চম্পকনগরের চাকমা সাহিত্য

অ+ অ-

 

বাঝি বেইয়া রু রু রু
আগে সালাম দ্যং মর গুরু
মা স্বরস্বতী সাক্ষীয়ে
সালাম দ্যং মা ভক্তিয়ে

[রাধামন-ধনপুদি/সালামি]

 

বাঁশি বাজে রু রু রু
আগে সালাম দিচ্ছি মোর গুরুকে
মা স্বরসতী সাক্ষী
সালাম দিচ্ছি মা ভক্তিতে

পাহাড়ে আগের মতোন কি এখন রু রু সুরে বাঁশি বাজে? নাকি বাজে অস্ত্রের বিকট জীবনবিনাশী শব্দ? একদা খবরের পাতা খুললেই দেখা যেত, আদিবাসীদের সঙ্গে নানামুখি বিরোধের ঘটনা। বড় বড় কর্পোরেট কর্তৃক বসতভিটা বা জুম চাষের জমি দখল করে ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য রিসোর্ট তৈরি আরও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে আদিবাসীদের। ১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তি হলেও শান্তি আসেনি পাহাড়ে। যেন সেখানে গোলমাল-সংকট বজায় রাখাটায় উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতাবানদের।

গোলাকার মুখ, চ্যাপ্টা নাক, ছোট ছোট চোখ, বক্র দৃষ্টি, প্রশস্ত বক্ষ, গৌরবর্ণ, মধ্যমাকার সবল শরীর, মুখে দুর্বোধ্য ভাষা, এই মঙ্গোলিয়ান/লৌহিতিক/তিবেতো বার্মা জাতের মানুষদেরকে এখন আমরা কতো নামেই না ডাকি। উপজাতি, আদিবাসী, পাহাড়ী, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী, নৃ-জাতিকতো তাদের জাতিগত পরিচয়! টিলা বা পাহাড়ের ওপর ছোট ছোট মাচাং। যেন চর্যাপদের সেই দোহা, টালত মোর ঘর নাহি পড়বেশী, হাড়ীতে ভাত নাহি নিতি আবেশী। দুর্গম পাহাড়ের জীবনে প্রাচীনকাল থেকে নিত্য অভাব।

মাচাংয়ের ভেতর নিজের ঐতিহ্য, সংস্কার, স্বকীয়তা নিয়ে ওদের জীবন। ওরা মানে চাকমা-মারমা-পাংখো-ম্রো-চাক-তনচ্যাঙ্গা-লুসাই-খুমি। বাংলাদেশে ওদের বাস পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি জেলায়। কিছু কিছু ছড়িয়ে আছে কক্সবাজারে। অবশ্য সেখানে রাখাইন সম্প্রদায় বেশি। সংখ্যায় ক্ষুদ্র এসব জাতিসত্তার রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ঐতিহ্য, রীতিনীতি ও ধর্ম। বাংলাদেশের আদিবাসীগুলোর মধ্যে চাকমারা সংখ্যাগুরু। শিক্ষার দিক দিয়েও এগিয়ে চাকমারা। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল ছাড়াও ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, অরুণাচল, মিজোরাম ও আরেক পাশ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে রয়েছে চাকমাদের আবাস। সরকারি হিসেবে ১৯৯১ সালে চাকমাদের সংখ্যা ২,৫২,৮৫৮ জন। ১৯৯৫ সালের বেসরকারি সংস্থার জরিপে পাওয়া যায় ৩,০০,০০০ জন। ২০১১ সালের আদমশুমারির হিসেব অনুযায়ী, এদেশে রয়েছে মোট ৪,৪৪,০০০ জন চাকমা। গত এক দশকের হিসেবে সংখ্যাটা আরও বাড়ার কথা।

প্রাচীন ভারতে চম্পককলি নামে এক রাজা ছিলেন। চম্পককলি যে নগর শাসন করতেন সেই নগরের নামকরণ হয় চম্পকনগর। গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত চম্পকনগর অঙ্গরাজ্য রূপে মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। চাকমাদের অন্যতম প্রাচীন সাহিত্যকীর্তি রাধামন-ধনপুদি গীতিকবিতায় চম্পকনগরের পরিচয় মেলে এভাবে

মানেইপুরীতে স্বর্গ সান
চম্পকনগর রেজ্যগান
সমুদ্র্র কূল পুগেদি
ফুগংতলী তলেদি

[রাধামন-ধনপুদি/পত্থম কধা]


মনুষ্যপুরীতে স্বর্গের মতো
চম্পকনগর রাজ্যটি
সমুদ্র কূলের পুর্ব দিকে
ফুগংতলী পাহাড়ের তলে

চম্পকনগরের অধিবাসীরাই এখন চাকমা নামে পরিচিত। মঙ্গোলিয়ান চেহারার কারণে অনেক বাঙালি তাদের মগ ডাকে। তবে চাকমা-মারমা জাতিগোষ্ঠীর মতো মগও ভিন্ন এক জাতি। চাকমাদের আদি নিবাস, চাকমা নামকরণ বিষয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন মত ব্যক্ত করেন। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৬ লাখ লোক চাকমা ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়াও মিয়ানমারের আরাকানে চাকমা জনগোষ্ঠী বাস করে। কেউ উন্নত জীবনের সন্ধানে প্রবাসী। চাকমারা মূলত থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের চর্চা করেন। তবে ধর্মীয় নিষেধ থাকলেও অনেকে প্রাণী শিকারে জীবিকা নির্বাহ করে। খীসা, চাক ও তঞ্চগ্যারাও চাকমা জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত। চাকমাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা। ৩৯টি বর্ণমালায় আছে ৫টি স্বরবর্ণ ও ৩৪টি ব্যঞ্জনবর্ণ। চাকমা ভাষা বৃহৎ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের অন্তর্গত।

নিজস্ব বর্ণমালা থাকা সত্ত্বেও এখনো চাকমারা নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত। অবশ্য সেই দৃশ্য কিছুটা হলেও এখন পাল্টেছে। বাংলা ভাষার দাপটে চাকমা ভাষা থেকে গেছে অবিকশিত। সরকারের উদ্যোগহীনতা এবং শিক্ষিত চাকমাদের এগিয়ে না আসাও এর প্রধান কারণ। বাংলাদেশে চাকমারা কেবল ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে অবহেলিত নয়; জাতিগত পরিচয়, সেটেলার বাঙালিদের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ-সংঘর্ষ ও অর্থনৈতিক বৈষম্যেরও শিকার তারা। দশকের পর দশক ধরে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে কাজ করলেও চাকমাদের মতো অন্যান্য আদিবাসীরা এখনো শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা থেকে সুবিধাবঞ্চিত।

চাকমা ভাষা যেমন কিছুটা মিশ্রিত [সবচেয়ে বেশি মিশ্রণটা ঘটেছ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ও বাংলাভাষার সাথে] তেমনি তাদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতির সংস্পর্শে আসার কারণে সমাজ-সংস্কৃতিতেও বেশ পরিবর্তন ঘটেছে। মুসলিম রাজার অধীনে থাকার সময় ইসলামিক সংস্কার ও ভাষায় ইসলামিক শব্দের ব্যবহার তার প্রমাণ বহন করে। হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাবও পরিলক্ষিত হয় চাকমাদের মধ্যে। হিন্দু ধর্মালম্বীদের মতো চাকমারা গঙ্গা নদীকে পবিত্র জ্ঞানে এখনো পূজা করে।

বর্তমানে চাকমা জাতি বৌদ্ধধর্মের অনুসারী। আগরতারাপুঁথি চাকমাদের প্রাচীন ধর্মীয় গ্রন্থ। চাকমা পুরোহিতেরা সম্পূর্ণ চাকমা বর্ণমালাতে এটি রচনা করেন। ২৮টি অংশে বিভক্ত এই আগরতারা মূলত পালি সুত্র’-এর অপভ্রংশ।

গোজেন লামা বা গোঁসাই পালা [গোজেন বা গোঁসাই শব্দের অর্থ ভগবান বা সৃষ্টিকর্তা] চাকমা লোকসাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় পালা বা গান। এগুলোকে গীতিকবিতাও বলা যায়। চাকমা গায়ক গেংখুলিরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সারারাত্রি ধরে এই গীতিকবিতা সুর করে একটিমাত্র বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে গেয়ে মানুষকে বিনোদিত করেন। অলৈাকিক শক্তিধর উদাসী শিবচরণ চাকমা গোজেন লামারচনা করেছেন বলে মনে করেন ঐতিহাসিকেরা। উদাসী শিবচরণ সম্পর্কে একটা কথা প্রচলিত আছে চাকমা সমাজে

যে বর মাগে সে বর পায়,
গোজেন বর দিলে ন ফুরাই।

[গোজেন লামা/২য় লামা]

এসব লামা বা পালায় ইহজাগতিক বিষয়ের সাথে রয়েছে জাগতিক বিষয়ও। সৌন্দর্য সৃষ্টির দিকেও চোখ রেখেছেন কবি।

উজানি ছড়া লামনী ধার
না আছিল সৃষ্টি জলৎকার
জল উপরে গর্য্যে স্থল
বানেল গোজেনে জীব সকল 

[গোজেন লামা/১ম লামা]

 

উজানমুখী নদী তার নিম্নমুখী জলস্রোত
ছিল না জলাকারের সৃষ্টি
জলের ওপরে সৃজন করেছেন স্থল 
ভগবানে বানালেন জীব সকল

দশ মাস দশ দিন দুখ পিয়ে
জম্বু দিবত-নি জন্মেয়ে। 
পুরি চেলং চোখ ভরি
মা বাপ পারা নেই দেশভরি। 

[গোজেন লামা/১ম লামা]

 

দশ মাস দশ দিন দুঃখ পেয়ে
জম্বু দ্বীপে নিলাম জন্ম
জন্ম নিয়ে দেখলাম চোখ ভরে
মা বাবার মতো কেউ নেই দেশভরে। 

চাকমা লোকসাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যালাড বা লোকগাথা হলো রাধামন-ধনপুদি। বিশ্বসাহিত্যের অমর প্রেম কাহিনী রোমিও-জুলিয়েট, শিরি-ফরহাদের মতো রাধামন-ধনপুদিও অনন্য প্রেমকাহিনী। এই গাথা ৯টি পর্বে বিভক্ত। যেখানে চাকমা ভাষায় কাব্যিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে দুই প্রেমিক হৃদয়ের গল্প। কীভাবে প্রতিকূলতার নদী ও সংকটের সংসার পেরিয়ে রাধামন পেল ধনপুদিকে।

চাকমা জাতির ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ওপর ভিত্তি করে রচিত চাঁটিগাং বা চাঁদিগাং ছাড়া পালা। ৯ম শতাব্দীর চাকমা রাজা বিজয়গিরির যুদ্ধ-অভিযান বর্ণিত হয়েছে এই পালায়। এটি রাধামন ধনপুদির দ্বিতীয় খণ্ড বিশেষ। তার থেকে ক্ষাণিক তুলে দেওয়া হলো

সেই সংবাদ শুনি কি গল্ল
সিত্তুন বিজয়গিরি লর দিল
   
সেই সংবাদ শুনে কি করল
হৃষ্ট চিত্তে বিজয়গিরি রওনা হল

এসব ছাড়াও চাকমা লোকসাহিত্যে রয়েছে ধাঁধা, প্রবচন, ছড়া, রূপকথা প্রভৃতি। বাংলাদেশের লোকসাহিত্যের সাথে তার যথেষ্ট মিল প্রত্যক্ষ করা যায়। যেমন

১. যে দেশত বৃক্ষ নেই সে দেশত এরেন্ডা প্রধান
২. ঝিরে মারি বৌরে শিখায়

চাকমা লোকসাহিত্যের অন্যতম অধ্যায় হলো ছড়া। প্রচুর পরিমাণ ছড়া নিয়ে চাকমা লোকসাহিত্য ভরপুর।

হাদত্ লয়ে বাদোল বাঁশ
কুজ্জদ লয়ে গুলি 
লক্ষো বুড়া ঘুম র্যা
সোনার ধুলনত্ পড়ি।।

[ঘুম পাড়ানী গান] 

 

হাতে নিয়ে বাঁশের বাটুল
কোমরে নিয়ে গুলি [মাটির গুলি]
লক্ষ খোকা ঘুমিয়ে আছে
সোনার দোলনাতে চড়ি।।

চাকমা সাহিত্য আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছে কবিতার হাত ধরে। বর্তমান বেশ কয়েকজন শক্তিমান কবি বাংলা বর্ণমালায় চাকমা কবিতা চর্চা করছেন। তারমধ্যে কবিতা চাকমা, প্রিয়দর্শী খীসা, শিশির চাকমা, আলোড়ন খীসা অন্যতম। তরুণদের মধ্যে অ্যালিসন চাকমা ও অন্বেষ চাকমা উল্লেখযোগ্য। তাঁদের লেখায় উঠে এসেছে সমাজের নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের কথা, পাহাড়ের প্রতি ও সুখ-দুঃখের গল্প। দীর্ঘদিন ধরে তারা সাহিত্যের ছোটকাগজও প্রকাশ করে আসছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুসময় চাকমা ও সজীব চাকমা সম্পাদিত জলি। মৃত্তিকা চাকমা সম্পাদিত ইরুক, দীপায়ন খীসা মাওরুম। এছাড়া জুম, হাজলং, স্ববন, মোনকধা, টঙ নামের ছোটকাগজ বেশ উল্লেখযোগ্য। অবশ্য সেসব কাগজ শহরকেন্দ্রিক সাহিত্যপাড়ায় পৌঁছায় না বললেই চলে। যার কারণে অনেক সাহিত্য প্রতিভার হদিশ মেলা ভার।

চাকমা নাটকও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছে মানুষের মনে। ধেঙা বৈদ্য ১৯৭৮ [নানাধন চাকমা], অয় নয় বৈদ্য ১৯৮২ [ভগদত্ত খীসা], আন্দারত জুনি প্রহর ১৯৮৬ [শান্তিময় চাকমা], হক্কানির ধনপানা ১৯৯৯ [মৃত্তিকা চাকমা] আরও অনেক নাটক চাকমা সমাজ ও বাংলাদেশে বেশ আলোচিত হয়।  

বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সরকার কোনো সময় আগ্রহ সহকারে চাকমা তথা অন্যান্য আদিবাসীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এই কথা বলা যাবে না। আদিবাসীউপজাতি নাকি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি কোন নামে তারা পরিচিত হবে এই সমস্যারও সমাধান হয়নি এখনো। সমাধানের চেয়ে দিনদিন এসব সমস্যা বাড়ছেই।