সঙ্গ-স্মৃতির অনন্য আখ্যান
আকাশভরা সূর্যতারা
মতিউর রহমান
প্রকাশক: প্রথমা
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৪
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
মূল্য: ৮০০ টাকা
মতিউর রহমানের লেখা ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা: কবিতা–গান–শিল্পের ঝরনাধারায়’ বইটি যেন সাতাশটি নক্ষত্রে সাজানো একটি আকাশ। যে আকাশ কালে কালে দীপ্তি ছড়াবে। বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা এবং এর শিল্প–সংস্কৃতির প্রসঙ্গ উঠলেই অনিবার্যভাবে উচ্চারিত হবে কিছু মনীষীর নাম। সেরকম কিছু মানুষের স্মৃতি আর সান্নিধ্যের শিল্পীত বিবরণ রয়েছে এই বইতে। এই বইয়ের লেখক মতিউর রহমান আশ্চর্য স্মৃতিশক্তিধর এক মানুষ। তিনি চলচ্চিত্রের মতো জীবনের ফ্লাশব্যাকে তুলে ধরেছেন কিছু মানুষের জীবন–কথা। যে কথাগুলোর মাধ্যমে উঠে এসেছে এই ভূখণ্ডের রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের ইতিহাস–ঐতিহ্য। ২৭ জন সৃজনশীল মানুষের সঙ্গস্মৃতির অনন্য আখ্যান এই বইটি বাংলা স্মৃতিকথা সাহিত্যের উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে।
বাংলাভাষার সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে দিনের প্রতিটি মুহূর্ত যাকে থাকতে হয় কর্মব্যস্ত, তিনি লিখেছেন প্রায় সাড়ে তিনশ পৃষ্ঠার এই বইটি। এটা ভাবতে অবাক লাগে। আসলে একটানা বসে তিনি বইটি লিখেননি। কখনো কখনো কারও প্রয়াণের খবর শুনে অভিচ্যুয়ারি লিখতে গিয়ে তুলে আনলেন জীবনের নানাদিক। কখনো হয়তো কারো স্মৃতিচারণ করলেন। সাংবাদিকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিকর্মী এবং শিল্প–সাহিত্যসেবী হিসেবে নিজের জীবনের স্মৃতিগুলোকে কাজে লাগিয়েছেন। বইটি পড়তে পড়তে মনে হলো সাংবাদিকতা শুধু বর্তমানকে তুলে ধরে না, কিছু কিছু বিশেষ সাংবাদিকতা অতীত, অতীতের মানুষ এবং ইতিহাসের ঘটনাকেও উদঘাটন করে। মতিউর রহমানও তাই করেছেন। ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা: কবিতা–গান–শিল্পের ঝরনাধারায়’ সত্যিকারের কিছু তারার আলো যিনি ছড়িয়ে দিলেন, তিনিও নিজের দ্যুতিতে দ্যূতিমান।
এই বইয়ের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের যারা তাঁকে শুধু প্রথম আলোর সম্পাদক হিসেবে চেনেন তারা মতিউর রহমানের বেড়ে ওঠার সময় আর তার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে পরিচিত হবেন। গেল শতকের ষাট দশকের শুরুতে হাইস্কুল শেষ করে কলেজ জীবনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন প্রথিতযশা সাংবাদিক, লেখক, চিত্রশিল্প সংগ্রাহক মতিউর রহমান। শোষণহীন একটা সমাজ নির্মাণের স্বপ্নে বিভোর সেই দিনগুলো কেটেছে উদ্দীপনার মধ্যে। বইয়ের ভূমিকায় তিনি উল্লেখ করেছেন ’৬২-এর ছাত্র আন্দোলনের শুরুর দিন থেকে প্রতিটি কর্মসূচিতে সরাসরি অংশ নিয়েছেন। সেই সময় থেকে সব রাজনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন। এরই সুবাদে যেমন বড় বড় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, তেমনি সংকলন প্রকাশ আর সেমিনার করেছেন। এসব কাজের সঙ্গে দেশের সেরা কবি, লেখক, গায়ক ও চিত্রশিল্পীদের যুক্ত করতে পেরেছিলেন। এমন কাজের সূত্রে ও ভালোবাসার টানে বাংলাদেশ ও ভারতের খ্যাতিমান কবি–শিল্পী–চলচ্চিত্রকারদের নিবিড় সান্নিধ্যের সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। নানা সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে পরিচয়ের মধ্য দিয়ে সেসব প্রিয় ও গুনীজনদের নিয়েই লেখা এই বইটি।
শুরুতে বইটিকে আকাশের সঙ্গে তুলনা করেছিলাম। রাতের অন্ধকারে কখনো আকাশের দিকে তাকালে মনের ভেতর ধন্দ তৈরি হতো। অযুত নিযুত তারার মধ্যে নির্দিষ্ট একটার দিকে দৃষ্টিটা স্থির করা কঠিন। একটু বড় হয়ে দু-একটার বৈশিষ্ট্য কিংবা নাম জেনে সেগুলোকে খোঁজার চেষ্টা করতাম। এই বইটির ২৭টি তারার মধ্যে সেরকম প্রথমেই বেছে নিয়েছি কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। উনি ছিলেন আমাদের তরুণ বয়সের নায়ক, স্বপ্নের আর চেতনার কবি। আমার দুর্বল স্মৃতি আর ক্ষীণ মেধা দিয়ে যে কটি কবিতা মুখস্ত রেখেছি তার মধ্যে তাঁর কবিতাই বেশি। সেগুলোর বেশিভাগের মধ্যে ফুলের অনুষঙ্গ আছে।
প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য, ...ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত..., ফুলগুলো সরিয়ে নাও/ আমার লাগছে, ...কিংবা ফুলকে দিয়ে মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই ফুলের ওপর কোনোদিনই আমার টান নেই।
কৈশোরের কোমল বয়সে ফুলের সৌন্দর্য আর কমনীয়তার বিপরীতে দ্বান্দ্বিক কিন্তু নান্দনিক উপস্থাপনায় এক আশ্চর্য নতুন বাস্তবতাকে উপলব্দি করতে শিখেছিলাম এইসব কবিতার মাধ্যমে। খেলাঘর আর ছাত্র ইউনিয়নের বয়সে তার সৃষ্টির সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য গানটির মাধ্যমে। পরবর্তীকালে একটু বড় হয়ে আমরা যখন জীবনানন্দে বুঁদ হয়ে সাতটি তারার তিমিরের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি তখন অচিরা পাঠচক্রে মোমেন ভাই [কবি আবুল মোমেন] একদিন আমাদের উদ্দেশ্যে পাঠ করলেন তার কবিতা—
তারপর যে-তে যে-তে যে-তে/ এক নদীর সঙ্গে দেখা।/ পায়ে তার ঘুঙুর বাঁধা/পরনে/উড়ু-উড়ু ঢেউয়ের/ নীল ঘাগরা।
এ এক অন্য ভাষা। অন্য ভাবনা। অন্য জগত। নতুন বিষ্ময়। জীবনানন্দের ভাষায় আমরা বলে উঠি এর পরপরই মোমেন ভাই পড়ে শোনালেন মেজাজ কবিতাটি। এর শেষ দিকের পংক্তিগুলো প্রথমবার শুনেই মনে গেঁথে গেল চিরজীবনের মতো—কী নাম দেব, জানো?/ আফ্রিকা।/ কালো মানুষেরা কী কাণ্ডটাই না করছে সেখানে।’
পৃথিবীটাকে আমরা যেমন ভাবে দেখতে চাইতাম, যেভাবে স্বপ্ন দেখতাম ঠিক তেমন করেই সুভাষ ধরা দিল আমাদের কাছে। ঠিক হয়তো এই কারণে আমি প্রথমেই বেছে নিয়েছিলাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। এরকম পর্ব ভাগ করা বইগুলোর একটা সুবিধা। শুরু থেকে পড়তে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আবার পুরো বইটা একসঙ্গে পড়া শেষ করতে হবে তাও নয়। সুভাষকে নিয়ে লেখাটির শিরোনাম—‘তিনি তো আমাদেরই লোক’। কবির চিরযাত্রা আর সর্বশেষ লেখার কথা দিয়ে লেখাটির শুরু। এরপর আদ্যোপান্ত একটা সুভাষকে তুলে এনেছেন সুদীর্ঘ একটা রচনায়। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সকল সৃষ্টির উল্লেখ যেমন আছে, তেমনি আছে তাঁর জীবনের সকল প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিবরণ। লেখক কীভাবে কবির লেখা বই সংগ্রহ করেছেন, কীভাবে তাঁর সঙ্গে পরিচয় ইত্যাদি। ১৯৭৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার হোটেল পূর্বানীতে সারারাত সাহিত্য সংস্কৃতি ও লেখকের সামাজিক দায় নিয়ে যে কথাবার্তা বলেছেন সবগুলো এমনভাবে লিখলেন যেন এই মাত্র আড্ডার টেবিল থেকে উঠে এলেন তিনি। স্বপ্নের এই কবিকে আমরা যেন কাছ থেকে দেখলাম। সুভাষের সুবাস নিলাম। একজন কবিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ পেলাম। তার জীবন–জীবিকা, জীবনের দর্শন, রাজনীতি, সাহিত্য, মনের দ্বৈততা [যেমন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে নিজের অবস্থান] সব মিলে এমন পূর্ণাঙ্গ লেখা আজকাল পাওয়া যায় না। এই ডিজিটাল যুগে সবাই কেমন যেন ওপরে-ওপরে একটুখানি চোখ ফেলে চলে যায়। গভীরে গিয়ে কোনো অনুসন্ধানের অবকাশ পায় না। এই বইয়ের প্রতিটি লেখায় শব্দের কোনো সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ ছিলেন না লেখক। যাকে নিয়ে লিখেছেন তাকে নিয়ে তাঁর যত স্মৃতি, যত মত, যত বিশ্লেষণ আছে সব উজাড় করে দিয়েছেন। কখনো স্মৃতিকাতর হয়ে, কখনো আবেগ তাড়িত হয়ে লিখেছেন। তবে মোহগ্রস্ত হয়ে নয়, বিচার বিবেচনাবোধ না হারিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন প্রতিটি মানুষকে।
শুধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় নয়, মতিউর রহমানের স্মৃতির উজ্জ্বল আধার থেকে এই বইয়ে উঠে এসেছেন কবি অরুণ মিত্র, গণসংগীত শিল্পী ও সংগীত পরিচালক আলতাফ মাহমুদ, চিত্রশিল্পী ও শিক্ষক কামরুল হাসান, চিত্রশিলপী ও লেখক কাইয়ুম চৌধুরী, চিত্রশিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া, গণেশ পাইন, চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক জহির রায়হান, চিত্রশিল্পী নিতুন কুণ্ডু, চিত্রশিল্পী-লেখক পরিতোষ সেন, কবি পূর্ণেন্দু পত্রী, চিত্রশিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর, চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী, লেখক-সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্ত, সেতার বাদক ও সুরকার রবিশঙ্কর, সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সার, কবি শামসুর রাহমান, সাংবাদিক, লেখক সন্তোষ গুপ্ত, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, চিত্রশিল্পী সোমনাথ হোর, দৈনিক সংবাদের সম্পাদক ও রাজনীতিবিদ আহমদুল কবির, সংগীত সাধক ও সাংস্কৃতিক নেতা ওয়াহিদুল হক, রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী জাহেদুর রহীম, চিত্রশিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, সাংবাদিক বজলুর রহমান এবং কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা শিরোনাম।
শামসুর রাহমান নিয়ে লেখাটির শিরোনাম ‘আলোর পথের যাত্রী’। শামসুর রাহমানে সঙ্গে লেখকের পরিচয় হয় ১৯৬৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের একুশে ফেব্রুয়ারির সংকলনের জন্য লেখা চাইতে গিয়েছিলেন তাঁর কাছে। পরে কবিতাটি আনতে গিয়েছিলেন কবির বাসায়। সারা রাত জেগে কবিতা লিখেছেন শামসুর রাহমান। কবিতার শিরোনাম ‘আমার স্বরের ডালে’। কবিতা দেওয়ার আগে নিজেই একবার আবৃত্তি করে শোনালেন। বাংলার সেরা কবির সঙ্গে সেই যে পরিচয় এবং সম্পর্কের সূত্রপাত তা ২০০৬ সালে কবির মৃত্যু অবধি অব্যাহত ছিল। কত দিন কাটল আলাপে আড্ডায়। ‘বিশেষ করে উনসত্তর আর সত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলোতে কত না সময় কেটেছে কবিতা, সাহিত্য, গান, রাজনীতি, আর আন্দোলন নিয়ে কত না কথা আর আলোচনায়। এই আলাপ-আড্ডার বিবরণ তিনি দিয়েছেন এমন ভাবে যেন পাঠকের পাশে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। বৈঠকি স্বতঃস্ফূর্ত ভাষায় তিনি বলে গেলেন শামসুর রাহমানের অনেক কবিতার জন্মকথা। আমরা জানলাম, ‘বন্দীরও মুহূর্ত আছে’ শিরোনামের সনেটটি কবি মতিউর রহমানের অনুরোধে সাপ্তাহিক একতা পত্রিকার জন্যই লিখেছিলেন।
