খ্যাতিমানের ছায়ায় এক অনামা লেখকের অন্তর্ধান!

অ+ অ-

 

এমন কি হতে পারেএকজন নামি লেখক একটা সমকালীন বড় ঘটনা নিয়ে উপন্যাস লিখে ফেলার কারণে একই বিষয়ে নবীন মেধাবী লেখকের উপন্যাস দীর্ঘকাল আলোর মুখ দেখবে না? ভাবতে কেমন লাগবে, যদি সেই কালপরিসর হয় পয়ষট্টি বছরের!

ঘটনার সূত্রপাত গত শতকের তিরিশের দশকে আমেরিকায়। জন স্টেইনবেক তখন খ্যাতির মধ্যগগনে, সেই খ্যাতিকে আরও এক ধাপ উঁচুতে নিয়ে গিয়েছিল তাঁর সে সময়ের বিখ্যাত উপন্যাস The Grapes of Wrath। উপন্যাসের বিষয় ডাস্ট বোল বলে পরিচিত ধুলিঝড়ের মুহুর্মুহু আঘাতে খরাপীড়িত ওকলাহোমা রাজ্যের বিপর্যস্ত কৃষককূলের ক্যালিফোর্নিয়া অভিমুখে যাত্রা ও অভিবাসন। সে সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। উপন্যাস রচনার আগে এ নিয়ে কয়েকটি নিবন্ধ লেখার জন্য সানফ্রানসিসকো নিউজের সঙ্গে স্টেইনবেক চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। নিবন্ধগুলো দ্য হারভেস্ট জিপসিজ শিরোনামে সানফ্রানসিসকো নিউজে ধারাবাহিক ছাপা হয়েছিল। ধারণা করা হয়, নিবন্ধগুলো লেখার সময় স্টেইনবেক যখন উদ্বাস্তু কৃষকদের ক্যাম্পে তথ্য আহরণের জন্য ঘন ঘন যাতায়াত করছিলেন, তখনই বুঝতে পারছিলেন নতুন উপন্যাসের রসদ তাঁর হাতের মুঠোয়। বাস্তবে তিনি সেই রসদকেই কাজে লাগিয়েছিলেন। ১৯৩৯ সালে বই আকারে বেরোনোর পর The Grapes of Wrath যুগান্তকারী উপন্যাস হিসাবে সাড়া জাগিয়েছিল। প্রকাশের প্রথম বছরেই চার লাখ তিরিশ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল।

এ গেল স্টেইনবেকের বইয়ের কাহিনি, কিন্তু অন্য যে কাহিনি এর সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িত তাকে দুঃখজনক বললে কম বলা হয়। স্টেইনবেকের বই বাজারে সবে এসেছে এমন সময় স্যানোরা বাব্ব নামে এক তরুণী একই বিষয়ের ওপর প্রকাশনা সংস্থা র‌্যানডম হাউজে একটি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি জমা দেন। Whose Names are Unknown নামে সে পাণ্ডুলিপিতে উন্নত সৃজনশীলতার ছাপ পেয়ে র‌্যানডম হাউজ বই করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পরপরই তারা যখন জানতে পারে স্টেইনব্যাকের সদ্যপ্রকাশিত উপন্যাস একই বিষয় নিয়ে, আর উপন্যাসটি বিক্রিও হচ্ছে প্রচুর, তাদের ধারণা হয় স্টেইনবেকের পাশাপাশি এই অনামা লেখকের পক্ষে বাজারে টিকে থাকা কঠিন হবে। ফলে বইয়ের প্রকাশ বন্ধ হওয়াই শুধু নয়, একজন কীর্তিমান লেখকের কারণে নবীন ও প্রতিশ্রুতিশীল অন্যজনের আত্মপ্রকাশের সম্ভাবনাও রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।

স্যানোরা বাব্বও সেই সময় তাঁর উপন্যাস লিখতে শুরু করে দিয়েছিলেন। তবে প্রকাশনা সংস্থা র‌্যানডম হাউজকে তিনি যখন পাণ্ডুলিপি পাঠান, ততদিনে স্টেইনবেকের উপন্যাসের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। ফলশ্রুতিতে র‌্যানডম হাউজ প্রথমে বই প্রকাশে সিদ্ধান্ত নিলেও, সে-সিদ্ধান্ত থেকে তারা সরে দাঁড়ায়। বাব্বের জন্য ঘটনাটি ছিল চরম হতাশার, আর সেই হতাশা বহুগুনে বেড়ে গিয়েছিল যখন দেখা গেল কোনো প্রকাশকই তাঁর উপন্যাস ছাপতে রাজি নন। বাব্ব এতটই মুষড়ে পড়েছিলেন, পরবর্তী কুড়ি বছর তিনি গল্প-কবিতা-নিবন্ধ লিখলেও উপন্যাসের পথে হাঁটেননি।

একই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হলেও দুই উপন্যাসের গল্প বা কাহিনিবিন্যাস যেমন আলাদা, তেমনি বয়ানভঙ্গিতেও রয়েছে লেখকদের যার যার শৈলীগত নিজস্বতা ও স্বাতস্ত্র্য। মোটা দাগে বলা যায়, স্টেইনবেক এখানে প্রচুর চিত্রকল্প ব্যবহারের মাধ্যমে গল্প বলাকে এক আলাদা মাত্রা দিয়েছেন, অন্যদিক বাব্ব তাঁর বর্ণনায় বাস্তবানুগতাকে সমাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। স্টেইনবেকের উপন্যাসে ক্যালিফোর্নিয়ার উপস্থিতি বেশি, বাব্বের উপন্যাসে ওকলাহোমার। একজন চরিত্র ধরে গল্প বলেছেন, অন্যজন বড় ফ্রেমে সে সময়ের আমেরিকার গল্প বলছেন। স্টেইনবেক লিখেছেন একটি সর্বস্বান্ত কৃষক পরিবাকে নিয়ে, অন্যদিকে বাব্ব লিখেছেন কয়েকটি পরিবারের অশেষ দুঃখ-কষ্ট ও তাদের উন্মুল, অনিশ্চিত জীবনকে নিয়ে।

এ প্রসঙ্গে আরও যা উল্লেখযোগ্য, স্টেইনবেক যেমন ডাস্ট বোলজনিত খরা ও দুর্ভিক্ষ পীড়িত উদ্বাস্তু কৃষকদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে প্রকৃত অবস্থা জানার চেষ্টা করেছিলেন, স্যানোরা বাব্ব চাকরির সূত্রে কৃষকদের বিভিন্ন উদ্বাস্তু ক্যাম্পে তাদের সাহায্যকারীর ভূমিকায় নানা কর্মকাণ্ডে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। সেখানে তাঁর অন্যতম কাজ ছিল বাস্তুচ্যুত কৃষকদের দেখভাল করা, বিশেষত তাদের শারীরিক-মানসিক অবস্থা, খাবারদাবার, অধিকারচেতনা ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার জন্য কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। সেই সঙ্গে অন্য যে কাজটি তিনি নিজ আগ্রহে করতেন তা ছিল গবেষণাধর্মী প্রতিবেদন ও ফিল্ড নোট তৈরি করা। সুতরাং, এটা ভাবা অস্বাভাবিক নয়, স্টেইনবেকের মতো তিনিও তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে প্রথম উপন্যাস রচনায় প্ররোচিত হয়েছিলেন। এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলোউভয়ে একই সময়ে মোটামুটি একই তথ্য-উপাত্ত নিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।

লিখতে বসে স্টেইনবেক ছয় মাসে তাঁর উপন্যাস শেষ করেছিলেন। ১৯৩৯ সালের এপ্রিলে বইটি বেরুনোর কয়েক মাস পর বছরের সবচেয়ে বিক্রিত বই হিসাবে গণ্য হওয়ার পাশাপাশি পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত হওয়ায় একে টেক্কা দিতে পারে এমন সিরিয়াস উপন্যাস সে সময় বাজারে ছিল না। উপন্যাসটিকে ভিত্তি করে চিত্র পরিচালক জন ফোর্ড সফল ছবি বানিয়েছিলেন যা নিঃসন্দেহে বইটির খ্যাতিবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।

পয়ষট্টি বছর বাদে ২০০৪ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ওকলাহোমা প্রেস বাব্বের হতভাগ্য উপন্যাস Whose Names are Unknown প্রকাশ করে। বাব্বের বয়স তখন সাতানব্বুই বছর। মনে হতে পারে, শেষ পর্যন্ত বইটির প্রকাশ দেখতেই তাঁর দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকা। বই বেরুনোর পরের বছর ২০০৫-এ তাঁর মৃত্যু হয়। বলা প্রয়োজন, উপন্যাসটির এই দীর্ঘ সময় আলোর মুখ দেখতে না পাওয়াকে অনেকের কাছে মনে হয়েছে একটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক ও অন্যায্য ঘটনা।

এদিকে স্যানোরা বাব্বও সেই সময় তাঁর উপন্যাস লিখতে শুরু করে দিয়েছিলেন। তবে প্রকাশনা সংস্থা র‌্যানডম হাউজকে তিনি যখন পাণ্ডুলিপি পাঠান, ততদিনে স্টেইনবেকের উপন্যাসের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। ফলশ্রুতিতে র‌্যানডম হাউজ প্রথমে বই প্রকাশে সিদ্ধান্ত নিলেও, সে-সিদ্ধান্ত থেকে তারা সরে দাঁড়ায়। বাব্বের জন্য ঘটনাটি ছিল চরম হতাশার, আর সেই হতাশা বহুগুনে বেড়ে গিয়েছিল যখন দেখা গেল কোনো প্রকাশকই তাঁর উপন্যাস ছাপতে রাজি নন। বাব্ব এতটই মুষড়ে পড়েছিলেন, পরবর্তী কুড়ি বছর তিনি গল্প-কবিতা-নিবন্ধ লিখলেও উপন্যাসের পথে হাঁটেননি।

মন্দের ভালো বলতে হবে, পয়ষট্টি বছর বাদে ২০০৪ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ওকলাহোমা প্রেস বাব্বের হতভাগ্য উপন্যাস Whose Names are Unknown প্রকাশ করে। বাব্বের বয়স তখন সাতানব্বুই বছর। মনে হতে পারে, শেষ পর্যন্ত বইটির প্রকাশ দেখতেই তাঁর দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকা। বই বেরুনোর পরের বছর ২০০৫-এ তাঁর মৃত্যু হয়। বলা প্রয়োজন, উপন্যাসটির এই দীর্ঘ সময় আলোর মুখ দেখতে না পাওয়াকে অনেকের কাছে মনে হয়েছে একটি অত্যন্ত পীড়াদায়ক ও অন্যায্য ঘটনা। এত বছর পরও উপন্যাসটির উন্নত সৃজনশৈলী পাঠককে এ কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে, স্যানোরা বাব্বের মতো পরিশ্রমী ও গুরুত্বপূর্ণ লেখকের পরিচিতি অনেক ব্যাপক হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল, আর তা হতে পারত যদি বইটি সময়মতো প্রকাশ পেত। সমালোচকদের অনেকের মতে, স্টেইনবেকের উপন্যাসের তুলনায় বাব্বের উপন্যাসে বাস্তবানুগতা ও ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণের ছাপ অনেক প্রগাঢ়। নিজের বই নিয়ে বাব্ব বরাবরই উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। ২০০৪ সালে বই প্রকাশের পর শিকাগো ট্রিবিউনকে এক সাক্ষাতকারে স্টেইনবেকের বইয়ের তুলনায় তাঁর বইটি যে তাঁর বিবেচনায় সুলিখিত ও অধিক বাস্তবানুগ এ কথা জানাতে দ্বিধা করেননি।

মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে বইয়ের প্রকাশ বাব্বের জন্য কতটা সুখকর ছিল, আদৌ ছিল কি না জানা না গেলেও, ইদানীং যখন বইটি নিয়ে আলোচনা হয়, অনেকেই ঘটনাটাকে দেখেন একজন খ্যাতিমান পুরুষ লেখকের ছায়ায় একজন অনামা মেয়ে লেখকের অন্তর্ধান হিসাবে।