হুমায়ূন আহমেদের আউটসাইডাররা
আলবেয়ার কামু ‘আউটসাইডার’ শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। তাঁর ‘আউটসাইডার’ উপন্যাসে আউটসাইডার মারসো বাইরে থেকে আসা কোনো আগন্তুক নয়, বরং মনোগত-আচরণগত দিক থেকে অপরাপর সামাজিক মানুষের চেয়ে আলাদা, তাই সে আউটসাইডার বা স্ট্র্যাঞ্জার বা আগন্তুক। হুমায়ূন আহমেদ যেসব স্ট্র্যাঞ্জার সৃষ্টি করেছেন তারা একইসঙ্গে রূপকার্থে ও আক্ষরিক অর্থে স্ট্র্যাঞ্জার; তারা দৃশ্যমান বহিরাগত, আবার তাদের মনোজগতও ভিন্নতর। আলবেয়ার কামুর মারসো যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত, যার কাছে ভালোবাসা-প্রেম-মানবিকতা স্রেফ ভণ্ডামি, যার কাছে নিহিলিজমই জীবনের মূল সুর। মানুষ, মারসোর কাছে, অন্য কোনো প্রাণির চেয়ে পৃথক নয়, শ্রেষ্ঠ নয়, স্রেফ একটা প্রাণিবিশেষ; বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন কোনো প্রাণীও নয়। মারসোর কাছে তিরিশ বছরে মরা আর সত্তর বছরে মরার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বিয়ে, মারসোর মতে, স্রেফ একটা গতানুগতিক সামাজিকতা রক্ষা; ভালোবাসা বলতে আসলে কিছু নেই জগতে। নিজের মায়ের মৃত্যু নিছক একটি ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। মারসোর কাছে ধর্মের কোনো মূল্য নেই, পরকালের প্রশ্ন তার কাছে অবান্তর; পরকাল ভাবনা তার কাছে কখনো কখনো এসেছে ঐহিক সুখ কামনার মতো, এর বেশি কিছু নয়। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া মারসোর বক্তব্য পাদরিকে উদ্দেশ করে—‘আমার সময় বেশি নেই এবং যেটুকু আছে সেটুকু আমি ঈশ্বরের পিছে নষ্ট করতে রাজি নই।’ [আলবেয়ার কামু: দি আউটসাইডার, অনুবাদ: মুনতাসীর মামুন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা, চতুর্থ মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০১০, পৃষ্ঠা ৮৬] অন্যদিকে হুমায়ূন আহমেদের আউটসাইডাররা একান্তই বাংলাদেশি, তারা দেশীয় বোধ-বুদ্ধি-প্রেম-ভালোবাসায় জারিত-সিক্ত হয়, নিস্পৃহভাবে তারা ভালোবাসে এবং ভালোবাসা নেয়, পৃথিবীর নশ্বরতা ও মায়া-মমতার অস্থায়িত্ব তাদের মনে সার্বক্ষণিক জেগে থাকে, তাই ভালোবাসা না পেলেও তারা সেই অপ্রাপ্তি মেনে নেয় স্বাভাবিকভাবে। আলবেয়ার কামুর ‘আউটসাইডার’ প্রথাগত আবেগ-অনুভূতিকে জয় করতে পারা এক অতিমানব। কামু প্লেটোনিক লাভের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন ‘আউটসাইডার’ দিয়ে; অন্যদিকে হুমায়ূন আহমেদের গল্পে-উপন্যাসে পাওয়া যায় প্লেটোনিক লাভ। আলবেয়ার কামুর আউটসাইডার ছদ্ম-ভালোবাসার পৃথিবীতে এসে ঘোষণা করে—‘ভালোবাসা নেই’। হুমায়ূন আহমেদের আউটসাইডার ভালোবাসা-মায়া-মমতা মাখানো পৃথিবীতে, যেখানে মানবিকতার ঘাটতি দেখতে পায়, সেটা পূরণ করার জন্যই যেন আবির্ভূত হয়ে জানান দেয়—‘ভালোবাসাই জীবনের মূল সুর’। দু’প্রকার আউটসাইডারের গতিপথ কখনো কখনো বিপরীতমুখী।
