হারুকি মুরাকামির ছোটগল্পের জগৎ
হারুকি মুরাকামি এই শতকের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে জাপানি এই লেখকের বিরুদ্ধে খোদ জাপানে একটি অভিযোগ বারবার উঠে এসেছে যে, তিনি জাপানি ভাষায় মার্কিনি উপন্যাস লেখেন। যেখানে জাপানি সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে ভিনদেশি পাঠকের মানসিক ও সামাজিক অবস্থার বয়ান বেশি থাকে। আধুনিক জাপান যে ধরনের সংযত, পরিশ্রমী, সুশৃংখল, কর্মনিষ্ঠ জীবনধারার জন্য বিখ্যাত মুরাকামির গল্প-উপন্যাসে তাদের খুব একটা দেখা মেলে না। তবে মুরাকামির কাহিনিতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের পণ্য নির্ভর অতি আধুনিক সমাজের দেখা মেলে। অথচ এই আধুনিক, অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও হাতের নাগালে স্বাচ্ছন্দ্যের সব রকম উপকরণ থাকা মানুষগুলো কোথায় এসে যেন থমকে যায়। এক আশ্চর্য একাকীত্ব, কখনো একঘেয়েমি বা তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাদেরকে গ্রাস করে প্রতিনিয়ত। তাদের হাতের নাগালে সুখে থাকার সব উপকরণ থাকলেও কোথাও না কোথাও জীবনের ছন্দ হারিয়ে ফেলে তারা। বিষণ্নতা, নিঃসঙ্গতা, অপূর্ণতা বিরাজ করে তাদের মানস জগতে।
একাকী এই মানুষগুলোর সুপ্ত বাসনা, ভয়, আকাঙ্ক্ষা যেন অদ্ভুত এক রূপ ধারণ করে। মুরাকামি কয়েকটি সাংকেতিক ঘটনাবলির মাধ্যমে তাদের অভ্যস্ত জীবনকে নাড়িয়ে দিয়ে যান। আপাত দৃষ্টিতে দেখা যায় মুরাকামি অদ্ভুত কাহিনি ফেঁদে ওইসব বিষণ্ন, অবসেসড মানুষগুলোর সমস্যার সমাধান বের করার চেষ্টা করেন। আবার কখনোবা ওইসব চরিত্র আরো জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। চরিত্রগুলো কিছুটা বাস্তব কিছুটা অবাস্তব এমন একটা পৃথিবীর বাসিন্দা। তাঁর গল্প উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই বিশ্বায়নের যুগের উত্তর-আধুনিক সভ্যতার ছবি। যেখানে সাধারণ মানুষ হয়ে পড়েছে পরস্পর বিচ্ছিন্ন, স্বার্থপর। এই উত্তর-আধুনিকতাকেই ফ্রেডরিক জেমিসন অবশ্য ‘ধনতন্ত্রের শেষ পর্যায়ে যুক্তিসিদ্ধ রূপ’ বলে মনে করেন।
তাঁর ‘হাতিটা উধাও’ গল্পে দেখা যায়, বৃদ্ধ হাতি মাহুতসহ একদিন উধাও হয়ে যায়। যে মাহুতের সাথে হাতিটার এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। দীর্ঘ এই সম্পর্কের ঠিক কোনো ব্যাখ্যা হয় না। তবে হাতিটা বৃদ্ধ, সে যেকোনো সময় মরে যেতে পারে। সে একটা বিশাল গরাদে বন্দি অবস্থায় থাকে, এ অবস্থায় সে কিভাবে মাহুত সমেত উধাও হয়ে যেতে পারে! এই উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় সবাই তার তত্ত্বাবধায়নকারী সিটি কর্পোরেশনের অবহেলাকে দায়ী করতে থাকে। কিন্তু এই গল্পের কথক জানান, হাতিটা তিনি মাহুত সমেত আকার পরিবর্তন করে উধাও হয়ে যেতে দেখেছেন। অর্থাৎ হাতিটা তার আকার পরিবর্তন করে ছোট হয়ে গরাদের বাইরে বের হয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। আবার একই সাথে বিষয়টি তার কাছে অতো পরিস্কারও নয়, যেন ঝাপসা এক ঝলক মাত্র। এই ঘটনা কথকের ভেতরে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। তিনি কিছু একটা করতে চান বলে ঠিক করেন আবার পরক্ষণেই ভাবেন, ব্যাপারটা করা আর না করার মধ্যে পার্থক্যটা কি! এক ধরনের দোলাচলে ভোগা লোকটা ভাবেন, চারপাশের সবকিছুর সঠিক ভারসাম্য যেন নেই।
মুরাকামির গল্পে প্রতিটি বিষয়েরই যেন অস্তিত্ব আছে। যাকে ঠিক কল্পনা বলেও ধরে নেয়া যায় না, আবার যে কল্পনা হয়ে দাঁড়ায় অতি বাস্তবের প্রতীক। তিনি তাঁর গল্পে বসবাসকারী চরিত্রদের সুপ্ত বাসনা বা আকাঙ্ক্ষার একটা অদ্ভুত রূপ দেন। বোনের হবু স্বামীকে অপছন্দ করার স্বাভাবিক ছন্দ কিন্তু অতি বাস্তবের সংকেত বা প্রতীক। ‘ফ্যামিলি অ্যাফেয়ার’ গল্পে দেখা যায় গল্পের কথক বলছে, ‘হয়তো এমন উদাহরণ অনেকই আছে বোনের হবু বরকে পছন্দ হয়নি।’ এর কারণ হলো বোনকে যে স্নেহের, ভালোবাসার দৃষ্টিতে ভাই দেখে এসেছে, তার যেমন সঙ্গী তারা কল্পনা করে, বাস্তবে অনেকটাই তার সাথে মেলে না। আর এক্ষত্রে যদি দেখা যায়, বোন তার হবু বরের সংস্পর্শে এসে বদলে গেছে, তাহলে তো সমস্যা আরো প্রকট হয়ে দেখা দেয়। এমনই একটা গল্প ফ্যমিলি এফেয়ার। যেখানে দেখা যায়, জন্ম থেকে ২৩ বছর বয়স অবধি যে বোন ছিল বন্ধুর মত। হঠাৎ একসময় তার হবু বরের সংস্পর্শে এসে ভাইয়ের সব ত্রুটিগুলো একে একে উন্মুক্ত করে তাকে খোঁচা দিতে থাকে।
সন্দেহ, অবিশ্বাস পরস্পর শ্রদ্ধাহীনতা তাঁর গল্পে এই প্রতিটি বিষয়েরই যেন বাস্তব অস্তিত্ব আছে। যা দেখা যায় না ঠিকই, আবার নিছক কল্পনা বলেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কখনো কখনো কল্পনা হয়ে দাঁড়ায় অজানা অতি বাস্তবের প্রতীক।
মুরাকামির বিরুদ্ধে রক্ষণশীল পাঠকদের অভিযোগ আছে তাঁর গল্পে অবাধ যৌনতার বিষয়ে। তাঁর চরিত্রদের কাছে যৌনতা যেন বিয়ার খাওয়ার মতোই স্বাভাবিক বিষয় বা তার চরিত্রেরা প্রচ্ছন্নভাবে যৌন চিন্তায় আবিষ্ট থাকে। কিন্তু এ গল্পে তিনি অবাধ যৌনাচারকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছেন। ফ্যামিলি অ্যাফেয়ার গল্পে তিনি বলতে চেয়েছেন, শুধু যৌনতার কারণে একের পর এক বিছানার সঙ্গী বদল করা কোনো স্বাভাবিক মানুষের আচরণ নয়। ভালোবাসা, বোঝাপড়া এসব যদি নাই থাকে তবে এর কোন মানেই থাকে না। সেটা হয় মাস্টারবেশনের মতো একটা ব্যাপার।
একইভাবে ‘মানুষ খেকো বেড়াল’ গল্পে আমরা দেখতে পাই, মানুষ তার সারাজীবন ধরে একজন আদর্শসঙ্গীর অপেক্ষায় থাকে। আর যে কোন সময় সেই সঙ্গীর দেখা পেতে পারে সে। হয়ত বিয়ের কয়েক বছর পরেও মিলতে পারে এমন কোন সঙ্গীর দেখা। দাম্পত্য সম্পর্ক হয়তো মসৃণভাবে চলছে, যেখানে অভিযোগ করার মত তেমন কিছু নেই। শ্রদ্ধা, ভালবাসা সব থাকার পরও হয়ত এমন কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, যাকে দেখলে মনে হয় এর কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মেলে ধরা যায়। মুরাকামি এই ধারণাটাকে ঠিক ভালোবাসার লেবেল দিতে চাননি। এ যেন পরিপূর্ণ সহমর্মিতা। তিনি বিবাহ বহির্ভূত এই সম্পর্কটাকে এত স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন করেছেন, এতো সহজতায় যে তাদের জৈবিক সম্পর্কটা যেন ঠিক যৌনতার জন্য নয়, ভালোবাসার এক শান্ত সমহিত প্রসন্ন টান।
‘মানুষ খেকো বেড়াল’ গল্পের কথকের বিবাহিত জীবনও চলছিল গোলযোগ বিহীন। তারা ধরেই নিয়েছিল তাদের বিবাহ বহির্ভূত প্রেম কখনো প্রকাশ পাবে না। তবে গল্পের কথক পুরুষটি এজন্য একটু বিবেকের যন্ত্রণায় ভুগত। কিন্তু যখন বিষয়টা প্রকাশ পেল তখনো গল্পের কথক ঠিক একইভাবে তার স্ত্রীকে বোঝাতে চেষ্টা করল যে, স্বামী-স্ত্রীর যে সম্পর্ক সেটা থেকে এটা সম্পূর্ণ আলাদা একটা ব্যাপার। কিন্তু তার স্ত্রী স্বাভাবিকভাবেই এটা মানল না। অপরদিকে কথকের প্রেমিকা ইজুমির স্বামীও বিষয়টা জানার পর চলে গেল। যে মানুষটাকে ইজুমি হাই স্কুল থেকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল, সেই স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যাক সেটা সে চায়নি। মানুষের মনের ভেতরের এমন টানাপোড়েন ক্রমশ গল্পে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।
গল্পের কথক এবং তার বান্ধবী ইজুমি দুজনেই যখন তাদের স্বামী ও স্ত্রী দ্বারা পরিত্যাক্ত হয়েছেন তখন তারা এক ধরনের মানসিক পীড়নের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা দুজনেই ভাবলেন, তাদের পক্ষে আর জাপান থাকা সম্ভব না। তাই তারা একদিন গ্রিসে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই গল্পের কথক যখন প্লেনে চেপে বসেন তখন মনে হতে থাকে তার সমস্ত অস্তিত্ব যেন বিলীন হতে চলেছে। সে প্রচণ্ড হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং তার একটা প্যানিক অ্যাটাক হয়। যদিও একটা ঘুমের পর তিনি সেই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পান। এবং গ্রিসে তারা একটা দ্বীপে বসবাস করতে শুরু করেন। ওই দ্বীপে বসবাসকালেও তাদের সম্পর্কের গভীরতার মধ্যে বিন্দুমাত্র কমতি ছিল না। কিন্তু একদিন ইজুমি জানতে চায় যে, কথক তার শিশু পুত্রকে মিস করে কিনা? কথক যখন তার পুত্রকে মিস করে বলে জানায় এবং তার স্মৃতি রোমন্থন করে, তখন ইজুমি প্রেমিককে বলে, তার আসলে জাপানে ফিরে যাওয়া উচিৎ। এবং পরদিনই ইজুমি কথকের জীবন থেকে নীরবে হারিয়ে যায়।
ইজুমি কথককে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর, তার অনুভূতি হতে থাকে যেন, কতগুলো বিড়াল তার সমস্ত শরীর অস্তিত্ব খেয়ে ফেলছে। মুরাকামি এখানে বলছেন, মানুষের পক্ষে আসলে তার অতীতকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করা সম্ভব নয়। আবার প্রকৃত ভালোবাসাকে তো নয়-ই। মুরাকামির বেশিরভাগ গল্পে অবাধ যৌনতা থাকে একথা ঠিক। আবার বহুগামিতা যে মানুষের স্বতির জায়গাটা কেড়ে নেয়, সেদিকেও তিনি প্রচ্ছন্নভাবে ঈঙ্গিত দেন।
