চর্ব্য চোষ্য [প্রথম পর্ব]

অ+ অ-

 

[প্রথম পর্ব]

মেয়েকে নিয়ে সকালে আশুলিয়ায় বিনোদন পার্কে গেছিল নাশিতা সুলতানা। সেখান থেকে সন্ধ্যায় কেবল ফিরছে। তার বেগুনি কার বনানী পার হয়ে গুলশানে ঢুকতেই চেয়ারম্যানের পিএ ফোন করলেন। 
এমন সময় পিএর ফোন মানে জরুরি কিছু হতে পারে। নাশিতা চিন্তিত মুখে কল রিসিভ করে। ‘চেয়ারম্যান সার আজ রাতে মিটিং করতে চান। কাল সকাল থেকে পোশাক শ্রমিকরা ধর্মঘট করছে যে—।’
মিটিংয়ের স্থান-কাল এখনও ঠিক হয়নি। ঠিক হলে জানাবে বলল।
নাশিতা চিন্তায় পড়ে। এ ধরনের মিটিংয়ে তাকে এই প্রথম ডাকছেন চেয়ারম্যান। ভাওয়াল শিল্প পরিবারের প্রধান। নাশিতা এই পরিবারের সিনিয়র পারফরমেন্স অ্যানালিস্ট। বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খোঁজা তার প্রধান কাজ।
বেগুনি কার একটা ছয়তালা হলুদাভ বাড়ির সামনে গিয়ে থামল। গুলশান দুই নম্বরে লেক সড়কে। দারোয়ান দৌড়ে এসে বিরাটকায় ইস্পাতের গেট ঘড়ঘড় করে টেনে খুলে দেয় আর গাড়ি ভেতরে ঢোকার সময় লম্বা স্যালুট। সব গাড়ি ঢোকার সময় আর বের হবার সময় এ তার অঘোষিত দায়িত্ব।
নিচতালায় মাঝখানে লিফটের সামনে দাঁড়ায় গাড়িটা। চালক নেমে দরজা খুলে দিলে নাশিতা মেয়ের দিকে তাকাল। সাড়ে পাঁচ বছরের তাহিরা ইসমি ট্যাবে ভিডিও গেম খেলছে।
নাশিতা সুর করে বলল, ‘আমরা এসে পড়েছি!’
এই বাড়ির তিনতালায় নিজেদের ফ্ল্যাট তাদের। প্রশস্ত ড্রইংরুমের পাশ দিয়ে ইংরেজি এল আকার কমন স্পেস। তার দুই পাশ দিয়ে নানা রকম রুম। ইসমি ভেতরে ঢুকতেই দাদি জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমি তোমাকে মিস করেছি, ময়নাপাখি!’
‘আমার মুড ঠিক নেই। আম্মি আমাকে পাইরেট শিপে রাইড করতে দেয়নি। বলে কিনা ভয় লাগে।’
‘ওহ! খুব দুঃখের কথা!’
‘আম্মি একটা ভিতুর ডিম।’
ইসমি খেলার ঘরে চলে গেল। ঘরের সব দেয়ালে বহু ধরনের কার্টুন এঁকে মিষ্টি একটা সুর তোলা হয়েছে। প্রশস্ত ঘরে দুই তাকে সারে-বেসারে সাজানো হরেক রকম খেলনা। কিছু আছে মেঝেতে ছড়ানো-ছিটানো। সব উল্টেপাল্টে ইসমি একটা হর্স রাইড খুঁজতে লগল। যা সে পার্কে দেখে এসেছে।
খেলনাটা এ রুমে না পেয়ে সে বেডরুমে গেল।
নাশিতা বিছানায় গড়িয়ে পড়েছে। চোখ বুজে আছে। মিনিট দশেক পরে নতুন করে তৈরি হবে। মিটিংয়ের আগেই ধর্মঘটের খোঁজ নেওয়ার কথা ভাবছে। হোটেল ওয়েস্টার্ন গেলে পোশাকশিল্পের বন্ধুবান্ধব কাউকে পাওয়া যাবে।
বাসার কাছেই গুলশান এভিনিউতে ওয়েস্টার্ন। বহস রীতির বিরাট এক নান্দনিক স্থাপনা। ঝা চকচক রঙিন মেঝে আর নানা রঙের দেয়াল। আছে বড় লাউঞ্জ। তারা ফাইভ স্টার দাবি করে। অনেকে তা মানতে নারাজ। তারা বলে আসনগুলো আরো ঘন ঘন ধোলাই করা উচিত। কিছু এসিতে অনেক শব্দ হয়। ইত্যাদি।
নিচতালায় কোনো বান্ধব নেই। নাশিতা চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠে গেল। এখানে স্মোক জোনে বিকালে একজন-না-একজন বন্ধু মেলে। আজ কেউ নেই। তবে তেইশতালায় কাউকে-না-কাউকে পাওয়া যাবে। সেখানে রয়েছে পানশালা, রেস্তোরাঁ, আলাদা ধূমপান এলাকা।
কাচের দরজা ঠেলে পানশালা পার হতেই তিন বন্ধুকে পেয়ে যায় নাশিতা। সবাই সাদা সোফায় বসে সিগারেট ফুঁকছে।
প্রায় সত্তর ফুট লম্বা ব্যালকনির একপাশে এক সারি সোফাসেট। প্রতিসেটে একটা করে নিচু টেবিল। আরেক পাশে বুকসমান গোল টেবিলে লম্বা লম্বা পা-অলা চেয়ারে বসার ব্যবস্থা। তার পাশে পাঁচ ফুট উঁচু স্বচ্ছ কাচের দেয়ালের ওপাশে বহুদূর বিস্তৃত শহর। শহরের ওপর দিয়ে দিগন্তে চোখ চলে যায়। কাচের দেয়ালের ওপর দিয়ে বাতাস হাঁটাহাঁটি করে। তেইশতালা পর্যন্ত ধুলো-ধোঁয়া না আসায় ব্যালকনিটা গুলশানের জনপ্রিয় আড্ডাখানা হয়েছে। দেশি-বিদেশি লোকজন দলে দলে দাঁড়িয়ে, বসে বসে মদিরা পান করছে। তামাকের ধোঁয়া গিলছে। নাশতা খাচ্ছে। দুচারজন তরুণী-নারী আছে তাদের মধ্যে। বেশির ভাগ ওড়নাবিহীন। ঘাড়ে বাঁধিয়ে বুকের ওপর দিয়ে দুই মুড়ো ঝুলিয়ে দিয়েছে কেউ কেউ। অনেকে ঝুলিয়েছে গলায় বাঁধিয়ে পিঠের ওপর দিয়ে। শর্ট টপস পরেছে দুই তরুণী। শার্ট পরার দলে আছে দুএকজন। বিদেশি নারীদের পরনে শার্ট আর টি-শার্ট।
নাশিতা ইংরেজিতে বলল, ‘এই যে, তিন বোম্বাটে! আমাকে রেখে কী পরিকল্পনা হচ্ছে, হুম?’
‘আমাদের গোপন মিটিংয়ে তুমি অপ্রত্যাশিত!’
‘ওহ! সত্যি?’
‘সত্যি!’ মজা করছে ইয়ানা মিলিনুরা। গ্রানাইট সিমেন্ট কম্পানির চেয়ারম্যান ইয়ানুর রহমানের মেয়ে। বিয়ে করবে না। সারা বছর বিদেশ ভ্রমণ করে বেড়ায়। ওড়না ছাড়া টপস পরে চলে সব জায়গায়। তার বন্ধুনাম ইয়া টুরিস্ট।
বন্ধুদের মধ্যে আরো আছে বায়িং হাউজের মালিক সেলিম হাসান। সুদর্শন। সুন্দর সুন্দর টি-শার্ট কেনা তার নেশা। একটা কোনো দিন দ্বিতীয়বার পরে না। আছে বহুজাতিক ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার তাহিদুল। বন্ধুরা বলে টাকলু। সব সময় স্যুট-বুট পরে থাকে।
সবাই নাশিতার বাল্যবন্ধু। স্কুল-কলেজে সহপাঠী ছিল কখনও কখনও।
মিলিনুরা বলল, ‘এই সন্ধেবেলা তুমি এমন সাজুগুজু করেছ কেন? কী মতলব?’
‘নতুন হাবি খুঁজতে যাচ্ছি, ডার্লিং!’
‘হা হা হা! সারা জীবনে একটা প্রেম করতে পারলে না! তারপর বাপের ধরে আনা একটা মাল নিয়ে—,’ মিলিনুরা যেন বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। আগ্রহের ভঙ্গিতে সামনে ঝুঁকে বলল, ‘আট-দশ বছরে তুমি একদিনের জন্যও মালটাকে চোখের আড়াল কর নাই! মালটায় কী আছে বল দেখি?’
‘মালটা বরাবরই সুস্বাদু, ডার্লিং! টকও আছে মিষ্টিও আছে। আর এটা খুব উপকারীও বটে। ভিটামিন সি, পটাশিয়াম…!’
‘হা। বুঝেছি। উপকারী না হয়ে আর উপায় কী।’
নাশিতা মৃদু হেসে সোফায় বসল। সামনে টি-টেবিলে তিনটা অস্ট্রেলিয়ান বিয়ারের খালি ক্যান। ইতালির স্যান পেল্লেগ্রিনো ব্র্যান্ডের স্পার্কলিং পানির সবুজ বোতল। আছে আমেরিকান সিগারেটের প্যাকেট। নাশিতা প্যাকেট নিয়ে একটা সিগারেট বের করল।
মিলিনুরা বইয়ের ভাষায় ইংরেজিতে বলল, ‘এটা কিন্তু মারাত্মক কড়া। তোমাকে আমার সাবধান করা উচিত।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু তুমি আমার বসের মত কথা বোলো না,’ নাশিতাও একই কায়দায় বলল।
এই বন্ধুরা এক জায়গায় হলে সাধারণত ইংরেজি বলে। ব্রিটিশ ভঙ্গিতে। কখনও কখনও বাংলিশ বলে। তাদের পরিবারের সদস্যরাও।
নাশিতা সিগারেটে টান দিয়ে বলল, ‘বিশেষ কড়া না।’
‘আরো কয় টান দিয়ে দেখ।’
নাশিতা ধীরে টানে। সে জানে দ্রুত হলে মাথা ঘুরাতে পারে। সে শুধু আড্ডায় বসলে দুএকটা চেখে দেখে। তার বিশেষ কোনো ব্র্যান্ড নেই। দ্বিতীয় টান দেওয়ার সময় এক ভুঁড়িঅলা বন্ধু আসল।
‘ওই যে আদম ব্যাপারি হাজির!’
‘সব শালাই আদম ব্যাপারি। কেউ এইখানে কারখানায় নিয়ে করে আর কেউ কেউ বিদেশ পাঠায়।’
‘ত তোমার মেজাজ খারাপ কেন? হয়েছে কী?’
‘কিছুদিন আগে মারকো হালার পুত বেইমানি করল। বিশটা ভিসা দেওয়ার কথা। পরে বলল আর লোক নেবে না। হারামজাদা অন্য কোনো এজেন্ট ধরেছে। তারপর হারুকি তানাকা মাদারচোত। আজ আবার অগাস্টিন। বাস্টার্ড।’
সবাই হোহো হাহা করল।
নাশিতা অবাক হবার ভঙ্গিতে বলল, ‘তার মানে সংকট তোমাকে সারা বছর করে নিয়ে বেড়াচ্ছে, হুম?’
‘সবই আমার কপাল!’ ব্যাপারি কাচের দেয়ালের পাশে উঁচু চেয়ারে উঠে বসে। ব্যাংকার তাকে সান্ত্বনা দেয়, ‘হতাশ হইয়ো না, বাডি। মাঝে মাঝে বেশি করে চোদন খাওয়া ভাল!’
হাহা হোহো।
‘যার যা ব্যবসা। মানুষ যত চোদন খায় তত তোমার সুবিধা হয়। না হলে তুমি বেশি করে ঋণ দেবে কেমনে, হুম? তোমরা শালারা ঋণ ব্যবসায়ীরা নিরিবিলি দাপট দেখাও।’
‘সারা দুনিয়া ঋণ ব্যবসায়ীদের কাছে ধরা।’
‘কৈয়ের তেলে কৈ ভাজার ওস্তাদ।’
‘ব্যবসা মানেই কৈয়ের তেলে কৈ ভাজা।’
নাশিতা ঘড়ির দিকে তাকাল। সে যে পোশাক শ্রমিকদের ধর্মঘটের খবর জানতে চাচ্ছে, তেমন কাউকে এখনও দেখা যাচ্ছে না। সেলিমও পোশাকশিল্পের লোক বটে। নিজের কারখানা না থাকলেও অনেক কারখানার সঙ্গে তার রয়েছে ঘনিষ্ঠ সংযোগ। সে সেসব কারখানায় কাজ করায় বিদেশি ক্রেতাদের জন্য। তারপর জাহাজে করে পাঠায়।
নাশিতা বলল, ‘আর তোমার কী খবর, দোস্ত? তোমার শ্রমিকরা নাকি ধর্মঘটে যাচ্ছে?’
‘হুম! আমি এই কিছুক্ষণ আগে খবর শুনলাম। মাদারচোতরা সব সময়—সারা বছর তাদের বেতন বাড়াও। মাদারচোত দেশের কোনো কিছু স্ট্যাবল না। আমি মাইগ্রেট করব ভাবছি।’
‘উম্ম্—ধর্মঘট কি নিশ্চিত?’
‘একশ পার্সেন্ট।’
নাশিতা বিস্তারিত জানতে চায়। শ্রমিকদের দাবিদাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু সেলিম আর কিছু জানে না। অনলাইনে ঢুঁ মেরে দেখা যায়। 
নির্ভর করার মত কোনো গণমাধ্যম এখনও খবর দেয়নি। দুএকটা যদু-মধু গণমাধ্যম বলছে বটে। তারা কোনো খবরের উৎস উল্লেখ করেনি। তার মানে এখনও কোনো শ্রমিকনেতা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি বলে ধরা যায়।
পরিচারক আসলে নাশিতা কফির অর্ডার দিল। যখন কফি দিল ঠিক তখনই চেয়ারম্যানের পিএর ফোন। রাত নয়টায় এই হোটেলেই মিটিং হবে। রুমের নাম গোল্ডেন মিট। নাশিতা চেনে। সোনালি রঙের ওই রুমে জনা দশেক লোক বসতে পারে। তার মানে ছোট মিটিং। নাশিতার মনের মধ্যে আলোড়ন হতে লাগল।
কাঁটায় কাঁটায় নয়টায় ঢুকল নাশিতা। ঢুকেই অবাক। এখানে কি মিটিং হবে নাকি ডিনার পার্টি। উজ্জ্বল বাদামি কভারে ঢাকা টেবিল-চেয়ার। টেবিলের দুপাশে সাদা ন্যাপকিনে সাজানো চিনামাটির সাদা প্লেট। ছুরি-চামচ। সামনে চকচকে কাচের গ্লাস আর আমেরিকান গ্ল্যাসিয়ায় স্মার্ট ওয়াটার বোতল। নকশা করা বক্সে টিস্যু। স্বচ্ছ কাচের উঁচু ফুলদানিতে লাল-নীল গ্লাডিওলাস। 
অতিথিরা সবাই এসে পড়েছে।
নাশিতা কিছু বুঝতে পারল না। সে বরং চকিতে অতিথিদের দেখে নিল। ভাওয়ালের সিইও, আরো দুইজন সিনিয়র কর্মকর্তা, চেয়ারম্যান আর তার কয়েকজন পোশাক ব্যবসায়ী বন্ধুকে দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে ওয়েলকাম গার্মেন্টসের মালিক শিরিনা কোয়েলিও আছেন। নাশিতা তাকে চেনে কিন্তু আলাপ নেই।
কোয়েলির শাড়ি পরার ভঙ্গি নাশিতার মনে ধরে। হঠাৎ করে তারও পরার ইচ্ছা হয়। যদিও কোয়েলির শাড়ি পরার মধ্যে বিশেষত্ব নেই। অন্যদের মতই নিচে প্যাঁচানোর পর বগল বরাবর টেনে এনেছে। তারপর ব্লাউজের ওপর দিয়ে উঠিয়ে কাঁধে ঝুলানো। শাড়ির আঁচলটা কোয়েলিও অন্যদের মতই বাঁহাতে ঝুলিয়ে রেখেছে। হাত কি সারাক্ষণ শাড়ি ধরে রাখার জন্য নাকি? স্টুপিড স্টাইল! শাড়িতে আর নাশিতার ভক্তি হল না। তার বরং একটু রাগ হল। সে সিইওর দিকে এগিয়ে যায়। সেই মুহূর্তে কোয়েলি অন্যদিকে তাকাতে গেলে মুখোমুখি।
নাশিতা বলল, ‘গুড ইভনিং!’
উত্তরে কোয়েলি শুধু একটু হাসি দিলেন। নাশিতা এর কোনো মানে বুঝল না। বহুত স্টুপিড আছে যারা ন্যূনতম ম্যানার জানে না। অনেকে আবার ভাব দেখাতে গিয়েও একটা কিছু ভঙ্গি করে। কোয়েলি সেই দলের কিনা বোঝার চেষ্টা করল নাশিতা। তখনই চেয়ারম্যান তার মন ঘুরিয়ে দিলেন। ‘উনি হচ্ছেন নাশিতা সুলতানা। দেখতে জুনিয়র হলেও জিনিয়াস সিনিয়র।’ চেয়ারম্যান মৃদু একটু হাসিও দিলেন।
ভাওয়ালে ছয় বছরের চাকরি জীবনে আজ তাকে প্রথম হাসতে দেখল নাশিতা। চেয়ারম্যানের কাছে ‘জিনিয়াস’ খেতাব পেয়ে তার মন-প্রাণ ফুরফুর করে ওঠে। মিটিংয়ে সে দারুণ কিছু বলার জন্য তথ্য-উপাত্ত হাতড়াতে লাগল আর মনে মনে বিশ্লেষণ।
চেয়ারম্যান বললেন, ‘আমরা খেতে খেতে আলাপ করতে পারি।’
‘আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক গো। খিদেয় আমি একেবারে মারা যাচ্ছিলাম। আপনার কথায় পৈত্রিক প্রাণটা আবার ফিরে পেলাম।’ সুন্দরী কোয়েলির মুখে মধুর হাসি।
চেয়ারম্যানও হাসলেন। কোয়েলির বয়স চুয়াল্লিশ হলেও বত্রিশ-তেত্রিশ মনে হয় চেয়ারম্যানের।
ধোপদুরস্ত পরিচালকরা সিলভার কালার ক্যাসেরোল হটপটগুলো আনতে শুরু করে কিছুক্ষণেই। সুস্বাদু মেজেস, কাবাব, সুঘ্রাণে ভুরভুর ল্যাম্ব অউজি, মরোক্কান ট্যাগিন। ইত্যাদি। চেয়ারম্যানের অতিথিদের জন্য ভূমধ্যসাগরীয় খাবার-দাবার। তারা বলে মেডিটেরর‌্যানিয়ান কুইজিন। জিবে জলা আনা চোদ্দ রকমের বিশেষ আয়োজন।
সবশেষে তুরস্ক থেকে আনা মিষ্টি। পরিচারক প্রথমেই আনল রঙিন ডনড্রুমা। আইসক্রিমের মত কিন্তু তারচেয়ে অধিক কিছু। তারপর লকুম যাকে বলে টার্কিশ ডিলাইট। আরো আসল বাকলাভা আর কাদায়ইফ অ্যান্ড কুনেফে।
নাশিতা এসব রেসিপির সাথে পরিচিত বটে। চেয়ারম্যানের রুচি-চিন্তায় সে যারপরনাই আলোড়িত হয়। কিছুতেই স্মার্ট হয়ে উঠতে পারে না। পুরোটা সময় মূলত অন্যরাই কথা বলল।
তারাও সবাই অর্ধেক ইংরেজি অর্ধেক বাংলা বলে। কখনও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা কখনও বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি।
চেয়ারম্যান বললেন, ‘ধর্মঘটের কথা শ্রমিকরা আগে থেকেই বলছিল। কিন্তু এবার মোটেও ঠেকানোর চেষ্টা হয়নি। আমিও আগে খেয়াল করতে পারিনি।’
ব্যবসায়ীরা সবাই একে একে মত দিলেন।
‘এখনও সময় আছে। রাতেই উদ্যোগ নেওয়া যায়।’
‘এত কম সময়ে কিভাবে হবে?’