হুমায়ূন আহমেদের নানা লেখায় দেখা দেয় আউটসাইডাররা। ‘অচিনপুর’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র রঞ্জু মানবিক-আখ্যানের গল্পকার, একান্নবর্তী পরিবারটিতে সে বড় হয় একজন আউটসাইডারের মতো; মনোগত দিক থেকে, আবার পরিবারের কেউ নয়—এই অর্থেও। তার বোন লিলির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর পরিবারটিতে তার আপন বলতে কেউ থাকে না, আগের চেয়েও বেশি আশ্রিতের মতো সে বাঁচতে থাকে নবু মামা, বাদশা মামা, নীল মামীদের সঙ্গে। হুমায়ূন আহমেদের আউটসাইডারদের আছে নিয়ন্ত্রিত আবেগ, আলবেয়ার কামুর আউটসাইডারের মতো তারা নিস্পৃহ খুনি নয়, কিংবা প্রথাগত আবেগ-অনুভূতিশূন্য মানুষ নয়। আলবেয়ার কামুর মারসো প্রথাগত মানবিকতা ও ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে নিস্পৃহ হতে পেরেছে, যাবতীয় মহাপুরুষত্বের ভান বিসর্জন দিয়ে সত্যিকার মহাপুরুষ হতে পেরেছে। যার ফলে নিজ মায়ের মৃত্যু তাকে আর দশজনের মতো আবেগ-তাড়িত করে না বা আবেগ-তাড়িত হওয়ার ভান করায় না। এক আরব যুবককে খুন করে অসামান্য নিস্পৃহতায়, আর এই খুনও তার মধ্যে কোনো অপরাধবোধ জাগাতে ব্যর্থ হয়। হুমায়ূন আহমেদের আউটসাইডাররা বাঁধনহারা, আপাত নিস্পৃহ এই মানুষগুলো প্রকৃতপক্ষে আর দশজনের চেয়ে উচ্চতর অনুভূতির চাষ করে; তাদের ভালোবাসা বন্ধনহীন, প্রেম পরিণতিহীন, চলে যাবার জন্যই তাদের আগমন ঘটে। রঞ্জু ‘অচিনপুর’ উপন্যাসে এমনই এক ভালোবাসতে পারা আউটসাইডার।
হুমায়ুন আহমেদের সৃষ্ট নানা চরিত্রে রঞ্জুর মতো এমনই আগন্তুক দেখা যায় যারা পরিবারের কেউ নয়, কিন্তু পরিবারের সঙ্গে মেশে পরিবারের মূল সদস্যদের মতোই; এবং একসময় হারিয়ে যায় এমনভাবে যেন সে কোনোদিন এই পরিবারের কেউ ছিলো না। হুমায়ূন আহমেদের ‘হিমু’ চরিত্রটি এমনই এক আলবেয়ার কামুর মারসো; তবে চরিত্রটি সিরিয়াস নয়, বরং কমিক; তাই পাঠকের কাছে হিমুর আউটসাইডার-টাইপ দর্শন প্রাধান্য পায় না, প্রাধান্য পায় হিমুর নানাবিধ পাগলামি। নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক ‘নক্ষত্রের রাতে’ও একজন আউটসাইডার ছিলো, ‘দুই দুয়ারী’ চলচ্চিত্রেও আছে এমন এক ‘রহস্যমানব’, যারা একটি পরিবারের সঙ্গে এমনভাবে মিশে যায় যেন তারা এই পরিবারেরই একজন; আবার তারা যখন চলে যায় তখন আমরা বুঝতে পারি তারা কেউ না, আক্ষরিক অর্থে ও মনোগত অর্থে এক আগন্তুক।
হুমায়ূন আহমেদের ‘একা একা’ উপন্যাসের বাবুভাইয়ের সঙ্গে কিংবা টগরের সঙ্গে আরেক দফা তুলনা চলতে পারে আউটসাইডার মারসোর। মারসো যে বাসায় বাস করে সে বাসা নোংরা, সেখানকার ভাড়াটিয়ারা নোংরা, আছে বিশ্রি লোমওঠা এক কুকুর, আছে ততোধিক বিরক্তিকর এক বৃদ্ধ সালামানো, বেশ্যার দালাল বলে পরিচিত রেমন্ড; কিন্তু মারসোর কাছে কিছুতেই কিছু আসে যায় না। সে বেঁচে আছে এক অর্থহীন বাঁচায়। কুকুর চলে যাওয়ায় বৃদ্ধ সালামানো কাঁদে, আর কুকুরের জন্য সালামানোর কান্না মারসোকে মনে করিয়ে দেয় নিজের মায়ের কথা। মারসোর বন্ধুনি মারি যখন তাকে জিজ্ঞেস করে সে তাকে ভালোবাসে কিনা তখন মারসো জবাব দেয় এরকম প্রশ্নের কোনো অর্থ হয় না। মারসোর মতোই ‘একা একা’ উপন্যাসের বাবুভাইয়ের রয়েছে একটি দৃঢ় মন ও মনন, যেখানে নাকিকান্নার কোনো আশ্রয় নেই, আছে মৃত্যুকে সমীহ করেও সেটা বরণ করে নেবার মতো দৃঢ় মানসিকতা। বাবুভাইয়ের কথা খুব গোছানো, আচার-আচরণ যুক্তিযুক্ত, তার মধ্যে আবেগের ভান নেই। দাদার মৃত্যু সন্নিকটে, বাবুভাই তখন কিংস্টোনের গান শোনে, ব্লাক টাওয়ার খায়, নিজ রুমের করিডরের বাতি খুলে ফেলে রুম অন্ধকার করে রেখে বড়চাচার সঙ্গে ভূত-ভূত খেলে, মগবাজারের ধূর্ত ফুফুর সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যায় এমনভাবে যাতে ফুফু অসম্মানিত না হয়েও অপমানিত হয়, বাড়িতে আসা মাওলানার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে । মারসোর মতোই বাবু ভাইয়ের রয়েছে গৎবাঁধা প্রেম-ভালোবাসার প্রতি তীব্র উষ্মা।
মারসো নির্দ্বিধায় খুন করে ফেলে এক আরবকে, কোনো অনুশোচনাও নেই এই নিয়ে তার মধ্যে। একই ব্যাপার দেখা যায় ‘একা একা’ উপন্যাসের টগরের মধ্যেও। দুর্বল লোকদের প্রতি কঠিন হতে টগরের ভালো লাগে, রমিজ সাহেবকে অপমান করে টগর আনন্দ পায়, বুড়োবুড়ি দেখতে পারে না একদম, টগরের কাছে ‘বৃদ্ধরা অসুন্দর বুদ্ধিহীন নারীর চেয়েও বিরক্তিকর’। [হুমায়ূন আহমেদ: উপন্যাস সমগ্র, প্রথম খণ্ড, অষ্টম মুদ্রণ আগস্ট ২০১৮, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, পৃষ্ঠা-৩৯৬] মানুষের স্বরূপ সম্পর্কে টগরের বোধ—
রমিজ সাহেব কি ইচ্ছে করেই মেয়েকে আমার কাছে পাঠান? তাঁর কি একবারও মনে হয় না যে, আমি নীলুকে অনায়াসে বলতে পারি, ‘টাকা দিচ্ছি, কিন্তু তার আগে দরজাটা ভেজিয়ে দে তো নীলু।’ আমি কোনো মহাপুরুষ নই। পৃথিবীর কোনো পুরুষই নয়। মহাপুরুষদের পাওয়া যায় ধর্মগ্রন্থে। [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৭৬]
টগর যেমন মহাপুরুষ নয়, বাবু ভাইয়ের আচরণেও ভালোমানুষ হবার জন্য আলাদা অর্জিত ভণ্ডামি নেই; সহজাত আবেগ একজন মানুষের মধ্যে যতটুকু থাকা স্বাভাবিক, এরা ততটুকুই ধারণ করে। সাধারণ মানুষ হয়েও নিজের ভিতরে মহাপুরুষত্ব ধারণ করার ছায়া-চেষ্টা থেকে টগর এবং বাবু ভাই নিজেদের, মারসোর মতোই, মুক্ত করতে পেরেছে। টগর কিংবা বাবুভাই দেখতে পায়, মগবাজারের ফুফু একটা ধূর্ত মহিলা, কিন্তু ভান করে থাকে অবুঝ মেয়েমানুষের মতো; আরও দেখে তাদের বড়চাচাকে, সংসারে যার মূল্য সামান্যই, কিন্তু অসামান্য হওয়ার জন্য তার কি তীব্র আস্ফালন। উপন্যাসের সবচেয়ে গৌণ মানুষটি রমিজ মিয়া, সারা উপন্যাস জুড়ে যাকে দেখে মনে হয়েছে তার মান-সম্মানের বালাই নেই মোটেও; সেই রমিজ মিয়াকে উপন্যাস শেষে তীব্র অপমানবোধে পাগল হয়ে যেতে দেখা যায়, বৃত্তি পাওয়া মেয়ের গর্বে রমিজ মিয়া ‘সামান্য দীন ভাড়াটে’ [হুমায়ূন আহমেদ: উপন্যাস সমগ্র, প্রথম খণ্ড, অষ্টম মুদ্রণ আগস্ট ২০১৬, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, পৃষ্ঠা ৩৪৮] থেকে হয়ে ওঠেন ‘এক জন অহংকারী বাবা’ [প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৪৮], অবশেষে হয়ে ওঠে একজন মূখ্য মানুষ। টগরের বাবা রহমান সাহেবের মধ্যে গাম্ভীর্য আছে, তাকে দেখলে বাড়ির সবাই সমীহ করে। টগরের বাবার মধ্যেও মারসোর মতোই এক নির্মম নিস্পৃহতা লক্ষ করা যায়। হুমায়ূন আহমেদ বলতে চান মানুষ নানাবিধ ভান করে, আর সেই ভানের মুখোশটি সরিয়ে নিলে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে সেই মানুষটির সত্যিকার চরিত্র।
কামুর বাবা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারান সৈনিক হিসেবে, মা ছিলেন প্রতিবন্ধী, নির্মম দারিদ্র ছিলো তার বাল্যসঙ্গি। জীবনের নির্মমতার মধ্য দিয়ে তাঁর শৈশব পার হয়েছে। মারসোর মেজাজ আলোচনায় এই তথ্যগুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে। কামু মনে করতেন এই জীবনের কোনো অর্থ নেই, কোনো মানে নেই। মানে এবং অর্থ না থাকার জন্য ‘The Myth of Sisyphus’–এ তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন যে এই অর্থহীন জীবন থেকে বাঁচার উপায় আত্মহত্যা কিনা; এবং সমাধান দিয়েছিলেন নিজেই- আত্মহত্যা নয়, বরং উৎকট জীবনের জঞ্জালকে টেনে নেওয়াই একমাত্র সমাধান [‘আলবেয়ার কামু: দ্যা ফার্স্ট ম্যান উইদিন অ্যাবসার্ডিটি’ সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দার, ২৯ আগস্ট, ২০২০, অনলাইন পত্রিকা ‘অধিকার’-এ প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে]। জীবনের যেখানে কোনো অর্থ নেই সেখানে প্রেম-ভালোবাসা-বিরহ-মায়া-মমতার কোনো নান্দনিক স্বরূপ থাকার কথা নয়। ‘একা একা’ উপন্যাসের চরিত্রগুলোও দাদার আসন্ন মৃত্যুর অপেক্ষায় আছে। অন্যের মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা টগরের মধ্যে, বাবু ভাইয়ের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে মৃত্যুচেতনাবোধ। তাদের মধ্যে মৃত্যুর ভয় ক্রিয়াশীল নয়, কিন্তু অনিবার্য পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবার জন্য যে দুঃখবোধ তা তাদের তাড়িত করে বেড়ায়। মৃত্যু কেউ একসেপ্ট করে না, বাধ্য হয়ে স্বীকার করে নেয়। মারসো গিলোটিনের নিচে মাথা দেবে। এটা অনিবার্য পরিণতি। তার মৃত্যুর পর পৃথিবীর কোনোকিছুই বদলাবে না। কিংবা যদি মারসোর বন্ধুনি মারিও ইতোমধ্যে মারা গিয়ে থাকে তবেও মারসোর কিছু আসে যায় না। কারণ মারির মৃত্যুতেও পৃথিবীর কোনোকিছুই বদলাবে না, যেমন বদলায় নি মারসোর মায়ের মৃত্যুতে।
‘প্রথম প্রহর’ উপন্যাসের ফরিদের মধ্যে আছে যুগপৎ আলবেয়ার কামুর মারসোর মতো প্রথাগত আবেগহীনতা আর বাঙালি আবেগ-ভালোবাসা। হুমায়ূন আহমেদ মমতাময় শিল্পী, প্রেমের মায়া-মমতার জয়গানই তিনি শেষপর্যন্ত করেন। ফরিদের মধ্যে যে আপাত নিস্পৃহতা দেখা যায় তার কারণ তার পারিবারিক ভঙ্গুরতা, দারিদ্র আর ডুওডেনালের টিউমার। ফরিদ মৃত্যুপথযাত্রী, তার মা মারা গেছে, ভাইদের সঙ্গেও তেমন যোগাযোগ নেই, বাবা এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়ান অন্ন ও স্থানের জন্য—এসব মিলিয়ে ফরিদের আচরণে রুক্ষতা ও ভালোবাসাহীনতা চলে আসাটাই স্বাভাবিক। ফরিদও আবেগবর্জিত যুক্তিবাদী মানুষে পরিণত হয়েছে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে। তাই ফরিদের অন্তকরণে আছে আবেগের বদলে যুক্তি, বিশ্বাসের বদলে সত্যাসত্য যাচাইয়ের প্রয়াস। মৃত্যুপথযাত্রী ফরিদ বন্ধু মনসুরের আদর-আপ্যায়নের আতিশয্য কিংবা ডাক্তারের ফি না নেওয়াকে সন্দেহের চোখে দেখে। নিজ মা সম্পর্কে ফরিদের উপলব্ধি ‘আউটসাইডারের’ মারসোকেই হুবহু মনে করিয়ে দেয়—
সংসারে কারো জন্যেই আমার বিশেষ কোনো টান নেই। মা মারা যাবার তিন দিনের দিন আমি স্কুলের অন্য সব ছেলেদের সঙ্গে পিকনিকে গিয়েছিলাম। সেখানে মায়ের কথা এক বারও মনে হয়নি। আমরা সবাই বোধহয় নিজেদের জন্যেই বাঁচি। জুবায়ের সাহেব যদি সত্যি-সত্যি মারা যান, আমার কি খুব খারাপ লাগবে? সাপের মতো লম্বা ফর্সা একটা মানুষ মারা গেলে আমার কী যায় আসে? শুধু আমার কেন, এ জগতের কারোরই কিছু যায় সে না। এ্যানি নামের এই চমৎকার মেয়েটি হয়তো কিছু দিনের ভেতরেই সুস্থ সবল একটি ছেলেকে বিয়ে করবে। [হুমায়ূন আহমেদ: উপন্যাস সমগ্র, দ্বিতীয় খণ্ড, ষষ্ঠ মুদ্রণ আগস্ট ২০১৮, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, পৃষ্ঠা ৪৯]