‘ঘুম’ গল্পটাতে আমরা দেখি টানা ১৭ দিন-রাত না ঘুমানো একজন ইনসোমনিয়ার রোগী ঘুম না হওয়াকে এক সময়ে ভাবছেন, ঘুম না হলে হবে না, তবে এই নিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে না ভুগে বরং এটা ভাবতে হবে যে সে তার জীবনটাকে প্রসারিত করছে। অর্থাৎ যে সময়টায় সে ঘুমাতো সেই সময়টা এখন তার একান্ত নিজস্ব একটা সময়। যে সময়টাতে কেউ তাকে বিরক্ত করতে পারবে না, যদিও এভাবে টানা নিদ্রাহীনতা তাকে বাঁচাতে পারেনি, যা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ঘুম গল্পটার মতো তাঁর এমন অনেক গল্পে মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনকে সাধারণ বা একঘেয়ে মনে হতে পারে,তবুও তার ভেতরেও থেকে যায় যন্ত্রণাময়, বিপজ্জনক বা কখনো মায়াবী এক কাহিনি।
‘দম দেয়া পাখি আর মঙ্গলবারের মেয়েরা’ গল্পটা পড়তে পড়তে মনে হয় কুয়াশায় আচ্ছন্ন এক পরিবেশে যেন কেউ পেঁজা তুলার মত হাওয়ায় ভাসছে। সদ্য চাকরি থেকে ইস্তফা দেয়া একজন ব্যক্তি যিনি সারাদিন বাড়িতে থেকে গৃহকর্ম করছেন। তাকে কেউ ফোন করে সাইবার সেক্স করার জন্য আহ্বান জানিয়ে উত্ত্যক্ত করছে বা কোন এক রহস্যময় তরুণীর সাথে স্ত্রীর হারিয়ে যাওয়া বিড়াল খুঁজতে গিয়ে দেখা হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটি তাকে তার বাড়ির লনের ডেক চেয়ারে বসিয়ে নানা কথা বলছে। যা ঠিক ছেলেমানুষি নয়, আবার খুব যৌক্তিক কিছুও নয়। কারো যদি ছটা আঙুল থাকতে পারে আর একথাটা যদি মেনে নেয়া যায়, তবে কারো চারটা স্তনের বিষয়টা কেন মেনে নেয়া যাবে না! এমন সব অবান্তর কথার মাঝে মেয়েটাকে এও বলতে শোনা যায় যে, ‘টিভিতে (টক শোতে) যারা আসে তারা সবাই ধান্দাবাজ।’ এই কথাটার মাঝে চুড়ান্ত রাজনৈতিক চিন্তা এবং কঠিন বাস্তবতা রয়েছে। আবার সারাদিন হারিয়ে যাওয়া বিড়াল খুঁজে না পেয়ে সন্ধ্যায় যখন ঐ ব্যক্তি বাড়িতে ফেরে, তখন তার স্ত্রী তার দিকে সন্দেহের তীর ছুড়ে দিয়ে বলে, ‘বিড়ালটাকে তুমিই হত্যা করেছো’।
সন্দেহ, অবিশ্বাস পরস্পর শ্রদ্ধাহীনতা তাঁর গল্পে এই প্রতিটি বিষয়েরই যেন বাস্তব অস্তিত্ব আছে। যা দেখা যায় না ঠিকই, আবার নিছক কল্পনা বলেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কখনো কখনো কল্পনা হয়ে দাঁড়ায় অজানা অতি বাস্তবের প্রতীক। ‘ক্যাঙ্গারু বার্তা’ গল্পটাতে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের একজন প্রোডাক্ট ম্যানেজার তার কাছে পাঠানো ক্রেতার একটি অভিযোগপত্র পেয়ে হঠাৎই ওই অজানা অচেনা নারীর প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এখানে প্রেম ঠিক ওভাবে নেই। ম্যানেজার অনেক ভনিতা করে, নিজের মনোভাব নিজেই ঠিক মত ঠাহর করতে না পেরে যা বলতে চেয়েছেন তা হলো, ওই অভিযোগ পত্রের প্রতিটি শব্দ, বাক্যগঠন, যতিচিহ্নের ব্যবহার ইত্যাদি তাকে ওই নারীর প্রতি এতটাই আকৃষ্ট করেছে যে তিনি ওই নারীর প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করছেন। এমন নয় যে লোকটি নারীসঙ্গ বিবর্জিত। তার একজন মেয়েবন্ধু রয়েছে। এমনও নয় যে লোকটি লম্পট। কিন্তু কেন তার এমন মানসিক পরিবর্তন! কেন সে ভাবছে, এই নারীকে না পেলে তার চলবে না!
একটা নির্দোষ, সাদামাটা, বা একটু ভিন্নধর্মী অভিযোগপত্র পেয়ে কেউ কারো প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করতে পারে এমন অদ্ভুত কাহিনি মুরাকামির পক্ষেই লেখা সম্ভব! যেখানে কাহিনি ছাপিয়েও এর ভেতরে রয়েছে ব্যক্তির বিষণ্নতা। বান্ধবী থাকা সত্বেও তার মানসিক নিঃসঙ্গতা। অর্থাৎ সবকিছু হাতের নাগালে থাকতেও এক অদ্ভুত শূন্যতায় আচ্ছন্ন তাদের জগৎ। এই শূন্যতার প্রতীকী প্রতিফলন প্রকাশ পায় প্রায় তাঁর প্রতিটি লেখায়। এই অশান্তির অর্থ কি? উপশম কিসে? সেই খোঁজ কি রয়েছে মুরাকামির সব লেখায়? ব্যক্তি তার একাকিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে একদম একা। এক ধরনের বিমর্ষ একাকীত্ব নয়, আলাদা নানারকম একাকীত্ব আছে। যা খুবই যন্ত্রণার। স্নায়ু ছিড়ে যাওয়ার মতো।
প্রেমাকাঙ্ক্ষীকে পছন্দ না হওয়া নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সম্ভব। এবং জিনিসটা যদি ভয়ংকর হয়, তা থেকে আত্মরক্ষার অধিকারও সবার রয়েছে। সেক্ষেত্রে নারীরাই নিষ্ঠুর নির্যাতনকারী এটা ধরে নেয়া টিপিক্যাল পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব বৈকি!
আপাতদৃষ্টিতে মুরাকামির বেশিরভাগ কাহিনিকে মনে হয় অদ্ভুত! কিন্তু এর গভীরে রয়েছে ব্যক্তির হতাশা, বিষণ্নতা বা অবিশ্বাস। এমনই একটা গল্প ‘একটি ছোট্ট সবুজ রাক্ষস’। বাগানের মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসা ক্ষুদে এক সবুজ রাক্ষস প্রেম নিবেদন করে এক নারীকে। যে নারী তার স্বামী কাজে বাড়ির বাইরে বের হয়ে যাওয়ার পর সারাদিন নিঃসঙ্গ সময় কাটান। ওই কুৎসিত দর্শন রাক্ষস নিশ্চয়ই তার কল্পনা নয়! আবার অখণ্ড অবসর কাটানোর উপাদানও হতে পারে না। তবু লেখক কেন প্রেমপ্রার্থী হিসেবে এমন এক কুৎসিত, ভয়ংকর দর্শন রাক্ষসকেই নির্মাণ করলেন! যার প্রেম তো অকৃত্রিম। কিন্তু তার কদাকার চেহারা ওই নারীর কাছে একই সাথে ভয়ঙ্কর ও বিরক্তি উদ্রেককারী। রাক্ষস দীর্ঘদিন ধরে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে টানেলের মত তৈরি করে তার ভেতর থেকে ক্রোলিং করে এসে যেভাবেই প্রেম নিবেদন করুক না কেন, নারীর তাতে সম্মতি দেয়ার কোনো কারণ নেই! সে মনে মনে রাক্ষসটাকে যতরকম ভয়ংকর ও বীভৎস নির্যাতন করা যায় তা ভাবতে থাকে। নারীর এই ভাবনার প্রত্যক্ষ প্রভাব রাক্ষসটার ওপরে পড়তে থাকে। নির্যাতিত রাক্ষস ক্রমাগত যন্ত্রণায় কাতর হয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে। সে যতই বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমাকে এভাবে নির্যাতন করার কথা ভেবো না। নারী তত তাকে আরো ভয়ংকর নির্যাতনের কথা ভাবে। এবং বলে, ‘এবার দেখো খুদে রাক্ষস তুমি জানো না, মেয়ে মানুষ কি জিনিস! তোমাকে যে কি কি করার কথা আমি ভাবতে পারি তার শেষ নেই।’ এই বাক্যের মধ্যে মুরাকামির প্রচ্ছন্ন নারী বিদ্বেষ দেখা দেয়। প্রেমাকাঙ্ক্ষীকে পছন্দ না হওয়া নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে সম্ভব। এবং জিনিসটা যদি ভয়ংকর হয়, তা থেকে আত্মরক্ষার অধিকারও সবার রয়েছে। সেক্ষেত্রে নারীরাই নিষ্ঠুর নির্যাতনকারী এটা ধরে নেয়া টিপিক্যাল পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব বৈকি!
এই গল্পটার সাথে আমরা মিল দেখতে পাই রামায়ণের একটা কাহিনির। যেখানে রামচন্দ্রের প্রেমে পড়ে সূর্পণখা নামের এক রাক্ষস, এবং রাম তার কুৎসিত রূপ দেখে তার নাক কেটে দেয় ও প্রেম প্রত্যাখ্যান করে। সেখানে কিন্তু রামকে পুরুষ বলে সে নিষ্ঠুর এমন বলা হয় নাই। নিষ্ঠুরতা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার থাকতে পারে। সেখানে একটা বিশেষ লিঙ্গের মানুষকে দায়ী করা বিদ্বেষ প্রসুত।
মুরাকামির সৃষ্ট কল্পনা জগত উত্তর-আধুনিকতার অর্থ বুঝতে সাহায্য করে। ‘খামার-দহন’ গল্পটাতে এক যুবক জানায়, দুমাস পর পর এক একটা খামার পোড়ানো তার শখ। এখানে সে কোন নৈতিকতার ধার ধারে না। নৈতিকতা তার কাছে ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্বের ভারসাম্য। একই সাথে ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্ব। যেন একই সাথে টোকিওতেও আছে আবার টিউনেশিয়াতেও।
মুরাকামির গল্প উপন্যাসের একটা বড় অংশ জুড়ে সংগীতের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ধ্রুপদি থেকে পপ, জ্যাজ থেকে র্যাপ সবকিছুরই দখলদারিত্ব দেখা যায়। বারোক সংগীত থেকে রবিশঙ্কর, মোৎজার্ট থেকে বেটোফেন, আবার মাইলস ডেভিস, জোহান স্ত্রাউস বা হালকা চালের হুলিও ইগ্লেসিয়াশ। এছাড়াও ব্রুস স্প্রিংস্টিন, জেফবেক, ডোরস ইত্যাদি। মুরাকামির লেখায় পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য সব দেশের শিল্প- সংস্কৃতি বা সাহিত্যের উল্লেখ পাওয়া যায়।
মুরাকামির লেখার ধরন সম্পর্কে বলতে গিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা সুপ্রিয়া চৌধুরীর জানান, ‘আধুনিক যুগের জাপানি সাহিত্যিকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন যেমন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ইয়াসুনারি কাওয়াতাবা, কেঞ্জাবুরো ওয়ে বা ইউকিও মিশিমা গভীরভাবে ইউরোপীয় মর্ডানিজমের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই আধুনিকতাবাদে ভরসা করে তাঁরা জাপানি জুনবুঙ্গাকুর [উন্নত সাহিত্য] ধারায় নিজেদেরকে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তবে মুরাকামির বিচরণ এই কঠিন সংস্কৃতি চর্চার কিছুটা বাইরে। তিনি জাপানের উন্নত সাহিত্য ধারণায় নিজেকে আটকে না রেখে বিচরণ করছেন বিশ্বজনীনতায়, আধুনিকতায়।’
মুরাকামি তাঁর রচনায় মিশিয়ে দিয়েছেন, গোয়েন্দা কাহিনি, রহস্য রোমাঞ্চ, কল্পবিজ্ঞান, জাদুবাস্তবতাসহ জন-সংস্কৃতির নানা উপাদান। তাঁর বলার ভঙ্গিতে আছে আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রভাব। ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানের প্রবল উপস্থিতি, একই সাথে তাঁর একান্ত নিজস্বতা। ♦
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন