চর্ব্য চোষ্য [চতুর্দশ পর্ব]

অ+ অ-

 

পড়ুন  চর্ব্য চোষ্য [ত্রয়োদশ পর্ব]

চর্ব্য চোষ্য [চতুর্দশ পর্ব]

আমিরের মোবাইলে রিং হচ্ছে। তার বান্ধবী শিউলি খাতুন ডাকছে তাকে।
ফিঙ্গেবাড়ি সেতুর গোড়ায় দোকানে বসে শিঙ্গাড়া খাচ্ছিল আমির। সাথে স্থানীয় একদল শ্রমিক নেতা-কর্মী।
আমির শিঙ্গাড়াটা নিয়ে উঠে পড়ল।
বেলা ডুবছে। শিউলি দাঁড়িয়ে আছে ফিঙ্গেবাড়ি মোড়ের কাছে। দিরহাম নিটওয়্যার কারখানার পাশে গলির মাথায়। আমির মোবাইলে কথা বলতে বলতে দ্রুত হাঁটে। তারপর প্রায় দৌড় দেয়।
শিউলি হেসে বলল, ‘খবর নেই কেন, নেতাজি?’
‘খবর না নিলে খবর থাকবে কী করে?’
‘আপনি খালি নেতাগিরি করে বেড়াবেন আর আমি খালি খবর নেব, তাই না?’ শিউলি হাসতে হাসতেই বলল বটে।
আমির গম্ভীর হয়ে যায়। সে এত বড় একজন নেতা অথচ শিউলি তা মোটেও বুঝতে চায় না। নাকি সে তাকে বিশেষ পাত্তা দেয় না। এমন করে ‘নেতাজি’ বলে যে, ঠাট্টা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। আর বলে কিনা ‘নেতাগিরি’ করে বেড়ান। দেখা হলেই বলে। ম্যাদা মারা শ্রমিকদের তাজা করা কি যা-তা কাজ নাকি। আবার রাস্তায় গেলে সবাই খেপে যায়। খ্যাপা শ্রমিকদের বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়া যে ঝকমারি!
শিউলি বলল, ‘কী ব্যাপার? কী হল?’
‘না। কিছু না।’
‘এখন আবার কোথায় মিটিং করতে যাবেন তাই চিন্তা করছেন?’
‘হ!’
‘ত যান গা!’
শিউলি মুখ ঝাড়ি মেরে গলির ভেতর ঢুকে পড়ল।
এমনটা প্রায়ই হয়। তবে আমির শুধু একটু পিছু নিলেই আবার সব ঠিকঠাক। শিউলির গোলগাল কালো মুখে সাদা হাসি ফোটে। এই হাসিতে আমির প্রথম দিন থেকেই আলোড়িত হয়। টানা টানা চোখের দিকে তাকিয়ে বারবার প্রেমে পড়ে। বছর দুই আগে পরিচয়ের পর থেকে।
শিউলি বলল, ‘আমার পাছে পাছে কই আসছেন, নেতাজি?’
‘দেখি কদ্দূর যাওয়া যায়।’
শিউলি হাসে। আমির তাকে কখনও মন খারাপ করতে দেখেনি। শিউলি কখনও কোনো আবদারও করেনি। কোনো সমস্যা নিয়ে আসেনি। যেখানে প্রতিদিন পাঁচ-দশজন শ্রমিক কোনো-না-কোনো সমস্যা নিয়ে হাজির হয়। বেশির ভাগ সময়ই আমির কিছু করতে পারে না। তাতে মন খারাপ হয়। তবে আমিরের চেষ্টায় সবাই কমবেশি খুশি হয়ে ফেরে।
শিউলি বলল, ‘আজ লাবণীর ছেলে হয়েছে।’
লাবণী তার সহকর্মী। দুইজনই প্যান্সি ক্লোথিং কারখানার অপারেটর। প্যান্সি শীতের দেশের ফুল। শীতের দেশের মেয়েদের জন্য তারা ফুলের পাপড়ির মত কোমল, উষ্ণ, রঙবেরঙের সোয়েটার বানায়। তা নিয়ে তারা কখনও একটা শব্দও বলে না।
আমির বলল, ‘লাবণী কই এখন? বাড়ি না?’
‘হা। বাচ্চা হবার জন্য গেল যে, আর ত ফেরেনি।’
‘চাকরি আছে এখনও?’
