শিল্পী সুলতানের স্বপ্নের খোঁজে নতুনপাঠ

অ+ অ-

 

আধুনিকতাবাদী প্যারাডাইম থেকে প্রস্থান করে শেখ মোহাম্মদ সুলতান [১৯২৩-১৯৯৪] ওরফে এস এম সুলতান ওরফে লাল মিয়ার শিল্পকাণ্ড পাঠের লক্ষ্যে এই লেখার সূত্রপাত। ফলে আধুনিকতাবাদী ভাবধারায় নির্মিত সুলতান-সমালোচনার পর্যালোচনার মাধ্যমে বর্তমান লেখার চৌহদ্দি গঠিত হবে। এবং এই পরিসীমার মধ্যে সুলতানের শিল্পকাণ্ড সম্পর্কে আধুনিকতাবাদ থেকে সরে গিয়ে অন্যপাঠ হাজির করা সম্ভব কিনা এই প্রশ্ন নিয়ে বর্তমান লেখা অগ্রসর হবে। এ কথা আজ সর্বজনবিদিত যে, মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে, ১৯৭৬ সালে কেন্দ্রীয় শিল্পকলা একাডেমিতে সুলতানের একক প্রদর্শনীর পর ঢাকার সিভিল সোসাইটিতে একটি বিধ্বংসী হৃৎকম্পন হয়েছিল। সুলতানের জীবন ও কাজ নিয়ে যে ক্রিটিকাল রিসিপশন বা বুদ্ধিবৃত্তিক সাড়া, উপভোগ ও সমালোচনার ধারা তৈরি হয়, এর সবচে আদি ও জনপ্রিয় নমুনা হলো আহমদ ছফার সাড়াজাগানো প্রবন্ধ বাঙালির চিত্র ঐতিহ্য: সুলতানের সাধনা। আরেকটি উল্লেখযোগ্য সমালোচনার দৃষ্টান্ত হলো বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের দেশজ আধুনিকতা: সুলতানের কাজ। সাম্প্রতিককালের আরেকটি উদাহরণ সৈয়দ নিজার রচিত ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা নামের গবেষণা-গ্রন্থ। এই তালিকায় অনায়াসে যুক্ত হতে পারে সাখাওয়াত টিপুর প্রবন্ধ লালমিয়ার রাষ্ট্র। সুলতান-সমালোচনার ধারায় মোস্তফা জামান পূর্ববর্তী ভাবধারার নৈয়ায়িক সংশ্লেষ ঘটিয়ে তুলেছেন একগুচ্ছ প্রবন্ধে—‘রিফ্রেমিং লাল মিয়া, দ্য ভিশন অব অ্যা কামিং সোসাইটি  এবং আবহমান বাংলার সুলতান

প্রথমত, এই লেখা উপরে উল্লেখ করা সমালোচকদের নানারকম চিন্তা দিয়ে আলোকিত, অনুপ্রাণিত ও প্ররোচিত। দ্বিতীয়ত, এই লেখা, উল্লেখিত সমালোচনাগুলোর পর্যালোচনা আকারে গড়ে উঠবে। অর্থাৎ উল্লিখিত সমালোচকদের চিন্তার ছায়ায় বর্তমান লেখার কায়া গঠিত। হোর্হে লুই বোর্হেস যেমন বলেছেন, এভরি রাইটার ক্রিয়েটস হিজ ওউন প্রিকারসর্স অর্থাৎ উত্তরকালে একজন লেখক নিজের পূর্বসূরিকেই লিখে চলেন [উদ্ধৃত Burke ১৯৯৮: ৯]। কারণ, অল ইন্টেলেকচুয়াল হিস্টরি ইজ পোস্ট ফ্যাক্টাম’—অতীতের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস বর্তমানেরই ঘটনা [পূর্বোক্ত]। তৃতীয়ত, এই লেখা পলিমিক্যালি বা তর্ক করার মাধ্যমে বিদ্যমান সুলতান বিষয়ক সমালোচনাগুলোর মূল প্রবণতার নতুন সমালোচনা হাজির করতে চেষ্টা করবে। কারণ, একজন লেখক বা সমালোচক নিজের কোনো একটি রচনাকর্মের মাধ্যমে যে বিষয়ে তিনি লিখেন সেই বিষয়ে সমস্ত জ্ঞানের সার্বভৌম উৎস হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন না। এই সূত্রে, মিশেল ফুকোর হোয়াট ইজ অ্যান অথর এবং রলাঁ বার্থের দ্য ডেথ অফ দ্য অথর নামের দুটি প্রবন্ধের পাঠ থেকে কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয় অনুধানব করা যায়। যেমন, রচয়িতার এজেন্সি বা চালিকাশক্তি একেবারে নির্ভুলভাবে ও সম্পূর্ণ এককভাবে সংহত কোনো মনুষ্যকর্তার মতন আচরণ করে না। করতে পারে না। যেকোনো লেখক তাঁর সত্তার নানান ভগ্নাংশ হিসেবে নিজের রচিত ভাষার মধ্যেই হাজির থাকেন। ভাষার মধ্যে লেখকসত্তার এই হাজিরা আবার মনের অজ্ঞান স্তরে জবরদস্তিমূলকভাবে দমিত অনেক কিছুর মধ্যেও বিশেষভাবে সমর্পিত থাকে [Abrams ২০০০: ২৪০]। তাই লেখালেখি সর্বদা সামাজিক ও ভাবাদর্শিক মূল্যবোধগুলো দিয়ে ঠাসা থাকে। এ কারণেই বলা হয় ভাষা কখনোই নিষ্পাপ, নিরীহ, গোবেচারা কিছু নয় [Macey ২০০০: ৩০]। ভাষা যেমন কিছু চিন্তা বা প্রশ্নকে প্রকাশ্য করতে পারে, তেমন ভাষার নিয়মেই লুকাতেও পারে। অতএব, এই লেখা, বিদ্যমান সমালোচনার সার গ্রহণ করে এর সারাৎসারকেই প্রশ্ন করতে আগ্রহী। ফলস্বরূপ, বিদ্যমান সমালোচনার তাৎপর্য ও মূল্য কৃতজ্ঞতা সহকারে এই লেখা স্বীকার করে। পাশাপাশি, এই লেখা সুলতানের শিল্প আবারও পাঠের মাধ্যমে অন্য আরেকটি বিকল্প অর্থের দিকেও পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সর্বোপরি, এই লেখা বিদ্যমান সমালোচনার মূল প্রবণতাকে চিহ্নিত করে প্রশ্ন তোলেসুলতানের শিল্পকর্ম কি আদৌ জাতি-রাষ্ট্রকেন্দ্রিক পরিচয়বাদী কোনো রাজনৈতিক প্রকল্প হাজির করে? নাকি, একটি সার্বভৌম শিল্পভুবন অঙ্কনের মাধ্যমে সুলতানের কাজ এই দুনিয়ায় মানবজীবনের এক বিশেষ রূপকল্প হাজির করে? অবশেষে, এই লেখা প্রস্তাব করে যে, সুলতানের শিল্পকর্ম এক ক্রিটিক্যাল হিউম্যান জিওগ্রাফি বা কর্তাশক্তি দিয়ে উদ্বোধিত মানব-ভূগোল সৃজন করে যেখানে কৌম বা সমাজ গঠনের কাজ-ই মুখ্য। এই প্রস্তাবকে বোঝা-পড়ার জন্য প্রাসঙ্গিকভাবে আরো কিছু অর্থ-তাৎপর্যমূলক অনুষঙ্গ অবধারিতভাবেই ভাষাভিত্তিক তর্কের নিয়মে এই লেখায় চলাচল করে।

 

বিদ্যমান সমালোচনার পর্যালোচনা

লেখার এই শাখাটি তিনটি প্রশাখায় ছড়িয়ে আছে। প্রখম প্রশাখার শিরোনাম বাঙালি মুসলমানের জাতীয় রাষ্ট্র এবং সাম্যের প্রশ্ন। এতে পর্যালোচিত হয়েছে আহমদ ছফার বাঙালি মুসলমানের মন শীর্ষক তুমুল প্রভাব বিস্তারী গ্রন্থের অর্ন্তভুক্ত প্রবন্ধ বাঙালির চিত্র ঐতিহ্য: সুলতানের সাধনা। তাছাড়া, আহমদ ছফার চিন্তার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ বিধায় এই অংশে আরো আলোচনা করা হয়েছে সাখাওয়াত টিপুর তার্কিক প্রবন্ধ লাল মিয়ার রাষ্ট্র। দ্বিতীয় প্রশাখার শিরোনাম আধুনিকতার দুই রূপ: দেশজ ও উপনিবেশোত্তর আধুনিকতা। এই অংশ জুড়ে আছে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর রচিত তাৎপর্যপূর্ণ পুস্তক দেশজ আধুনিকতা: সুলতানের কাজ এবং সৈয়দ নিজারের গবেষণামূলক কাজ ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা। তৃতীয় প্রশাখা দোদুল্যমান আধুনিকতা এবং জাতিরাষ্ট্র বনাম সমাজ। এই অংশে মোস্তফা জামানের অত্যন্ত অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন তিনটি প্রবন্ধ পাঠ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এখানে এও বলা আবশ্যক, মোস্তফা জামানের শিল্পচিন্তার সূত্রে এই লেখার পরবর্তী নানা তর্কসূত্র গঠিত হয়েছে।

[ক] বাঙালি মুসলমানের জাতীয় রাষ্ট্র এবং সাম্যের প্রশ্ন

এস এম সুলতানের শিল্পকর্ম নিয়ে বিদ্যমান সমালোচনার পরিমণ্ডলে খোঁজ করলে লক্ষ্য করা যায় আহমদ ছফার বাঙালির চিত্র ঐতিহ্য: সুলতানের সাধনা প্রবন্ধটি একটি আদি ও প্রভাবসঞ্চারী কাজ। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের শিল্পচর্চার পরিমণ্ডলে সুলতানের নয়া আবির্ভাবের সময়কে আহমদ ছফা জাতির ইতিহাস মুক্তির কাল হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ছফার সিদ্ধান্ত: জাতি অর্ধেক ভূমিষ্ঠ হলো, অর্ধেক রয়ে গেল ইতিহাসের জরায়ুর সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে। সুলতান শিল্পের জরায়ুর বন্ধন ছিন্ন করে জাতির ইতিহাসকে মুক্ত করে দিলেন [২০০২: ৬০]। ছফার বিচারে, বাংলার ইতিহাসের জাগ্রত-দেবতা আপন স্বরূপে রেনেসাঁস যুগের ফুল ফুটিয়েছে সুলতানের কাজে। ছফা একেই সুলতানের অনন্যতা হিসেবে চিহ্নিত করেন [২০০২: ৫৩]। তিনি ধর্মতাত্ত্বিক মেটাফর দেবতা এবং এর সঙ্গে সক্রিয়তার অর্থে বিশেষণ যুক্ত করেন জাগ্রত। আহমদ ছফার পাঠ অনুযায়ী সুলতানের ছবির সম্মিলিত সত্তার উপমা দেবতা একদিক থেকে নিপীড়িত। নিপীড়ন ঘুচিয়ে জেগে ওঠার কারণে সেই দেবতাকে আখ্যায়িত করা হয় জাগ্রত-দেবতা। ছফার মতে, সুলতানের ছবিতে শোষিত অর্থাৎ ঘুমন্ত অবস্থা থেকে নিপীড়িত শ্রেণীর কৃষকদের যে উত্থানপর্ব চাক্ষুষ করা যায় তা-ই জাগ্রত-দেবতার আপন স্বরূপ। তাই বাংলার ইতিহাস ও ইউরোপীয় রেনেসাঁসএই দুয়ের এক অনন্য ব্যতিক্রমী রূপকার সুলতান। ইউরোপীয় আধুনিকতার এই গড়ন চিহ্নিত করে, এর সঙ্গে সুলতানের প্রাসঙ্গিক সম্পর্ক তত্ত্বায়নের মাধ্যমে ছফা সুলতান সম্পর্কে শেষবিচার করেন। ছফার মতে, বাংলার ইতিহাসের নির্মাতা হলো সুলতান-অঙ্কিত এই নিপীড়িত কৃষক। ছফার বিচারে, রেনেসাঁসের শিল্পীরা আদর্শায়িত মানুষের নৈর্ব্যক্তিক সৌন্দর্য্য অন্বেষণ করেছেন। অন্যদিকে, সুলতানের মানুষ অঞ্চল ও শ্রেণি-নিরপেক্ষ নয়। সুলতানের মানুষেরা বাংলার ইতিহাসের নির্মাতা এবং শ্রেণি-পরিচয়ে কৃষক। ছফার মতে, কৃষকের অজেয় সৌন্দর্য্যকে সুলতান রূপ দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে মার্কিন শিল্পচিন্তাবিদ ডিওয়েইর ভাবনা সঙক্রান্ত একটি উদাহরণ বিবেচনা করা যেতে পারে। ডিওইয়ে কবি, দার্শনিক ও সমালোচক জর্জ সান্তানার দোহাই দিয়ে বলেন, শেক্সপিয়ারের মধ্যে যে বিশ্বাস নেই তা হোমার ও দান্তের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে। সেই বিশ্বাস করেছে কি কল্পনার পৃথিবী দিয়ে অভিজ্ঞতার পৃথিবীকে আবৃত করেছে। এই পুনঃসৃজিত পৃথিবীতে যুক্তি ও কল্পনার নানা আদর্শ ও হৃদয়ের একটি স্বাভাবিক অভিব্যক্তি থাকে। ব্রাউনিংকে উদ্ধৃত করে ডিওয়েই আরো বলেন, অভিজ্ঞতার মূল্য অভিজ্ঞতার মধ্যে নিহিত থাকে না, বরং একগুচ্ছ আদর্শের মধ্যে থাকে। অভিজ্ঞতা এই আদর্শকেই উন্মোচন করে [Dewey ১৯৭৯: ৩২১]। ডিওয়েইর ভাবনা কাজে লাগিয়ে আহমদ ছফার সুলতান-বিচারকে অভিহিত করা যেতে পারে বিশেষ এক স্থানিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে শিল্পের আদর্শসন্ধানী সমালোচনা। সুলতানের শিল্পকর্মে কৃষকের অজেয় সৌন্দর্য্য’—

এই আদর্শের অভিনব উদ্ভাসন হয়েছে বলে ছফার একটি প্রধান সিদ্ধান্তকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি। সুলতানের শিল্পকে তিনি সাধনা অভিহিত করেছেন। এবং বাহ্যিকভাবে তিনি একটি নন্দনতাত্ত্বিক মূল্যবিচারসহ সার্বিক পর্যালোচনা হাজির করেন। ছফা সুলতানকে, সার্বিকভাবে ইউরোপ ও বিশেষভাবে বাংলার আধুনিক চিত্রচর্চার বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে স্থাপন করেন এবং বাঙালি মুসলমানের আধুনিক শিল্পযাত্রার ঐতিহাসিক পরিক্রমায় সুলতানের অবস্থান নির্ণয় করেন।

অন্যদিকে, আহমদ ছফা সূচিত সুলতান-সমালোচনা ঘরানার বিস্তৃতি লক্ষ্য করা যায় সাখাওয়াত টিপুর লাল মিয়ার রাষ্ট্র নামক প্রবন্ধে। যদিও ছফার চিত্র-বিচারের অন্যতম প্রত্যয় আধুনিকতাকেই স্বয়ং নাকচ করেন টিপু। যদিও টিপু আধুনিকতাবাদের মূলভাবনা মান্য করেই তাঁর সুলতান-সমালোচনা প্রস্তুত করেন। ছফার চিত্র-বিচারের অনন্যতা নির্দেশ করে টিপু বলেন:

বাঙালী মুসলমানের মন বহিতে বাংলার চিত্রকলার ঐতিহ্য: সুলতানের সাধনা নামের আহমদ ছফার [১৯৪৩-২০০১] মর্মমধুর রচনায় লাল মিয়ার ঠিকুজি চিনিয়া লওয়া একদম সহজ। ছফা তাঁহার শিল্প বিচার করিয়াছেন বাংলার চিত্রকলার ঐতিহ্যের নিক্তিতে। খানিক ইতিহাসের ঝরনাধারায়। তাঁহার দরদী রচনায় লাল মিয়ার যুগের শিল্প ও শিল্পীসভার বিশ্লেষণও বাদ পড়ে নাই। অন্তত বাংলাদেশের চিত্র সমালোচনা সাহিত্যে ইহা একমেবাদ্বিতীয়ম [২০১৪]।

তথাপি, সুলতানের শিল্প নিয়ে মনীষী আহমদ ছফার এমন উৎকৃষ্ট ও অদ্বিতীয় সমালোচনার পরও দ্বিতীয় আরেকটি সমালোচনা হাজির করা প্রয়োজন বলে মনে করেন টিপু। এই প্রয়োজনীয়তার কমপক্ষে দুটো কারণ রয়েছে বলে টিপুর অনুসিদ্ধান্ত। টিপুর মতে, সেই দুটো কারণের একটি হলো মুক্তিযুদ্ধপূর্ব তিন দশকের [১৯৪০-৬০] সৃজনকর্ম খুঁটিয়া দেখা। দ্বিতীয় কারণ হলো, যুদ্ধোত্তর [১৯৭০-১৯৯০] আধুনিক চিত্রকলার সহিত [সুলতানের] চিত্রকর্মে সাক্ষাৎ দ্বন্দ্বে মাতিবার কারণ উদ্ঘাটনের প্রয়োজনে। সাখাওয়াত টিপু আহমদ ছফার আলোচনায় অনুপস্থিত উপরোক্ত দুই কারণের রাহা সন্ধান করতে গিয়ে যে অনুসিদ্ধান্ত প্রস্তাব করেন তার মধ্যে দোদুল্যমানতাও শনাক্ত করা যায়। শিল্প-সমালোচক নজরুল ইসলাম ও আবুল মনসুরের সুলতান-সমালোচনার সমালোচনা করে টিপু সিদ্ধান্ত হাজির করে বলেন, শেখ মোহাম্মদ সুলতান ওরফে লাল মিয়ার ছবিতে কৃষকেরা বীর্যবান বা সহজ মানুষ রূপে হাজির। কারণ  লাল মিয়ার ছবির মানুষেরা সরল নহে, সহজ। সহজ মানে অপরের সহযোগে। স্বরূপ আর অরূপএই দুই রূপ্রেই মিলন। সুলতানের এই সহজ মানুষেরা বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে রচিত জাতীয় সংস্কৃতির প্রতীকস্বরূপ। তিনি ব্যক্তির বদলে একদল সামাজিক [কৃষক শ্রেণির] মানুষের কর্মযজ্ঞকে জাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এই জাতীয় সংস্কৃতি সুলতানের কৃষকেরা নির্মাণ করেন সামাজিক মালিকানাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। যেমন টিপু বলেন: শ্রেণীবিভক্ত বুর্জোয়া রাষ্ট্রে দুর্নীতি স্বাভাবিক। এইখানে অস্বাভাবিক রাষ্ট্র মানেই সামাজিক মালিকানার রাষ্ট্র। টিপুর জাতি-রাষ্ট্রবাদী সমালোচনা প্রস্তাব করে যে, সুলতানের এই সহজ মানুষেরা ছবির ক্যানভাসে জাতীয় রাষ্ট্র নির্মাণের জীবন-সাধনায় নিরত। জাতীয় সংস্কৃতির সম্বল এই কৃষকদের জীবন সাধনার এ উৎপাদনের নামই সাম্য। টিপুর সিদ্ধান্ত হলো, সুলতানের শিল্পে উপস্থাপিত সহজমানুষরূপী কৃষকেরা সংগ্রামের মাধ্যমে একটি সাম্যবাদী রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন। এ পর্যায়ে এই লেখায় আমাদের প্রশ্ন হলো, বাঙালি মুসলমানের সাম্যবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আখ্যান চিত্রায়ণ করার কারণেই কি কেবল বলা যায় সুলতান আধুনিকতা ধারণাটিকে প্রত্যাখ্যান করেন? কি জ্ঞানতাত্ত্বিক কি ইতিহাসতাত্ত্বিক যেকোনো বিচারেই কি আধুনিকতা ও রাষ্ট্র এই দুই ধারণা একে অপরের সমার্থক নয়? সর্বোপরি, সুলতানের জ্ঞানতত্ত্বে রাষ্ট্র নামক ধারণার আদৌ কি কোনো উপস্থিতি আছে? রাষ্ট্রের মতন একটি বশ্যতাকামী আধুনিক মানবযন্ত্র-ব্যবস্থার কায়েম কি সুলতানের শিল্পকর্মের পাঠ আদৌ অনুমোদন করে? 

[খ] আধুনিকতার দুই রূপ: দেশজ ও উপনিবেশোত্তর আধুনিকতা

বাংলাদেশের শিল্পে আধুনিকতা ধারণার নিক্তিতে সুলতানের কাজ বিচারের ক্ষেত্রে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের একটি কূটাভাষিক [প্যারাডক্সিক্যাল] অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। যেমন তাঁর দেশজ আধুনিকতা: সুলতানের কাজ বইতে সুলতানের শিল্প বিশ্লেষণের মাধ্যমে জাহাঙ্গীর দুই ধরনের আধুনিকতা চিহ্নিত করেন। একটি হলো আন্তর্জাতিক আধুনিকতা ও অপরটি হলো দেশজ আধুনিকতা [১৯৯৯: ১৪]। জাহাঙ্গীরের সমালোচনায় আধুনিকতার বিশেষায়ণ ও নামকরণে একটি দোদুল্যমানতা লক্ষ্য করা যায়। দেশজ আধুনিকতাকে তিনি বিকল্প অধুনিকতা হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন। তিনি সুলতানের শিল্পে আন্তর্জাতিক আধুনিকতার প্রত্যাখ্যান ও দেশজ আধুনিকতার সৃজন আবিষ্কার করেছেন। জাহাঙ্গীরের মতে, দেশজ আধুনিকতায় শিল্পী আপন ইতিহাসে ফেরার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এর ফলে, জাহাঙ্গীরের বর্গীকরণে দেশজ আধুনিকতার প্রধান গঠনমূলক উপাদান হয়ে ওঠে নস্টালজিয়া বা স্মৃতিকাতরতার বোধ। সুলতানের কাজের সূত্রে, সংস্কৃতি ও প্রকৃতির সম্পর্ক বিশ্লেষণের মাধ্যমে জাহাঙ্গীর দেখিয়েছেন জমি হলো এমন এক বাস্তবতা যা একই সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। এর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পত্তি, খাজনা, মালিকানা, ভাগচাষ, উৎপাদন, বীজ, সেচ ও শ্রমের সম্পর্ক অত্যন্ত জাজ্বল্যমান। অথচ শহুরে শিল্প-সাহিত্যে জমি যে প্রক্রিয়ায় নিসর্গ বা নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যে [সিনিক বিউটি] পরিণত হয়েছে একে জাহাঙ্গীর ঔপনিবেশিক আধুনিকতা হিসেবেও বিবৃত করেন [৫৭]। সর্বোপরি, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সমালোচনায় বাংলাদেশের শিল্পের অন্তর্গত পরস্পর-বিরোধী ঔপনিবেশিক আধুনিকতাদেশজ আধুনিকতা’—এই দুই ধরনের আধুনিকতার খোঁজ মেলে। জাহাঙ্গীরের মতে, সুলতান ঔপনিবেশিক আধুনিকতাকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং দেশজ আধুনিকতাকে গ্রহণ করেন।

জাহাঙ্গীরের উত্তর-ঔপনিবেশিক সুলতান-সমালোচনা ঘরানার অন্তর্ভূক্ত সৈয়দ নিজার রচিত ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা নামের গবেষণাগ্রন্থ। একটি বিস্তৃত ঐতিহাসিক-নন্দনতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে সৈয়দ নিজার উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদী অবস্থান থেকে সুনির্দিষ্ট তাত্ত্বিক কাঠামোতে সুলতানের কাজকে স্থাপন করেন। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় ঔপনিবেশিক শিল্পচর্চার ইতিহাস ও তত্ত্বের পরম্পরায় প্রতিস্থাপন করেন। এক্ষেত্রে তিনি জাহাঙ্গীর সূচিত ঔপনিবেশিকতা প্রত্যয়টিকেই সূচিমুখ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং সুলতানের শিল্পকর্মকে ব্যূপনিবেশায়নের ধারণা দিয়ে ব্যাখা করেন। তিনি সুলতানের ছবির বিষয়বস্তু, অঙ্কনরীতি ও উপকরণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরিশেষে শিল্পীর একটি ‘আত্মপরিচয়আত্মসত্তার অন্বেষণমূলক প্রকল্প চিহ্নিত করেন। যদিও সৈয়দ নিজার তাঁর শ্রমসাধ্য গবেষণা-কর্মে পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্বের একটি প্যারাডাইম [নমুনা অর্থে] আধুনিকতাবাদকে এর সার্বজনীন বাধ্যবাধকতার কারণে সমালোচনা করেন, তবুও নিজারের সুলতান-বিচার শেষপর্যন্ত একটি পরিচয়বাদী রাজনীতির [আইডেনটিটি পলিটিকস] ধারণা-ই প্রতিষ্ঠা করে। কারণ, তিনি মনে করেন, সুলতান রাষ্ট্রের আত্মসত্তাঅন্বেষণ করেছেন এবং শিল্পীর এই সন্ধানযাত্রা লোকজ সংস্কৃতিভিত্তিক, যুক্তিবাদী ও বস্তুজাগতিক যেখানে আধ্যাত্মিকতার কোনো স্থান নেই। এ পর্যায়ে আমাদের প্রশ্ন হলো, পাশ্চাত্যে আধুনিকতাবাদ পরিগঠনের ক্ষেত্রে যুক্তি কি প্রধান উপাদান হয়ে ওঠেনি? সুলতান যদি আধুনিকতাবাদ প্রত্যাখ্যানই করবেন তাহলে যুক্তিভিত্তিক নন্দন-ভাবনা আবার কি করে তিনি আত্মস্থ করেন? তাহলে কি সৈয়দ নিজার সচেতনভাবে যে সুলতান-বিচার করেন তা তাঁর অজ্ঞান মনের অসম্মতিকেই প্রকাশিত করে? অন্যদিকে, তিনি সুলতানের জন্য প্রযোজ্য যে-বিউপনিবেশায়ন ধারণার কথা বলেন, সেই বিউপনিবেশায়ন কি অপরায়নের ধারণা দিয়ে অভিযুক্ত নয়? যেমন উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদী তত্ত্বায়নের গুরু খোদ এডওয়ার্ড সাঈদ নিজেই তো বাইনারিজমের এই ফাঁদ নিয়ে সচেতন হয়েছিলেন [বিস্তারিত জানতে দেখুন Said ১৯৭৮]। যে সাম্রাজ্যবাদী সহিংসতা উপনিবেশায়নের মাধ্যমে উপনিবেশিতকে অপরায়িত করে, এর পাল্টা হিসেবে বিউপনিবেশায়ন ভাবনাকে শিল্প-বিচারের প্রধান নিক্তিতে পরিণত করে কি আরেকটি অপরায়নের প্রকল্পকেই বৈধতাদান করা হয় না? সুলতানের চিত্রপটে কি কোনো পাল্টাপাল্টি রূপায়িত হতে আমরা দেখি? সুলতানের শিল্পকর্মে চিত্রিত উৎপাদনশীল কর্মমুখর সহজ মানুষেরা কি আমরা এবং তোমরায় বিভক্ত? সুলতানের শিল্পে প্রতিরূপায়িত [রেপ্রিজেন্টেশন] চিহ্নতত্ত্বের [সেমিওটিকস] নিবিড় পাঠ [ক্লোজ রিডিং] কি এমন কোনো প্রমাণমূলক চিহ্ন [সিগনিফায়ার] সরবরাহ করে, যার ফলে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, সুলতানের শিল্পকলা অপরকে উৎখাত করে দিয়ে আত্মসত্তা বা নিজকে তুলে ধরেছে? যেমন সুলতান চরদখলরত যে বলবান দৃপ্ত বিদ্রোহী কৃষকদের আখ্যান চিত্রিত করেছেন সেখানে প্রতিপক্ষ অনুপস্থিত এবং রক্তপাত অদৃশ্য। এই চিত্রে যা আছে তা হলো রেভ্যুলিউশনারি অ্যাক্ট বা বৈপ্লবিক ক্রিয়া। এই বৈপ্লবিক ক্রিয়া কি পরিচয়ের রাজনীতির মাধ্যমে অপরায়িত করে নাকি মানুষের সামগ্রিক সত্তাহয়ে ওঠার প্রক্রিয়া চিহ্নিত করে?

[গ] দোদুল্যমান আধুনিকতা এবং জাতিরাষ্ট্র বনাম সমাজ 

বাংলাদেশের শিল্পকলার ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক ও নব্য ধারার শিল্পী মোস্তফা জামানের সুলতান বিষয়ে কমপক্ষে তিনটি পৃথক প্রবন্ধ রয়েছে। সুলতান-সমালোচনার বিদ্যমান ধারা থেকে তাৎপর্যপূর্ণ অনুসিদ্ধান্তগুলো আত্মস্থ হতে দেখা যায় জামানের সুলতান-পাঠে। আহমদ ছফা ও বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সমালোচনার সারগ্রাহী একটি সংশ্লেষ ঘটেছে তাঁর সমালোচনায়। মোস্তফা জামানের সুলতান-পাঠে এমন অর্ন্তদৃষ্টি আছে যার অর্থ সম্পূর্ণ নতুন এবং বিশেষভাবে আমলযোগ্য। তাছাড়া, জামানের সুলতান-পাঠ টেক্সট [পাঠ্যবস্তু] ও কনটেক্সট [পরিপার্শ্ব] উভয়ের একটি ভারসাম্যপূর্ণ সংযোগ স্থাপনের সূত্রে গড়ে ওঠে। অর্থাৎ পাঠ্যবস্তু হিসেবে সুলতানীয় শিল্পের ঘনিষ্ঠ পাঠের [ক্লোজ রিডিং] মাধ্যমে শিল্পার্থকে সম্যক উপলব্ধির জন্য আরো বিশেষভাবে তিনি যুক্ত করেছেন পারিপার্শ্বিকতার পাঠ। এর ফলে, মোস্তফা জামান যে পাঠ-পদ্ধতি গড়ে তুলেন, তাতে নান্দনিক বিবেচনা [এস্থেটিক ক্রিটিসিজম] মুখ্য হলেও, পারিপার্শ্বিকতা অর্থাৎ আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের বিবেচনাও গৌণ নয়। জামানের শিল্প-সমালোচনা পদ্ধতি একদিক থেকে ব্যাখ্যার পুরাতন ধরন পুরোটা স্বীকার করে না। কারণ, পুরাতন ব্যাখ্যাশাস্ত্র কেবল শিল্পের আঙ্গিক ও বিষয়গত ঐক্য [ফরমাল ও থিমেটিক ইউনিটি] অনুধাবনে নিবিষ্ট থাকে। অন্যদিকে, জামানের পদ্ধতি, নয়া-ইতিহাসবাদ [নিউ হিস্টরিসিজম] বা আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, সাংস্কৃতিক বস্তুবাদ [কালচারাল ম্যাটেরিয়ালিজম] থেকেও নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার সূত্র আত্মসাৎ করে। রেমন্ড উইলিয়ামসের মার্কসবাদ-উত্তর চিন্তার ঘরানা থেকে যেমন জানা যায় যে, সংস্কৃতি [বা শিল্প-সাহিত্য] শুধুমাত্র অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিফলন নয়। আবার, এই ব্যবস্থা থেকে তা সম্পূর্ণ স্বাধীনও নয় [উদ্ধৃত Dollimore, ১৯৯৪, viii]। শিল্পের কল্পভুবনের সঙ্গে বস্তুজগতের নিয়ামক বিধি-ব্যবস্থার এই দোলাচলমূলক সম্পর্কের সচেতন পাঠ হিসেবেও জামানের সুলতান-সমালোচনা বিশেষ আগ্রহ সঞ্চার করে। 

মোস্তফা জামান [Zaman ২০১০] অধুনালুপ্ত ডেপার্ট নামের এক ইংরেজি সাময়িকীতে রিফ্রেমিং লাল মিয়া শীর্ষক এক সম্পাদকীয়তে, এস এম সুলতানের শিল্প নিয়ে যে তর্ক উত্থাপন করেন, সেখান থেকে কিছু ভাবনাসূত্র প্রয়োজনমাফিক অনুবাদ করে পাঠ করা যেতে পারে। তাঁর মূল তর্ক হলো এস এম সুলতানের শিল্পভাষা বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পের সমকালীন মানচিত্র থেকে একটি প্রস্থানের সূচনা করেছিল। তাহলে প্রশ্ন হলো, আধুনিক শিল্পের মানচিত্রটি এদেশে কেমন করে অঙ্কিত হয়েছিল? মোস্তফা জামানের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ১৯৬০-এর দশকে জয়নুল আবেদিন [১৯১৪-১৯৭৬], কামরুল হাসান [১৯২১-১৯৮৮], সফিউদ্দিন আহমেদ [১৯২২-২০১২] প্রমুখের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত এদেশের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীরা ইউরোপীয় একাডেমিক শিক্ষা ও দেশীয় বীক্ষণের সংশ্লেষে যে বিমূর্ত শিল্পচর্চার বাগ্ধারা গড়ে তুলেছিলেন, তা-ই আধুনিক মানচিত্রের অতি প্রতাপশালী এক পর্ব সূচনা করেছিল। জামান তৎকালীন ষাটের দশকে এ দেশে সূচিত শিল্পধারায় আধুনিকতার কয়েকটি লক্ষণ চিহ্নিত করেন। যেমন সে সময়ের শিল্পকলা সবেগে উদযাপন করে চলছিল কিছু বিভাজনমূলক ধারণা। তিনি এই বিভাজনগুলো স্পষ্ট করেছেন কিছ বাইনারি বা বিপরীত জোড়ের উদাহরণ দিয়ে। যেমন: স্বদেশ ও বিদেশ, ভেতর ও বাহির, মন ও শরীর, ব্যক্তি ও সমষ্টি। শুধু তাই নয়, জামানের মতে, বাংলাদেশের আধুনিক শিল্প উদযাপন করছিল এমন এক প্রতাপশালী আদর্শ যার ফলে কিনা শিল্পে এমন ব্যক্তি রূপায়িত হয়েছে, যে ব্যক্তি নিজের সত্তা ও সমাজ উভয় থেকেই বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত। ব্যক্তিকে সামাজিক জীবন-প্রবাহ থেকে বিযুক্ত ও অক্রিয় সত্তায় পরিণত করে যে আধুনিকতা, সে আধুনিকতার বিরোধিতার মাধ্যমে সুলতান একটি পাল্টা বয়ান [কাউন্টার-ন্যারেটিভ] নিয়ে ১৯৭৬ সালের প্রদর্শনীর মাধ্যমে ঢাকার আর্ট সিনে পুনরায় আবির্ভূত হন। মোস্তফা জামান জর্জিও আগামবেনের কামিং সোসাইটি ধারণা কাজে লাগিয়ে সুলতানের এই বিদ্রোহী আবির্ভাবকে ব্যাখ্যা করেন। জামান সুলতানের ক্যানভাসকে আনুভূমিক ক্ষেত্র বা জমির রূপক হিসেবে পাঠ করেন। ফলে জানা যায় যে, মানবীয় শ্রমের সৃষ্টিশীল রূপায়ণের মাধ্যমে সুলতান উল্লম্ব আধুনিকতাকে নাকচ করেন। শুধু তাই নয়, মোস্তফা জামানের ভাষ্যমতে, শিল্পী সুলতান প্রতাপশালী উল্লম্ব আধুনিকতার প্রভাবকে নাকচ করার এক কাল্পনিক-নান্দনিক তরিকায় একটি আসন্ন সামাজিক ব্যবস্থাকে রূপদান করেন ক্যানভাসে। তাঁর মতে, ভবিষ্যতের সমাজ কেমন হবে তা সুলতান নিজের কল্পদৃষ্টি দিয়ে অঙ্কন করেন। সুলতানের কল্পদৃষ্টিতে রূপায়িত হয়েছে,বিপুল পেশিসমৃদ্ধ শক্তিশালী কিষান-কিষানি [...] গাঁয়ের যে ভূমিপুত্র, যারা একেবারে মাটির মানুষ, সুলতান যেন তাঁদের আকাশের উচ্চতায় ওঠালেন [জামান ২০২২]। তিনি আরো মনে করেন, প্রকৃতি ও মানুষের শরীরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের সূত্রে গঠিত অঙ্গসংস্থানিক জৈব বাস্তবতাকে [অর্গানিক রিয়েলিটি] এই কল্পদৃষ্টিসম্পন্ন [ভিশনারি] শিল্পী পুনরায় উজ্জীবিত করেছেন। সমাজের সম্মতি আদায়কারী অধিপতিশীল [হেজেমনিক] বর্তমান কাঠামোকে নস্যাৎ করে, কল্পদৃষ্টি দিয়ে সুলতান মানুষের যে ভবিষ্যত কল্পনা করেছেন, একে জামান নন্দনতাত্ত্বিক পরিভাষায় আখ্যায়িত করেছেন ভবিষৎমুখী লোককলা [ফিউচারিস্টিক ফোকলোর]  [Zaman ২০২১]।

মোস্তফা জামানের সুলতান-পাঠ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করে যেগুলো পূর্ববর্তী সমালোচকদের আলোচনায় হয় অনুপস্থিত, না হয় অস্পষ্ট। প্রথম সিদ্ধান্ত, সুলতানের কাজ আধুনিকতাবাদ প্রত্যাখ্যান করে। দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত, সুলতানের কাজ রাষ্ট্র নয় বরং সমাজ তুলে ধরে। তৃতীয় সিদ্ধান্ত, সুলতানের কাজ সমাজ ও প্রকৃতির সুষম সম্পর্ক আবিস্কার করে বাস্তবতার নতুন সংজ্ঞা দান করে। যদিও তাঁর সমালোচনার মধ্যে সমাজ বনাম রাষ্ট্রের ধারণা চিত্রায়ণ সংক্রান্ত একটি দোলাচল লক্ষ্য করা যায়। কারণ, তিনি এক প্রবন্ধে প্রস্তাব করেন যে, সুলতানের কাজে একটি বিস্তৃত গ্রাম জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে বিধিবদ্ধ হয় [Zaman ২০২১]। আবার তিনি সুলতানের কাজকে উল্লম্ব আধুনিকতার বিপরীত আনুভূমিক আধুনিকতার সূত্রেও পাঠ করতে সচেষ্ট হয়েছেন [Zaman ২০১০] । অতএব, দেখা যাচ্ছে যে, মোস্তফা জামানের সমালোচনা সুলতানের শিল্প সম্পর্কে যে নতুন পাঠ প্রস্তাব করে সেখানে সম্পূর্ণ স্ববিরোধ না থাকলেও, ন্যূনপক্ষে একটি দোদুল্যমানতা রয়েছে। যদিও বর্তমান লেখা এই দোদুল্যমানতা অতিক্রম করে, মোস্তফা জামানের সমালোচনা থেকে প্রাপ্ত সমাজআধুনিকতাবাদ বিরোধিতার ধারণা থেকেই বিকাশ ও বিস্তার লাভ করতে সচেষ্ট। তবে, এই অনুসিদ্ধান্ত অনুযায়ী বর্তমান লেখা অগ্রসর করার আগে, ওপরে উল্লিখিত সমালোচকদের প্রায় সকল আলোচনায় সাধারণভাবে উপস্থিত ধারণা আধুনিকতার একটি ঐতিহাসিক-জ্ঞানতাত্ত্বিক পর্যালোচনা হাজির করা জরুরি। 

 

আধুনিকতা কী?: ইতিহাস ও দর্শনের বিচার

মডার্নিজম বইয়ে পিটার চাইল্ডস আধুনিকতাকে একটি স্খলিত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরিভাষা হিসেবে প্রস্তাব করেন। আধুনিকতার উদ্ভবকে তিনি ইতিহাসের আলোকে পাঠ করে অবহিত করেন: পাশ্চাত্যের ইতিহাসের রেনেসাঁ [পুনর্জাগরণ] পর্ব থেকে এর বিস্তার। অথবা এমনও বলা হয় যে, সতেরো শতকের গ্যালিলিও, হবস, নিউটন, লেইবনিজ ও দেকার্তের মাধ্যমে সূচিত বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের কাল থেকে [এর বিকাশ] [Childs ২০০০:১৬]। ক্রিটিকাল বাগ্ধারা হিসেবে আধুনিকতাকে পাঠ করতে গিয়ে চাইল্ডস অন্য সমালোচকদের ভাবনার সারাৎসার তুলে ধরে বলেন, আঠারো শতকের এনলাইটেনমেন্ট [আলোকায়ন] যুগ-ই বস্তুত আধুনিকতার উদগাতা। এনলাইটেনমেন্টের দার্শনিক ভিত্তির প্রতি চাইল্ডস দৃষ্টি আকর্ষণ করেন: কার্যকারণমূলক যুক্তি দিয়ে প্রকৃতি ও সমাজের উপর প্রভুত্ব বিস্তারের মাধ্যমে এই যুগের যে অগ্রযাত্রা ঘটে, তখন থেকেই ন্যায়বিচার, নৈতিকতা, নিয়ন্ত্রণ, সংগঠন, বোঝাপড়া ও সুখের চাবিকাঠি হয়ে ওঠেছে যুক্তি [র‌্যাশনালিটি] [পূর্বোক্ত]। অন্যদিকে, মারশাল বেরমান আধুনিকতাকে পাশ্চাত্য ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে মানবীয় কর্মকাণ্ডের বৈশিষ্ঠ্য পর্যালোচনা করে আধুনিকতার তিনটি কালিক পর্ব চিহ্নিত করেছেন। প্রথম পর্ব ১৫০০ থেকে ১৮০০ সাল অবধি যখন মানুষ আধুনিক জীবনকে প্রকাশ করতে উপযুক্ত ভাষা খোঁজার সংগ্রামে লিপ্ত; দ্বিতীয় পর্ব ১৮০০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ সমগ্র উনিশ শতক ব্যাপি আমেরিকান ও ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে ইউরোপজুড়ে বিরাট বিরাট উত্থানের ঘটনাবলী; তৃতীয় পর্ব ১৯০০ থেকে পরবর্তী প্রায় এক শতাব্দী—‘এই কালপর্বে প্রায় সমগ্র বিশ্বই আধুনিকায়নের প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে যায় [উদ্ধৃত পূর্বোক্ত]।

কালক্রমিক ধারা অনুযায়ী পুরাতন ইতিহাসতত্ত্বের আলোকে আধুনিকতার ঠিকুজি খোঁজার এই প্রবণতাকে বিভিন্ন দার্শনিক পদ্ধতি নাকচ করে দেয়। যেমন, আঠারো শতকে ইমানুয়েল কান্ট রচিত হোয়াট ইজ এনলাইটেনমেন্ট প্রবন্ধ পর্যালোচনা করতে গিয়ে বিশ শতকে মিশেল ফুকো লিখেন তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ হোয়াট ইজ এনলাইটেনমেন্ট। এই প্রবন্ধে প্রতীয়মান হয়, ফুকো আধুনিকতাকে কোনো কালপর্ব হিসেবে গ্রহণ করেননি। ফুকোর চিন্তা অনুযায়ী, আধুনিকতা একটি অ্যাটিটুড বা মনোভাব[Foucault ১৯৮৪: ৩৭]। ফুকো বলেন, মনোভাব বলতে আমি বোঝাচ্ছি সমকালীন বাস্তবতাকে সম্পর্কিত করার একটি ধরন; কিছু নির্দিষ্ট লোকের স্বতঃপ্রবৃত্ত পছন্দ; মোদ্দা কথায় অনুভব ও চিন্তা করার একটি পন্থা [...] [পূর্বোক্ত]। অধিকন্তু, ফুকোর মারফত কান্টকে পাঠ করে আধুনিকতা বিষয়ক সারগ্রাহী একটি রূপরেখার হদিস মেলে। কান্ট এনলাইটেনমেন্টকে চিহ্নিত করেন একটি প্রক্রিয়া রূপে যা [পাশ্চাত্যের] মানুষকে অপরিপক্কতার দশা থেকে নিস্কৃতি দিতে পারে। কান্টের এনলাইটেনমেন্ট দর্শন অনুযায়ী অপরিপক্কতা হলো আমাদের [অর্থাৎ পাশ্চাত্যের মানুষের] ইচ্ছার একটি নির্দিষ্ট অবস্থা। এই ইচ্ছাবস্থা আমাদেরকে অন্য কারো কর্তৃত্ব মেনে নেওয়ায় যা [আবার] আমাদেরকে এমন একটি ক্ষেত্রের দিকে পরিচালিত করে যেখানে [অবশ্যই] যুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে [পূর্বোক্ত]। ফুকো থেকে জানা যায় এই প্রস্তাব খোলাশা করতে কান্ট তিনটি উদাহরণ দেন: আমরা অপরিপক্কতার দশায় নিপতিত কারণ একটি বই আমাদের বোঝাপড়ার স্থান দখল করে নেয়, একজন আধ্যাত্মিক পরিচালক আমাদের বিবেকের স্থান দখল করে নেয়, একজন চিকিৎসক আমাদেরকে বলে দেয় আমরা কী খাব না খাব [পূর্বোক্ত ৩৪]। ফুকো মনে করেন, ইচ্ছা, কর্তৃত্ব ও যুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে [পাশ্চাত্য সমাজের] বিদ্যমান সম্পর্ক পরিমার্জনার মাধ্যমে কান্ট এনলাইটেনমেন্টকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কান্টের এনলাইটেনমেন্ট বিষয়ক অনুধ্যানকে ফুকো তাৎপর্যপূর্ণ মনে করেছেন কারণ কান্ট তাঁর নিজের বর্তমান সময়কেই ব্যাখ্যা করেছেন। ফলে, বর্তমানের অপরিপক্ক দশা কাটিয়ে যুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অগ্রযাত্রা বা এনলাইটেনমেন্ট একটি প্রস্থান-বিন্দু অঙ্কন করে। যুক্তি প্রয়োগের দিকে প্রত্যাবর্তনকে কান্ট একদিকে যেমন একটি চলমান প্রক্রিয়া আখ্যায়িত করেছেন, অন্যদিকে, তেমনি একে একটি দায়িত্ব এবং বাধ্যবাধকতা হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন। কান্টের মতে, মানুষের অপরিপক্ক দশার কারণ মানুষ নিজেই। এ থেকে মানুষের উত্তরণ কেবল তখনই সম্ভব যদি সে নিজের মধ্যে নিজেই একটি পরিবর্তন সাধন করতে পারে। পরিবর্তন সাধনের সূত্র হিসেবে এনলাইটেনমেন্ট মানুষকে দিকনির্দেশনা দেয়: জানতে ভয় পেও না, জানার জন্য সাহসী হও, হও উদ্ধত [পূর্বোক্ত]। কান্টের ভাবনা পর্যালোচনা করে ফুকো সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন যে, ফলশ্রুতিতে এনলাইটেনমেন্টকে অবশ্যই গণ্য করতে হবে একদিক থেকে একটি প্রক্রিয়া হিসেবে যাতে মানুষ যৌথভাবে অংশ নেয়; এবং অন্যদিক থেকে একটি নির্ভীক ক্রিয়া রূপে যা ব্যক্তিগতভাবে সুসম্পন্ন হয় [পূর্বোক্ত]। এনলাইটেনমেন্ট আধুনিকতা নামক ক্রিটিকাল ধারণা উৎপাদনের মাধ্যমে যুক্তিতে মুক্তির বাধ্যবাধকতার অধীনস্থ একটি মানব-ব্যবস্থা প্রস্তাব করে। এই ব্যবস্থায় মানুষ একটি একক প্রক্রিয়ার যুগপৎ উপাদান ও চালিকাশক্তি [এজেন্ট]। অতএব, ফুকোর কান্ট-পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, আধুনিক মানবজাতি একটি যুক্তি-ব্যবস্থার অধীন। যুক্তি প্রয়োগের দুটি পরিসর রয়েছেএকটি ব্যক্তিগত, অপরটি সমষ্টিগত। আধুনিক ব্যক্তি অ্যা কগ ইন দ্য মেশিন’—একটি বিরাট যন্ত্র ব্যবস্থার ছোট খাঁজকাটা চাকার একটি খাঁজ মাত্র। আধ্যাত্মিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অর্থাৎ নৈতিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রক্রিয়ায় যুক্তিশীল বিরাট সাংগঠনিক ব্যবস্থার অধীনে ও সাপেক্ষে ব্যক্তি যুক্তির চর্চার মাধ্যমে অপরিপক্কতার দশা থেকে মুক্তি অন্বেষণ করে।

ইমানুয়েল কান্ট যেমন যুক্তির আলোকবর্তিকাস্বরূপ আধুনিকতাকে উদযাপন করেন, জুরগেন হেবারমাস তেমনি আধুনিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। হেবারমাস বলেন, আলোকায়নের দার্শনিকগণ আঠারো শতকে আধুনিকতার প্রকল্প সূত্রবদ্ধ করেন। অন্তর্নিহিত যুক্তির আলোকে নৈর্ব্যক্তিক বিজ্ঞান, বিশ্বজনীন নৈতিকতা ও আইন এবং সার্বভৌম শিল্ককলা গড়ে তোলার [এই] প্রচেষ্ঠা [বস্তুত] দৈনন্দিন জীবনের যুক্তিসঙ্গত গড়ন নির্মাণের লক্ষ্যে [উদ্ধৃত Childs ২০০০: ১৭]। কিন্তু হেবারমাস মনে করেন [একান্ত যুক্তিনির্ভর] আধুনিকতা একটি অসম্পূর্ণ প্রকল্প। কারণ এটি অগ্রসরই হয় নিজেকে নিজেই পুনঃসংজ্ঞায়িত করে [পূর্বোক্ত]। আধুনিকতার অন্তর্গত স্বরূপতাত্ত্বিক সমস্যা স্বচ্ছ হয় চাইল্ডস কর্র্র্তৃক উত্থাপিত তর্কে:

সর্বোপরি আধুনিকতার প্রধান চরিত্র হলো সাধারণভাবে এটি মানবতাকে সবার ওপরে স্থান দেয়ার প্রচেষ্ঠা চালায় এবং বিশেষত মানবীয় যুক্তি-আশ্রয়ী বুদ্ধিকেধর্ম থেকে প্রকৃতি, অর্থ-ব্যবস্থা থেকে বিজ্ঞানসবকিছুরই কেন্দ্রে স্থাপন করে। পুঁজি, সমাজ অধ্যয়ন ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উত্থানকে বিবৃত করতে আধুনিকতা বিশ্বাস স্থাপন করে প্রগতি ও উৎপাদনশীলতায়। [আধুনিকতা বিশ্বাস করে] এই প্রগতি ও উৎপাদনশীলতা-ই শিল্পায়ন, প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, প্রশাসন ও নজরদারির একটি গণ-ব্যবস্থা তৈরি করে [পূর্বোক্ত]।

বিপরীতে, আধুনিকতার নঞর্থক মাত্রাগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে চাইল্ডস ব্যাখ্যা করেন:

যুক্তি ও বিজ্ঞানের আধিপত্য বস্তুগত সুফল দিলেও, ব্যক্তির স্বায়ত্তশাসন বা উপকারী আত্মজ্ঞানের বিকাশ ঘটাতে পারেনি। এই জগত, এর ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক জীবনএই জাতীয় কোনো কিছুকেই [তা] অর্থপূর্ণ করতে পারেনি। অন্যদিক থেকে বললে, সম্ভবত তা মানুষকে নিছক যুক্তিশীল প্রাণীতে পর্যবসিত করেছে [...]। দেখা গেছে মানুষ আরো জটিল। এমনকি, পর্যায়ক্রমে সে আবেগিকভাবে, মনস্তাত্ত্বিকভাবে ও প্রযুক্তিগতভাবে ক্রমশ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তর্ক তুলে বলা যায়, মানবতা আবির্ভূত হয়েছে যার কোনো উদ্দেশ্য নেই। বরং মানবতাকে দেখা যায় পরিবর্তন ও রূপান্তরেরর জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে, শুধুমাত্র সাময়িক তুষ্ঠি বা অর্থ তৈরি হচ্ছে [পূর্বোক্ত]। 

আধুনিকতার সমালোচকগণ মনে করেন, সমগ্র মানবজাতির পর্যায়ক্রমিক মুক্তির লক্ষ্যে বিশ্বজনীন প্রচেষ্টা নামে আধুনিকতার প্রকল্প যুক্তি ও জ্ঞানের নামে কেবল মাত্র বিকল্প উপায়ে প্রাগাধুনিক সমাজকে দাস বানিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এর জন্য দমন, ধর্ম ও স্বাভাবিক কর্তৃত্বের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে সামাজিক আধিপত্য অর্জন করেছে [পূর্বোক্ত ১৬]। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আধুনিকতার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভাষা হিসেবে ইউরোপীয় পুঁজির বৈশ্বিক সম্প্রসারণ ঘটেছে। এই সম্প্রসারণকে উত্তর-উপনিবেশবাদ আখ্যায়িত করে সাম্রাজ্যবাদ। ইম্পেরিয়ালিজম, দ্য হাইয়েস্ট স্টেজ অব ক্যাপিটালিজম বইয়ে লেনিন তর্ক অনুযায়ী বলা যায়, পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে  আর্থিক পুঁজি [ফাইন্যান্স ক্যাপিটালিজম] একটি বৃহদাকার প্রয়োজনের অতিরিক্ত পুঁজি জন্ম দিয়েছে। লেনিনের মতে, এই টাকা তাদের নিজেদের দেশে লগ্নি করা লাভজনক ছিল না। কারণ সেখানে শ্রমশক্তি সীমিত। উপনিবেশগুলোতে পুঁজির অভাব থাকলেও শ্রম ও মানবসম্পদের প্রাচুর্য ছিল। তাদের পুঁজির বিকাশ ও প্রবৃদ্ধি টেকসই করতে তারা অ-শিল্পায়িত দেশগুলোকে অধীনস্থ করেছে। অতএব, লেনিনের মার্কসবাদী ব্যাখ্যার সূত্রে আধুনিকতাকে অনুধাবন করা যায় পুঁজির রাজনৈতিক অর্থনীতি ও সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ রূপে [Loomba ১৯৯৮: ৫]। আধুনিকতা ও ঔপনিবেশিকতার যোগসূত্র নিরূপণ করতে আনিয়া লুম্বা অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া, সামাজিক প্রক্রিয়া এবং জ্ঞানের পুনর্বিন্যাসের মধ্যকার পারস্পরিক নিবিড় সম্পর্ক পর্যালোচনা করেন। বিশেষ করে, এডওয়ার্ড সাঈদ ও গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক প্রমুখের ভাবনা থেকে সারাৎসার আহরণ করে লুম্বা পাশ্চাত্য আধুনিকতার ঔপনিবেশিক ও পুরুষতান্ত্রিক মাত্রা উন্মোচন করেন। কারণ, ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের ডিসকোর্স তথা পাশ্চাত্যের মানবতাবাদী  প্রকল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্ররূপে নিরন্তর জিজ্ঞাসু কর্তারূপী যে মানুষটিকে নির্মাণ করা হয়েছে তা আসলে একজন শ্বেতাঙ্গ পুরুষ উপনিবেশ বিস্তারকারী [পূর্বোক্ত ৬৬]। 

এডওয়ার্ড সাঈদ ওরিয়েন্টালিজম বইয়ে দেখিয়েছেন পাশ্চাত্য কীভাবে জ্ঞান উৎপাদনের মাধ্যমে প্রাচ্যকে অপরায়নের ভিত্তিতে হীন করে প্রতিরূপায়িত করে। এর ফলে, আধুনিকতা হয়ে ওঠে উপনিবেশবাদের জ্ঞানতাত্ত্বিক তথা সাংস্কৃতিক কলকব্জা। প্রাচ্যবাদ বা পাশ্চাত্য কর্তৃক প্রাচ্য সম্পর্কিত উৎপাদিত জ্ঞান মূলত আমরা এবং তারা’—এই বাইনারি বা বিপ্রতীপ যুগল দিয়ে নির্মিত একটি রাজনৈতিক প্রকল্প। ইউরোপীয় আধুনিক আত্মপরিচয়ের প্রকল্প মনে করে, উপনিবেশিত জনগণ যদি হয় অযুক্তির, তাহলে ইউরোপীয়রা হলো যুক্তিশীল। উপনিবেশের লোকেরা যদি হয় বর্বর, ইন্দ্রিয়কাতর ও অলস, তাহলে ইউরোপীয়রা স্বয়ং সভ্যতার বাহক। ইউরোপ নিজেই একটি সভ্যতা। এর জনগণ যৌনসংমী ও কঠোর পরিশ্রমের নীতি অবলম্বন করে। প্রাচ্য যেখানে স্থির, ইউরোপ সেখানে সচল, উন্নয়নের লক্ষ্যে সম্মুখে আগুয়ান [উদ্ধৃত পূর্বোক্ত ৪৭]।  ফলে, সাঈদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, লুম্বা কথিত শ্বেতাঙ্গ পুরুষ উপনিবেশ বিস্তারকারী আধুনিক মানুষ বস্তুত ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব অর্জন করে জ্ঞানতাত্ত্বিক ক্ষমতা চর্চার সূত্রে, মনুষ্যকর্তার শ্রেষ্ঠ রূপে আবির্ভূত হয়। যদিও সাঈদের প্রাচ্যতত্ত্ব সাধারণীকরণ ও বাইনারিকরণের [বিপ্রতীপ যুগলায়ন] কারণে অন্যান্য সমালোচকগণ ভিন্ন ভাবনা হাজির করেন। কারণ ঔপনিবেশিকতার আধুনিক কর্তাশক্তি কেবল একতরফা জ্ঞান উৎপাদন করে না। উপনিবেশের অধীন সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিগুলো আত্মপরিচয়ের বহুমাত্রিক জটিল প্রক্রিয়াতে একইভাবে অংশ নেয়। যেমন, লুম্বা যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম নিছক প্রতাপশালী ভাবাদর্শকেই প্রতিফলিত করে না। বরং এগুলো উপনিবেশের সংস্কৃতির মধ্যে জারি থাকা বিরোধ-বিসম্বাদ, বিস্তর জটিলতা ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রভেদগুলোও সংকেতায়িত করে [পূর্বোক্ত ৭০]। এর ফলে, উপনিবেশে আধুনিকতার চর্চায় লক্ষ্য করা যায় অনুকরণ [মিমিক্রি] ও সংকর [হাইব্রিডিটি] পরিস্থিতি। যেমন হোমি ভাভা বলেন, ঔপনিবেশিক উপস্থিতি সর্বদাই দোদুল্যমান। আসল ও কর্তৃত্বরূপী বহিরাবরণ এবং পুনরাবৃত্তি ও পার্থক্যরূপী উচ্চারণ[এই দুয়ের] মধ্যে এটি বিভক্ত হয়ে থাকে [উদ্ধৃত পূর্বোক্ত ১৭৭]। অন্যদিকে, ভাভার তত্ত্ব দিয়ে অনুপ্রাণিতউনিশ শতকে কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা নাটক তথা সাংস্কৃতিক চর্চার আধুনিকতার স্বরূপ সম্পর্কেএক সমালোচনামূলক পর্যালোচনা প্রস্তাব করে:

উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক আধুনিকতা হলো একটি বিচ্ছিন্ন কিন্তু প্রতাপশালী শ্রেণীর ক্ষমতা ও আভিজাত্যের অভিব্যক্তি। তাছাড়া, তৎকালীন বাংলায় আধুনিকতার আরো একটি বৈশিষ্ঠ্য হলো পাশ্চাত্যের/ইংরেজের জীবনবীক্ষণের ষোল আনা নকল। বলা বাহুল্য, বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে লক্ষণীয় আধুনিকতা হলো কৃত্রিম আধুনিকতা। [...] কলকাতায় বাবুদের [ভদ্রলোক শ্রেণির] নাটক থেকে প্রতীয়মান হয় [বিলাতি] ঔপনিবেশিকতা এবং [বঙ্গীয়] আধুনিকতা মূলত অবিচ্ছেদ্য। এই আধুনিকতা সাম্রাজ্যের কেন্দ্র থেকে প্রান্তে নকল সংস্করণ আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। [...] যা ঔপনিবেশিকতা, আদতে তা-ই আধুনিকতা। সাম্রাজ্যবাদের ছদ্মবেশে প্রগতি ও যুক্তির মাহাত্ম্য বর্ণনা করে এটি বিশ্বজনীন এক সাংস্কৃতিক বাধ্যবাধকতা হয়ে ওঠে [মৈশান ২০২১]।

আধুনিকতার এই বাধ্যবাধকতামূলক রাজনীতিকে সমাজতাত্ত্বিক আলাঁ তোরেইঁ সমালোচনা করেন। যদিও, তোরেইঁ মানুষের স্বতন্ত্র ব্যক্তি হওয়ার কর্মকাণ্ডের সূত্রে পাশ্চাত্য আধুনিকতাকে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি মনে করেন, আধুনিক ব্যক্তি-মানুষ নিজেকে কর্তাশক্তিতে রূপান্তরিত করে প্রতিনিয়ত নানা বন্ধন থেকে মুক্ত হতে নিরন্তর সংগ্রামে লিপ্ত থাকে [Touraine ১৯৯৫]।

এই পর্যালোচনা থেকে আধুনিকতা বিষয়ক কিছু সিদ্ধান্ত প্রণয়ন করা সম্ভব। প্রথমত, আধুনিকতা ও ঐতিহাসিকতা পরস্পর সম্পর্কিত। কারণ, আধুনিকতার একটি ইতিহাস রয়েছে। যদিও এই ইতিহাসের ভূগোল ইউরোপ, তথাপি উপনিবেশ ও সাম্রাজ্য বিস্তারের ঘটনা একে বৈশ্বিক প্রপঞ্চে পরিণত করেছে। এই বৈশ্বিক ইতিহাসের কর্তারূপে যুক্তিশীল ব্যক্তি-মানুষের আবির্ভাব নিশ্চিত হয়েছে। ফলে, ব্যক্তির স্বায়ত্তশাসনের পরিধি এক মৌলিক প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। কার্যকারণভিত্তিক যুক্তির নীতিতে তৈরি সামষ্টিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্বায়ত্তশাসিত ব্যক্তির নৈতিক ক্রিয়ার সম্পর্কটি আধুনিক রাষ্ট্র, সমাজ ও বিবিধ সংগঠনের কাঠামো ও কার্যকে সংজ্ঞায়িত করেছে। যুক্তি, প্রগতি ও কল্যাণের মানবকেন্দ্রিক এক মহাবয়ান তৈরি হয়েছে। আধুনিকতার রাজনৈতিক অর্থনীতি সাংস্কৃতিক উপনিবেশায়নে এমনকি বিশ্বায়নেও অনুঘটকের ভূমিকা রেখেছে। আধুনিকতা ও ঔপনিবেশিকতার এই রসায়নে পুঁজি, জ্ঞান ও ক্ষমতা অনুশীলনের বহুবিচিত্র জটিল অসমস্বত্ব এক মিশ্র ক্ষেত্র সর্বত্র তৈরি হয়েছে। আধুনিকতা উদ্ভাবিত হয়েছে, উদযাপিত হয়েছে, প্রচারিত হয়েছে, আরোপিত হয়েছে, আত্মস্থ হয়েছে, মোকাবিলা হয়েছে, সর্বোপরি প্রতিরোধে পড়েছে।

 

শিল্পচিন্তার বিচার, বোদলেয়ার ও অন্যান্য সূত্র

পাশ্চাত্যে আবির্ভূত এই সর্বব্যাপী ধারণা আধুনিকতা খোদ পাশ্চাত্যের শিল্পচিন্তার অঙ্গণে কী অর্থ প্রকাশ করেছে? এই প্রশ্ন নিয়ে অগ্রসর হলে দেখা যায় যে, আধুনিকতাস্বরূপ নতুনকে প্রধান প্রত্যয় ধরে নিয়ে জার্মান দার্শনিক ওয়াল্টার বেনজামিন ফরাসি আধুনিক কবি ও সমালোচক শার্ল বোদলেয়ারের ফ্ল্যানুর ধারণা বিশ্লেষণে অগ্রসর হন। বোদলেয়ারের ফ্ল্যানুর একই সাথে পর্যবেক্ষক ও ভোক্তা রূপে বিরাট শহর ঘুরে বেড়িয়ে পরিবর্তন ও পণ্যায়ণ মোকাবিলা করে হয়ে ওঠে দ্য পেইন্টার অব মডার্ন লাইফ বা আধুনিক জীবনের অঙ্কনশিল্পী বা চিত্রকর। যদিও আধুনিকতার রূপ গভীরভাবেই দ্ব্যর্থবোধক। বেনজামিনের সমালোচনার সূত্রে আধুনিকতার বিশেষ লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায় বোদলেয়ারের লে ফ্লর দ্যু মাল কবিতায়। বোদলেয়ার ব্যক্ত করেন সেই নান্দনিক প্রয়োজনীয়তা, যার ফলে দেখা যায় নতুন কিছু খোঁজার লক্ষ্যে অজানার গভীরে নিমজ্জন। এমনকি, শিল্পী মানেঁর কাজে এবং পাশ্চাত্যের বিভিন্ন আভাঁগার্দ শিল্পান্দোলনে উদ্বোধিত হয়েছে আধুনিকতার মূল সূত্র ট্র্যাডিশন অব দ্য নিউ বা নতুন ধারা [Macey ২০০০: ২৬০-২৬১]। অন্যদিকে, স্বয়ং বোদলেয়ার  দ্য পেইন্টার অব মডার্ন লাইফ নামের প্রবন্ধে আধুনিকতাকে তুলে ধরেন আধুনিক অর্থা সমকালীন জীবনের রূপায়িত বৈশিষ্ঠ্য হিসাবে। বোদলেয়ারের সমালোচনামতে এই রূপায়ণে ফুটে ওঠে সৌন্দর্য্য ও বর্তমান সময়। তাঁর মতে, সৌন্দর্য্য দুই প্রকার: সামান্য [জেনারেল] ও বিশেষ [পার্টিকুলার]। বিশেষ সৌন্দর্য্যকে তিনি চিহ্নিত করেন পরিস্থিতির সৌন্দর্য্য ও জীবনাচারের স্কেচ বা রেখাচিত্র হিসেবে। তাঁর মতে, শিল্পীরা নিজেদের বর্তমান সময়কে রূপায়ণ করেন আর এর মাধ্যমে আমরা যে আনন্দ আহরণ করি তা কেবল মাত্র সৌন্দর্য্যের জন্য নয়, এটি বর্তমানের অপরিহার্য গুণকে তুলে ধরার কারণেও। এই বর্তমান সময় বিশেষভাবে ধরা পড়ে প্রাত্যহিক জীবন-পরিস্থিতি ও জীবনাচারের রূপায়ণে [Baudelaire ১৯৬৫:১]। ফলে, বোদলেয়ারের তত্ত্বমতে, আধুনিক শিল্পী তাঁর নিজের সময়ের জীবনাচারকেই রূপায়ণ করেন। আধুনিকতার এই রূপায়ণের সৃজনশীল প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, শিশুর সারল্য ও বিস্ময়াভিভূত এক পরিপ্রেক্ষিত থেকে আধুনিক শিল্পী তার কাগজে বাহ্য দুনিয়ার পুনর্জন্ম দেন যা প্রকৃতি থেকেও অধিকতর প্রাকৃত, সুন্দর থেকেও অধিকতর সৌন্দর্য্যমণ্ডিত। ফলে, আধুনিক শিল্পে ব্যক্ত হয় স্বতঃস্ফূর্ত উদ্দীপনায় গঠিত জীবন, যে-জীবন এর স্রষ্টার আত্মার মতোই। শিল্পে নিজের কালের উপরোল্লিখিত জীবনকে রূপায়ণ করতে এক নিরন্তর খোঁজে ছুটে চলে; এই ছুটে চলায় শিল্পী যা খোঁজেন তাকেই বোদলেয়ার আখ্যায়িত করেন আধুনিকতা [পূর্বোক্ত ১২]। বোদলেয়ার বলেন, আধুনিকতা বলতে আমি বোঝাচ্ছি ক্ষণস্থায়ী, ফেরারি, শর্তসাপেক্ষ, শিল্পের অর্ধাংশ যার অপরাংশ চিরন্তন ও ধ্রুব [১৩]। অতএব, ফুকোর চিন্তা অনুযায়ী আধুনিকতা একটি মনোভাব এবং কান্টের এনলাইটেনমেন্ট দর্শন অনুযায়ী অপরিপক্কতার দশা অতিক্রমের জন্য জন্য ব্যক্তি-মানুষের ক্রমশ জানার বাধ্যবাধকতা। এবং বোদলেয়ারের সমালোচনা অনুযায়ী বলা যায়, আধুনিকতা প্রতিফলিত হয় শিল্পীদের প্রত্যেকের নিজের কালের নতুনত্ব অনুসন্ধানে গভীরে নিমজ্জনের বিশেষ ক্রিয়ায়।

 

সুলতান বিচারে আধুনিকতাবাদী মাপকাঠি কি পরিহার্য নয়?

প্রথমত, আধুনিকতা সংক্রান্ত ঐতিহাসিক-জ্ঞানতাত্ত্বিক পর্যালোচনার সারাৎসার তাহলে কী? ওপরের পর্যালোচনা প্রস্তাব করে যে, কার্যকারণভিত্তিক যুক্তির নীতিতে তৈরি বৈজ্ঞানিকতাকে চূড়ান্তভাবে বিশ্বাস করার একটি প্রকল্পের নাম আধুনিকতা। এই প্রকল্প ব্যক্তির স্বায়ত্তশাসন প্রস্তাব করে বটে কিন্তু ব্যক্তি শেষ বিচারে মুক্ত নয়। এমনকি রাষ্ট্রসহ বিভিন্ন ব্যবস্থার সঙ্গে ব্যক্তির নৈতিক চুক্তির যে শর্ত উন্মোচিত হয়ে পড়ে, তাতে তো ব্যবস্থাগত শোষণকে সম্পূর্ণ ঠেকাতে পারার কোনো বাস্তব প্রমাণ দেখা যায় না। এই প্রকল্পে পুঁজির পুঞ্জীভবন, সাম্রাজ্য বিস্তার, শ্রেণী-শোষণ, ঔপনিবেশিকতা প্রভৃতিও ঠাসাঠাসি করে আছে। ফলে, এই লেখায় পর্যালোচিত বাংলাদেশের সমালোচকদের ভাবনা মান্য করেও বলা যায় সুলতানের শিল্প-বিচারে আধুনিকতাবাদ প্যারাডাইমের প্রয়োগ শুধু সমস্যাজনক নয়, পরিহার্যও কি নয়?

দ্বিতীয়ত, বোদলেয়ারের ভাবনা প্রয়োগ করে এই লেখা মোস্তফা জামানের সুলতান-বিচারে আধুনিকতা সংক্রান্ত দোদুল্যমানতার কারণ মীমাংসা করতে প্রয়াসী। তিনি সুলতানের আধুনিকতা প্রত্যাখ্যানের একটি বিশদ বিবরণী দান করেন। তিনি একই লেখায় সুলতান কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত এই আধুনিকতাকে আবার উল্লম্ব হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এর অর্থ দাড়াচ্ছে সুলতানের কাজে তাহলে খাড়াখাড়ি আধুনিকতার বিপরীত কোনো ভূমি-সমতল আধুনিকতার চিহ্ন রয়ে গেছে। বোদলেয়ারের ভাবনা পাঠ করে, মোস্তফা জামানের সমালোচনায় প্রচ্ছন্ন থাকা এই আনুভূমিক আধুনিকতার অর্থ করা যেতে পারে। অর্থাৎ মোস্তফা জামান কথিত আনুভূমিক আধুনিকতার অর্থ করা যেতে পারে [সুলতানের] নিজের কালের নতুনত্ব অনুসন্ধানে গভীরে নিমজ্জনের বিশেষ ক্রিয়া হিসেবে। কারণ, মোস্তফা জামানের সমালোচনা নির্দেশ করে যে, আধুনিকতা প্রত্যাখ্যান করে সুলতান কল্পদৃষ্টির মাধ্যমে নতুন শিল্প রচনা করেন। এর ফলে কি প্রশ্ন তোলা যায় না, সুলতান একই সঙ্গে আধুনিকতাকে প্রত্যাখ্যান ও গ্রহণ কিভাবে করেন? ফেলে দেয়া একটি বস্তু কি করে আবার থেকে যায়? এভাবে বর্তমান লেখায় উত্থাপিত প্রশ্নগুলোকে প্রশ্ন করে এও বলা যায় যে, আধুনিকতা তথা মতাদর্শরূপে আধুনিকতাবাদএই ধারণা সুলতানের শিল্প চিহ্নিত করতে ও সেই চিহ্ন অনুযায়ী নান্দনিক অবধারণে সমূহ সমস্যা উৎপাদন করে।

 

সুলতানের রাজনৈতিক শিল্পের আধ্যাত্মিক শাস্ত্র

পাশ্চাত্যের স্থানীয় অনুকরণমূলক আধুনিকতাবাদ নয়, বরং বাংলার স্থানীয় ভাবচর্চার মধ্যে সর্বসাধন সিদ্ধি ভিত্তিক জ্ঞানতত্ত্ব হতে পারে সুলতানের শিল্প-বিচারের একটি যুতসই আশ্রয়স্থল, এক নয়া প্যারাডাইম। সুলতানের চিত্রপটে রাজনৈতিক ক্রিয়ায় অঙ্কিত মানব-ভূগোলের সংস্কৃতি প্রকৃতি থেকে পতিত নয়। সুলতানীয় মানব-ভূগোলে উদ্বৃত্ত সময়ের বিনোদনকেন্দ্রিক আধুনিক সাংস্কৃতিকতার কোনো স্থান নেই। প্রকৃতি ও সংস্কৃতির বিরোধ না ঘটিয়ে এই মানব-ভূগোলে মানুষের ক্রিয়া প্রকৃতির মধ্যে প্রতিনিয়ত জীবনের উৎপাদন-পুনরুৎপাদন ঘটায়। এই পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়া মানুষ ও প্রকৃতির স্বাভাবিক পারস্পরিক জীবনসম্পর্কের চক্র নির্দেশ করে। সুলতানের এই প্রাকৃতিক জীবনদৃষ্টির ফলে গড়ে ওঠা শিল্প আমাদের আবার মনে করিয়ে দেয় আর্ট অ্যাজ অ্যা স্পিরিচুয়াল ডিসিপ্লিন’—শিল্প সর্বদা একটি আধ্যাত্মিক শাস্ত্র [Bonnie Marranca and Gautam Dasgupta উদ্ধৃত Mark ২০০২, ৪৫]। সুলতান-কল্পিত মানুষেরা জগৎসংসারে নিজেদের হারানো স্থানকে ফিরে পেতে যে রাজনৈতিক ক্রিয়া করে তা কোনো কর্তৃত্ব অর্জনের ইশতেহার নয়। বরং সাম্যের স্বপ্নে আন্দোলিত। এই অন্দোলনের ভাব দিয়ে সুলতানের ছবিতে তৈরি হয় সৌন্দর্য্য। সমতার মধ্যে যে আনন্দ ও সৌন্দর্য্য বিরাজ করে সুলতানের ছবি এর সাক্ষী। ফলে, কর্তৃত্বের বিলুপ্তি ঘটিয়ে নতুন আরেকটি কর্তৃত্বমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মতন আধুনিক স্ববিরোধিতা সুলতানের শিল্পকাণ্ডে নেই। সুলতানের মানুষেরা রাজনৈতিক আত্মতত্ত্বের অধিকারী। বিদ্রোহে উত্থানশীল সুলতানের মানুষেরা লালন ফকিরের ভাবচর্চারত সেই ক্ষেপার মতন একটি কার্যকর প্রশ্ন উত্থাপন করে: ক্ষেপা তুই না জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথায়? মানুষের কোথাও যাবার আগে কেবল প্রশ্ন নয়, সিদ্ধান্তও গ্রহণ করতে হয়—‘সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার, ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার। লালনের আত্মতত্ত্ব অনুযায়ী মানুষের একটি সর্বনাম হলো ক্ষেপা। অর্থাৎ বিরাজমান দমনমূলক ব্যবস্থার প্রতি ক্ষিপ্ত হওয়ার, বিদ্রোহ করার রাজনৈতিক কর্তব্যবোধ ও ক্রিয়াশীলতা মানুষের মানুষ হওয়ার প্রাথমিক শর্ত তৈরি করে। সুলতানের মানুষের আত্মতত্ত্ব নিরীক্ষণ করলে, সেই শর্ত পূরণ হতে দেখা যায়। নিজের ভূগোলে কেবল বিদ্রোহ নয়, সর্ব সাধন সিদ্ধি হলো সেই মানুষের মূল লক্ষ্য। আর এই লক্ষ্যে পৌঁছুতে হলে বিদ্রোহের মাধ্যমে রাজনৈতিক-আধ্যাত্মিক ক্রিয়া সাধন করে মানুষকেই তীর্থ করতে হয়। ফলে, মানুষের গন্তব্য যখন মানুষ তখন অনিবার্যভাবেই সুলতানের কাজে প্রতিহিংসা, প্রতিপক্ষ ও রক্তপাত অনুপস্থিত। সুলতানিয় মানুষের নিজসত্তা আপন হয় অপরের সঙ্গে যোগ সাধন করে। এই অপর কেবল অপরাপর মানুষ নয়। প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ সমস্তকিছুই এই বিরাট অপরের অংশ। ফলে, সুলতান কল্পিত মানব-সমাজের ব্যক্তিরা যে রাজনৈতিক ক্রিয়া করে তা রাজনৈতিক আধ্যাত্মিকতার স্ফূরণ ঘটায়। এই বিস্ফোরণে মানুষের রাজনৈতিক পরিচয় সমাজ ও পরিবেশে বিমূর্ত হয়ে নিরাকার [অ]রূপ লাভ করে।

 

সুলতানের ভাষায় বিধৃত যৌথ রাজনৈতিক অজ্ঞান

মার্কসীয় রাজনৈতিক দর্শন ও ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণের তত্ত্বকে একত্রে পাঠ করে ফ্রেডরিক জেমিসন প্রস্তাব করেন নয়া ভাবনা—‘পলিটিকাল আনকনশাস। অন্যদিকে, বাংলা ভাষায় জাক লাঁকার মনোসমীক্ষণের তত্ত্বতালাশ করতে গিয়ে পণ্ডিত সলিমুল্লাহ খান [২০০৫] স্থানীয় জ্ঞানতত্ত্ব থেকে নিয়ে নতুন একগুচ্ছ কার্যকর পরিভাষা তৈরি করেছেন। যেমন আকার’‘সাকার’‘নিরাকার প্রভৃতি। এই লেখা সলিমুল্লাহ খানকে অনুসরণ করে আনকনশাস অর্থ অজ্ঞান পরিভাষা বিশেষভাবে মান্য করেছে। এ ক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত অবচেতন শব্দটি সচেতনভাবে পরিহার করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, শিল্পী সুলতানের চিত্রভাষায় বিধৃত যৌথ রাজনৈতিক অজ্ঞান কী অর্থ উন্মোচন করে তা অনুধাবনেও সলিমুল্লাহ খানের ভাষা ও অজ্ঞান মন বিষয়ক লাঁকানীয় ডিসকোর্স এই লেখায় জ্ঞানে-অজ্ঞানে যে হাজির আছে সেটি পাঠকগণ সহজেই আন্দাজ করতে পারবেন এই লেখার আগের ও পরের শাখা-প্রশাখায়।

[ক] কল্পনার রাজনীতি

ভাষা যদি অজ্ঞান মনের নিগূঢ় অর্থ ব্যক্ত করতে সক্ষম হয়, তবে সুলতানের শিল্পভাষায় উন্মোচিত অজ্ঞান মনের রাজনৈতিক বাসনাকে কল্পনার ধারণা দিয়ে বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা আছে। কারণ, সুলতানের শিল্প কৃষিকাজে রত মানুষের যে উত্থান ও উত্তরণ নির্ণয় করে তা চর্মচক্ষে দেখা নিরেট বাস্তবতার রূপায়ণ নয়। সৃষ্টির জন্য শিল্পী প্রধানত যা আশ্রয় করেন তা হলো কল্পনা। জ্যঁ পল সার্ত্রের ধারণা অনুযায়ী কল্পনাকে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে বস্তুত যা নেই [হোয়াট ইজ নট দ্য কেইস] [Warnock ১৯৮৩: ৭৪]। কর্মমুখর উৎপাদনশীল মানুষের শরীর, দ্রোহ ও স্বর্গরূপী স্বরাজ-সমাজের যে রূপ ও পরিণতি সুলতান চিত্রিত করেছেন তা সাধারণত ইতিহাস ও স্মৃতিতে নেই। যা নেই বা অনুপস্থিত তাকে চিত্রিত করার মাধ্যমে সুলতান শিল্পের একটি চিরন্তন প্রবণতাকেই বিশেষভাবে প্রয়োগ করেছেন। আর তা হলো কল্পনা। শিল্পী সুলতান কল্পনা’ ও ‘কল্পদৃষ্টি’র মাধ্যমে চিত্রপটে বিষয়কে এমনভাবে সংগঠিত ও সংঘটিত করেছেন যাতে প্রতীয়মান হয় কল্পনা হলো মুক্তির উৎস [পূর্বোক্ত, ৭৭]। সুলতানের শিল্পভাবনার কেন্দ্রীয় প্রসঙ্গ কল্পনার রাজনীতি বিদ্যমান সমালোচনায় বিশেষভাবে বিবেচিত হয়নি।

ফলে ইতিহাস ও আধুনিকতাবাদকে মানদণ্ড বিবেচনা করে সুলতান-সমালোচনার যে কেন্দ্রিয় ধারা গড়ে উঠেছে তাকে মিশেল ফুকোর ভাবনা দিয়ে ভিন্নভাবে আবারও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। মিশেল ফুকো স্থান ও কাল সম্পর্কে পাশ্চাত্য আধুনিকতার দৃষ্টিভঙ্গি নির্ণয় করেন। ফুকোর মতে, উনিশ শতকের পাশ্চাত্যে স্থানকে সাধারণত ভাবা হয়েছে মৃত, নির্দিষ্ট, নির্দ্বন্দ্ব ও অনড়। কিন্তু বিপরীত দিকে, কাল বা সময়কে ভাবা হয়েছে সমৃদ্ধি ও উর্বরতার প্রবাহ হিসেবে। এই কালপ্রবাহে জীবন দ্বান্দ্বিক Michel Foucault উদ্ধৃত Soja ১৯৯৯: ১১৪]। ফুকোর এই তত্ত্ব উনিশ শতকের ইউরোপে ইতিহাস নিয়ে এক বিশেষ মোহগ্রস্ততাকে উন্মোচন করে। ফুকো, ইতিহাসের প্রতি এই মোহকে, পাশ্চাত্য আধুনিকতার একটি অন্যতম বুদ্ধিবৃত্তিক লক্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। কৌতূহল জাগানিয়া ব্যাপার হলো বাংলাদেশের প্রধান প্রধান বুদ্ধিজীবী যেমন মনীষী আহমদ ছফা ও নৃবিজ্ঞানী বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর উভয়ই ইতিহাসের প্রতি এই আধুনিকতাবাদী মোহ থেকে যে সুলতানের শিল্পকে ব্যাখ্যা করতে আগ্রহী হননি তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়? তাঁদের বিবেচনায় শিল্পের সার্বভৌম উপাদান হিসেবে কল্পনা গণ্য হয়নি। যদি হয়েও থাকে তবে একে বলা যেতে পারে ঐতিহাসিক কল্পনা। সুলতানের কাজকে ঐতিহাসিক কল্পনা ধারণার আশ্রয়ে ব্যাখ্যা করার ফলে, ইতিহাসবাদের কবলে থেকে সুলতানের কাজের মূল আধার ও আধেয় যে স্থানিকতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত, তা অনেকক্ষেত্রেই নীরবতার শিকার হতে বাধ্য হয়। অথচ মিলস বলছেন, মানুষের ইতিহাস ও মানুষের আত্মজীবনীর সমালোচনামূলক রাজনৈতিক [ক্রিটিকাল] সম্পর্ক সমাজ নামক স্থানের মধ্যেই ফলনশীল। সমাজতত্ত্বীয় কল্পনা হলো মানুষের মনের এমন এক গুণ যা তাদের চারপাশের বিশ্বে কী ঘটে চলেছে এবং তাদের নিজেদের মধ্যে আর কী কী ঘটতে পারে সেইসব বুঝতে প্রয়োজনীয় যুক্তিবোধ গঠন করে [C. W. Mills উদ্ধৃত পূর্বোক্ত ১১৬]। শুধু তাই নয়, মিলস আরো মনে করেন, সমাজকেন্দ্রিক কল্পনার আদি ফল হচ্ছে সেটা, যার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের অভিজ্ঞতাকে বুঝতে পারে এবং নিজের কালে নিজেকে স্থাপন করে নিজের ভাগ্যকেও পরিমাপ করতে পারে। এমনকি, ব্যক্তি তার নিজের জীবনের সম্ভাবনাগুলোকেও বুঝতে পারে, ব্যক্তি তার নিজের সমরূপ দশায় থাকা অন্য আর সকল ব্যক্তির জীবন সম্পর্কেও সচেতন হতে পারে [পূর্বোক্ত]। যেমন এডওয়ার্ড সজা বলেন, মানুষের জীবন-গল্পগুলোর একটি ভূ-গোল রয়েছে। তাদের অতি নিকটবর্তী জায়গা-জমি-জিরাত রয়েছে, রয়েছে উদ্দীপনাময় বসতি যা চিন্তা ও কর্মকে প্রভাবিত করে। ফলে, ঐতিহাসিক কল্পনা কখনোই ভূমিহীন নয় [Soja, পূর্বোক্ত]। যদিও বি কে জাহাঙ্গীর সুলতানের শিল্পে রূপায়িত কৃষকদের জীবন-গল্পের বসতস্বরূপ ভূমির কথা বলেন, কিন্তু জাহাঙ্গীরের এই সমালোচনা পদ্ধতি শিল্পকর্মের কল্পভুবন থেকে বাস্তবের ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় নির্মিত ভূমির সঙ্গে কৃষকের শ্রম-সম্পর্কে দারুণভাবে অবহিত করলেও, তা শেষ পর্যন্ত, শিল্পের পাঠ থেকে সমাজের পাঠে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে, এ ধরনের সমালোচনা-পদ্ধতি টেক্সট ও কনটেক্সেটের সম্পর্ক উদ্ঘাটনের ফাঁদে পড়ে এসথেটিক বা নন্দনতত্ত্বীয় সমালোচনা থেকে প্রস্থান করে শিল্পের সমাজিক-ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের খপ্পড়ে নিপতিত হয়। বিপরীত দিকে, মোস্তফা জামানের সুলতান-বিচারকে আমরা বিশেষভাবে পাঠ করতে পারি।

[খ] স্বর্গীয় রাজনৈতিক মানব-ভূগোল

মোস্তফা জামান সুলতানের ক্যানভাসকে স্থানের রূপক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। মোস্তফার ধারণা অনুযায়ী এই স্থানিকতার বাস্তুতন্ত্রেই শিল্পী সুলতান সৃজন করেন আসন্ন সমাজের নতুন বিন্যাস। মোস্তফা জামান থেকে আলোকিত হয়ে আরো একপ্রস্থ অগ্রসর হয়ে বলা যায় সুলতানের কল্পদৃষ্টি দিয়ে সৃজিত সমাজ যেন হয়ে ওঠে পোস্টমডার্ন ক্রিটিকাল হিউম্যান জিওগ্রাফি অর্থাৎ আধুনিকতাবাদ পরবর্তী সমালোচনামনস্ক কিন্তু রূপান্তরের লক্ষ্যে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিকভাবে সক্ষম এক মানব-ভূগোল। এই সূত্রে তর্ক করা যায় যে, সুলতান সমাজের শোষণমূলক ক্ষমতা-সম্পর্কের স্থিতাবস্থা মান্য করেননি। বরং শিল্প সৃজনকে মানব মুক্তির একটি প্রতীকী উপায় হিসেবে গণ্য করেছেন। সুলতানের কাজে একটি বিশেষ সামাজিক পরিসর ও সে স্থানের মানব-ভূগোল কর্মমুখর মানুষের রাজনৈতিক ক্রিয়ার ফসল হিসেবে অঙ্কিত হয়। এই সমালোচনামনস্ক রাজনৈতিক মানব-ভূগোল [পূর্বোক্ত ১১৮] আধুনিকতার শর্ত অতিক্রম করেই সুলতানের চিত্রপটে অঙ্কিত।

সুলতানের মানব-ভূগোল কেবল মাত্র মানসিকভাবে নির্মিত নয়, আবার বস্তুগত ভাবে হাজির, তাও নয়। এ হলো তৃতীয় স্থান। ফলে, এটি বাস্তবতার [রিয়েলিটি] মধ্যে নেই। কিন্তু কল্পনার ফসল হিসেবে বাস্তব সত্য [রিয়েল] আকারে আছে। একে বলা যেতে পারে সম্মিলিত মানুষের অবদমিত অকাঙ্ক্ষার বিস্ফারিত প্রকাশ। ফ্রেডরিক জেমিসন বর্ণিত পলিটিক্যাল আনকনশাস বা রাজনৈতিক অজ্ঞানের ফলিত রূপ। জেমিসনের সূত্রে বলা যায়, পুঁজিবাদের অধীনতা ব্যক্তি মানুষের কর্তাশক্তিকে পঙ্গু করে দেয়। এমনকি, আমাদের ভাষা থেকেও আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় [Jameson, ১৯৮৩, ৪]। এমনি সব অন্ধকার ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে ব্যক্তি হিসেবে শিল্পী এসএম সুলতান যেন আশ্রয় খুঁজেন, নির্মাণ করেন তাঁর প্রজেক্ট অফ স্যালভেশন’—মানবজাতির পরিত্রাণের শিল্প প্রকল্প [পূর্বোক্ত, ৫]। মানব মুক্তির নিশ্চয়তা ঘোষিত সুলতানীয় কল্পদৃষ্টি দিয়ে সৃজিত শিল্পের অর্থ চিহ্নিত করতে আমরা তখন সক্ষম হবো যখন একে না সামাজিক, না ঐতিহাসিক কিন্তু শেষ বিচারে আমরা যখন বলতে পারব রাজনৈতিক [পূর্বোক্ত]। মানুষের এমন বৈপ্লবিক রূপান্তরমূলক কর্তাশক্তির উদ্বোধনসুলতানের ছবি ব্যতীত বাংলার আধুনিক শিল্পে কি তেমন চাক্ষুষ করা যায়?

[গ] শরীর: ব্যবস্থাগত বশ্যতা বনাম অধিবিদ্যক শক্তির চিহ্ন 

সুলতানের চিত্রপট যেহেতু একটি রাজনৈতিক মানব-ভূগোলের রূপক, সেহেতু তাঁর শিল্পের আরাধ্য হলো মানব-শরীর। সুলতানের শিল্পে শরীর মুক্তিপ্রাপ্ত। এই শরীরী পরিত্রাণ করুণার আজ্ঞাপত্র থেকে পাওয়া নয়। মানুষকে তার নিজের স্থান থেকে যে দমনমূলক ক্ষমতাতন্ত্র উৎখাত করে সেই শোষণব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটিয়ে এই শারীর মুক্তির অনুশীলন করে সুলতানের কল্পিত মানুষেরা। সুলতানের শিল্পে চিত্রার্পিত এই বিশেষ শরীর দুটো অবস্থায় বিরাজ করে। শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক প্রযুক্তি ও ভাবাদর্শিক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বয়ানের অনুশাসন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এবং মুক্ত অবস্থার চিহ্ন হিসেবে এই বিশেষ শরীর রূপায়িত। পীড়ন ও দমনের মাধ্যমে যে শরীর শারীরিকভাবে বশীকরণের রাজনীতির [বায়োপলিটিক্স] দাগা বহন করে, সেখান থেকে তাদের মুক্তি ঘটে। এটা সামাজিক চেতনার অভিব্যক্তি নয় বরং অবদমিত মনের রাজনৈতিক অজ্ঞান প্রসূত। এই রাজনৈতিক নিরাকার মন সুলতানের শিল্পভাষায় কৃষকের শরীরের মাধ্যমে আকার লাভ করে। এভাবেই, ভৌত [ফিজিক্যাল] দুনিয়ার সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করতে অধিবিদ্যক [মেটাফিজিক্যাল] শক্তি [এনার্জি] যে অত্যাবশ্যক, সুলতান শরীরের অতিমানবীয় রূপাখ্যান সৃষ্টি করে সে ইশারা দেন।

[ঘ] আত্মসত্তা নয় সামাজিক সত্তার বয়ান

সুলতানের ছবিতে একাকী ব্যক্তির উপস্থাপনা নেই। পুঁজিকেন্দ্রিক সভ্যতার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা শ্রম বিনিয়োগ করতে সক্ষম শরীরকে, একদিকে, শ্রমজাত ফলন থেকে বিচ্ছিন্ন সর্বহারায় পরিণত করে। অন্যদিকে, অপরাপর শরীর ও সত্তার সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রচনার অবশ্যাম্ভাবী সামাজিক প্রক্রিয়া থেকেও ব্যক্তিকে উৎখাত করতে দমনমূলক পদ্ধতি কায়েম করে। সুলতানের শিল্পকাণ্ড মানুষের সত্তা সম্পর্কে যে জ্ঞানতত্ত্ব প্রস্তাব করে, তা পুঁজিকেন্দ্রিক সভ্যতার মাধ্যমে উৎপাদিত একাকীত্বের শর্ত ও বাস্তবতাকে উল্টে দিয়ে নতুন প্রস্তাব হাজির করে। ফলে, সুলতানের শিল্পে ব্যক্তিসত্তার বিচ্ছিন্নতা চিত্রিত হয় না। তাঁর কাজে উপস্থাপিত সত্তা [বিয়িং], বস্তুত, সামাজিক সত্তা [সোশ্যাল বিয়িং]। সুলতানের একটি বহুল প্রচারিত চিত্র প্রথম রোপণ [ফার্স্ট প্ল্যানটেশন]। এই ছবিতে উপস্থাপিত যে একক ব্যক্তিকে বৃক্ষরোপণরত দেখা যায়, ধারণাগত দিক থেকে, সেই একাকী ব্যক্তি গূঢ়ার্থে আদৌ একা নন। এই চিত্রে রূপায়িত আদি রোপণকর্মে সংলিপ্ত চরিত্রটি যেহেতু আদম, তাই ধর্মতত্ত্বীয় পুরাণবিদ্যা অনুযায়ী তিনি একটি অখণ্ড মানবমণ্ডলীর সম্মিলিত কৃষিযাত্রার আদি সূচকমাত্র। ফলে বলা যায়, এই ছবির আদমসুরত, প্রকৃতপক্ষে, এই ধরিত্রীর প্রাকৃত বাস্তুতন্ত্রের আওতাধীন সকল মানুষের অন্তহীন কাফেলারই রূপক। এমনকি, সুলতান যাদেরকে ছবিতে তুলে ধরেছেন, সেই মাছুমদিয়া গ্রামের কৃষক-শ্রমিককুল তাঁর ছবির কাঁচামালস্থানীয় উপকরণ দিয়ে রঙ এবং ক্যানভাসউৎপাদনেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এখানে দাগিয়ে রাখার মতন প্রসঙ্গ হলো, সৃজিত শিল্প এবং শিল্প সৃজনের আয়োজন প্রক্রিয়া, উভয়ই একটি সামষ্টিক অংশগ্রহণমূলক সৃষ্টিশীলতার বয়ান তুলে ধরে। কৌমধর্মী এই যে যূথবদ্ধ সত্তার গল্প বয়ান করেন সুলতান, এর মাধ্যমে সত্তার সঙ্গে সত্তার মৌলিক নির্ভরশীলতার প্রসঙ্গটিকেই বারবার ফিরিয়ে আনেন শিল্পী। যেমন দিব্য দ্বিবেদী ও অন্যান্য সমালোচকগণ আখ্যানমূলক বয়ানকে চিহ্নিত করেন যেকোনো বোঝাপড়ার একটি মৌলিক পন্থা হিসেবে। তখনই তা বয়ান হয়ে ওঠে, যখন সেটি সত্তাসমূহের পারস্পরিক অনিবার্য আন্তঃনির্ভরশীলতা চিহ্নিত করার নমুনা [প্যারাডাইম] হয়ে ওঠে। [ব্যক্তি] বিশেষ ও নির্বিশেষ জনসাধারণের মধ্যকার বিমূর্ত, অভিবাজ্য ও পারস্পরিকতার সম্পর্ক জানা-বোঝার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই বয়ানের মাধ্যমে আখ্যানমূলক অর্থ তৈরির প্রক্রিয়াটিও গড়ে ওঠে। [Dwivediet al. ২০১৮: ৬]।

সুলতানের মহাকব্যিক চিত্রপট ও গ্রামীণ বাস্তুসংস্থানের আওতায় জনসাধারণ কৃষককুলের অংশগ্রহণে গঠিত শিল্প সৃজনের প্রক্রিয়া পাঠের পর, আমরা অনুধাবন করতে পারি, সেই নির্বিশেষ সামাজিক সত্তার যূথবদ্ধ জীবন-প্রবাহের ব্যক্তি একা নয়, নির্বিশেষ সামাজিক সত্তার মধ্যেই বিশেষ ব্যক্তিসত্তার ফলিত প্রকাশ-বিকাশ ঘটে। অধিকন্তু, স্টিফেন গ্রিনব্লাটের তর্কে সম্মত হয়ে সুসান বেনেট প্রস্তাব করেন যে, রচনার যৌথ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি অথর বা রচয়িতা  [কেবল সাহিত্যের লেখক অর্থে নয়, শিল্পের স্রষ্টা অর্থে] নিজেই সামাজিক সত্তা হয়ে উঠেন। এই হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায়  রচয়িতার একটি একক ক্রিয়া উন্মোচিত হয় বহু হিসেবে [Bennett, ১৯৯৭, ৯১]। নয়া ইতিহাসবাদী সমালোচনা ঘরানার এই প্রস্তাব মান্য করে সিদ্ধান্ত হাজির করা যায় যে, শিল্পের বিষয়বস্তু, প্রকাশ ও সৃজন-প্রক্রিয়ার বৈশিষ্ঠ্য বিচারে শিল্পী সুলতান রচয়িতা হিসেবে নিজেও একক থেকে বহুতে অর্থাৎ সামাজিক সত্তায় রূপান্তরিত হন।

 

রেনেসাঁসের নায়কোচিত ব্যক্তির ধারণা প্রত্যাখ্যান

সুলতানের ছবিতে কোনো একক নায়ক নেই। স্বাভাবিকভাবে একক কোনো খলনায়কও নেই। বস্তুত সুলতান নায়কোচিত ধারণার মাধ্যমে ব্যক্তি-চরিত্রের মাহাত্ম্যগাথা চিত্রণের কোনো প্রয়োজন অনুভব করেননি। তিনি ক্যানভাসে রেখা রং পরিপ্রেক্ষিত প্রভৃতি এমনভাবে প্রয়োগ করেন যার ফলে সমগ্র কম্পোজিশনটিতে কোনো একক গুরুত্ব আরোপ হতে দেখা যায় না। তাই তাঁর বিশালকায় চিত্রপটগুলোতে একক কোনো আগ্রহ উদ্দীপক কেন্দ্রও [পয়েন্ট অফ ইন্টারেস্ট] নেই। তিনি সমগ্র ক্যানভাসটিকেই আগ্রহসঞ্চারী মানবজমিন রূপে চিত্রিত করেন। সমগ্র সমাজই যখন নায়ক তখন কোনো এক ব্যক্তির জন্য আলাদা মহিমাকীর্তন গাঁথার আদৌ কি প্রয়োজন আছে? পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের শিল্পীদের সঙ্গে এখানেই শিল্পী সুলতানের মৌলিক প্রভেদ। রেনেসাঁসের শিল্পীরা সাধারণত পৌরাণিক ব্যক্তি-চরিত্রের অন্তর্গত মহিমা চিত্রিত করে এক বিশেষ উচ্চতর শ্রেণির মানুষের নৈতিক-শারীরিক সৌন্দর্য্যকে চিরায়তসার্বজনীন আদর্শ রূপ হিসেবে প্রস্তাব করেন। রেনেসাঁসের শিল্পীদের এই অভিজাততান্ত্রিক শিল্পাদর্শ পাশ্চাত্যের আধুনিকতাবাদী ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের পুর্বাভাস প্রচার করে। পাশাপাশি, ব্যক্তি-মানুষের নির্ভুল’, ‘নিখুঁত বা পারফেক্ট চরিত্রের মধ্যেই নিহিত আছে নৈতিকতা ও সৌন্দর্য্যরে পরাকাষ্ঠাএই বাণী তুলে ধরে। সুলতানের শিল্পাদর্শ রেনেসাঁসের একেবারেই বিপরীত। সুলতান ব্যক্তির আদর্শ জীবন তুলে ধরেন না। সেই আদর্শে সৌন্দর্য্য সৃষ্টির প্রয়োজনও পড়ে না। সুলতান ব্যক্তি-মানুষের মনোজাগতিক-নৈতিক অবস্থার নিখুঁত সৌন্দর্য নিয়ে মনোযোগী নন। সুলতান বরং প্রপঞ্চময় বাহ্য জগতের রূপান্তরে লিপ্ত যূথবদ্ধ সত্তা রচনায় মনোযোগী। শ্রেণিলুপ্ত বাস্তবতা সৃজনে রত ব্যক্তিদের চিত্র রচনা করে সুলতান কৃষিকাজের লৌকিক স্তরে পৌরাণিক মহাশক্তির ইন্দ্রজাল বুনে দিতে সক্ষম। এই লেখায় সুলতানের প্রথম রোপণ চিত্রের প্রসঙ্গ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে বলা যায়, সুলতান অভিজাততান্ত্রিক ব্যক্তিবাদী মহিমা রচনার রেনেসাঁস আদর্শ নাকচ করেন। বরং কৃষ্টির মাধ্যমে যূথবদ্ধ সত্তার ক্রিয়া-কর্মকে মূল বিবেচনা করেন। অতএব, যে শিল্পী রেনেসাঁসের মৌল আদর্শকেই গ্রহণ করেননি, তাঁর শিল্পের বিবেচনায় রেনেসাঁস শিল্পের টেকনিক প্রয়োগ হয়েছে কিনা সেই প্রশ্ন কি প্রাসঙ্গিক?

 

সংকীর্ণ রাষ্ট্রবাদী পরিচয়ের রাজনীতি প্রত্যাখ্যান 

 আহমদ ছফা, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সাখাওয়াত টিপু, নিজার আলম প্রমুখ এক সারি গুরুত্বপূর্ণ লেখক-চিন্তক-গবেষকদের সুলতান-সমালোচনার একটি কেন্দ্রীয় অভিমুখ হলো জাতিরাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রকল্পনার বিভিন্ন রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক মহাবয়ান। কিন্তু মোস্তফা জামানের ভাবনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই লেখা প্রস্তাব করে যে, সুলতানের কাজে জাতীয়তাবাদী বা রাষ্ট্রবাদী পরিচয়ের প্রকল্প অনুপস্থিত। সুলতানের শরীরে বলে দৃপ্ত মহাকাব্যিক চিত্রপটের বর্ণ, বিন্যাস, বুনন, রেখা, আল্পনা বা মোটিফ কোনো চিত্র-উপাদানই রাষ্ট্রচিহ্ন ফুটিয়ে তোলে না। এ ক্ষেত্রে সুলতানের কলাবিদ্যা বরং লালন সাঁইজী ও মহাত্মা রবীন্দ্রনাথের চিন্তার সঙ্গে আত্মীয়বন্ধনে আবদ্ধ। লালন সাঁইয়ের রূপান্তরকামী বৈপ্লবিক ভাবচর্চা এবং উদারনীতিবাদী রবীন্দ্রনাথের নেশনভারতবর্ষের প্রাচীন সমাজ বিষয়ক সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা আমলে নিলে বিশেষভাবে অনুধাবন করা যায় পাশ্চাত্যের আধুনিকতাবাদী নেশনালিজম ও রাষ্ট্রবাদ কেমন করে মানুষের স্বাভাবিক সংঘ-প্রবণতাকে নিপীড়ণমূলক যান্ত্রিক প্রণালীতে পর্যবসিত করে।

একটি নির্দিষ্ট জনপদে শ্রমজীবী [কৃষকের] শরীরে শোষণের ইতিহাস যে সাংস্কৃতিক অভিলেখ অনুশাসন আকারে খোদাই করে একটি লাঞ্ছিত শরীরে পর্যবসিত করে, একে সর্বোতভাবে সুলতান প্রত্যাখ্যান করেন। সুলতানের চিত্রপটে মানবশরীর ও আবাদী জমি সমার্থক, এক, অভিন্ন ও অদ্বৈত। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভূমি এবং শরীর সুলতানের কাজে অভিন্ন দ্যোতনা তৈরি করে। ভূমির কর্ষণের মাধ্যমে শরীরেরও কর্ষণ সাধিত হয়। শারীরিক কর্ম অর্থৎ কায়িক শ্রম যে উৎপাদনের মৌলিক উৎস, এই সত্যকে শিল্পী পুনঃসংজ্ঞায়িত করেন। লড়াই আছে কিন্তু প্রতিপক্ষ নেই। এভাবে সুলতানের শিল্পকাণ্ডে একটি নৈতিক-রাজনৈতিক ক্রিয়া অজ্ঞান মনের চিহ্ন আকারে উপস্থিত। সুলতানের শিল্পে শরীর, সময়, ক্ষেত্র ও সাম্যের ধারণা অবিচ্ছেদ্য। এখানে কৃষকের রূপান্তর করার অকৃত্রিম যে কর্তা-শক্তি [এজেন্সি] তা স্বভাবতই কল্পনার রাজনৈতিকতা দিয়ে আধ্যাত্মিক অর্থ প্রকাশ করে। এই অর্থে সুলতানের শিল্পকে ঘনিষ্ঠভাবে পাঠ করলে দেখা যায় সেখানে রাষ্ট্র নেই, আছে কৌম, কৃষক সমাজ। অধিকন্তু, জগৎ-সংসারের একটি অনুবিশ্ব আকারে পাঠ করা যায় সুলতানের কল্পিত স্বর্গীয় সমাজ বা রাজনৈতিক মানব-ভূগোল। ফলে, সুলতানের শিল্পকাণ্ডকে জাতীয়তাবাদী-রাষ্ট্রবাদী পরিচয়ের সংকীর্ণ রাজনীতির বর্গে চিহ্নিত করা যায় না।

ভিটগেনস্টাইনের ভাষা বিষয়ক দর্শন [Hanfling ২০০২] ধার করে বলা যায় যে, সুলতান হিউম্যান ফর্ম অব লাইফ বা জীবনের মনুষ্যরূপ সৃজিতে সাধনা করেছেন। এই মানুষেরা আধুনিকতাবাদী ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদী ভোক্তা সমাজের বিপরীত এক আন্তঃনির্ভরশীল কৌম সমাজের রূপকার। এই  মানুষেরা হয়ে ওঠার ক্রিয়া [প্রসেস অব বিকামিং] শুধু করেননি। হয়ে ওঠার পর স্বর্গীয় সুখদশার অভিজ্ঞতাও লাভ করেন। সুলতানের মানবসমাজ ভাষা দিয়ে গঠিত। এই মানবসমাজের মাতৃভাষা হলো কর্মশক্তি যা তাদেরকে সম্মিলিতভাবে কর্তাশক্তিতে পরিণত করে। এবং তাদের যূথবদ্ধ জীবনের প্রস্তাবনা হাজির করে। তাই সুলতান জাতীয়তাবাদী শিল্পের পরিচয়বাদিতায় নিপতিত কোনো শিল্পী নন। সুলতানের মানুষেরা একটি নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ডের অন্তর্গত হলেও তাদের একটি বিমূর্ত রূপ রয়েছে। এই নিরাকার রূপের উত্তরাধিকার পৃথিবীর সকল মানুষ। কারণ, সুলতানের কাজের একটি অ্যালিগরিকাল বা রূপকধর্মী মাত্রা আছে। সুলতানের কাজে দেশ আছে, সমাজ আছে। কিন্তু জাতি নেই, রাষ্ট্রও নেই। সুলতান নৈরাষ্ট্রবাদী শিল্পী। সুলতান মানব-সমাজের একটি নৈতিক-স্বাভাবিক জীবন-বিন্যাস প্রস্তাব করেন। ফলে, তার কাজে কৃষক-কৃষাণীর উৎপাদনক্ষেত্র সংলগ্ন সম্মিলিত জীবনের একটি অন্তর্গত রূপরেখা সত্য হয়ে ওঠে। বিদ্যমান ক্ষমতা-কাঠামো ও দমনমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে মোকাবিলা করে একটি গ্রামের শ্রমনিষ্ঠ মানুষেরা সকলে মিলে তাদের সুখ-শান্তিতে সমৃদ্ধ এক স্বর্গীয় গ্রাম-সমাজ গড়ে তোলে। এই সামাজিক স্বর্গ প্রতিষ্ঠার মূলে আছে মুক্তিপ্রাপ্ত শরীর, সেই শরীরের কর্ম ও উৎপাদন। সুলতানের স্বর্গ বহু দূরে নয়, মানুষের মধ্যেই তা অবস্থিত, তবে একে শারীরিক ক্রিয়ায় নির্মাণ করতে হয়সুলতান তা-ই প্রস্তাব করেন।

এ কারণেই সুলতানের কৃষকেরা কৃষিজমিতে বা মাছ ধরার জলাভূমিতে লড়াইয়ে লিপ্ত। সুলতানের কাজের মধ্যেই একে পাঠ করার পদ্ধতিগত সূত্র নিহিত আছে। একে কেবল আধুনিকতাবাদী বাস্তববাদ দিয়ে বিবেচনার সুযোগ নেই। কারণ সুলতানের ছবিতে নিরেট পঞ্চ-ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপায়ে কার্যকারণসূত্রে লব্ধ বাস্তবতা নেই। বরং বাস্তবতার বিনির্মিাণ আছে। সুলতান এই বিনির্মিাণকে একটি নৈতিক ক্রিয়া হিসেবে প্রস্তাব করেন। এই বিনির্মাণের মাধ্যমে মানব-ভূগোলের সকল অপরাপরকে নিজের অংশ করে নেওয়ার ব্যাপার রয়েছে। এই সূত্রেই সুলতানের কাজে শত্রুপক্ষের অনুপস্থিতি বিশেষভাবে বিবেচনাযোগ্য। অনুপস্থিত অপরকে ইঙ্গিত করে সুলতান অপরায়নের প্রক্রিয়ায় থাকা নিদারুণ নৃশংসতাকে দারুণভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। এই বিনির্মাণের অর্থ হলো, যা অনুপস্থিত তা প্রবল ভাবে সবখানেই উপস্থিত। এর ফলে, মার্কসবাদী প্রোলিতারিয়েতের বিপ্লব-পরবর্তী নতুন মানুষের ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে আরেকটি একনায়কতান্ত্রিক শোষকে পরিণত হওয়ার আশঙ্কাকে সুলতান আমলে এনেছেন। তাই সুলতানের চিত্রিত এই শরীর সুপারম্যান নয়, নিউ ম্যানও নয়, বরং ক্রিটিকাল বিয়িং অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্রিয়ায় দুনিয়ার বুকে স্বর্গ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম মানুষ। এই মানুষের কোনো সংকীর্ণ পরিচয় নেই। সুলতানের মানুষেরা ভালোবাসার রাজনৈতিক ভাষা দিয়ে গঠিত।

 

আঙ্গিকের অচিনকরণ রাজনীতি, শিল্প ও জ্ঞানের অভেদ

[ক] শিল্প ও দর্শকের রাজনৈতিক সম্পর্কশাস্ত্র

সুলতানের শিল্পকাণ্ডের আরেকটি প্রায় অনালোচিত দিক হলো তাঁর শিল্পবস্তুর সঙ্গে দর্শকের সম্পর্ক কী এবং কিভাবে সেই সম্পর্ক নির্মিত হয়। দর্শক ও শিল্পের যে সম্পর্কশাস্ত্র সুলতান গড়ে তোলেন এর কেন্দ্রীয় সূত্র হলো বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনার অচিনকরণ [ডিফ্যামিলিয়ারাইজেশন বা অচেনাকরণ]। সুলতান সাধারণত মহাকাব্যিক পরিসরে চিত্রপটকে সৃজন করেন। এবং সেখানে চর্মচক্ষুতে গ্রাহ্য শ্রমজীবী মানুষের কঙ্কালসার অবয়বকে পরিণত করেন বলদৃপ্ত পেশিবহুল অতিমানবীয় অস্তিত্বে। সুলতান এই দুয়ের মাধ্যমে শিল্পবস্তুকে দর্শকের কাছে অচিনরূপে হাজির করেন। এর ফলে কী ঘটে? এই প্রশ্নের মীমাংসার জন্য রুশ গঠনবাদ [ফরমালিজম] ও জার্মান নন্দনতত্ত্বের শরণ গ্রহণ করা যেতে পারে।

রুশ গঠনবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা অস্ট্রানেনি [ostranenie] থেকে জানা যায় যে, কোনো সাহিত্য বা শিল্পকর্ম দৈনন্দিন চেনা-জানা বস্তুরূপকে ডিফ্যামিলিয়ারাইজ বা হঠাৎ অপরিচিত করে তুলতে সক্ষম। এই কলাকৈবল্যবাদী ভাবনা থেকে সারাৎসার গ্রহণ করে এর মধ্যে মার্কসবাদী রাজনৈতিক অর্থ যোগ করেন জার্মান নাট্যকার, পরিচালক ও তাত্ত্বিক বার্টল্ট ব্রেশট। ব্রেশট ফারফ্রেমডাংগস্ট এফেক্ট [এলিয়েনেশন/এ এফেক্ট] প্রস্তাব করেন দর্শককে নাট্যদৃশ্যে সম্মোহিত করার বদলে শোষণমূলক  বাস্তবতা সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন করে তুলতে। ব্রেশট তাঁর নাটকের মাধ্যমে অচিনকরণের প্রভাব সৃষ্টি করেন যাতে দর্শকের স্বাভাবিক যুক্তিশীলতাকে ভেঙে দিয়ে দর্শকের অনুধাবন ক্ষমতার শূন্যস্থানে নতুন চিন্তা-চেতনা সঞ্চার করা যায় [Krasner ২০০৮: ১৭০]।

ব্রেশটীয় রাজনৈতিক কাব্যতাত্ত্বিক এই ধারণা আ্যারিস্টটলীয় অভিজাততান্ত্রিক কাব্যতত্ত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত। অ্যারিস্টটলিয় ক্যাথারসিস বা বিমোক্ষণ হলো সেই ধারণা যা ট্র্যাজেডির নায়কের পরিণতির সঙ্গে একটি এমপ্যাথি বা সমানুভূতিমূলক সম্পর্ক স্থাপন করে। কিন্তু ব্রেখটীয় এ এফেক্ট দর্শককে আবেগে আচ্ছন্ন না করে বরং চিন্তনশীল কর্তারূপে সক্রিয় করে তোলে। একই ভাবে, সুলতানও তার শিল্পে শ্রমজীবী মানুষের দুঃখকষ্ট চিত্রিত করে দর্শকের মধ্যে সহানুভূতি [সিমপ্যাথি] বা সমানুভূতি [এমপ্যাথি] উদ্রেক করাতে চাননি। ব্রেখটের ভাবনার সাদৃশ্য যেন সুলতানের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। সুলতানও দুনিয়ার আরেক প্রান্তে থেকে ভেবেছেন দুঃখকষ্টের রূপায়ণ সমালোচনামূলক ও কল্পদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তার প্রধান শত্রু [পূর্বোক্ত]। এ কারণে তাঁর বিস্তৃত চিত্রপটে চিত্রিত নর-নারী, সুনির্দিষ্টভাবে বললে, কৃষক-কৃষাণীর পেশীবহুল অতি-মানবীয় শারীরিক রূপ দর্শকের কাছে অচিনরূপে আবির্ভূত হয়। কারণ তিনি কৃষকের দুঃখকষ্ট নয় বরং তাদের  উত্থান ও উত্তরণ তুলে ধরে মূলত মানুষের পরিবর্তনশীল স্বভাব এবং সমাজকে রূপান্তর করা যে সম্ভব, এই সত্যের জানান দিয়ে সুলতান দর্শককে সচকিত করেন। শিল্পকর্ম দেখার নান্দনিক অভিজ্ঞতা বিলম্বিত করে দর্শককে তৎক্ষণাৎ সচেতন ও সমালোচনামূলক ভাবনায় সক্রিয় করে তুলেন। এভাবে, সুলতানের ছবির কৃষক-কৃষাণীর অতি-মানবীয় আঙ্গিক অ্যারিস্টটটলীয় নন্দনতত্ত্বানুযায়ী দর্শককে আবেগিকভাবে সমানুভূতিতে আচ্ছন্ন না করে, বরং এই প্রতাপশালী আধুনিকতাবাদী কৌশলকে প্রত্যাখ্যান করে। ফলে, বলা যায় যে, সুলতানের ছবির কেন্দ্রীয় অভিমুখ কেবল কৃষক-কৃষাণীর অতিমানবীয় আঙ্গিক নয়। এর পাশাপাশি, সুলতানের ছবিতে রয়েছে অদৃশ্য চরিত্র যারা তাঁর ছবির দর্শক। ফলে, সুলতানের অতিকায় ক্যানভাসে অঙ্কিত হয়নি যে চরিত্র, সেই অনুপস্থিত দর্শককে না ভেবে সুলতানের ছবি পাঠ করা অসম্ভব। সুলতানের শিল্পকর্ম অচিনকরণ প্রভাব সৃষ্টি করে বিরাজমান দমনমূলক বাস্তবতাকে যে রূপান্তর করা সম্ভব, সেই রাজনৈতিক ভাবনায় দর্শককে অনুপ্রাণিত ও চিন্তনশীল সক্রিয় মানুষে পরিণত করতে সচেষ্ট। সুলতানের শিল্প ও দর্শকের মধ্যকার রাজনৈতিক সম্পর্কশাস্ত্রের রচনাপদ্ধতি তাঁর শিল্পকাণ্ডের এক অনন্য বৈশিষ্ঠ্য।

[খ] শিল্পীর অনুভব ও জ্ঞানের অভেদ

অধিকন্তু, সুলতানের ছবির মধ্যে যা রূপায়িত হয় সেগুলোকে শিল্পী কিভাবে রূপায়ণ করেন তার একটি ব্যাখ্যা জ্যঁ পল সার্ত্রের অনুসরণে হাজির করা যায়। যেমন, সার্ত্রে জগতের বিষয়-আশয়কে [থিংস] ধারণায় [আইডিয়া] পর্যবসিত করার প্রবণতাকে বস্তুজগতের স্বাভাবিকতার প্রতি আক্রমণের শামিল বলে মনে করেন [Heyfron ১৯৮৩: ৪৮]। বৈজ্ঞানিকভাবে জগতকে ব্যাখ্য করার অধিপতিশীলতাকে অস্বীকার করেন সার্ত্রে।  জগৎসংসার মূলত মানবীয় মূল্যবোধ দ্বারা পরিপ্লাবিত। এই মূল্যবোধ আমাদের মাথায় থাকে না, থাকে বাহ্য জগতে। এমনকি আমাদের অনুভূতিগুলো আমাদের দেহজ কোনো সংবেদনা থেকে তৈরি কোনো চৈতন্য নয়। এগুলো বরং আমাদের বাইরের জগতের দিকে ধাবিত। অর্থাৎ বাহ্য জগতের প্রপঞ্চ বা নানা কাণ্ডকীর্তি, আলামত ও ঘটনাবলির দিকে পরিচালিত। সার্ত্রে মনে করেন, অনুভূতি হলো এই বিশ্ব সংসারকে পুনরায় আবিস্কার করার উপায় [পূর্বোক্ত, ৪৮-৪৯]। সুলতান শিল্পীর অনুভব দিয়েই তার পারিপার্শ্বিক মানব-সমাজের একটি নৈতিক-রাজনৈতিক বিন্যাস আবিস্কার করেছেন। যে বিন্যাসে দেখা যায় শ্রমনিষ্ঠ মানুষ কর্মের মাধ্যমে উৎপাদন ক্ষেত্র অর্থাৎ কৃষি জমিতে, ফসলের ক্ষেতে, মাছের জলাভূমিতে নিজেদের সম্মিলিত অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। নতুন কর্র্তৃত্ব জারি করে। এই পুরো শৈল্পিক ক্রিয়া মূলত শিল্পীর কল্পনার মাধ্যমে সংঘটিত হয়। কারণ, অনুভব করার মানে হলো ক্রিয়া করা [ফিলিং ইজ অ্যা কাইন্ড অব অ্যাকটিভিটি] [পূর্বোক্ত ৪৭]। বনি মারানকা ও গৌতম দাসগুপ্ত যেমন বলেন, ভেতরগত এক প্রয়োজনীয়তার শক্তিবলে একজন শিল্পী তাঁর আবেগিক চাহিদার একদম অতলে ডুব দিয়ে খাঁটি কিছু সন্ধান করতে বাধ্য হন [উদ্ধৃত Mark পূর্বোক্ত]। শিল্পী সুলতান তার নিকটতম পরিপার্শ্ব সম্পর্কে যে তীব্র আবেগিক চাহিদা অনুভব করেছেন তাই তিনি খাঁটি বা সত্য করে এঁকেছেন। এভাবে, আমরা একালের দর্শক একটি তীব্র আবেগ দিয়ে সৃজিত শৈল্পিক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই সুলতানের কাজ দেখার সূত্রে। এই অভিজ্ঞতা তৈরি করতে সুলতান যে শিল্পবস্তু সৃজন করেন তা মোটেই ব্যক্তিগত উৎকল্পনা নয়। সার্ত্রের ভাবনাকে ব্যাখ্যা করে হেফ্রন যেমন তুলে ধরেন নান্দনিক অভিজ্ঞতা দানকারী শিল্পবস্তু কখনোই একান্ত ব্যক্তিগত উৎকল্পনার প্রক্ষেপণ [প্রজেকশনস অব প্রাইভেট ফ্যান্টাসিস] হতে পারে না [Heyfron ১৯৮৩: ৪৯]। কারণ, শেষপর্যন্ত সবকিছুই, এমনকি আমরা নিজেরাও, এই বাহ্য দুনিয়ার প্রপঞ্চ মাত্র।  ফলে, সুলতানের কাজ মূলত অপরের সঙ্গে নিজের সংশ্লেষ ঘটাবার নৈতিক-রাজনৈতিক শৈল্পিক ক্রিয়াকে বিধিবদ্ধ করে। এই অপর আবার শ্রেণি-নিরপেক্ষ নয়। তা সাম্যের আকাঙ্ক্ষা দিয়ে গঠিত একদল মানুষ যাদের অবলম্বন শরীর। অচিনকরণ প্রভাবের সূত্রে সর্বহারা শরীরের চালিকা শক্তি তিনি পুনরায় আবিস্কার করেন এক শৈল্পিক অনুভবের মাধ্যমে। ফলে, সুলতানের কাজ একটি বিশ্বজনীন রূপকের মূল্য অর্জন করে। সুলতানের কাজে যে কোনো মানব সমাজ নিজেদেরকে আবিস্কার করতে পারে সাম্যের স্বপ্নে। শুধু সমতার স্বপ্ন নয়, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার রাজনৈতিক-শারীরিক ক্রিয়া-ই সৌর্ন্দয্য সৃষ্টি করেএই অনুভবের মুখ্য প্রকাশ ঘটে সুলতানের কাজে।

 

উপসংহারের বদলে 

সুলতানের ছবি আঁকার কাঁচামাল, পদ্ধতি ও ছবির আধেয় বিষয়বস্তুর সঙ্গে সুলতান নিজের সমুদয় ব্যক্তিগত দূরত্ব শেষপর্যন্ত ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন। শিল্পের সাধন ও জীবনের যাপনএই দুইয়ের অদ্বৈততায় এসএম সুলতান স্বয়ং যেন হয়ে উঠেন এক পরিবেশনমূলক শিল্পকলা। পৃথিবীর নানা প্রান্ত পরিভ্রমণের পর নিজের জন্মভিটা মাছিমদিয়া গ্রামে প্রত্যাবর্তন ও সেখানে নিমগ্ন জীবন-যাপন সবটুকু মিলিয়ে পাঠ করলে চাক্ষুষ করা যায় সমগ্র সুলতান একটি শারীরিক পরিবেশনারূপী কৃৎকলা বা পারফরম্যান্স আর্ট। একদা সলিমুল্লাহ খান উদ্ধৃত, অকালপ্রয়াত দার্শনিক খান মোহাম্মদ ফারাবির উক্তি খানিক বদলে বলা যায় সুলতানের এই মৃত্যু-চিহ্নিত জীবনের অপর নাম [পরিত্রাণমূলক এক শারীরিক] শিল্প। যাপন যদি হয় শিল্প [আর্ট অব লিভিং] আর তার নাম যদি হয় কৃৎকলা [পারফরম্যান্স আর্ট] তবে এসএম সুলতানের জীবন ও কাজের মূল পরিচয় হবে একটি পারফরম্যান্স আর্ট [Johnson, ২০১৫]। সুলতানের প্রাত্যহিক জীবন আর তার সৃজিত শিল্পকলার মধ্যে ব্যবধান সামান্যই। শেষপাদে সুলতানের মাছুমদিয়া গ্রামে নিজের জীবনের অনুশীলন [প্র্যাক্সিস অব লাইফ] তাঁর শিল্পের স্বগীয় স্বপ্নকে প্রতি মুহূর্তেই সংবিধিবদ্ধ করেছে। সুলতান নামক পারফরম্যান্স আর্টের একটি সাধারণ অর্থ হলো, তিনি বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পে প্রথম উত্তরাধুনিক শিল্পী। তাঁর কাজ আধুনিকতাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে, সংকীর্ণ পরিচয়বাদী রাজনীতি নাকচ করে, জাতি-রাষ্ট্রবাদের বদলে সমাজের বিন্যাসকে রিডিজাইন করে এক রূপান্তরিত মানব-ভূগোল শীর্ষক স্বর্গ সৃষ্টি করে। সুলতান শীর্ষক এই পারফরম্যান্স আর্ট, এই দুনিয়াতে মানুষের অস্তিত্বের কোরিওগ্রাফি ততদিন করে যাবে, যতদিন দুনিয়াকে স্বর্গে পরিণত করার স্বপ্ন দেখার কারণ রয়ে যাবে।  

 

তথ্যসূত্র

⇒ খান, সলিমুল্লাহ [২০০৫] সম্পা. জাক লাকাঁ বিদ্যালয়, ঢাকা: এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা।
⇒ ছফা, আহমদ [২০০২]: ‘বাঙালির চিত্র ঐতিহ্য: সুলতানের সাধনা’। প্রবন্ধ সমগ্র। ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স। পৃ. ৩৪-৬০।
⇒ জামান, মোস্তফা [২০২২], ‘আবহমান বাংলার সুলতান’, ৭ অক্টোবর, দৈনিক সমকাল, ঢাকা।  https://samakal.com/feature/article/2210135365
⇒ টিপু, সাখাওয়াত [২০১৪], ‘লাল মিয়ার রাষ্ট্র’, বাংলা নিউজ ২৪ ডটকম: শিল্প-সাহিত্য, ১০ আগস্ট, ঢাকা। https://www.banglanews24.com/cat/news/bd/313614.details
⇒ নিজার, সৈয়দ [২০১৭], ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা,  সিলেট: চৈতন্য।
⇒ মৈশান, শাহমান [২০২১], “সাহেব-বাবুর বৈঠকখানায় বাংলা নাটক: ঔপনিবেশিকতা ও আধুনিকতা”, তর্ক বাংলা [অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা], ঢাকা। পড়ার তারিখ ১১ জুন ২০২২। লিংক: https://tarkabangla.com/content/20
⇒ Abrams, M.H. [2000] A Glossary of Literary Terms, Singapore: Harcourt Asia pte ltd.
⇒ Baudelaire, Charles [1965] The Painter of Modern Life and Other Essays, Translated and edtited by Jonathan Mayne, London: Phaidon Press.
⇒ Bennett, Susan [1997] Theatre Audiences: A Theory of Production and Reception, London and New York: Routledge.
⇒ Burke, Sean [1998] The Death and Return of the Author: Criticism and Subjectivity in Barthes, Foucault and Derrida, Edinburgh: Edinburgh University Press.
⇒ Childs, Peter [2000] Modernism, London and New York: Routledge.
⇒ Dewey, John [1979] Art as Experience, New York: Paragon Books.
⇒ Dwivedi, Divya. et al. [2018] Introduction’ in Narratology & Ideology: Negotiating Context, Form, and Theory in Postcolonial Narratives, Divya Dwivedi, Henrik Skov Nielsen, and Richard Walsh [eds.], Columbus: The Ohio State University Press.
⇒ Dollimore, Jonathan. [1994], "Introduction: Shakespeare, cultural materialism and the new historicism", in Political Shakespeare: Essays in cultural materialism, eds. Jonathan Dollimore and Alan Sinfield, Manchester: Manchester University Press. pp.2-17.
⇒ Eagleton, Terry [1988] “Towards A Science of the Text” in K.M. Newtonn [K. M.], ed., Twentieth Century Literary Theory: A reader, London: Macmillan Press
⇒ Fortier, Mark [2002] Theatre/Theory: An Introduction, London and New York: Routledge.
⇒ Foucault, Michel [1984] “What is Enlightenment?” in Rabinow [P.], ed., The Foucault Reader, New York: Pantheon Books, pp.32-50.
⇒ Hanfling, Oswald. [2002]. Wittgenstein and the Human Form of Life. London and New York: Routledge.
⇒ Heyfron, Victor [1983] ‘The Objective Status of Aesthetic Knowing’ in The Arts: A way of Knowing, edited by Malcolm Ross [ed.], Oxford: Pergamon Press,pp. 43-72.
⇒ Jameson, Fredric [1983] The Political Unconscious: Narrative as a Socially Symbolic Act, London and New York: Routledge.
⇒ Krasner, David [2008], ‘Bertolt Brecht [1898-1956]’ in Theatre in Theory 1900-2000: An Anthology, David Krasner [ed.], Malden and Oxford: Blackwell Publishingpp.169-184.
⇒ Loomba, Ania [1998] Colonialism/Postcolonialism, London & New York: Routledge.
⇒ Macey, David [2000] The Penguin Dictionary of Cirtical Theory, London: Penguin Books.
⇒ Slaughter, Cliff [1980] Marxism, Ideology & Literature, London: The Macmillan Press.
⇒ Said, E.W. [1978] Orientalism, London and Henley: Routledge and Kegan Paul.
⇒ Soja, Edward [1999] ‘History: Geography: Modernity’ in The Cultural Studies Reader, Simon During [ed.], London and New York: Routledge.
⇒ Touraine, Alain [1995] Critique of modernity. Translated by David Macey. Oxford: Blackwell.
⇒ Warnock, Mary [1983] ‘Imagination’ in The Arts: A way of Knowing, ibid.,pp. 73-83.
Zaman, Mustafa [2010] ‘Reframing Lal Miah’, Depart, Dhaka. http://www.departmag.com/index.php/en/detail/32
⇒ [2021] ‘SM Sultan: The Vision of a Coming Society’, 10 August, The Daily Star, Dhaka. https://www.thedailystar.net/views/opinion/news/sm-sultan-the-vision-coming-society-2148666