হান কাং-এর আসন্ন উপন্যাস ‘উই ডু নট পার্ট’

অ+ অ-

 

হান কাং-এর আসন্ন উপন্যাস উই ডু নট পার্ট, যা ২০২৪ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর প্রথম বড় উপন্যাস, আবারো ট্রমা, ইতিহাস এবং মানবিক সম্পর্কের ভঙ্গুরতাকে গভীরভাবে অনুসন্ধান করে। দ্য ভেজেটেরিয়ান এবং হিউম্যান অ্যাক্টস-এর মতো গদ্যের গীতিময়তা ও তীক্ষ্ণতা ইতিমধ্যে পাঠক হৃদয়ে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। এই উপন্যাসেও তিনি বাস্তব আর অবাস্তবের সীমানা মুছে দিয়ে এক অনন্য অভিজ্ঞতার গল্প তুলে ধরেছেন।

উপন্যাসের গল্প সহজ মনে হলেও, এর গভীরতা অসাধারণ। কিউনগা একদিন তার বন্ধুর, ইনসিওনের কাছ থেকে একটি জরুরি বার্তা পায়। দুর্ঘটনায় আহত ইনসিওন কিউনগাকে তার প্রিয় পোষা পাখি, আমা-কে বাঁচানোর জন্য জেজু দ্বীপে যেতে অনুরোধ করে। কিন্তু হান কাং-এর রচনায় সহজ ঘটনাও জটিল গভীরতায় রূপ নেয়। জেজুতে যাত্রা শুধু তুষারাবৃত পথে চলার গল্প নয়, এটি লুকানো ইতিহাস আর অপ্রকাশিত সত্যের দিকে এক আবিষ্কারযাত্রা। এই বিপজ্জনক ভ্রমণ আসলে বিস্মৃত ট্রমার প্রতিফলন, যা কিউনগার সামনে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়একটি থিম যা হান কাং-এর লেখায় বারবার ফিরে আসে।

উই ডু নট পার্ট আমাদের দক্ষিণ কোরিয়ার এক অবহেলিত অধ্যায়ের দিকে চোখ ফেরাতে বাধ্য করে। উপন্যাসটি মনে রাখা ও পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে ইঙ্গিত করে সেই অন্ধকার ইতিহাসের, যা হয়তো জেজু বিদ্রোহের মতো ঘটনার প্রতিফলনযেখানে কণ্ঠহীন মানুষদের কাহিনি হারিয়ে গেছে সময়ের গর্ভে। যেমন হিউম্যান অ্যাক্টস গওয়াংজু অভ্যুত্থানের ভয়াবহতার মুখোমুখি করেছিল, তেমনই এই উপন্যাস আমাদের একটি জাতীয় বিস্মৃতির সাথে সরাসরি সংঘাতে দাঁড় করায়।

উপন্যাসটি শুধু কিউনগা এবং ইনসিওনের বন্ধুত্বের গল্প নয়, বরং সেই সম্পর্কের গভীরতায় লুকিয়ে থাকা বৃহত্তর সহিংসতার ছাপও তুলে ধরে। ইনসিওনের পাখি বাঁচানোর আকুতি যেন শুধু একটি প্রাণীর জন্য নয়, জীবনের ভঙ্গুরতা, স্মৃতি এবং অর্থের প্রতি চ্যালেঞ্জ। সাদা পাখি আমা এখানে একটি প্রতীক হয়ে ওঠে, যা কোরিয়ান শামানবাদী বিশ্বাসের সাথে সংযুক্তযেখানে পাখি আত্মার প্রতিনিধি, বার্তাবাহক বা জীবিত ও মৃতের সংযোগ স্থাপনকারী হিসেবে দেখা হয়। হান কাং-এর কাজের আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক সংযোগের প্রবণতা এই প্রতীকের বিশ্লেষণকে আরও গভীর অর্থ দিতে পারে।

উপন্যাসটির শামানবাদের সঙ্গে সংযোগ গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কোরিয়ান ইতিহাসে শামানবাদ আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ এবং জীবিত-মৃতদের মধ্যে মধ্যস্থতার এক শক্তিশালী প্রতীক। তুষারঝড়, যা কিউনগার যাত্রায় বাধা সৃষ্টি করে, একপ্রকার আধ্যাত্মিক বিশৃঙ্খলার চিহ্ন হতে পারেএকটি লুকিয়ে থাকা ঐতিহাসিক ট্রমার প্রতিফলন, যা উন্মোচিত হওয়ার অপেক্ষায়। কিউনগার যাত্রা হয়তো শুধুই আমাকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা নয়, বরং হারানো স্মৃতি পুনরুদ্ধারের এক নিঃশব্দ আহ্বান। এটি জীবিতদের সঙ্গে অতীতের অদৃশ্য সংযোগ ঘটানোর একটি গভীর প্রয়াসও হতে পারে।

হান কাং-এর গদ্য, যা নোবেল পুরস্কারের বিবৃতিতে তীক্ষ্ণ কবিতার মতো বলে প্রশংসিত হয়েছে, এই জটিলতাকে আরও গভীর করে তোলে। এটি পাঠকদের এমন এক সীমানায় নিয়ে যায়, যেখানে বর্তমান এবং অতীতের মধ্যে অবিরাম সংঘাত চলছে। স্বপ্ন ও বাস্তবতার মধ্যে সংযোগ হান কাং-এর লেখার সহজাত শক্তি, যা উই ডু নট পার্ট-এ আরও গভীরভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বরফ, ঠান্ডা, এবং জেজু দ্বীপের বিশাল নিঃসঙ্গতা এক স্থগিত সময়ের অনুভূতি তৈরি করে, যেখানে কিউনগার বেঁচে থাকা কেবল তার শারীরিক সহনশীলতার ওপর নয়, বরং অদেখা বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার সাহসের ওপরও নির্ভরশীল।

লক্ষণীয়, হান কাং তাঁর লেখায় সহিংসতার প্রশ্নকে সবসময় গভীরভাবে অনুসন্ধান করেছেনশুধু শারীরিক সহিংসতা নয়, মানসিকভাবে এটি ব্যক্তি ও সমাজকে কীভাবে প্রভাবিত করে, সেদিকেও তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। পূর্ববর্তী উপন্যাসগুলোর মতোই, উই ডু নট পার্ট সম্ভবত এই বিষয়ে সরাসরি আলোকপাত করে। এটি কেবল ঐতিহাসিক ঘটনার কাহিনি নয়, বরং সেই অদৃশ্য ক্ষতগুলোরও গল্প, যা জীবনের ওপর গভীর ছাপ রেখে যায়। হান কাং-এর লেখা বারবার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং সামগ্রিক স্মৃতির জটিল সম্পর্ককে উন্মোচিত করেছে, যা তাঁকে সমসাময়িক সাহিত্যের অন্যতম সংবেদনশীল ট্রমা বিশ্লেষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

উই ডু নট পার্ট প্রকাশের অপেক্ষায়, আমাদের ভাবা উচিত যে এই উপন্যাসটি কীভাবে হান কাং-এর থিমগুলোর ধারাবাহিকতা ও বিবর্তনের প্রতিফলন হতে পারে। স্মৃতি, বন্ধুত্ব এবং ঐতিহাসিক বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করে তুষারাবৃত এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের গল্পটি সহিংসতা ও মানব সম্পর্কের স্থায়িত্বের প্রতি গভীর দৃষ্টি দেয়। হান কাং-এর গদ্যের মতোই, এই উপন্যাস পাঠকদের এমন এক মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে প্রবেশ করায়, যেখানে ইতিহাসের অস্বস্তিকর সত্যের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না, তা যতই বেদনাদায়ক হোক না কেন।

উই ডু নট পার্ট কেবল ঠান্ডায় বেঁচে থাকার গল্প নয়; এটি স্মৃতি, ভালোবাসা এবং সহিংসতার বরফাচ্ছন্ন ভূখণ্ডে এক গভীর ভ্রমণ। হান কাং-এর অন্যান্য রচনার মতোই, এই উপন্যাস পাঠককে অনুভব করতে বাধ্য করে, যেন প্রতিটি শব্দই তাদের মনকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।

[পর্যালোচনাটি হান কাং-এর আসন্ন উপন্যাস উই ডু নট পার্ট-এর খসড়া কপির উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে। উপন্যাসটি ২১ জানুয়ারি, ২০২৫-এ প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।]