ফরিদের নির্মম পৃথিবীতে আউটসাইডার মারসো উপস্থিত হয়। মারসো মায়ের মৃত্যুর খবরে বিচলিত হয় না, মারসোকে যখন মৃত মায়ের বয়স জিজ্ঞেস করা হয় সে বলতে পারে না, মায়ের কফিনের পাশে বসে সিগারেট খায়, কফি খায়, তার চোখে পানি আসে না, অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া শেষে আলজিয়ার্সে ফিরে গিয়ে সে হাঁফ ছাড়ে, মায়ের মৃত্যুর পরেরদিন বন্ধুনি মারিকে নিয়ে সাঁতার কাটে, কমেডি ঘরানার সিনেমা দেখে। ফরিদও মায়ের মৃত্যুর তিনদিনের মাথায় পিকনিকে যায়। ফরিদ উপলব্ধি করে, একটি জীবন অন্য একটি জীবনের মৃত্যুর জন্য থেমে থাকে না। বিচ্ছেদে কষ্ট আছে, কিন্তু সে কষ্ট চিরস্থায়ী নয়, বরং নির্মমভাবে ক্ষণস্থায়ী। একজন মানুষ কখনো আরেকজন মানুষের জীবনে অপরিহার্য নয়, তাই চিরবিদায়ের দুঃখও চিরস্থায়ী নয়। আউটসাইডার থেকে—
আরেকটা রোববার কোনোরকমে কাটিয়ে দিলাম। মাকে কবর দেয়া হয়ে গেছে এবং কাল থেকে আমি আবার আগের মতো অফিস যেতে শুরু করব। সত্যি, আমার জীবনের কিছুই বদলায়নি। [আলবেয়ার কামু: দি আউটসাইডার, অনুবাদ: মুনতাসীর মামুন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা, চতুর্থ মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০১০, পৃষ্ঠা ২২]
হুমায়ূন আহমেদের নায়কেরা আলবেয়ার কামুর তৈরি আউটসাইডার নয়, তাদের চরিত্রে আপাত নিরাবেগের পাশাপাশি আবেগের মূলস্রোত বহমান। তাদের ভালোবাসা ও প্রেম নিস্পৃহতার মুখোশে ঢাকা থাকে। ফরিদের মধ্যেও প্রেম আছে, জেসমিন নামের মেয়েটির অস্তিত্ব সে অনুভব করে। উপন্যাসের শেষে ফরিদের অব্যক্ত ভালোবাসার কথা অন্তিম স্বীকারোক্তির মতো শোনা যায়—
আমি সবাইকে ভালোবাসি। এই কথাটি কখনো কাউকে বলা হয় নি। আমাকে বলার সুযোগ দিন, আমার প্রতি দয়া করুন। [হুমায়ূন আহমেদ: উপন্যাস সমগ্র, দ্বিতীয় খণ্ড, ষষ্ঠ মুদ্রণ আগস্ট ২০১৮, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, পৃষ্ঠা ৫৬]
‘নক্ষত্রের রাত’ উপন্যাসের পাশা চরিত্রটি যেন হিমু চরিত্র সৃষ্টির প্রেক্ষাপট। পাশা চরিত্রে আছে হিমুর মতোই অনেকটা আপাত যুক্তিহীনতা। যুক্তরাষ্ট্রে বাসকারী পাশা এক গ্রিনকার্ডবিহীন এলিয়েন, পুলিশি ঝামেলার ভয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ানো এক শেকড়হীন মানুষ। ফুড ডিপার্টমেন্টের হেডক্লার্ক নিজাম চৌধুরীর ছেলে পাশার আছে পারিবারিক অশান্তির মধ্য দিয়ে বড়ো হওয়া এক নষ্ট অতীত। তার উপর নির্ভরশীল তার বড়ো ভাইয়ের পরিবার সহ আরও অনেকে। পাশা নিজেই আর্থিক কষ্টে ভুগতে শুরু করে। সে গেম বানানোর কাজ করে। কিন্তু গেমের খদ্দেররা পাশার বানানো গেমের পরিমার্জন চায় আর পাশা নিজের কাজের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সে পরিমার্জন আনতে রাজি হয় না। পাশার মধ্যে হিমুর মতো কষ্ট সইবার ক্ষমতা আছে, দুঃখ-কষ্টকে অস্বীকার করবার মধ্য দিয়ে বিশাল পৃথিবীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ার শক্তি আছে। তাই সে বাংলাদেশে বাসকারী রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলোর কাছ থেকে ডুব দিতে পারে, পরিচিতজনের কাছ থেকে হারিয়ে যেতে পারে। রেবেকার প্রচ্ছন্ন ভালোবাসাকেও পাশা অস্বীকার করতে পারে। পাশা দীর্ঘ সময় আমেরিকায় থাকায় তার মধ্যেও জন্ম নেয় আমেরিকানদের মতোই যুক্তিবোধ, অপসৃত হয় বাংলাদেশি ভালোবাসা ও কোমলতা। পাশা বন্ধন থেকে মুক্ত, একারণে তাকে থামাবার কেউ নেই। উপন্যাসের শেষে তার যাত্রা শুরু হয় ঠিকানাহীন গন্তব্যের দিকে। আলবেয়ার কামুর আউটসাইডারের মতোই পাশা বেঁচে থাকে কোমলতার শাঁসটুকু শুষে নিয়ে।
‘আউটসাইডার’-এ অফিসের কর্তা মারসোকে ডেকে জিজ্ঞেস করে যে সে প্যারিসে কাজ করতে যেতে চায় কিনা, আর মারসোর কাছে সেটিও মনে হয় অর্থহীন; কারণ তার কাছে জীবন বদলানোর কোনো অর্থ নেই, প্রতিটি জীবনই বর্তমানের মতো আনন্দের অথবা নিরানন্দের। হুমায়ূন আহমেদের ‘যদিও সন্ধ্যা’ উপন্যাসে শওকত ও রেবেকার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় ছেলে ইমনের জন্মের পর। রেবেকা ইমনকে নিয়ে চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রে, চিত্রকর শওকত থেকে যায় বাংলাদেশে। বাংলাদেশে এসে রেবেকা ইমনকে শওকতের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেয় এবং তার সঙ্গে কয়েকদিনের জন্য থাকতে দেয়। ইমন যখন শওকতের কাছ থেকে সংক্ষিপ্ত সফর শেষে চলে যায় রেবেকার কাছে অর্থাৎ বাবার কাছ থেকে মায়ের কাছে, তখন শওকতের স্বাভাবিক দুঃখবোধে জারিত হবার কথা; কিন্তু শওকতের যুক্তিবাদী আধুনিক মন প্রথাগত আবেগকে ঠেকিয়ে রেখেছে, কারণ তার কাছেও, মারসোর মতোই, জীবন বদলানোর কোনো অর্থ নেই—
ইমনের আর না আসাই ভালো। অভ্যস্ত জীবনে হঠাৎ ঘূর্ণির কোনো প্রয়োজন নেই। সবাই নিজের জীবনে থাকুক। প্রতিটি জীবন নদীর মতো। একটা নদীর সঙ্গে আরেকটা নদীর মিলে-মিশে যাওয়া খুব খারাপ ব্যাপার। [হুমায়ূন আহমেদ: উপন্যাস সমগ্র, চতুর্দশ খণ্ড, ফেব্রুয়ারি ২০১৭, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, পৃষ্ঠা ২৩৩]
মারসোর অপরাধ হত্যার। কিন্তু আদালতে তাকে কোণঠাসা করা হয় মায়ের মৃত্যুতে না কাঁদার জন্য। হত্যার চেয়েও নিজ মায়ের মৃত্যুতে নির্লিপ্ত থাকার ব্যাপারটিই সমাজের প্রথাগত মানুষগুলোর কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আদালত বা রাষ্ট্রের কাছে মায়ের মৃত্যুতে যে ব্যক্তি কাঁদে না সে মনের দিক থেকে অপরাধী। হুমায়ূন আহমেদের নির্লিপ্ত মানুষেরা ঠিক মারসোর মতো নয়, তারা সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় রীতি-নীতি ও আইন-কানুনের বাইরে যায় না। হিমু, রঞ্জু, টগর, বাবু ভাই, ফরিদ কিংবা পাশার মধ্যে বিদ্রোহ নেই, তারা শেষপর্যন্ত হয় ভালোবাসে নয়তো ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয়।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন