লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [পঞ্চম পর্ব]
পড়ুন ► লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [চতুর্থ পর্ব]
লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [পঞ্চম পর্ব]
ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল। কাল রাতে অনেক দেরি করে ঘুমিয়েছিলাম। কয়েকটা ফরমায়েশি লেখা দেওয়ার লাস্ট ডেট পেরিয়ে গেছে। সেগুলো শেষ করে তারপর ঘুমালাম। চাপ না থাকলে আমাকে দিয়ে কাজ করানো মুশকিল। নিজ উদ্যোগে কোনো কিছু লেখা হয় না অনেকদিন। পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পাতা, ফিচার পাতা, কিংবা সম্পাদকীয় পাতার ইনচার্জরা তাড়া দিলে তবেই লিখি। এই বদভ্যাসের কারণে গত কয়েক মাসে একটা কবিতাও লেখা হয়নি। গল্পও না। ভেবেছিলাম এবার একটা বই করে ফেলব। কিন্তু নতুন কবিতা নেই। আগের লেখাগুলোও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কোনোভাবেই এক জায়গায় জড়ো করতে পারছি না। গোটা পঞ্চাশেক চলনসই কবিতা হলে একটা বই হয়। আগেরগুলো গোছাতে পারলে ত্রিশটা হয়ে যেত। আর কয়েকটা লিখতে পারলে কোনো একটা প্রকাশককে দিয়ে দিতাম। কিছুদিন একটা দৈনিকের সাহিত্য পাতায় কাজ করার কারণে কয়েকজন প্রকাশকের সঙ্গে অল্প চেনা-জানা আছে। তারা মাঝে মাঝে ফোন করে বই চায়। অবশ্য সৌজন্য করে চায় কিনা সেটা জানি না। পাণ্ডুলিপি দিতে পারলে বোঝা যেত।
ফোনটা বাড়ি থেকে এসেছে। আমার সাথে বাড়ির যোগাযোগ ভালো না। ফোন তুলে প্রথমেই আমি কেন ফোন করি না এ ধরনের অনেকগুলো অভিযোগ শুনতে হবে। ঢাকায় গিয়ে পর হয়ে গিয়েছি, মা-বাবা, ভাই-বোনের খবর রাখি না ইত্যাদি হাজারটা প্রশ্ন তুলবে মা। অভিযোগ অবশ্য সত্যি। আমি আসলে কাউকেই ফোন করি না। সৌজন্য জিনিসটা আমার ভেতরে প্রায় নেই। ইদানিং মনে হয় মায়া-মমতাও নেই। বড় খালা মারা গেলেন, দেখতে যাইনি। কাজিন মারা গেল দেখতে যাইনি। ঠিকঠাক মনেও পড়ে না ওদের। অথচ বেঁচে থাকতে বেশ ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল দুজনার সাথেই। আমাকে খুব ভালোবাসত ওরা। কারো অসুখ-বিসুখ হলেও সচরাচর দেখতে যাই না। ফলে আমার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ নিয়ে আমি পাল্টা প্রশ্ন করি না। মেনে নেই। আমি হয়তো বলতে পারতাম, তোমারাও তো ফোন করো না, আমি হয়তো বলতে পারতাম কতদিন বাড়ির গাছের দুটো ফল খাই না, কতদিন পুকুরে মাছ ধরি না, কতদিন প্রিয় নদীটার ধারে ভোরবেলা হেঁটে বেড়াই না। তোমরা তো সেজন্য কোনোদিন আসতে বলো না। শুধু দরকারেই ফোন দাও। তোমরা তো জানতে চাও না ছেলেটা সত্যিই ভালো আছে কিনা! এসব মাঝে মাঝে মনে হয়, কিন্তু বলি না। প্রত্যেকেই তাদের জীবনযাপন নিয়ে ব্যস্ত। প্রত্যেকেই ছুটছে। কারো জন্য কারো কোনো সময় নেই। বলে আর লাভ কী! মা প্রাথমিক অভিযোগ সেরে বললেন, ‘তোর ছোট ভাইটারে নিয়ে যা, আমি আর ওকে সামলে রাখতে পারছি না।’
আমরা দুই ভাই, এক বোন। ছোট ভাইটা ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছে। এরই মধ্যে সে নানা কীর্তি করে এলাকায় বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। এলাকাবাসীর ঘুম হারাম হয়ে গেছে তার জন্য। আমাদের মফস্বল শহরটা খুব ছোট। প্রায় সবাই সেখানে সবাইকে চেনে। সব খবরই আমার কানে আসে। ওখানে আমার বন্ধুরা আছে, তারাই মূলত ওকে ছোটখাটো ঝামেলা থেকে বাঁচায়। ওদেরও দরকার হয় জুনিয়র ছেলেপেলে হাতে রাখা। আবার ওরা আমাকেও জানায় ওর কাণ্ডকারখানার কথা। মায়ের কথার উত্তরে আমি জানতে চাই, ‘কেন, সে নতুন আবার কী করেছে?’
মা যা বললেন তার সারমর্ম হলো, দুটো ছেলেমেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল আমাদের বাড়ির পাশের ছোট্ট বাগিচামতোন জায়গাটায়। হয়তো প্রেমিক-প্রেমিকা ওরা। লোকে যেমন বলে তেমন ‘অসামাজিক’ কর্মকাণ্ড জাতীয় কিছুই না, নিছক ঘোরাঘুরি। ছোট ভাই আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা মিলে ছেলেটাকে মেরেছে। শুধু ছেলেটাকে মেরেই তারা থামেনি, মেয়েটাকেও চড়-থাপ্পড় দিয়েছে। এখন মেয়ের বাসার লোকজন জানার পর ওদের নামে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার মা চাইছেন আমি যেন থানায় কথা বলে বিষয়টা ‘ম্যানেজ’ করার ব্যবস্থা করি। মামলা হলেও আমার ভাইয়ের নাম যেন সেখানে না থাকে। কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবে জানি এই কাজের হোতা সে-ই। মামলা হলে তার ‘ছোট’ ছেলেটার জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি আমার মাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, এই কাজ করে সে যদি শাস্তি না পায়, তাহলেই বরং তার জীবন ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তিনি আমার কথা বুঝতে পারলেন না। বললেন, আমি নাকি চাই না ভাইটা বড় হোক, ভালো থাকুক, আমি নাকি হিংসে করি তাকে, এজন্য এসব কথা বলছি। রেগে গেলে মা এরকমভাবেই কথা বলেন। আমরা সবাই সেটা জানি। আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে এসব শুনে। আমি পাত্তা দেই না। তাঁর মতের বিরুদ্ধে গেলে তিনি কাউকেই ছাড় দেন না। চল্লিশ মিনিট ধরে নানা অযৌক্তিক কথা বলার পর তিনি শান্ত হলেন।
আমার এই ভাইটার কিছু বিষয়ে আমি মুগ্ধ। বিশেষ করে তার মিথ্যে বলার ক্ষমতায়। একবার স্কুলে ফাঁকি দিয়ে তাকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগ্রেট খেতে দেখলাম। বাসায় এসে জিজ্ঞেস করতেই সে বেমালুম অস্বীকার করল। এত আত্মবিশ্বাসের সাথে সে ঘটনাটা নাকচ করে দিল যে আমারই মনে হতে লাগল আমি বোধ হয় ভুল দেখেছি। এখন ওকে আমি ফোন করে যদি ধমকাতে যাই, সে এমনভাবে ঘটনাটা সাজিয়ে বলবে যেন ও নিতান্ত বাধ্য হয়ে এটা ঘটিয়েছে। এখানে তার কোনো দোষ নেই। সে কারণে ওকে ফোন না দিয়ে বাবাকে ফোন দিলাম। ঝামেলার সবচেয়ে সহজ সমাধান হলো, মেয়েটার বাড়িতে গিয়ে তার বাবা মাকে বোঝানো এবং একটা আপোষরফার ব্যবস্থা করা। বাবা আমার কথা বুঝলেন। কিন্তু সমস্যাটা অন্য। সামাজিক কারণে আমার বাবা অপেক্ষাকৃত নিচু অবস্থানের কারো বাড়িতে গিয়ে এটা করতে চাইছেন না। কিন্তু কখনও কখনও এ ধরনের পরিস্থিতি হতেই পারে।
ওই মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরে দুপুরের দিকে আমাকে আবারও মা ফোন দিলেন। ‘তোর ভাইয়ের জন্য তো এলাকায় আর মুখ দেখানোর অবস্থা নেই।’
আমার খুব মেজাজ খারাপ হলো। আসলে সময়মতো ওকে শাসন করা হয়নি। বাবা বা আমি শাসন করতে গেলে উনি সেটা করতে দিতেন না। ভাইটা নষ্ট হওয়ার পেছনে উনার অনেক অবদান আছে। আমি বললাম, ‘আগে থেকে প্রশয় না দিলে এই অবস্থা হতো না।’
‘কী! আমি ওকে এমন করেছি? পেটের ছেলে হয়ে তুই এই কথা বলেতে পারলি?’
‘দেখো মা, আবার চিল্লাচিল্লি শুরু কোরো না। আমি এখন অফিসে যাব। যা বলার শর্টকাটে বলো।’
এ কথায় কাজ হলো। উনি সরাসরি মূল কথায় চলে এলেন। বললেন, ‘ওই ছোটলোকদের বাড়িতে গিয়ে তোর বাবার ক্ষমা চাইতে হলো। এই ছেলেকে আমি আর পড়াব না। লেখাপড়া শিখে ও দিন দিন আমাদের মান-সম্মান ডোবাচ্ছে।’
‘তো, এখন কী করতে চাইছো?’
‘তোর ভাইকে কী তুই কী করবি আমি জানি না। তোর বাবাও ওকে আর পড়াবে না। একটা টাকাও দেবে না বলে দিয়েছে।’
‘বাবা বলেছে, নাকি তুমি বাবাকে কানপড়া দিয়েছো?’
‘খবরদার বাজে কথা বলবি না। জিহ্বা টেনে ছিড়ে ফেলব।’
আমার মা এখনও আমাদের জিহ্বা টেনে ছিড়ে ফেলতে চান। চামড়া তুলে ফেলতে চান। উনি এমনই। বাবাকে পর্যন্ত দু’চার কথা শুনিয়ে দেন। আমরা এতে অভ্যস্ত। এসব আমাদের কাছে ডালভাত।
‘তার মানে, তুমিই বাবাকে এই বুদ্ধি দিয়েছো?’
‘আমি কেন দেব? তুই কি ভাবছিস তোর বাবা মেয়ে মানুষের কথায় চলা লোক? সে বলেছে আর একটা টাকাও ওর পড়ার পেছনে খরচ করবে না। ওকে কোনো একটা গাড়ির গ্যারেজে রেখে দেবে। কাজকর্ম শিখবে, টাকা আয় করবে।’
‘আমাদের কি এতই টাকার অভাব পড়েছে যে ওকে গ্যারেজে রেখে টাকা আয় করতে হবে?’
‘সেটা তোর বাপকে জিজ্ঞেস কর। আর রুমার বরের অবস্থা বেশি ভালো না। তাকে টাকা দিতে হবে। সে অনর্থক তোর ভাইয়ের পেছনে টাকা ঢালতে পারবে না।’
রুমা আমার বোন। তার বর মোটামুটি বেকারই বলা যায়। ছেলে খারাপ না, তবে একটু বোকা ধরনের। কদিন পরপর নতুন একটা ব্যবসা শুরু করে। আবার লস খেয়ে কিছুদিন চুপচাপ বসে থাকে। তারপর ওদের বাড়ি আর আমাদের বাড়ি থেকে টাকা নেয়। আবার নতুন ব্যবসা শুরু করে এবং লস খায়। এভাবে গত কয়েক বছর এই চক্রটি সে বেশ সফলতার সাথে চালু রেখেছে। তবে, রুমার বরকে টাকা দিতে হলে যে আমাদের টাকাপয়সার টানাটানি হবে বিষয়টা মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। মফস্বল শহর হলেও আমরা বেশ ভালো টাকা বাড়িভাড়া এবং দোকাভাড়া পাই। বাবা পেনশনের টাকা পায়। পুকুরে মাছ আছে। বাড়ির জমিতে সবজি হয়। চাল কেনা লাগে না। নিজেদের জমির চালে সারাবছর চলে যায়। নিজেদের কারেন্ট বিল, পানির বিল আর বাজার-সদাই ছাড়া তেমন কোনো খরচ নেই। আগে তবু আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর খরচ দিতে হতো। এখন সেটাও হয় না। উল্টো মাঝে মধ্যে আমি টাকা দেই। আরিফের ডিগ্রি পড়ার খরচ কতই বা হতে পারে। টিউশন ফি আর প্রাইভেট টিচার মিলিয়ে মাসে পাঁচ হাজার বড়জোর। সেটা দিতে কষ্ট হবে এই কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। মায়ের সঙ্গে কথা বলার পর বাবার সঙ্গে কথা বললাম। তিনিও দেখলাম গোঁ ধরেছেন। বুঝলাম ফন্দিটা তাঁদের দুজনারই। এই কুলাঙ্গার ছেলেকে আর তারা পড়াবেন না। আর পড়লে পড়ুক, একটা টাকাও তারা দিতে পারবে না।
আমার মনে হলো, উনারা চাইছেন আমি যেন তার পড়ার খরচটা চালাই। এতে যতটা না টাকার সাশ্রয় তারও বেশি আমাকে একটু টাইটে রাখার চেষ্টা। অনেকটা এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো। আমার পানশালায় যাওয়াসহ অন্যান্য বদঅভ্যাস বিষয়ে তারা জ্ঞাত। যার ফলে দূর থেকে আমাকেও কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন এখনও। তাদের এই চেষ্টার মধ্যে চালাকি থাকলেও আমার খুব একটা খারাপ লাগল না।
আমি শেষ পর্যন্ত বললাম, ওর পড়ার খরচ তোমাদের দিতে হবে না। আমিই দেব। বলা যায় বলতে বাধ্য হলাম। আমি চাইছিলাম না পড়াশোনা না করে ও আরো নষ্ট হয়ে যাক। অশিক্ষিত মাস্তানদের আজকাল লোকে দাম দেয় না। তার চেয়ে শিক্ষিত মাস্তান হওয়া ভালো, সমাজে কিছুটা দাম পাওয়া যায়। বাবা মায়ের কথার যে ভঙ্গি, তাতে আমার কাছে মনে হচ্ছিল, সত্যিই বুঝি তারা ওর পড়া বন্ধ করে দেবে। ফলে রিস্ক নেওয়ারও সাহস পেলাম না।
► আসছে ষষ্ঠ পর্ব
দারুণ লাগলো।
সজীব
জুন ০৩, ২০২৩ ১৮:২৪