গণপরিষদ ও সংবিধান বিতর্ক নিয়ে বই
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়েছিল গণপরিষদের ৮ মাস প্রচেষ্টায়। খসড়া সংবিধান নিয়ে সে সময় গণপরিষদ সদস্যদের তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনা লিপিবদ্ধ হয়েছিল পরিষদের কার্যবিবরণী ও অন্যান্য দলিলপত্রে। সেসব দলিলপত্রের গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে বই লিখেছেন কথাসাহিত্যিক ও আইনের অধ্যাপক আসিফ নজরুল। বইটির শিরোনাম ‘সংবিধান বিতর্ক ১৯৭২: গণপরিষদের রাষ্ট্রভাবনা’। বইমেলাকে সামনে রেখে এটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। বইটিতে রয়েছে গণপরিষদ ও বায়াত্তরের সংবিধান নিয়ে বারটি অধ্যায়। শিল্পী মাসুক হেলালের আঁকা প্রচ্ছদের বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ৫০০ টাকা।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ গঠিত হয়। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা গণপরিষদের সদস্য হন। গণপরিষদের সদস্য ছিল ৪০৩ জন। এই পরিষদের সদস্যদের মধ্যে ৪০০ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের, ১ জন ন্যাপের ও বাকি ২ জন নির্দলীয়। ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে সংবিধান কমিটি হয়। সে সময় কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে প্রশ্ন উঠেছিল গণপরিষদের কার্যক্রম ও বৈধতা নিয়ে। নানা আলোচনা ও দীর্ঘ বিতর্কের ৮ মাস পর বাংলাদেশের সংবিধানটি রচিত হয়।
খসড়া সংবিধানের কিছু বিষয়বস্তু নিয়েও গণপরিষদে গুরুতর আপত্তি ওঠে। দীর্ঘ আলোচনা হয় স্বাধীন দেশের লক্ষ্য, আদর্শ, নাগরিক অধিকার ও সরকার কাঠামো-সংক্রান্ত অধিকাংশ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়। সংবিধানে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয় শোষণ ও বৈষম্যহীন একটি গণতান্ত্রিক ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে। সেই সঙ্গে গণপরিষদে আলোচনাকালে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অস্বীকৃতি, অবাধ জাতীয়করণ, প্রধানমন্ত্রীর হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান, সংসদ সদস্যদের অধিকারহীনতা, নির্বাচনকালীন সরকারসহ কিছু বিষয়ে সতর্কবাণীও উচ্চারিত হয়। দীর্ঘ ৮ মাস নানা তর্ক-বিতর্কের পর রচিত এই সংবিধানের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের অধিকার, রাষ্ট্র পরিচালনার আইনি ভিত্তি রচিত হয়।
‘সংবিধান বিতর্ক ১৯৭২: গণপরিষদের রাষ্ট্রভাবনা’ বইটি নানাদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত। আসিফ নজরুলের বইয়ে উঠে এসেছে সেই সময়ের ইতিহাস, পরিষদের কার্যবিবরণী ও অন্যান্য দলিলপত্রের বিশ্লেষণ। তার বিশ্লেষণ বলে দেয়, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পর আমরা কেমন বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলাম, আমাদের ভুলটা কোথায় হয়েছে, আর কোথায়ই-বা আমাদের সম্ভাবনা। বস্তুত, ১৯৭২ সালের গণপরিষদ বিতর্কে প্রতিফলিত সেই স্বপ্ন, শংকা আর অঙ্গীকারের কথা না জানলে আমাদের মূল সংবিধান, অভীষ্ট সাংবিধানিক গন্তব্য কিংবা আগামীর সংস্কার-আকাঙ্ক্ষাকে বোঝা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাও উপলব্ধির বাইরে রয়ে যাবে।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন