চর্ব্য চোষ্য [নবম পর্ব]
পড়ুন ► চর্ব্য চোষ্য [অষ্টম পর্ব]
চর্ব্য চোষ্য [নবম পর্ব]
গভীর রাত। আশপাশ নীরব। নিথর।
নাশিতা আর তার হাজবেন্ড এসির ঠাণ্ডায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। ডিম লাইটের নীলাভ আলো ঝরে ঝরে পড়ছে সাদা বিছানায়।
এমন সময় জানালায় খড়াং করে শব্দ হল যেন।
নাশিতা উঠে বসে। ঘুমালেও তার কান সজাগ থাকে। সে কান খাড়া করে রাখল কিছুক্ষণ। হাজবেন্ডের দিকে তাকাল এক পলক। উপুড় হয়ে এক পা ভাঁজ করে ঘুমাচ্ছে লিমন। যেন মরে পড়ে আছে। নাশিতা সিথানের পাশে হাত বাড়িয়ে টি-টেবিল থেকে পানির বোতল টেনে নিল। কেবল মুখ খুলবে এমন সময় আরো জোরে খড়াং। যেন জানালার গ্রিল খুলে পাকা মেঝেতে পড়ল। একই রকম শব্দ হল নাশিতার বুকের ভেতর। সে প্রায় লাফ দিয়ে নেমে গেল। তার দরজার সামনেই ইসমির বেডরুমের দরজা। নানা রঙে রাঙানো রুমে একসেট ডিম লাইটের আলো জোছনার মত ঝরে ঝরে পড়ছে। মায়াবি রূপকথার মত ঘুমাচ্ছে তার রাজকন্যা। চিত হয়ে। ফুলবাগানের মত বিছানায় কনুই রেখে বাঁ হাতটা পেটে হেলান দিয়ে নাভির ওপর কাত হয়েছে। ডান হাত পেট বরাবর লম্বা হয়ে ঊরুর ওপর। আর পায়ের ওপর পা। এভাবে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না নাশিতা। কাত না হলে তার ঘুমই আসে না। তবু মেয়েকে সে এভাবেই অভ্যস্ত করেছে। সোনার কাঠি রুপার কাঠি দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখার মত। মেয়েও ঠিকঠাক অভ্যস্ত হয়েছে। ঘুমের ঘোরে মোড় ভাঙে বটে। কিছুক্ষণ পর আবার এমন হয়ে যায়। নাশিতার মনে দারুণ সুখ হয়। ইসমি প্রথম যেদিন উপুড় হয় সেদিনই নাশিতা এই যুদ্ধ শুরু করে। অভ্যস্ত হতে ইসমি সময় নিয়েছে প্রায় চার বছর।
বুক ধড়ফড় করেই যাচ্ছে নাশিতার। গুলশানের অনেকগুলো আতঙ্কের খবর মনে পড়ছে। পরশু ছিল ইসমির জন্মদিন। ২৯ মে ২০১২। লেকপার থেকে ডাকাতির প্রস্তুতি নেয় কয়েকজন। তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বছর তিনেক আগেও ডাকাতির চেষ্টা হয়েছে। ডিসিসি মার্কেটের সামনে থেকে হাতেনাতে দুইজনকে আটক করে পুলিশে দেয় জনতা। বছর পাঁচেক আগে এক পোশাক ব্যবসায়ীর শিশুছেলে অপহৃত হয়। দুই কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায় করার ঘটনায় একজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। আর গত বছর বাড়ির কাছে বনানীতে দিন দুপুরে ডাকাতি হয়ে গেল। ইকবাল সেন্টারের সোনার দোকানে।
নাশিতার আতঙ্ক বেড়ে যায়। মেয়ের রুম থেকে বের হতে ভয় লাগে। তবু দরজা বন্ধ করার জন্য পা বাড়াল। সাথে সাথে ভেতরে ঢুকে পড়ল আমির আর তার দুই সঙ্গী। তামাটে আমিরকে ছোট দানবের মত লাগছে। তার লম্বা মুখটা যেন রোবট। চোখ থেকে আগুন ঠিকরে পড়ছে। নাশিতার স্নায়ুর বল পড়ে গেল। চিৎকার দেওয়ারও ক্ষমতা নেই। ধাতস্থ হবার আগেই একজন তার মুখ চেপে ধরল। পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল। আর মুখে এঁটে দিল টেপ। হরর মুভির দৃশ্য।
আমিরসহ সবাই নগ্ন। নাশিতা এতক্ষণে খেয়াল করল। তারা কি নগ্ন হয়েই এসেছে নাকি পরে নগ্ন হয়েছে? নাশিতা বোঝার চেষ্টা করছে।
‘শব্দ করলে খুন!’ আমির বলল। তারপর ধারাল ছুরি নাশিতার গলায় চেপে ধরে মুখ খুলে দিল।
নাশিতা বলল, ‘আপনারা কী চান?’
আমির টর্চ লাইট ফোকাস দিয়ে সুইচ বোর্ড খুঁজল। আলো জ্বালানোর পর এগিয়ে গেল ইসমির কাছে। তুলতুলে পুতুলের মত ঘাড় ধরে টেনে তুলল। নাশিতা খুন হবার ভয় ভুলে চিল্লিয়ে ওঠে। সাথে সাথে আমির তার মুখ চেপে ধরে। আবার টেপ মেরে দেয়।
ইসমি কেঁদে উঠলে আমির তার মুখ চেপে ধরল। টেপ এঁটে দিল। নাশিতা কথা বলার চেষ্টা করলে গলার ভেতর গোঁ-গোঁ শব্দ হয়।
সবকিছু ঘটছে নাশিতার যুক্তিবোধ যেমন। তাকে ধাক্কা দিয়ে খাটের ওপর ফেলল আমির। একজন বাঁধল তার দুই হাত একসঙ্গে। অন্য দুইজন গিয়ে বেঁধে নিয়ে আসল নাশিতার হাজবেন্ডকে। ইসমিকে খাটের ওপর ছুড়ে ফেলল আমির।
ইসমি কাঁপছে। তার চোখ বুজে আসল। মুখ নীল হয়ে গেল। জ্ঞান হারাচ্ছে? ভয়ে নাকি আঘাত লাগল? নাশিতা কাত হয়ে মুখ দিয়ে নাড়া দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আমির তাকে হ্যাঁচকা টানে খাড়া করে বসায়। তারপর তার রাতের পোশাক টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করে। এই পোশাক ছেঁড়া কঠিন। বোতাম খোলার ধৈর্য নেই তার। সে ছুরি দিয়ে কেটে ফেলল। মেয়ের সামনে। হাজবেন্ডের সামনে। নাশিতা চোখ বুজে ফেলল। এ ধরনের নিষ্ঠুরতা সে শুধু হরর মুভিতেই দেখেছে। কোনো হরর মুভি সে বেশিক্ষণ দেখতে পারেনি।
আমির বলল, ‘সময় নষ্ট হচ্ছে। তোরা তোদের কাজ কর।’
অন্য দুইজন নাশিতার হাজবেন্ডকে নিয়ে চলে গেল।
ইসমি এতক্ষণে গোঁ-গোঁ করে সাড়া দিচ্ছে।
আমির কিছুক্ষণ চিন্তার পর নাশিতার বাঁধন খুলে দিল। সে ছোট নেতা হোক আর বড় নেতা হোক, সে মানুষের জন্য কাজ করে। নাশিতা জানত। মিটিংয়ে যাবার পথে গাড়িতে বসে সব বিষয়ে বিস্তারিত শুনেছিল ব্যবস্থাপকের কাছে।
ইসমির ফুলের মত টেবিলে বসতে গিয়ে উঠে পড়ল আমির। মনে হচ্ছিল টেবিলটা মুষড়ে পড়বে। ধসে যাবে। আমির যেন এমন কিছু করতেই পারে না। সে টেবিলটার দিকে তাকাল। কোমল চোখে। তারপর ঘুরে ঘুরে রুমের দেয়াল দেখল। ছাদ দেখল। হঠাৎ করে তার চোখমুখ থমথমে হয়ে উঠল।
মিনিট দশেকের মধ্যে সবাইকে হাতমুখ বেঁধে ড্রইংরুমে নিয়ে গেল তারা।
আমির বলল, ‘টাকা পয়সা কই?’
প্রথমে নাশিতার শ্বশুরকে ধরে তারা। গলায় ছুরি ধরে নিয়ে যায়। শ্বশুর মুখ দিয়ে চাবি দেখিয়ে দিল। মানিব্যাগ দেখিয়ে দিল। একই কায়দায় অন্যদের। কাজের মেয়েকে বাদ দিল না।
সাকল্যে হাজার বিশেক টাকা পায় তারা।
নাশিতারা যেখানে কেনাকাটা করে সেখানে কার্ড চলে। কত দিন তারা কাগুজে টাকা ব্যবহার করে না তা প্রায় ভুলেই গেছে। নাশিতা ‘ও’ লেভেলের পর কোনো দিন গয়না কেনেনি। কালেভদ্রে যা পরে তা নকল। বিয়ের সময় ষাট-সত্তর ভরি উপহার পেয়েছিল। তা রয়েছে ব্যাংকের লকারে। শাশুড়িও তার সব গয়না দুই মেয়ে আর নাশিতাকে ভাগ করে দিয়েছে। অনেক দিন আগে।
ডাকাতরা বিশ্বাস করল না। ইসমির ডানা টেনে ধরে ছুরি এগিয়ে নিল।
আমির হুকুম দিল, ‘ঘ্যাচাং করে কেটে ফেল!’
‘না, প্লিজ!’ তখন নাশিতার মুখ খোলা। আমির আবার বেঁধে ফেলল।
আমির বলল, ‘এত বুদ্ধিমান আপনারা! অথচ এই বুদ্ধিটুকু নেই যে, ডাকাত এসে টাকা-পয়সা না থাকলে মার দেয়?’
একজন ব্যাংকের কার্ড নিয়ে পিন নম্বর চাইল। আমির তাকে ধমক দিয়ে থামাল। কার্ড আর চেক নিয়ে অনেকেই ধরা খায়। আমির জানে।
‘তাহলে এখন খালি হাতে ফিরে যাব নাকি?’
‘না। ভাল করে মার দেব।’
আমির সবাইকে ঘোড়ার মত দাঁড় করিয়ে পিঠের ওপর রড দিয়ে পিটাতে শুরু করল। অন্য কোথাও পিটালে ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু তাদের ক্রোধ বেড়ে যায়। সবার পাছার ওপর একের পর এক ছুরি বসিয়ে দিল। মুখ বাঁধা থাকায় তারা গোঁ-গোঁ করছে। সাদাটে মার্বেল টাইলসের মেঝেতে কেঁচোর মত রক্ত বেয়ে যাচ্ছে।
আমির বলল, ‘এতে শান্তি পাচ্ছি না। পিচ্চিটাকে নিয়ে চল ভাগি!’
ইসমিকে কোলবালিশের মত ধরল একজন। তারা দরজা পার হবার সময় নাশিতা জোরে চিল্লিয়ে উঠলে ঘুম ভেঙে যায়। ধড়ফড় করে উঠে বসল বিছানায়। তারপর লাফ দিয়ে ইসমির ঘরে।
মায়াবি রূপকথার মত ঘুমাচ্ছে তার রাজকন্যা।
সাড়ে পাঁচটা বাজে। নাশিতা বিছানা ছাড়ে ছয়টায়। টেবিল ঘড়িতে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। তবে অ্যালার্মের আগেই সে প্রায় দৈনিক সময়মত জাগতে পারে। এখন আর বিছানায় না গিয়ে খাবার ঘরে ঢুকল। সরল পানি বা টোটকা পানি কিছু একটা খাবে। একটা তরল দিয়ে তার পাকস্থলীর দিন শুরু হয়।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন