অক্ষর ও বালির পৃথিবীতে আপনাকে স্বাগতম

অ+ অ-

 

অক্ষর ও বালির পৃথিবী
রথো রাফি
প্রচ্ছদ: এনায়েত ইসলাম
প্রকাশক: আনন্দম
মূল্য ৬৮০ টাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২০

পোস্টকলোনিয়্যাল তাত্ত্বিক হিসেবে পরিচিত কেনিয়ান লেখক নগুগি ওয়া থিয়োংগো এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তিনি ভয় পান লিখতে অক্ষম হওয়াকে। হঠাৎ কোনো কারণে যদি লেখকের কলম থেমে যায়, ভাষায় ভাটার টান পড়ে তবে তাঁর জন্য এরচেয়ে যন্ত্রণার আর কি হতে পারে!  

জীবনের কোনো এক পর্যায়ে লেখক অন্ধ হয়ে যেতে পারেন, হারিয়ে যেতে পারে তার আঙুলের শক্তি। তাই বলে কী তিনি লেখা বন্ধ রাখেন! কল্পনার জগতে তার যে অসংখ্য চোখ! সেই চোখ দিয়েই তো লিখেছিলেন হোর্হে লুইস বোর্হেস। অন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও লেখার টেবিলে প্রলয় বন্ধ করেননি। লেখক জানেন, বাস্তব দেখার চোখে ছানি পড়লেও স্মৃতি ও কল্পনার বিশাল সমুদ্র তাঁকে দেবে অসংখ্য মনি-মুক্তো। শব্দের ঘ্রাণের কাছে লেখক যে আজীবন শেকলে বাধা দাস! এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল রথো রাফির মহাশূন্যতার ঢেউকবিতার কয়েক লাইন, শব্দের ঘ্রাণ কী যে অদ্ভূত/ তাদের ফাঁকে ফাঁকে এসে বাসা বাঁধে জীবন/ মহাকালের ঢেউ আছড়ে পড়ে বিরামহীন/ আমাদের চেতনার সৈকতে।   

লেখকের কাছে অক্ষর হলো মুক্তো। ঝিনুকের মতো মুখ বুঝে সেই তো মুক্তো ফলায়। অর্থ নয়, র্কীতি নয়, সচ্ছলতা নয়লেখকের কাছে অক্ষর সবসময় আরও এক বিপন্ন বিস্ময় হয়ে তাঁর অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে। সব পেশাতেই একদিন অবসর আসে, কিন্তু সৃজনশীল মানুষের অবসর কোথায়! লেখালেখির এমন এক মাফিয়া জগত চাইলেও সে বেরিয়ে আসতে পারে না। না লিখলেও দিনের কোনো না সময় সে শব্দবিচ্ছেদের যন্ত্রণায় হাহাকার করে। তার ছুটি নেই। লেখকের কাছে তাঁর দুনিয়াটা অক্ষরের পৃথিবী। আজ আপনাদের তেমন এক দুনিয়ার কথায় বলব। রথো রাফির অক্ষর ও বালির পৃথিবী

এ যেন এক বিশাল ক্যানভাস জুড়ে ধ্যানমগ্ন শিল্পীর রঙতুলির সুপ্রশিক্ষিত আঁচড়। রথো রাফি আত্মমগ্ন কবি। ১৯৯৯-২০১৯ পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছরের কবিতা যাপনের সোনালি ফসল তাঁর বিপুল আয়তনের ৪৩২ পৃষ্ঠার বইটি। রয়েছে দুইশোর্ধ্ব কবিতা, যা আবার সাত শিরোনামে বিভক্ত। বাংলা ভাষার কোনো কবিতার বই সচরাচর এত ঢাউশ আকারের হয় না। এত বিপুল কবিতাও দুই মলাটে অচিন্ত্যনীয়। সংকলন বা কোনো কবির শ্রেষ্ঠ কবিতার আয়োজন অবশ্য আলাদা। বইটির চমৎকারিত্ব এখানেই শেষ নয়। রথো রাফির দীর্ঘ দুই দশকের কবিতা ভ্রমণের স্বাদ পাওয়া যায় বইটির প্রতি উজ্জ্বল পাতায়। প্রতিটি শব্দের ভেতরটা যেন একেকটি সুড়ঙ্গ হয়ে কোনো নেশাতুর অভিযাত্রীকে ডাকছে আরেকটি নতুন ভ্রমণের গল্প শুনতে।

রথো রাফির কবিতা মূলত বোধের মর্মমূল ছিঁড়ে ধেয়ে আসা গান। আর কে না জানে, বোধের উৎসারিত প্রতিটি শব্দই কবিতার প্রধান উপাদান। ডানা যেমন পাখি হওয়ার পূর্বশর্ত তেমনি কল্পনাবিহীন কবিতা হয় না। এ বইয়ের তিক্তমাধুর্যের সুর কবিতাটি আমার অত্যন্ত প্রিয়। বইটি খুলে এ-পাতা ও-পাতা করে কয়েকটি কবিতা পড়ার পর এটি নজরে পড়ে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবগতভাবে পাতা ডগইয়ার করে রেখেছিলাম। টানা গদ্যে লেখা কবিতাটি এখানে পুরোপুরি তুলে দেওয়া গেলে ভালো লাগত। কিন্তু সেটি যখন সম্ভব নয়, শেষ স্তবকটি দিলাম, সে যদি দূরে যায়, আগের মতোই বিশ্বাস রেখো, ‍দুটি ডানা রয়েছে তার, উড়ে আসতে পারে আবার! বলো, ডানা ছাড়া কে পাখি হয়! তুমিও তো পাখিই ভালোবাসো! আর পাখি মাত্রই উড়ে আসে, বসে, উড়ে যায়। লক্ষ করো, কি না করো, প্রতি মুহূর্তে ও চিরকাল তা-ই ঘটছে! মনে রেখো ডানা যা হতাশার, তা-ই আশার!

অক্ষর ও বালির পৃথিবীতে রথো রাফি বিভিন্ন পথে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তাঁর কবিতার স্বর অনুচ্চগ্রামের। টানা গদ্যে সিদ্ধহস্ততা লক্ষ্যণীয়। ছন্দের বাড়াবাড়ি নেই এবং সবচেয়ে আকর্ষনীয় হলো পরিমিতিবোধ। নির্মেদ, নিজস্ব ধ্যান ও বয়ানে ভাবনার জগত চিত্রিত করেছেন। তাঁর কবিতা প্রাঞ্জল নয়, অপ্রাঞ্জলতা মানে সরল নয়। এক নিজস্ব সুরে কথাকে জড়িয়েছেন তিনি। কবির প্রাথমিক দিক হলো, সর্বপ্রেম। সেই সর্বপ্রেমে তিনি বস্তুতেও প্রাণসঞ্চার করেন। কবি মণীন্দ্র গুপ্ত বলতেন, কবিতা জীবন্ত শিল্প। জীবন্ত এই কারণে, একটি অনন্য কবিতা পাঠ আরেক কবিকে নতুন সৃষ্টিতে উৎসাহিত করে। রথো রাফির কবিতাও তেমন। তিনি বস্তুর ভেতরেও প্রাণ সঞ্চার করে কয়েক হাজার বছরের মানব সভ্যতার নিদারুণ সত্যকে এঁকেছেন এভাবে, রক্ত চেটে চেটে তলোয়ারের জিভ ক্লান্ত তখন/অগণন মৃত্যুতে তুমুল লাল হয়ে গেছে কুরুক্ষেত্র/আর ওই আদিগন্ত রক্তের কার্পেটে সূর্য ঢেলে দিচ্ছে তার অশেষ গোধুলি! (গোলাপ)

অক্ষর ও বালির পৃথিবী ভ্রমণ আপনি যেকোনো জায়গা থেকে শুরু করতে পারবেন। আদতে কবিতার বই এমনই। প্রতিটি পাতায় নতুন দৃশ্যপট ও নতুন চিন্তা। এ শুধু একার যাত্রা। নিজের সঙ্গে কথা বলে বলে কোনো এক গন্তব্যে পৌঁছানোর অপেক্ষা। কিন্তু শেষ বলে তো কিছুই নেই। যেখানে পাহাড়ী রাস্তাটি শেষ হলো, তার পরেই সমুদ্রে যাওয়ার বালির রাস্তা। রথো রাফির কবিতাও তেমনি, তর্ক এগিয়ে চলে ক্রমশ তর্কাতীত পথের দিকে এমন একটা আশা নিয়ে ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে ভাবি, আমরা নই, তর্কই শেষ হয়ে এলো এবার! [তর্ক]

রথো রাফি পড়ন্ত ৯০ দশকের কবি। এ সময়ের কবিদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো দেখার বহুরৈখিকতা। সময়ের সঙ্গে চিন্তার গতিকে মিলিয়ে নেওয়া। রথো রাফির কবিতা নিজের সময় ছুঁয়ে আরও বহুদূর গড়িয়েছে। তাঁর কণ্ঠস্বর মূলত সাম্যের, হোক হিন্দু, হোক বৌদ্ধ/ ইহুদি, খ্রিষ্টান, কিংবা মুসলিম, কী আসে যায়/ যখন ভাবি প্রতিটি দেশেই আছে/ বিশাল সেনাবাহিনী/ প্রতিটি দেশেই আছে প্রচুর দরিদ্র মানুষ/ প্রতিটি দেশই ভাবে/ বাকি সব দেশ নেহাতই দূরের বিদেশ। [কী আসে যায়]

ঢাউশ আকারের কবিতার বই পড়ার কিছু ঝামেলা যে নেই তা নয়। টানা পড়ায় বাধা দেয়। এদিক ওদিক মন দৌড়ে। অনেক সাধারণ কবিতার ভিড়ে ভালো ও অসাধারণ কবিতাগুলো লুকিয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে কবিকে দোষ দিতে চাই না। বরং পাঠককে বলতে চাই, সেসব মনি-মুক্তো নিজের তাগিদে খুঁজে নিতে। রথো রাফির তেমন এক কবিতার আশ্চর্য করে দেওয়া কয়েকছত্র এখানে, দূরত্ব হেতু নক্ষত্রকেও কত তুচ্ছ মনে হয়/ আর প্রেম, হায়, কী গভীর ও ব্যাপক হয়ে ওঠো! [দূরত্ব]

রথো রাফির কবিতা বিষয় বৈচিত্র্যে ভরপুর ও লিরিক্যাল। তেমনি তাঁর হৃদয়ে বাস এক নিরীহ প্রেমিকের। কবি মাত্রই রোমান্টিক সে তো চতুর্পাশে সর্বজনবিদিত। তবুও প্রকাশের ভিন্নতা মানুষকে আলাদা করে দেয়। সেই ভিন্নতা আমরা দেখি তাঁর দহন নামের কবিতায়, প্রবল হরিণ এক/ আঁকাবাঁকা শিংয়ের/ আঘাতে আঘাতে/ প্রেমিক বাঘটিকে/ ফেলো দিলো/ জলের কাদায়।/ স্বপ্নের এই একটুকরো/ সফলতা/ মেঘলা করে রাখে/ তার আকাশ/ সারাটাদিন।/ ধ্বস্ত নিরীহ বাঘের/ চোখ দুটি/ মনে হলো/ আরো কী মায়াবী!

বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, যে কবিতার দুটি পঙ্‌ক্তিও পাঠযোগ্য সেটি ভালো কবিতা। তিনি কেন এমনটা বলেছিলেন, সেই প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তবে এমন ঢালাও মন্তব্য অবশ্য অনেক সময় জেনুইন পোয়েটকে তাঁর যথার্থ মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়। রথো রাফির কবিতা টোটালিটির দিকে ঝুঁকেছে। সেখানে এক-দুই লাইনের চমক নেই। তাঁর প্রতিটি যথাযথ শব্দচয়ন ও বিন্যাস আগ্রহ জাগানিয়া। প্রতিটি কবিতা শেষ পযর্ন্ত পড়ার চূড়ান্ত দাবি রাখে। সেই পাঠ নিয়ে কবিকে শেষ পর্যন্ত ফিরতে হয় টেবিলে। একজন লেখকের কাছে তার টেবিলই সবচেয়ে কাছের সঙ্গী। শেষরাতের টেবিলে বসে রথো রাফিও মুগ্ধ হয়ে জানতে চাচ্ছেন টেবিলের কাছে, একটা একা টেবিল কী দিতে পারে?/ একটা সঙ্গহীন শরীর?/ একটা একাকী সময়/ কিংবা সাদা কাগজ? বিস্মৃতিভরা ভুবন?/ অক্ষরগুলো যখন/ কিছুই বহন করে না আর?