‘আপনার কি ধারণা?’ শিউলির রাগ হয় আমিরের কথায়।
ফিরে আসলে বোঝা যাবে চাকরি আছে কি নেই। আসার পর যদি কারখানায় লোক দরকার হয় তাহলে চাকরি আছে। না হলে নেই। আমির কি তা জানে না।
লাবণী ছুটি চেয়েছিল। ম্যানেজার ছুটি দিয়েছে। কিন্তু বেতন দেয়নি। ফেব্রুয়ারির বাইশ তারিখে জানুয়ারির বেতন পেয়ে বাড়ি গেছে লাবণী। সেই বাইশ দিনের বেতনও দেয়নি। আর আজ হল জুন মাস।
শিউলি বলল, ‘মাস তিনেক পরে আবার আসবে লাবণী।’
‘ছেলে থাকবে কই?’
‘নানির কাছে।’
‘আর তোর কী খবর? আইবুড়ো হয়ে গেছিস যে সে খবর আছে?’
‘আইবুড়ো হব না ত কী করব? চিরকাল খুকি থাকব নাকি?’
‘ভাল!’
‘কী ভাল?’
‘আইবুড়ো হওয়া ভাল।’
‘আমি সব ভালই করি।’
শিউলি হাসতে হাসতে সামনে ঝুঁকে পড়ে। হুমড়ি খাবার জোগাড়।
আমির বলল, ‘পড়ে যাবি। সাবধানে হাঁট।’
‘পড়ে গেলে কার কী? আপনি আছেন আপনার ইঁদুর নিয়ে।’
‘বললাম চল বিয়ে করি। তা ত করবি না।’
‘আহ! কী শখ! শখের জ্বালায় আর বাঁচি নে!’
‘আজ তোকে অনেক ফুরফুরে লাগছে। ডিউটি নেই?’
‘নাহ্। আপনারা ত কারখানা বন্ধ করে দিলেন।’
‘তোদের কারখানাও বন্ধ হয়ে গেছে নাকি?’
‘হা। মাঝে মাঝে এভাবে বন্ধ করে দিয়েন। হি হি হি।’
‘হি হি না। ঠিক বলেছিস। ছুটির দিন অভার টাইম ডিউটি বন্ধ না হলে এটাই করা উচিত। বিষয়টা আমরা ইশতেহারে যোগ করব।’
‘প্রায় সব শ্রমিক ছুটির দিন অভার টাইম করতে চায়। আপনার ইশতেহারে তারা রাগ করবে।’
আমির গম্ভীর হয়ে গেল। ইট বিছানো গলির ভেতর দিয়ে উত্তর দিকে হাঁটতে হাঁটতে। ইট উঠে উঠে গলিটার যেখানে-সেখানে গজদাঁত বের হয়েছে। অনেক জায়গায় নর্দমা উপচানো পানি জমেছে। রাস্তার দুই পাশে ইলেকট্রিক লাইটের আলোয় ব্যস্ত কেনাকাটা চলছে। সব রকম দোকানই আছে এখানে। কোনো কোনো দোকানের মাথার ওপর আর পেছনে পাছার ওপর মাইলকে মাইল ভাঙড়ির দোকানের মত বাড়িঘর। মানুষ কিলবিল করছে। ফাঁকে ফাঁকে দু-চারটা করে পাঁচ-সাত তালা ফ্ল্যাটবাড়ি। কারখানা বা মাঠপর্যায়ের ব্যবস্থাপক টাইপের কর্মকর্তারা থাকে সেখানে। নানা কিসিমের দালাল, ঠিকাদার, খুদে ব্যবসায়ী আর দোকানিও আছে অনেক।
প্রায় এক কিলো হাঁটার পর প্রধান গলি থেকে উপগলিতে ঢুকল তারা। অনেকখানি যাওয়ার পর লম্বা টিনশেড। সেখানে গোটা ছয়েক রুম। তার একটায় রান্নাঘর। আরেকটায় আছে টয়লেট। কালো ছাতার নিচে আসল রঙ ঢাকা পড়েছে সবকিছুর।
এক তরুণী আমিরকে দেখেই বলল, ‘কেমন আছেন, দুলোভাই?’
‘সেই রকম!’
‘মানে কী? আগের মত নাকি আচ্ছামত?’
‘আগের মত এবং আচ্ছামত। তোর কী খবর?’
‘এই ত।’
তরুণী আর শিউলি গেটের পাশের রুমটায় থাকে। বাচ্চা জন্ম দিতে বাড়ি যাবার আগে লাবণীও থাকত।
আমির বলল, ‘তোরা এখনও দুইজনই আছিস? আর একজন নিবি নাকি? একটা ভাল মেয়ে আছে।’
‘আপনার এইখানে ইঁদুরনীতি করতে হবে না। আমাদের দরকার হলে আমরা খুঁজে নিতে পারব,’ শিউলির রাগ হচ্ছে।
একটু আগে সে যখন বের হল তখন গোটা মেসে কেউ ছিল না। এমন সময় কেউ থাকে না সাধারণত। কারুর যদি অভার টাইম ডিউটি না থাকে তাহলে কেবল সে-ই থাকে। সেই সুযোগে আমির এখানে মাঝে মাঝেই আসে। যদিও ঝুঁকি আছে। একদিন মহল্লার কয় যুবক তাদের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাল।
আমির বলল, ‘কবে দেখিস ধরা খাব।’
‘ইঁদুরের বাচ্চাগুলোকে এত ভয় করেন কেন? ঘেউ ঘেউ করে কিন্তু একটু এঁটো দিলে অমনি পায়ে পড়ে।’
‘ইঁদুর কি ঘেউ ঘেউ করে নাকি?’
‘চুপ করেন। আমার এখন রাগ হচ্ছে।’ শিউলিকে আরো রাগিয়ে দিল পাশের বাসার বাচ্চাদের কান্নাকাটি। ‘ইঁদুরের বাচ্চাগুলো সব সময় এত কেঁউ কেঁউ করে কেন?’
‘ইঁদুরের বাচ্চাদের কী করা উচিত?’
‘বললাম আমার এখন রাগ হচ্ছে।’ শিউলি অস্থির হয়ে উঠল।
আমির বেকায়দায় পড়ে। শিউলিকে সে আগে কখনও এমন দেখেনি। কিছুক্ষণ চিন্তার পর শিউলির হাত ধরে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল আমির। তার বাড়ি এখান থেকে কাছেই। পুব দিকে একটু এগিয়ে গেলে তুরাগ তীরে। 
শিউলি বলল, ‘কী ব্যাপার? কী মতলব?’
‘এই মতলব,’ শিউলির গা ঘেঁষে হাতে চাপ দিল আমির।
শিউলি বলল, ‘এখানে মতলব করতে হবে না। ইঁদুরের বাচ্চারা ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছে।’
‘তাকাক। ইঁদুরের বাচ্চাদের ভয় করি না।’
শিউলি শব্দ করে হেসে উঠল।
বরাবরের মতই শিউলিকে একটু দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে আগে বাড়ি যায় আমির। শিউলি যায় মিনিট তিনেক পরে। যেমনটা আমির বাড়ি থাকলে কিছুক্ষণ পরপর কেউ-না-কেউ আসতে থাকে। তারা রুমে ঢোকে গলিমুখো দরজা দিয়ে। ঢোকার পর ভেতরের দরজাটা বন্ধ করে দেয় আমির। না হলে ভাগনেরা এসে পড়ে।
আমির বাইরের দরজাও বন্ধ করে দিল শিউলি ঢোকার পর।
শিউলি বলল, ‘এত দেরি করে বোঝেন কেন, নেতাজি?’
‘সবকিছু বুঝে নিতে হবে যদি তাহলে মুখ আছে কেন?’
‘সবকিছু মুখে বলতে হবে যদি তাহলে মন আছে কেন?’
এমন করে কথা বলতে হয় যাতে অন্য রুম থেকে শোনা না যায়। এভাবে কাজ চলে কিন্তু মন ভরে না। দ্রুত শেষ করতে হয়। দরজায় কেউ টোকা দেওয়ার আগেই। আর রাতে হয় মনোকষ্ট। সেই গপ্প আমিরও বলে শিউলিও বলে। অনেক দিন পরপর একেকজন বিয়ের কথাও বলে।
শিউলি হাসতে হাসতে বলে, ‘বিয়ে করবেন, নেতাজি?’ এমন করে বলে যেন কিছুক্ষণ আগে কষ্টের কথা বলেনি। বিয়ে যেন তামাশা।
আর আমিরের উত্তর হল, ‘চল!’
এই কথায় প্রাণের তেজ নেই। শিউলি ভাল করেই বোঝে।
আমির মাঝে মাঝে জোর দিয়েও বলে, ‘চল। বিয়ে করি।’
শিউলি তখন আবার হেসে মরে। মাঝে মাঝে ক্ষুব্ধ হয়ে বলে, ‘একদল ইঁদুর কিচকিচ করে। রাগ লাগে। মন খারাপ হয়ে যায়।’
‘কোথায় ইঁদুর কিচকিচ করে? বিয়ের সাথে তার কী সম্পর্ক?’
‘জানি না, নেতাজি! আমার মনে হয় মাথা ঠিক নেই।’
আমির চিন্তা করে। বোঝার চেষ্টা করে। শিউলির মুখের দিকে নিরিবিলি চেয়ে থাকে মাঝে মাঝে। গ্রামের বাড়িতে শিউলির বাপ-মা আর ছোট ভাইবোন আছে। পিচ্চি ভাগনে-ভাতিজি আছে। আমির জানে বটে।
বাড়ি থেকে বের হতেই আমিরের এক চাচাত ভাইয়ের সাথে দেখা হল। পাতলা ঠোঁট। চোপা ভাঙ্গা তরুণ। পিকআপ চালায়। শিউলির দিকে তাকিয়ে নিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘আন্দোলন-সংগ্রাম চলছে কেমন, আমির ভাই?’ 
‘এই ত। তোর কী খবর?’
মহল্লার বেশির ভাগ বাসিন্দা স্থানীয়। তারা প্রায় সবাই আমিরের চাচাত ভাই। কিছু ভাড়াটে আছে যারা আমিরদের মতই কাজকাম করে। দু-একজন বাদে সবার সাথে আমিরের কমবেশি সখ্য আছে।
শিউলি বলল, ‘আজ কেমন কেমন যেন লাগল, নেতাজি। এখন আবার মাথা ঘুরাচ্ছে।’
‘কেন?’
‘জানি না ত।’
আমির কিছু বুঝতে পারে না। তবে আজ তার অবচেতন মনে একটা অনুভূতি সক্রিয় হয়েও হচ্ছে না: শিউলিকে বেশ ফাঁপা ফাঁপা লেগেছে তার। রক্ত-মাংস ক্ষয়ে ক্ষয়ে বাতাস ঢুকেছে যেন চামড়ার নিচে। শিউলির ত্বকও ইদানীং ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে লাগে। খালি চোখে সবার বোঝার মত হয়নি এখনও। 
শিউলি অভার টাইমসহ মাসে আট হাজার টাকার বেশি আয় করে। একটা রুম ভাড়া নিয়ে ভাল করেই খেতে-পরতে পারে। কিন্তু সে বলে যে, সারাক্ষণ তার চোখের সামনে ইঁদুর কিচকিচ করে। মাথা নষ্ট হবার জোগাড়। কিচকিচ থামাতে গিয়ে তার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। খাওয়াও হয় না নিয়মিত।
আমির মোবাইল চালু করতেই রিং হল।
ওপাশ থেকে তার এক সাগরেদ বলছে, ‘আশুলিয়ায় পুলিশ শ্রমিকদের লাঠিপেটা করেছে। পুলিশ বলছে ওরা শ্রমিক না। ওরা বহিরাগত সন্ত্রাসী। বহিরাগতরা অস্থিরতা সৃষ্টির পায়তারা করছে।’
‘কখন?’
‘এই ত এখন।’
আমির মোবাইলে সময় দেখল। রাত আটটা ১১ জুন ২০১২ সোমবার।
‘কোন কারখানা বললি?’
‘হামান দিস্তা উভেন।’ 
আমিরের গলা কাঁপছে। শিউলিকে পৌঁছে দিয়ে ফিঙ্গেবাড়ি মোড়ে গেল সে। ততক্ষণে ফিঙ্গেবাড়ি এলাকায় ডজন খানেক কারখানার শ্রকিরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করেছে। একটা টায়ারও জ্বলছে রাস্তার মাঝখানে। একটা পুলিশের গাড়ি দূরে দাঁড়িয়ে ভাব বোঝার চেষ্টা করছে।

 

আসছে পঞ্চদশ পর্ব