লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [সপ্তম পর্ব]

অ+ অ-

 

পড়ুন ► লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [ষষ্ঠ পর্ব]

লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [সপ্তম পর্ব]

সকালে অফিসে এসে ফেসবুক খুলতেই একটা বীভৎস ভিডিও চোখে পড়ল। প্রকাশ্য দিবালোকে একটা ব্যস্ত রাস্তায় কয়েকজন যুবক অন্য আরেকজন যুবককে রামদা দিয়ে কোপাচ্ছে। একটা মেয়ে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ছেলেগুলো মেয়েটাকে বারবার সরিয়ে দিয়ে তাদের মনের সাধ মিটিয়ে কুপিয়ে চলে গেল। ওরা চলে গেলে মেয়েটা অন্যদের সহায়তায় আক্রান্ত ছেলেটাকে নিয়ে চলে গেল। ঘটনাটা তিন দিন আগের। আজকে ব্যাপকভাবে অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইলাম। সাদেক ভাইকে জিজ্ঞেস করলে বললেন, ‘রিপোর্ট করতেছি আমরা। অন্যেরা একটু আগেই দিয়া দিছে।’ অফিসে আজকের আলোচনা টপিক এটাই, সবাই বলাবলি করছে ঘটনাটা। ছেলেটা মারা গেছে। নিউজের কপি নিয়ে দেখলাম আমাদের বরগুনার প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। যে মেয়েটাকে দেখা গেছে সে নিহত ছেলেটার স্ত্রী। বরগুনা প্রতিনিধি আগেই জানত, কিন্তু খুনিরা ওখানকার প্রভাবশালী হওয়ায় সে নিউজটা দিতে পারেনি। ঢাকায় বসে যারা সাংবাদিকতা করেন তারা জানেন না মফস্বলে সাংবাদিকতা কত কঠিন। সব নিউজ সবসময় করা যায় না। জীবনের ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে প্রতিপক্ষ যখন ভীষণ শক্তিশালী, তখন তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই নিউজ করতে হয়, বেঁচে থাকতে হয়। মফস্বলের সাংবাদিক এবং তাদের পরিবার প্রভাবশালীদের ধরাছোঁয়ার ভেতরে থাকে। সাংবাদিকতার মূল চ্যালেঞ্জ আসলে মফস্বলেই। ঢাকায় আমরা যারা থাকি তারা সব ক্রেডিট নিই। কিন্তু এটা একেবারেই ঠিক না।

তবে মূলধারার গণমাধ্যমের এখন সংবাদ চেপে যাওয়া বা এড়িয়ে যাওয়া অনেকটাই কঠিন। বিকল্প গণমাধ্যম হিসেবে এখন হাজির হয়েছে ফেসবুক। কোনো পত্রিকা প্রথমে নিউজটা না ছাপালেও এখন প্রায় সবাই বাধ্য হয়ে ছাপছে। কেননা ফেসবুকে ভিডিওটা ছড়িয়ে পড়ার পর ঘটনা এখন আর কারো অজানা নেই। মূলধারার গণমাধ্যমের স্বচ্ছতার প্রশ্নে এখন এটা ছাপতেই হবে। এবং দেরি করে ছাপার কারণে নতুন নতুন তথ্য, নতুন অ্যাঙ্গেল খুঁজে বের করতে হবে। সম্প্রতি আরো অনেকগুলো ঘটনার ক্ষেত্রে এরকম হয়েছে। মূলধারার সংবাদপত্র হয়তো কোনো একটা খবর প্রাথমিকভাবে এড়িয়ে গিয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফেসবুকের কারণে তাদের বাধ্য হয়েই সেটা ছাপতে হয়েছে।

সাদেক ভাই ভিডিও দেখে বলল, ‘অনিক, এই মাইয়াটা মনে হয় খুনের সাথে জড়িত।’

শুনে আমিসহ অন্যান্যদের খুব মেজাজ খারাপ হলো। ভিডিওতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে মেয়েটা তার স্বামীকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে আর সাদেক ভাই বলে কিনা মেয়েটা জড়িত। নারীবিদ্বেষী, রেসিস্ট লোক কোথাকার! কিন্তু এর আগে এরকম কিছু ঘটনায় সাদেক ভাইয়ের অনুমান পুরোপুরি মিলে গেছে। এজন্য আমার সন্দেহ হলো। সাদেক ভাইয়ের সাংবাদিকতার ক্যারিয়ার কমপক্ষে দেড় যুগের। নিউজের ফাঁক ফোকর তিনি খুব ভালোভাবে ধরে ফেলতে পারেন। কোন জেলার কোন প্রতিনিধি বাসায় বসে অন্যদের কাছ থেকে নিউজ কপি করে পাঠিয়েছে আর কে ঘটনাস্থলে গিয়েছিল সেসব তিনি একবার নিউজের কপি পড়েই বলে দিতে পারেন। সাদেক ভাইয়ের মন্তব্য শুনে ভিডিওটা আমি আবার দেখলাম। যদিও ওই নৃশংসতা দেখা এবং সহ্য করা খুব কঠিন, কিন্তু সংবাদকর্মীদের এসব কাজই নির্বিকারভাবে করতে হয়। আমার মনে হলো সাদেক ভাইয়ের কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো না। অন্য কয়েকজন কলিগও মনে করছে মেয়েটা কোনো না কোনোভাবে জড়িত। তবে নারীবাদী হিসেবে পরিচিত মেয়ে কলিগরা খুব ক্ষেপে গেল সাদেক ভাইয়ের কথায়।

তারা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করল এবং যেকোনো কিছুতে যে মেয়েদের ভিকটিমাইজ করা হয় সেটা নিয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দিতে লাগল। আমার একবার মনে হলো সাদেক ভাইয়ের কথা ঠিক, আবার বিপ্লবী নারীবাদী কলিগদের জোরালো কণ্ঠের প্রতিবাদ শুনে মনে হলো তাদের কথা ঠিক। কেন যেন আমি খুব সহজেই কনভিন্স হয়ে যাই। এর মধ্যে আমাদের নিউজ এডিটর এলেন। তিনি দুই পক্ষকেই ঠাণ্ডা করলেন। বললেন, ‘এখনই আপনার এত উত্তেজিত হইয়েন না, কয়েকদিন যেতে দেন, তারপর এমনিতেই জানা যাবে। কাজ করেন।’

সাদেক ভাই কখনও বসদের কথার বাইরে যান না। বসেরা একবার একটা নিয়মের কথা বললে সেটা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন। পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত সেই নিয়ম থেকে তাকে টলানো অসম্ভব। নিজের বুদ্ধিতে তিনি কোনো ডিসিশন পরতপক্ষে নেন না। অফিসেও সম্ভবত এ ধরনের কর্মীর চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। যে কাজ করবে, কিন্তু কখনও বসদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে না। সাদেক ভাই বসের কথা শুনে কাজে মনোযোগ দিলেও বিপ্লবী নারীকর্মীদের শান্ত করতে বসের একটু সময় লাগল। তারা সমস্বরে আদুরে কিন্তু বিপ্লবী কণ্ঠে নিউজ এডিটরকে ভাইয়া ভাইয়া করতে থাকল অনেকক্ষণ পর্যন্ত।

আসছে অষ্টম পর্ব