারী বিভূতি, সৌন্দর্য, অবলোকনের উচ্চতা, কবিতাগুলোকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রিক ছান্দিক গতি-প্রগতি ও বিলয় ভাবনা। টানা গদ্যে লিখিত কবিতাগুলো দৃশ্যত দৃষ্ট হলেও অন্তরাত্মার বাঁধন শক্ত করেছে কবি পূর্ণেন্দু পত্রী।
ঘামছো না কেন? স্বর্গীয় এই সুবাতাস আমার ভালো লাগছে না। মোম পালিশ করা স্বর্গীয় শরীর। আমি চাই কড়া ঘাম—বন্ধ নাক, চোখ অন্ধ হয়ে যেতে। শ্রমিক কিনা সারাটি জীবন—কেবল সম্ভ্রান্ত সুগন্ধীতে মেতে থাকে মন।
ভ্রমণের গল্প শেষ মাটিতে নামছি যখন—বুঝতে হবে নিরাপদ বন্দর কোনখানে—প্রাণে মারবে না বলো—পাপ বলে কিছু নেই—কেবল হত্যা ছাড়া—সৃষ্টির প্রথম শর্তে সবল—তরল পাপ আর একজোড়া সাপ, এঁকেবেকে মাধবীলতাকে জড়িয়ে রেখেছে দু’জনে।
গুল্মলতাকে বলি, মাধবীলতাকেও। তোমাকে বলি, বলি পানকৌড়িকে। ভালোবাসা একখানি নাও, এসে বসো—সাথে তরীটাও
কবিতা-৯: কলম লিখছে কবিতা, আমি তার প্রথম শ্রোতা
ভালোবাসায় ভেসে যাচ্ছে পূর্ণ চন্দ্রলোক, আমার গভীর ক্ষতে জমে যাচ্ছে কিছু শ্লোক। তোমাকে হারাতে হবে এই ভয়ে ছুটে যাচ্ছি দরজায়। দরজায় কড়া নেড়ে—অবেলায় কার ঘরে কি যে পাই। নাই—নাই—নাই। সুসময়ে বন্ধু সবাই—এখন অবসর নেবার আর বেশি বাকি নাই।
কবিতা-১০: কলম লিখছে কবিতা, আমি তার প্রথম শ্রোতা
কবি দেখতে পান নিকট সময়কে। সময়ের ভেতরে নিজেকে। ভবিষ্যৎ দেখতে পান। দেখতে ভবিষ্যতে ঘটিতব্য নিয়তিকে। এখানে হারানোর ভয়, দরজার কড়া নাড়া, অবেলায় ফিরে যাবার ব্যকুলতা। অখণ্ড অবসরের ঘোষণা। এই ইঙ্গিত কী নিজের বন্ধন ছিন্ন করার!
এই মৃত্যু উপত্যকা নিয়ে কবিতা লিখে বনানীতে মাটির নীচে অন্ধকার—উপরে ল্যাম্পপোস্টের আলোয়—শুয়ে আছে—প্রিয় কবি—প্রিয় বন্ধু আমি তার আগেই যৌবন উলোট-পালট করে তেড়ে আসবো তোমার স্বর্গের বাগানে। আমাকে বাঁচাতে হবে।
…
বাদামী শরীর এঁকেই চলছিল—শাদা বৃন্তের দিকে
…
আলোর ট্যানেল পার করে কৃষ্ণ গহ্বরের অন্ধকার তেড়ে আসছে বেমালুম—
কবিতা-৫: কলম লিখছে কবিতা, আমি তার প্রথম শ্রোতা
‘কলম লিখেছে কবিতা আমি তার প্রথম শ্রোতা’ কবিতা বইয়ের প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সাল। ক্রমিক ধারাপাতে তিনি ৪০ টি কাব্যভাষ্য রচনা করেন টানা গদ্যে। অজস্র কথার সংগীত হয়ে কলমপ্রাণে সবটা কলমি কবিতা। চূর্ণবিচূর্ণ অনুভূতির রাগমালা নিয়ে প্রকাশিত এই গ্রন্থে চিত্রিত হয়েছে বিখ্যাত কবি চিত্রশিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রীর আঁকা ৬ টি অনবদ্য ছবি। পূর্ণেন্দু পত্রীর ছবির মধ্যে সর্বদা যা থাকে বিশেষ করে ড্রয়িং আর্টের মধ্যে, নারী বিভূতি, সৌন্দর্য, অবলোকনের উচ্চতা, কবিতাগুলোকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রিক ছান্দিক গতি-প্রগতি ও বিলয় ভাবনা। টানা গদ্যে লিখিত কবিতাগুলো দৃশ্যত দৃষ্ট হলেও অন্তরাত্মার বাঁধন শক্ত করেছে কবি পূর্ণেন্দু পত্রী।
কবি অপরের অদৃশ্যমানতায় খুব সন্তর্পণে নিজের ছায়া আবিস্কার করেন। উপরোক্ত এই কাব্যাঙ্গে কী নিবিড়ভাবে লুকানো সময়ের কথা ব্যক্ত করেন। শব্দের খোলসে যে ব্যাপকতা যে এন্যাটমি তা কবির নিজেরই ছায়ার মর্মর ধ্বনি। দুটো কবিতায় শব্দের জানাজা জানাজানি হয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ। কবিসৃষ্ট এই শব্দানুষঙ্গ বিভাসিত গভীর অন্তর্লোকের বিধান। এখানে যতটা না কবিতা তারও বেশি অন্তর্গূঢ় বেদনার ধারাপাত। তিনি যেন মুক্তি চেয়েছেন মুক্তছন্দের অবারিত জোয়ারের গভীর নাব্যতায়। মৃত্যু একটা অবস্থা থেকে ভিন্ন একটা অবস্থায় পৌঁছানোর নাম। রূপান্তর। জীব বিজ্ঞানের ভাষায় প্রাণের সমাপ্তির সিনড্রোম। আত্মা যতক্ষণ দেহের খোলসে থাকে ততক্ষণ নামের পরিচিতির আবহে বেড়ে উঠে মানুষ। একটা সময় পোষ-মানানো আত্মা স্বাধীন সার্বভৌম ও শূন্যতান্ত্রিক হতে চায়, তখন পরিচয়ের ধার ধারেন না। কারণ আত্মার কোনো নির্দিষ্ট নাম নেই, সাকিন নেই। ভিন্ন একটা খোলসে ফিরে যাবার শক্তি থাকলেও থাকতে পারে।
মৃত্যুকে হাগ করবেন এই অভ্যাস বা চর্চা দীর্ঘদিন থেকে করে আসছিলেন কবি। তবে মৃত্যু দেহটা নিয়ে খেললেও কবির কাব্যচিন্তা নিয়ে যেতে পারেন না। কবির একটি কবিতা অনূদিত হয়ে বিবিধ ভাষার অবয়ব হতে পারে যা দেবে অমরত্ব। কবির কাব্যচক্র মধুতে আবর্তিত হয়েছিল জীবন নামতা এবং অন্বেষণ। তিনি সর্বত্র সুন্দরের প্রতি নমিত ও বেদনাবিধুর। ঊনিশ শতকের পাশ্চাত্য রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন থেকে প্রকৃতি প্রভুর করতলে মানব সমাজের অর্কেস্ট্রা বাজিয়ে দিয়েছিলেন শৈল্পিক নির্যাসে। কবিকল্পনা, স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ দৃষ্টভঙ্গির অবচেতনের আরাধনা ছিল আলোক প্রাপ্তি।
খালিদ আহসান, একজন জাতমাতাল শিল্পী কবি। তিনি চলে গেলেন নীরবে। কোভিড ১৯, তাঁকে বাঁচতে দেয়নি। তবে, তিনি সকল কিছু ছিন্ন করে চলে যাননি। তাঁকে ভাববার যথেষ্ট অনুষঙ্গ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখে গেছেন। মৃত্যুর মাত্র ২০ দিন আগে তাঁর সাথে আমার ভিডিও কলে কথা হয়। সকাল বেলায় কবির ভিডিও কল পেয়ে আমি বিস্মিত হয়েছি। এর আগে তাঁর সাথে আমার ফোনে কিংবা ভিডিও কলে কখনো কথা হয়নি। ভিডিও কল পেয়ে আমি বিস্মিত হয়েছি বটে তবে টলকে যাইনি। শ্মশ্রুমণ্ডিত স্মিত হাস্যোজ্জ্বল ছবি মোবাইল স্ক্রিনে। তিনি স্বভাব সৌজন্যবশে জিজ্ঞাসা করলেন—‘কেমন আছি?’ আমি ‘ভালো’ বলতে তিনি কেমন আছেন, এই জিজ্ঞাসা করার সুযোগ না দিয়ে আবারও বললেন, ‘গতরাত ভারতবর্ষের গত শতকের ৬০-এর হাংরি জেনারেশনের বিখ্যাত দ্রোহি কবি মলয় রায় চৌধুরীকে নিয়ে তোমার বক্তব্য ভীষণ ভালো লেগেছে।’ তিনি আরও কিছু যুক্ত করে আমার উপস্থাপনার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। তাঁর সাথে নিরবচ্ছিন্ন লেগে থাকা কোনো স্মৃতি নেই। একটা জায়গায় খুব বেশিক্ষণ থাকতেন না। তবে, মাঝেসাঝে দেখা হতো বিভিন্ন আড্ডায়। প্রকাশক কবি মনিরুল মনিরের ‘খড়িমাটি’ অফিসে বেশি দেখা হতো। আমার পঞ্চম কবিতার বই ‘দুপুরলতা’র প্রচ্ছদ শিল্পী তিনি। কোনো এক কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে মুখোমুখি হলে, স্মিত নম্র হেসে জানতে চেয়েছিলেন; দুপুরলতার প্রচ্ছদ পছন্দ হয়েছে কি-না। আমার হস্তাক্ষরে উল্লিখিত গ্রন্থের একটা সৌজন্য কপিও ছেয়েছিলেন। আমার বিরামহীন অপারগতায় কপিটি তাঁকে আর দেওয়া হলো না। আমার সৌভাগ্য, দুপুরলতা তাঁর অনিন্দ্য সুন্দর হাতে সজ্জিত হতে পেরেছিল। গ্রন্থটির কিছু কবিতার বেশ প্রসংশা করেছিলেন। ভীষণ তাড়াহুড়ো করে চলে গেলেন তিনি। সে-ই ভিডিও কলটি প্রথম এবং শেষ কল। কল শেষে অনেকটা অগ্রজের স্নেহের সুরে বলেছিলেন, যেন মাঝে-মধ্যে কল করতে ভুলে না যাই। সে-ই তিনি খুব দ্রুত সব ধরনের কলের ঊর্ধ্বে ওঠে গেলেন। কবি খালিদ আহসানের মৃত্যুতে অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি। জানি বিদায়ের ক্ষণকে কেউ আমরা ঠেকাতে পারি না। তাঁকে আমি দূরে থেকে প্রচণ্ড ভালোবাসতাম। কথাটি জীবদ্দশায় কম জানতেন তিনি। জানতেন এক ভাগ হয়তো, মৃত্যুতে দু’ভাগ রয়ে গেল অজানা।
► লেখায় ব্যবহৃত ড্রইয়িং প্রখ্যাত ভারতীয় কবি, লেখক ও শিল্পী পূর্ণেন্দু পত্রীর। তিনি খালিদ আহসানের বইয়ের জন্য এঁকেছিলেন।
অত্যন্ত চমৎকার ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, পড়ূ ভালো লাগলো।
রুদ্র সুশান্ত
অক্টোবর ১৬, ২০২৩ ০৮:২৬