বেগমবাহার

অ+ অ-

 

গলির ভিতর মাঝবয়েসি তরকারিওয়ালা ভ্যান নিয়ে এসে সুর করে বলছে—‘এ্যাই বেগুন আছে, মুলা আছে, শিম আছে, ধইন্যাপাতা আছে, টমেটো আছে, লালশাক আছে, পালং শাক আছে। একটু দম নিয়ে আবার বললো—‘ফুলকপি আছে, বোম্বাই মরিচ আছে, বাঁধাকপি আছে, পিয়াজের কলি আছে, নতুন আলু আছে ।প্রতিবার এভাবে সুর করে বলার ভিতর সে ছন্দ খুঁজে পায় একটা। মূলত এই ছন্দ সে শহরের সব গলিতে ছড়িয়ে দিতে চায়, সেই সঙ্গে নিজস্ব যে কথা বলার ঢং ও পরিচিতি। সে কল্পনা করে, গৃহিনীদের কড়াই, পাতিলের ভিতর তার সবজি, তার কথার ছন্দের মতোই টগবগ ছন্দে ফুটছে, ভিতর থেকে ওঠা ধোয়া পুরো রান্নাঘরে মৌ মৌ ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিচ্ছে।

টিভিতে এই সকালবেলা সুন্দরী একজন উপস্থাপিকা কথা বলছে। তার সামনে বসা একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। উনি শীতকালে রোদের উপকারিতা ও ভিটামিন-ডি সম্পর্কে বলছেন। রোদ যে শুধু ভিটামিন-ডি তৈরি করে তাই না, রোদ ডিপ্রেশন বিষণ্নতা দূর করতেও সহায়তা করে। রোদ আমাদের শরীরে সেরোটোনিন নামক হরমোন তৈরি করে, যা আনন্দ দেয়। শীতকালে অধিকাংশ মানুষই রোদে যায় না, লেপ বা কম্বলের ভিতর বেশি থাকে। এজন্য সেরোটনিন তৈরি হতে পারে না। ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতাও বেশি দেখা যায়। রিমোট দিয়ে টিভি চ্যানেল লাফিয়ে লাফিয়ে পাল্টানো ইয়াসমিনের একটা অভ্যাস। সে স্থির থাকতে পারে না এক  চ্যানেলে বেশিক্ষণ। রোদ এবং বিষণ্নতা বিষয়ক এই কথা শুনে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে টিভির দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলো। যে কেউ এসময় বাইরে থেকে দেখলে বলবে তার হয়তো চোখের কোনো সমস্যা, টিভি দেখতে কষ্ট হচ্ছে। আসলে তা না। ইয়াসমিন কোনো বিষয় নিয়ে একটু ভাবতে শুরু করলেই তার এরকম হয়। সে গত কদিন ধরে বেশ বিরক্ত। মেজাজ খিটখিটে। ঘরের চারপাশে সে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। প্রতিটা ঘরের চারকোনায় উপরে বড় বড় লোহা ঝুলছে। এগুলো দিয়ে ঘর বন্ধ দিয়েছে তার এক দূর সম্পর্কের খালাকে দিয়ে। যাতে কেউ ক্ষতি বা সংসারের অমঙ্গল না করতে পারে। এই খালা বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন, যে কিনা অনায়েশে যেকোনো মানুষের মুখের দিকে তাকিয়েই তার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে। শুধু খালার সংসারটা টিকলো না, বাচ্চাকাচ্চাও হলো না। খালু আবার বিয়ে করে ঘর-সংসার শুরু করলেন। খালা ওনার বাবার বাড়িতে ফিরে একা একাই থাকতে শুরু করলেন। রুম অন্ধকার করে জিকির-আজগার শুরু করলেন। সবসময় ওনার ঘরে আগরবাতি জ্বালানো থাকতো, এখনো থাকে। উনি সবকিছু একসময় চোখের সামনে দেখতে পাওয়া শুরু করলেন। উনি ছিলেন তুলা রাশির জাতিকা, কিছু জ্বীন ওনার বাধ্যগত করে ফেললেন। অন্তত এলাকাবাসী এটাই জানলো।

ধীরে ধীরে ওনার কাছে মানুষ বিভিন্ন তদবির নিতে আসা শুরু করলো। ওনার দিন চলে যায় বিভিন্ন মানুষের দেয়া খাবার-দাবার, হাদিয়া দিয়েই। ইয়াসমিন চোখ নামিয়ে সামনে আনলো। একটু সামনেই প্যাসেজে তার মেয়েটা খেলছে রঙ-বেরঙের হাতি-ঘোড়া, পুতুল দিয়ে। গতকাল রাতেও মেয়েটাকে একটা চড় দিয়েছে। মেয়েটা ভাত খায় না। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার সময় কাঁচা নুডলস খেতে চাইলো। মশারির ভিতর অল্প একটু ভেঙে মুখে দিয়েই নুডলসের প্যাকেটটা ফেলে দিলো। আর খেলো না। লাইট অফ করে শোয়ার কিছুক্ষণ পরেই চিপস খেতে চাইলো। সে কি চীৎকার! আবার উঠে চিপস দেয়া হলো। দুটো খেয়েই ফেলে দিলো প্যাকেট। ইয়াসমিনের আর সে সময় ধৈর্য থাকলো না। সে মেয়ের গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো। পাশ থেকে বশির মেয়েটাকে ধরলো। কান্না থামাতে বাইরে বের হয়ে কিছুক্ষণ হাটলো। এরপর একসময় মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে মশারীর ভিতর নিয়ে এসে শুইয়ে দিলো। পাশে সারাদিনের ক্লান্ত ইয়াসমিন তখনো ঘুমায়নি।

রাতে বশিরের ব্যবসায়ী বস এসেছিলো আর তিনজন নিয়ে। তাদের জন্য সে রান্না করেছে। পোলাউ, মুরগির রোস্ট, গরুর মাংস ভুনা, ইলিশ মাছ ভুনা, করল্লা আলু দিয়ে ভাজি, শিম ভাজি, শাক ভাজি, ভাত আর ফিরনি। সবশেষে সে শরবত, ফল কেটে ভালো একটা ইন্ডিয়াল জর্জেটের সালোয়ার-কামিজ পরে, মুখে পাউডার বুলিয়ে মেহমানদের জন্য অপেক্ষা করেছে। ইলিশ রান্নার সময় সে বসিয়ে একটু মেয়েকে খাওয়াতে এসেছিলো, এমন সময় রান্নাঘরে বিকট আওয়াজ হলো। এক্সস্ট ফ্যান খুলে ইলিশের কড়াইয়ের উপর পড়েছে। চারপাশে মাছের তরকারি ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কয়েক মুহূর্ত লাগলো ব্যাপারটা বুঝতে ইয়াসমিনের। এরপর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুল না চীৎকার দিতে যেয়ে। দৌড়ে গিয়ে সুইচ অফ করেই বশিরকে দোকানে ফোন দিলো হাঁপাতে হাঁপাতে। সেগুলো পরিষ্কার, বাকি রান্না শেষ করে মেহমান খাইয়ে যখন বিদায় দিলো, তখন সে ক্লান্ত, বিদ্ধস্ত। ব্যথায় কোমড় নাড়াতে পারছে না।

বিয়ে হয়েছে প্রায় তিন বছর হতে চললো। এর ভিতরেই সে হাফিয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিটা দিন রান্না, খাওয়া, ছোট একটা বাচ্চা সামাল দেয়া। প্রায় প্রতিদিন এক ঘেয়েমী রুটিন। বশির সারাদিন বাসায় থাকে না। রাতে ফেরে, মেয়েটাকে নিয়ে বসে থাকে বা টিভি দেখে। দু-একসময় মেয়েটাকে নিয়ে চিপস চকলেট কিনে নিয়ে আসে পাড়ার দোকান থেকে। এসএসসি পাশ, বিদেশ ফেরত বর্তমানে মোটরপার্টসের দোকানের ব্যবসায়ী বশিরের সঙ্গে ডিগ্রি কমপ্লিট করা ইয়াসমিনের কোথায় যেন একটা দূরত্ব থেকেই যায়। এমন না যে সে খুব ভালো ছাত্রী ছিলো, টেনেটুনে পাশ করা। তারপরেও সার্টিফিকেট তো আছে। বশির কথা বলার কোনো বিষয় খুঁজে পায় না সংসারের দরকারি বিষয় ছাড়া। সারাদিন যা কথা বলার ইয়াসমিন একাই বলে। কখনো ফোনে, কখনো মেয়েটার সঙ্গে । মেয়েটা হয়তো তার অধিকাংশ কথাই বোঝে না কিন্তু সে একা একাই বলে যায়। মেয়েটাও হয়েছে বাবার মতো চুপচাপ স্বভাবের। একা, চুপচাপ খেলতে থাকে সারাদিন।

ইয়াসমিন মাঝেমধ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে কি জানতো শেষমেষ তার কপালে এই জুটবে? বশির দেখতে একটুও ভালো না। তার ওপর পড়ালেখাও জানে না। বিয়ের আগে পোশাক-আশাকের অবস্থাও ছিলো খুব খারাপ। সারজীবন ঢাকায় থেকে বশিরের সঙ্গে বিয়ের পর তাকে ঢাকা ছাড়তে হয়েছে। এখনো মনে হয় শুধু শরীরটাই তার এখানে, মনটা এখনো ঢাকায়। বাবার উপর রাগ হয় প্রচণ্ড। নদীর ওপাড় বশিরের বাড়িতে গেলো। বিদেশ ফেরত বশিরের আধাপাকা বড় বাড়ি দেখে সারাজীবন ভাড়া থাকা বাবা বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। একবারও ভাবলেন না মেয়েটা এসে কিভাবে এই অজপাড়াগায়ে থাকবে। বশির শেষ পর্যন্ত ইয়াসমিনকে শহরে নিয়ে এসেছে ঠিকই ব্যবসার কাজের জন্য, কিন্তু নদীর ওপাড় থেকে শ্বশুড়বাড়ির লোকজন আসতেই থাকে।  

একদিন বশির ঢাকায় ফিরে বিয়ের দাওয়াতের কথা বললো। ইয়াসমিনের একসঙ্গে বিয়ের দাওয়াতও খাওয়া হবে, আবার বাবা-মার সঙ্গে ও বেড়ানো হবে কিছুদিন। শীতকালে ইয়াসমিন কিছুটা ঘরের কাজেও শান্তি পাবে। সবমিলিয়ে সে দ্বিগুন উৎসাহে ব্যাগ গোছাতে লাগলো। বেশ কিছুদিন ধরেই সে বিরক্ত, ক্লান্ত। মেয়েটার সঙ্গে ও খারাপ ব্যবহার করছে। কিন্তু যাওয়ার দিন ঘরে তালা লাগানোর সময় কেমন যেন লাগে। এই প্রথম বিয়ের পর মাসখানেক থাকার জন্য যাচ্ছে সে। ধীরে ধীরে সে নিজের সংসার গুছিয়ে নিয়েছে। এখানেই তার একটা আধিপত্য। পাশের ভাড়াটে নাসরিনের মা, যার সঙ্গে ইয়াসমিনের সারাক্ষণ ঝগড়া লেগেই থাকে, তাকে ডেকে বললো—‘আপা, আমার পুঁই শাক, লাউশাকের গাছগুলো দেইখেন। আর আপনি আইনা ডালের ভিতর দিয়া চচ্চড়ি খাইয়েন, ভাল লাগবে।নাসরিনের মায়েরও খারাপ লাগলো। বললো—‘তাড়াতাড়ি আইস্যা পইড়ো গো। বেশিদিন বেড়াইয়ো না। বাসায় মানুষ না থাকলে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মন ভালা লাগে না। ভালো কইর‍্যা যাইয়ো। পৌছাইয়্যা জানাইয়ো।

ঢাকায় পৌঁছে মায়ের বাসায় দুদিন শুধু শুয়েই কাটালো। এরপর নিউমার্কেট গিয়ে কেনাকাটা করলো বিয়ের দাওয়াতে যাওয়ার জন্য। ওদিকে বশিরের ইচ্ছা দুপুরের দাওয়াত খেয়েই রাতের বাসেই চলে যাবে। বউ-বাচ্চা বেড়াক কিছুদিন।

বিয়ে বাড়িতে ইয়াসমিন বসে ছিলো প্ল্যাস্টিকের চেয়ারে মেহমানদের সঙ্গে। এসেই সে বর-কনের সঙ্গে স্টেজে উঠে দেখা করে এসেছে, ছবি তুলেছে। অন্য মহিলাদের সঙ্গে সে গল্প করছে এই মুহূর্তে। বিয়েতে কনের বাবা-মা কতো ভরি সোনা আর কি কি দিয়েছে তার একটা আন্দাজ সে নেয়ার চেষ্টা করছে। সেই সঙ্গে বিয়ে বাড়িতে অন্য মহিলাদের শাড়ি-গহনাও খেয়াল করছে। নিজের বিয়েতে পাওয়া ছোট-বড় সব গহনাই সে পড়ে এসেছে। তার নিজেকে খুব সুখি মনে হয় যখন এগুলো সব পড়ে সে। বাসার সব ফার্নিচার তার বিয়েতে বাবার বাড়ি থেকে দেয়া হয়েছে, এটা সে সবার সঙ্গে খুব গর্ব করে বলে।

দূরে একজনকে গল্প করতে দেখে তার চোখ আটকে গেলো। লম্বা, ফর্সা, মুখে দাড়ি একজন পুরুষ। পাঞ্জাবি পড়া, কালো চাদর গায়ে দেয়া। পাশের লোকের সঙ্গে গল্প করছে। ইয়াসমিন বাচ্চাকে কোলে নিয়ে সেই পুরুষের দিকে এগিয়ে গেলো। তার গলা শুকিয়ে পানির তেষ্টা পেতে লাগলো। পুরু মেকাপ এই শীতেও ঘেমে উঠতে থাকলো। কাছে যেতেই আলাপরত সেই পুরুষ স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে সামনে তাকাতেই ইয়াসমিনকে দাঁড়ানো দেখতে পেলো। ইয়াসমিন হাসবার চেষ্টা করলো। কতোদিন পর মাহমুদের সঙ্গে দেখা তাও এরকম একটা জায়গায়।

মাহমুদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ইয়াসমিন বারবারই বলছিলো তার সুখে থাকার কথা। ওর বর হীরের নাকফুল বানিয়ে দিয়েছে। আবার এ মাসে আরেকটা কানের দুল বানিয়ে দিতে বলেছে। বাজারের বড় বড় মাছ, দেশি মুরগি আর মেহমান, খানাপিনাতো সবসময় লেগেই আছে। জামাই ওর কথার বাইরে যায় না, বউ-বাচ্চা ছাড়া কিছু বোঝেই না। কোনো বাজে পান-সিগারেটের নেশা নেই। এমন জামাই পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। নিশ্চয়ই অজান্তে কোনো বড় সওয়াব করেছিলো। কোলে নিয়ে বসা মেয়েটাকে বললো ছড়া শোনাতে মাহমুদ আংকেলকে। মেয়েটার ব্রেইনও মাশাল্লাহ ভালো হবে, এই বয়সেই অনেক কিছু মুখস্ত করে বসে আছে। সব মিলিয়ে মাহমুদকে সে একটা সুখী সংসারের কর্ত্রী হিসেবে ধারণা দিলো।

মাহমুদও ওর লেখালেখির কথা বললো। সবাই চেনা শুরু করেছে। একটা পত্রিকায় সম্পাদকের কাজ করছে। আরো নানাধরনের কাজ পাচ্ছে, অনেককেই না করে দিচ্ছে। সামনের বইমেলায় ওর বই আসবে। সবমিলিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। ওর স্ত্রী সুলতানা খুব ভালো মেয়ে। এই মেয়ের স্বামী হওয়ার যোগ্যতা মাহমুদের নেই। কোনো লেখা লিখে সবার আগে মেয়েটাকে দেখাতে হয়। স্বামী লেখক, এই পরিচয় দিতে সে আলাদা গর্ববোধ করে। এমনকি মাহমুদকে সংসার নিয়ে কোনো চিন্তাই করতে হয় না। সব সামাল দেয় স্ত্রী। শুধু একটাই চাওয়া, মাহমুদ লিখে যাক, সবার কাছে পরিচিতি পাক। অনেক বড় লেখক হোক। আর সব মানুষের মতো যেন শুধু খাওয়া পড়া নিয়ে চিন্তা না করে। সবাই তো লেখালেখির ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় না।

কিছুক্ষণ পর খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শুরু হলো। ইয়াসমিন স্বামীকে বাচ্চাকে নিয়ে এক টেবিলে। ইয়াসমিনের পোলাউ খাওয়া দেখে বশির বলে উঠলো—‘ওকি, পোলাউডি খাইতেয়াছো ক্যা। খালি রোস্ট খাও, মাংস আর কাবাব লও। দাওয়াতে আইয়্যা কেউ পোলাউডি খায় বোহা মাইনষের নাহান? কতোডি টাহার উপহার আনছি। মাইয়্যাতো কিছুই খাইবে না। দুইজন মিল্যা যা খাইয়্যা লওয়া যায়, হেইয়্যাই লাভ্।ইয়াসমিন লজ্জায় মরে যায় এই কথা শুনে। সে পাশের মাহমুদের টেবিলের দিকে বারবার তাকায় শুনে ফেললো কিনা। ওদিকে মাহমুদকে খাওয়ার সময় তার মেসের বড়ভাই বলে উঠে—‘আরে বস, দেখো দেখো খাবার কি টেস্ট! কতোদিন পর এরকম জম্পেশ খাবার খাচ্ছি হে ভায়া। আবার কবে খাওয়া হবে তাই বা কে জানে। কব্জি ডুবিয়ে খাও, হে ভায়া। খাওয়া শেষে বর-বউয়ের জন্য হাত তুলে একটু দোয়া করতে হবে। এদের উছিলায় এরকম খাওয়া, হেহেহে।মাহমুদ সে সময় দোয়া করতে থাকলো। এমনভাবে, যেন বড়ভাইয়ের বলা কথাগুলোর একটুও যেন পাশের টেবিলের ইয়াসমিনের কানে না পৌঁছায়।

সেদিন রাতে দুজনেই শুয়ে ভাবতে লাগলো। ইয়াসমিনের মনে হলো, মাহমুদকে বিয়ে না করে কি ভুলই করে ফেললো? আরেকটু হলেই তো ধরা পড়ে যেতো। বশির যে পরিমাণ ভুলভাল ইংলিশ বলে, বোকা বোকা কথা বলে, তাতে পড়ালেখার দৌড় আন্দাজ সহজেই করা যায়। সেরকম ভালো কোনো পরিবেশে, কোনো লোকের সঙ্গে চলাফেরা করে না, হুটহাট কি কাজ করে বসে ঠিক নেই। আর যেরকম টাকা-পয়সার গল্প আসলে সে আজকে দিয়েছে, এতোটাও তাদের নেই।  দু-রুমের একটা ফ্ল্যাট বাসায় আছে, শহরের বাইরে ধান গবেষণা কেন্দ্রের ওখানে চার শতক জায়গা নিয়েছে। চলে আর কি। তবে বশির খুব চুপচাপ স্বভাবের। মদ তো দূরে থাক, পান, সিগারেট কিছুই খায় না। কারো সঙ্গে কোনো আড্ডা নেই। বাসায় ফিরে মেয়েটাকে সময় দেয়। জীবনে আর কি-ই বা চাওয়ার আছে? চার বছরের প্রেম কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হলো না। উড়াধুড়ো মাহমুদ বিয়ের ব্যাপারে কিছুই গুছিয়ে উঠতে পারেনি তখনো। সেরকম ইচ্ছেও নেই। লেখালেখি নিয়ে অনিশ্চিত জীবন। মাঝেমধ্যে মদ খেতো। এসব ছাড়া নাকি লেখালেখি হয় না। থাকুক, মাহমুদ ভালো থাকুক। ওর সঙ্গে কপালে লেখা ছিলো না বিয়ে। সব আল্লাহর ইচ্ছা।

ওদিকে মাহমুদ মেসবাড়িতে শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আজকে আরেকটু হলেই ইয়াসমিনের কাছে তার মান-সম্মান সব শেষ হয়ে যেতো। ভাগ্যিস, বুদ্ধি করে মিথ্যা কথা বলেছিলো। ওর যে এখনো চাকরি হয়নি সে রকম কোথাও, টাকাপয়সার টানাটানি এসব চেপে গিয়েছে। একটা পত্রিকায় কথাবার্তা চলছে চাকুরির, তাও নিশ্চিত না। মেসের এক সিটের ভাড়া তাও বাকি পড়ে আছে আজ তিনমাস হলো। মেসের মালিক বলেছেন ভাড়া দিতে, নয়ত সামনের মাসে যেন অন্য কোথাও ব্যবস্থা করে। কতোদিন পর আজকে বিয়ে বাড়িতে ভালোমন্দ খাওয়া হলো, তাও উপহার ছাড়া। মেসের আরেক বড়ভাইয়ের আত্মীয়ের বিয়ে। যাওয়ার সময় মাহমুদকে নিয়ে গেলেন ভালো সম্পর্ক এজন্য। এক লেখালেখির জন্য জীবনটা আর পাঁচ-দশটা মানুষের মতো থিতু হলো না। তবে হ্যাঁ, ওর বউ সুলতানা খুব ভালো। ইয়াসমিনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বাড়ি থেকে মাহমুদের জন্য মেয়ে দেখা হয়। খুব সাদামাটা মেয়ে, চাহিদা নেই কোনোরকম। বিয়ের আগে যখন শুনেছে মাহমুদ লেখালেখি করে, তখনই সে রাজি হয়ে গিয়েছে। মেয়েটা যখনি ছাপার অক্ষরে মাহমুদের নাম, আর লেখা দেখে, তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়। কি কষ্টই না করে মেয়েটা গ্রামের বাড়িতে মায়ের সঙ্গে থেকে। ওদের একটা ছেলে হয়েছে। ইয়াসমিনের এতো চাহিদা মেটানো আর লেখালেখি করা একসঙ্গে মাহমুদের পক্ষে সম্ভব না। ইয়াসমিন কখনো তার লেখা হাতে নিয়ে দেখেনি, পড়াতো দূরে থাক। মাহমুদের সঙ্গে কখনো যেতো না। এক সঙ্গে সংসার করা বা এক ছাদের নীচে থাকা হতো না। দূর থেকে অনেককিছুই তো সুন্দর লাগে। কাছে আসলে বোঝা যায় সবকিছু। দূর থেকে ইয়াসমিনের সৌন্দর্য্য, শরীর আর সহজ সরল কথাবার্তা দেখেই তো সে প্রেমে পড়েছিলো, তাকে নিয়ে অনেক কবিতা লিখে ফেলেছিলো। দূর থেকে হয়তো সবকিছু ভালো ছিলো। ইয়াসমিন কাছে আসার পর সে দেখেছিলো আসলেই মেয়েটা অনেক বেশিই সহজ-সরল, কোনো গভীরতা নেই জীবন নিয়ে, মানুষ নিয়ে। শুধুই শাড়ি, গহনা, টাকাপয়সার কথা বলে সারাক্ষণ। আর সবসময় এতো কথা শুনতে আসলে ভালোও লাগে না। কখনো কখনো মৌনতাও যে অনেক কথা বলে, এটা বোঝার ক্ষমতা ওর ছিলো না। মাহমুদের দীর্ঘশ্বাস পড়ে। মনে হয়, যা হয়েছে ভালো হয়েছে।   

সেদিন রাতে এসব ভাবতে ভাবতেই ইয়াসমিন একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। বশিরকে গতকাল সে যেতে দেয়নি। সকালে উঠে নাস্তা সেরেই মায়ের কাছে বলে চলে যাওয়ার কথা। বাবা-মা, এমনকি বশিরও অবাক হয়। সবাই নিষেধ করে কিন্তু ইয়াসমিন মত বদলায় না। শেষে বশিরও একমত হয়। শ্বশুড়-শাশুড়ি বোঝায় শেষবার এসে বউ-বাচ্চার শরীর স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার কথা। ঢাকার আবহাওয়া এখন আর ইয়াসমিনের সহ্য হয় না, একথা সবাই স্বীকার করে। ইয়াসমিন নিজের বাসায় এসে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। আহা, এই কদিনে সংসারের কি হাল! সে কাজে লেগে যায়। বশিরকে বলে, বড় ননদকে গ্রামে ফোন দেয়ার কথা। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কদিন তাদের সঙ্গে যেন বেড়িয়ে যায়। বশিরও ফোন দিয়ে বোনকে আসতে বলে, সঙ্গে যেন একটা রাজহাঁস নিয়ে আসে। সবাই মিলে শীতে হাঁসের মাংস আর রুটি না খেলে তো শীতটাও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

সেসময় ঢাকায় মাহমুদ পার্কের বেঞ্চে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মাথায় কিছু শব্দ ঘুরঘুর করছে

প্রিয় ভুল
মন ফুল
ইচ্ছে বকুল
মেঘ-নদী
হতেম যদি
প্রেমগন্ধা
বনসন্ধ্যা।