বইতে তথ্য আর স্মৃতির পাশাপাশি তিনি দিয়েছেন মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ। যেসব কবি-লেখক-চিত্রকরের কথা উঠে এসেছে, তাদের সামগ্রিকভাবেই তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। তাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড, জীবনদর্শন, মতামতের সন্ধান পাই এই বইতে। গেলো শতকের শুরুতে জন্ম এমন মনীষীরও বৃত্তান্ত পাই এখানে। ফলে গ্রন্থটি পরোক্ষভাবে হয়ে উঠেছে এক শতাব্দীর বিবরণ। ভাবীকালের ইতিহাসবেত্তারা এখান থেকে অতিমূল্যবান উপাদান খুঁজে পাবেন। বইয়ের প্রথম আখ্যানের শিরোনাম ‘মিছিলের কবি, মিছিলের যাত্রী নন’। পশ্চিমবঙ্গের কবি অরুণ মিত্র নিয়ে এই লেখার শুরু তার প্রয়াণের খবর দিয়ে। পরে স্মৃতিচারণে অরুণ মিত্রের চিন্তা, মতামত, কথাগুলো উঠে আসে। অরুণ মিত্রের কথার একটা উদ্ধৃতি—‘ওই সময় নগর আর গ্রাম ছিল মেশামেশি। কুঁড়েঘর আর দালান লাগালাগি, পুকুর আর ডোবা পাশাপাশি। ঝোপঝাড়, বাঁশবন, নারকেল সুপুরি, তাল, খেজুরগাছের একসঙ্গে জটালা। শহর থেকে পা বাড়ালেই গ্রাম।’ এমন সাবলীল বর্ণনা পাঠকালে যে কোনো পাঠকের মনের ভেতর সেকালের গ্রামবাংলার নিখুঁত ছবি অনায়াসে পাঠ হয়ে যায়। পাওয়া যায় আর্থসামাজিক চিত্র এবং মানুষের স্বপ্নের কথাও—‘বর্তমান দুর্দশা দুর্গতি—যা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে—সেসব দূর করা, সমস্ত মানুষ মুক্ত জীবনের স্বাদপাবে বা নিজের জীবনের স্বাধীনতা পাওয়ার মতো পরিবেশ পাবে, সেরকম ভবিষ্যতের দিকে উন্মুক্ত হয়ে থাকার অর্থে আমি বামপন্থী।’ আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে সাক্ষাৎকারে এই কথাগুলো অরুণ মিত্র একতা পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমানকে বলেছিলেন। এখনো কেমন প্রাসঙ্গিক কথাগুলো। বাংলার ভূগোল জুড়ে কীর্তির কারণে উৎকীর্ণ থাকবে যাদের নাম সেরকম কিছু মানুষের কথার আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে পুরো বই জুড়ে।
একুশের অমর সংগীত ‘আমার ভাইয়ে রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র সুরকার, গণসংগীত শিল্পী ও সংগীত পরিচালক মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ আলতাফ মাহমুদকে নিয়ে লেখাটির নাম ‘ঝড়ের পাখির অসমাপ্ত গান’। শিরোনামে উঠে এসেছে এই মহান শিল্পী জীবনের ট্র্যাজিক দিকটা। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ কিন্তু সৃজনশীলতায় ভরপুর। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আগস্ট মাসে পাকহানাদার বাহিনীর সৈন্যরা তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আর ফেরেননি। বইয়ের প্রত্যেকটা শিরোনাম যাকে নিয়ে লেখা তার জীবন আর কর্মের ইঙ্গিত রয়েছে। অনেক ভেবেচিন্তে যথার্থ এসব শিরোনামগুলো এই বইয়ের অন্যতম আকর্ষণ। কারণ এসব শিরোনামের মধ্যেই পুরো মানুষটার চরিত্রকে খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন শিল্পী কামরুল হাসানের শিরোনাম ‘আমৃত্যু বিদ্রোহী এক শিল্পী।’ কাইয়ুম চৌধুরীর শিরোনাম ‘একজন কত দিতে পারে’। ‘বিমূর্ত চিত্রকলার প্রধান শিল্পী’ এই শিরোনামটা দেওয়া হয়েছে শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার জন্য। শিল্পী গনেশ পাইনের শিরোনাম ‘শেকড়ের সন্ধানে’। জহির রায়হানকে নিয়ে লেখার শিরোনাম ‘জীবনের একটু আগুন চাই’। শহীদুল্লাহ কায়সারের শিরোনাম ‘অন্য এক আলোয় দেখা’। বইয়ের দ্বিতীয় অংশের নাম ‘স্মৃতিতে’। সর্বমোট সাতাশ জনের মধ্যে এই অংশে আছে ছয়জন মনীষীর স্মৃতিকথা। এগুলো প্রথম অংশের ২১ জনের মতো বিস্তারিত নয়, কিছুটা সংক্ষিপ্ত। এই অংশে হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে লেখাটির শিরোনাম ‘তাঁর আরেক যুদ্ধ’। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘আামিই মিসির আলী’ উপন্যাসের উৎসর্গ পত্রে লিখেছেন—
প্রথম আলোর মতি ভাই
জনাব মতিউর রহমান
এই মানুষটাকে আমার মাঝে মাঝে মিসির আলী বলে মনে হয়।
লেখাটা পড়ে আমারও এখন মনে হচ্ছে—তাইতো মিসির আলীর মতো মতিউর রহমান অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। বাংলা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার মানকে তিনি এক বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যা এর আগে কেউ পারেননি। তাঁর সম্পাদিত প্রথম আলো জনপ্রিয়তায় সর্বকালের সকল রেকর্ড ভেঙে কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে। মিসির আলী যা কিছু করে, যুক্তি দিয়ে এবং ভীষণ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে করে। তিনিও প্রথম আলো, প্রথমাসহ এ জীবনে যা কিছু করেছেন সবকিছু যুক্তি আর বুদ্ধি দিয়ে করেছেন বলে এগুলো দেশ সেরায় পরিণত হয়েছে। তিনি একজন সফল মানুষ এসব কারণে। বহুগুনের অধিকারী। তাঁর স্মৃতিশক্তি প্রখর। বহু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা তিনি অনুপুঙ্খ মনে রাখতে পারেন। প্রবল স্মৃতিশক্তি একজন লেখকের জন্য শ্রেষ্ঠ একটা পুঁজি। এ কারণেই তিনি এরকম একটি অসাধারণ বই লিখতে পেরেছেন। জীবন বর্ণিল, ঘটনাবহুল, বাংলাদেশের ইতিহাসের বহু বাঁকবদলের সাক্ষী তিনি। বহু মনীষীর সঙ্গ পেয়েছেন। বড় মাপের মানুষের স্মৃতির বর্ণনা ভবিষতের জন্য সম্পদ হয়ে ওঠে। ইতিপূর্বে সাহিত্য সংস্কৃতি শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত মানুষের স্মৃতি নিয়ে বাংলা ভাষায় লেখা দুটো বই পড়েছি। একটি হলো দেশ পত্রিকার সম্পাদক কথাসাহিত্যিক সাগরময় ঘোষের লেখা ‘সম্পাদকের বৈঠকে’। সম্পাদক হিসেবে বহু লেখকের সঙ্গে তার সংযোগ ছিল, বন্ধুতা ছিল। তার হাত ধরে উঠে এসেছেন অনেক লেখক। ‘সম্পাদকের বৈঠকে’ বইটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একটি সেরা সম্পদ। দ্বিতীয় যে বইটি আমি পড়েছি সেটি হলো কলকাতা প্রখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা মিত্র ও ঘোষের কর্ণধার সবিতেন্দ্রনাথ রায়ের লেখা বই ‘লেখকের কাছাকাছি’। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে তার প্রকাশনা সংস্থার অফিসে নিয়মিত আড্ডা দিতে আসতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাশসহ সেকালের বিখ্যাত বিখ্যাত সব লেখক। তাদের স্মৃতি নিয়ে এই বই। এরকম বইয়ের তালিকায় এখন যুক্ত হলো তিন নম্বর বইটি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সিন্দুকে আরও একটি সম্পদ জমা হলো।
বইয়ের পাতায় পাতায় দুর্লভ সব ছবি। লেখককে দেওয়া চিঠি, অটোগ্রাফ, উপহারের স্মারক, বই, চিত্রকর্মের ছবি প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বইটির মর্যাদা বাড়ানোর পাশাপাশি ভেতরের পাতাগুলোতে দিয়েছে বাড়তি সৌন্দর্য। ৯.৬০ ইঞ্চি বাই ৭ ইঞ্চি সাইজের প্রথমা প্রকাশনার বইটির অঙ্গসৌষ্টব অসাধারণ। কাইয়ুম চৌধুরীর মতো শিল্পী যে বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেন এবং অঙ্গসৌষ্টবের পরিকল্পনা করেন সে বই বাহ্যিক দর্শনে একটা ধ্রুপদী আমেজ থাকবে তাতে আর সন্দেহ কী।
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন