অনুভব

অ+ অ-

 

এক মলিন বিকেলে এক জনের অপেক্ষায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছের ছায়ায় একটা চা-স্টলে ছোটখাট একটা বেঞ্চের ঠিক মাঝখানে একা-একা বসে আছি। আশেপাশের লোকজন একা বা কয়েকজন ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে, পিচের রাস্তাগুলো ধরে হাঁটতে হাঁটতে কেউ কেউ হঠাৎ পরিচিত কারো দেখা পেয়ে দাঁড়ানো অবস্থাতেই গল্পে মশগুল আর জায়গায় জায়গায় চক্রাকারে বাঁধানো কনক্রিটের বেঞ্চগুলোতে বসে আছে কেউ কেউ। মাঝে মাঝে বাতাসে ভেসে আসছে দু-একটা কথা, উচ্ছ্বল হাসির টুকরা, জুটিদের হালকা মেজাজের খুনসুটি, গাছের ডালে বসে থাকা পাখিদের ডাকাডাকি, হঠাৎ এক ডাল থেকে আরেক ডালে উড়ে যাওয়ার সময় ডানার ঝটপটানি; পাখির, মানুষের, পতঙ্গের, কীটের দু-চারটা দীর্ঘশ্বাসও বোধ হয় পড়ে থাকবে, তবে সেগুলোর কোনটাই আমার কান পর্যন্ত এসে পৌঁছায় না। দীর্ঘশ্বাস অন্যের অস্বস্তির কারণ হতে চায় না বলেই হয়ত পড়ার প্রায় সাথে সাথেই নীরবে মিলিয়ে যায়, চতুর্দিকে সরবে প্রকাশিত হয়ে পড়ে না।

মুমূর্ষু বিকেলে লালচে আভা ফুটে উঠা আকাশের কিনার ধরে দূর থেকে এগিয়ে আসা ঝাঁক বাঁধা পাখির মত সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। আঁধারের সাথে পাল্লা দিয়ে জমে উঠা আমার অনস্তিত্ব বোধটি রক্তে নিকোটিনের অভাব বাড়িয়ে তোলে। যার ফলে টেবিলের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে সিরামিকের কাপের ভেতরে স্টিলের চামচের খটখট শব্দ তুলে চা বানাতে থাকা ছেলেটির দিকে এগিয়ে যাই।

দুই ঠোঁটের মাঝ দিয়ে বের হতে থাকা ধোঁয়ার আধিপত্যে সামনের শূন্য জায়গার অধিকার নিতে নিতে বেঞ্চটির বেশ খানিকটা নিকটে চলে আসতেই চোখে পড়ে একটি সুবেশী তরুণী। তরুণীটি বেঞ্চটির যেখানে আমি বসেছিলাম ঠিক সেইখানে আয়েশ করে বসে আছে: খানিকটা প্রসারিত দুই হাঁটুর উপর কনুই রাখা, মোনাজাতের ভঙ্গিতে থাকা দুই হাতের তালুতে রাখা একটা স্মার্ট ফোন; যন্ত্রটির স্ক্রিনটিকে যদি মনে করি গ্রাম্য উঠান তাহলে তার বুড়ো আঙুল দুটো যেন সেখানে হুড়োহুড়ি রত দুষ্ট ছেলেমেয়ের দল। তার দিকে কেউ এগিয়ে আসছেএটা বুঝতে পারা মাত্রই সে হালকা নড়ে উঠে। কোন মানুষ নিকটে চলে এলে আপন মনে মাছের কাঁটা-খেতে-থাকা বিড়ালের আনত মুখ উপরের দিকে তোলার মত করে তরুণীটি আমার দিকে তাকায়। একটা সাদাসিধে করুণ ছাপ ফেসিয়াল মাস্কের মত তার মুখের উপর সেটে আছে। আমি নিজেও তো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক এরকমই একটা ভাব আমার মুখের উপর এঁটে থাকতে দেখি। মনে হল মেয়েটি যেন আমার অস্তিত্বের অংশ হয়ে কিছুক্ষণ আগে আমার-বসে-থাকা-জায়গায় এসে বসেছে। কেউ যদি একটা নির্দিষ্ট সময় কোন একটা জায়গা নিজের দখলে রাখে তাহলে সেই জায়গাটির ওপর তার একটা অধিকার জন্মে। ঐ জায়গাটির প্রতি আমার সেই অধিকারের দৃষ্টিতে সে যাতে বিব্রত বোধ না করেএই ভেবে অন্যদিকে ঘুরে যাই ঠিক যেমন ভাবে দিক পরিবর্তন করে বাঁধা পাওয়া স্রোত। এমনকি বেঞ্চের কিনারে তার পাশে বসার আকাঙ্ক্ষাকেও অনেক কষ্টে নিবৃত্ত করি যাতে কোন অপ্রত্যাশিতের কাছ ঘেঁষে আসার অস্বস্তিতে মেয়েটি উঠে অন্য কোথাও চলে না যায়। ফলে তাড়া আছে এমন একটা ভাব মুখের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেযেন আমি পাশের রাস্তা দিয়ে চলার সময় থেমে সিগারেট ধরিয়ে আবার চলতে শুরু করেছিবেঞ্চের সামনে দিয়ে কিছু দূর হেঁটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।

এই ঘটনাটি আমাকে অতীতের একটা ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যা হয়ত আমার জীবনে কখনও ঘটেনি। সম্ভবত এই ঘটনাটিই আমার অতীতে উড়ে গিয়ে অন্য একটা ঘটনায় পরিবর্তিত হয়ে অবস্থান নিয়েছে। অতঃপর আবার বর্তমানে ফিরে এসেছে স্মৃতি হয়ে।

তখন আমি গ্রামের বাড়িতে থাকি।  

একদিন বেশ দেরিতে ঘুম থেকে উঠে দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় দেখি উঠানে একটা চড়ুই আমাদের পোষা কবুতরদের উচ্ছিষ্ট রাখা ধানের খোসা ছাড়িয়ে একটা একটা করে মুখে পুরে নিচ্ছে। আমি উঠানে নেমে খানিকটা এগিয়ে যেতেইতাকে আমি তাড়িয়ে দেব এই ভয়েচড়ুইটি বেশ কয়েক লাফ দূরে সরে যায়। আমার ডান হাতে ধরা ব্রাশটিকে পাখিটি বোধ হয়ে ভেবেছে তার শরীরের মাপে তৈরি করা ছোট্ট একটা লাঠি যা এক্ষুণি তার দিকে তেড়ে আসবে। তবে তার পেটে হয়ত খিদে ছিল বা ডিম থেকে সদ্য ফুটে উঠা ছানাগুলোর জন্য তার পাকস্থলিতে আরো কিছু চাউল পুরে নিতে চাইছিল। তাই সে সহৃদয়তার খোঁজে চোখ মিটমিট করে একবার আমার মুখ পানে আবার চকচকে দৃষ্টিতে ধানগুলোর দিকে তাকায় গৃহবধূদের পায়ের তালে উঠা-নামা করতে থাকা ঢেঁকির মত। আমি প্রথমে বাগিয়ে ধরা টুথ-ব্রাশটিকে পিছনে লুকিয়ে ফেলি, তারপর সামনের দিকে চোখ রেখেই কয়েক পদক্ষেপ পেছনে হেঁটে দরজার পাশে এসে দাঁড়াই। আমার পিছন দিকে চলে আসায় অভয় পেয়ে খুদে প্রাণীটি ছোট ছোট লাফে ফিরে আসে, আর ওদিকে আমি পাখিটির ফিরে আসার সাথে সাথে পেছাতে পেছাতে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ি। প্রথমটার দেখাদেখি আরো কয়েকটা চড়ুই মাটিতে নেমে আসে, তারপর হেঁটে হেঁটে, লাফিয়ে লাফিয়ে, একটু একটু উড়ে উড়ে ছড়ানো ধানের দিকে এগিয়ে আসে। এই চড়াইগুলোর ছড়ানো ধানের কাছে আসার এবং অন্যদের উঠানের কিনারের ছায়াময় স্থান থেকে, ঘরের টুঁইয়ে বাঁধা বাসা থেকে, আমগাছের শাখা থেকে এসে যোগ দেওয়ার সমানুপাতিক হারে আমি ঘরের ভেতরে ঢুকে যেতে থাকি, যাতে আমার অস্তিত্ব ওদেরকে ভয় পাইয়ে না দেয়, স্বচ্ছন্দে ধান খেতে পারে। পিছনে হটতে হটতে একসময় ঢেউটিনের বেড়ার সাথে আমার পিঠ লেগে যায়।

আমার দাঁড়িয়ে থাকার জায়গাটিতে সূর্য সরাসরি তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, দরজা খোলা পেয়ে ঘরের ভেতর একফালি জমির আকারে ঢুকে পড়ে ধান ক্ষেতের আলের ভেতর দিয়ে সেচের পানির মত চুইয়ে এসে ভেতরের অন্ধকারকে খানিকটা নরম করে তুলেছে মাত্র। নিঃসঙ্গ ও অস্পষ্ট আঁধারে দাঁড়িয়ে আলোতে অনেকগুলো চড়ুইয়ের লাফিয়ে লাফিয়ে চলার ও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খাওয়ার দৃশ্য উপভোগ করতে থাকি।

ঐদিন চড়ুইগুলো বোধ হয় বাহিরের খরখরে রৌদ্রে নয়, বরঞ্চ আমার ভেতরের কোন এক আলো ঝলমলে স্থানে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছিল আর অন্ধকার আমাকে ঘিরে রেখেছিল স্বল্পব্যাসার্ধ বৃত্তের মসৃণতায়।