‘রাতেই শ্রমিকনেতাদের সাথে ফোনে কথা বলা যায়। মোটেই অসম্ভব মনে হচ্ছে না।’
‘আর সরকারের লোকজনের সাথেও যোগাযোগ করা দরকার। পুলিশমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী, দরকার হলে প্রধানমন্ত্রীর সচিব—।’
তাছাড়া তারা সব পোশাক পরিষদকে চাপ দেওয়ার কথা বলল। তারা অবশ্য পোশাক পরিষদ বলে না। অ্যাসোসিয়েশন, নিট, উভেন, এক্সপোর্ট ইত্যাদি ডজন খানেক ইংরেজি শব্দ দিয়ে তৈরি কয়েকটা সংগঠন আছে তাদের। সেগুলো তারা লেখে আর মুখে বলে ‘নিট’ ‘উভেন’ ‘অ্যাসোসিয়েশন’ এমন দুচারটা শব্দ।
দাপুটে চেহারার এক ব্যবসায়ী বলল, ‘ধর্মঘট যদি হয়ই তাহলে সেটা যেন বেলা দশটার মধ্যে শেষ হয়ে কাজে যায় শ্রমিকরা!’
‘তাও না। সকালে আমি ধর্মঘটের আলামতই দেখতে চাই না। সেজন্য মিনিস্টারদের চাপ দিলেই হয়। এটা কি ফাজলামি নাকি? মন্ত্রীদের কাজ কি শুধু অফিসে বসে বসে পায়ের ওপর পা তুলে নাচানাচি করা নাকি?’
অনেকে উত্তেজিত হয়ে রাগ ঝাড়ল। সংক্ষেপে আলোচনা করল বিভিন্ন বিষয়ে। তারপর তারা দায়িত্ব ভাগ করে নিল। কে কাকে ফোন করবে। ইত্যাদি।
নাশিতা কিছু বলার সুযোগ না পেয়ে চুপ। সবাই যেসব কথাবার্তা বলছে সে বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই। সে বরং মাথা নিচু করে ভাবতে লাগল এমন মিটিংয়ে চেয়ারম্যান তাকে কেন ডাকলেন।
এরই মধ্যে চেয়ারম্যান হেসে বললেন, ‘আপনি হচ্ছেন ভাওয়াল মাদার! আপনি মাথা হেঁট করে রাখলে সবার মাথা হেঁট!’
নাশিতা লাজুক হাসি দিল।
কোয়েলি বললেন, ‘লজ্জা পেয়ো না। আমি জানি তুমি একটা স্মার্ট মেয়ে!’
নাশিতা খুব অবাক হয় কোয়েলি তাকে চেনেন বলে। তার জড়তা খানিকটা কেটে যায়। তারপর সে ধর্মঘট বাদ দিয়ে তার আগে-পাছে বলার কথা ভাবে। ‘ধর্মঘট মোকাবিলা করার বিষয়ে আমার ভাল ধারণা নেই। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে যে, আমাদের শ্রমিকরা সব সময় অসন্তুষ্ট। প্রায় সবার মধ্যে সারা জীবন ক্ষোভ থাকে। হতাশা থাকে। আমার মনে হয় এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব। লাভের অংক মোটামুটি ঠিক রেখেই।’
অনেকে বিরক্ত হল মনে মনে। তবে কোয়েলি আগ্রহ দেখালেন।
নাশিতা বলল, ‘তাৎক্ষণিক লাভের জন্য যুদ্ধ হয়। সামগ্রিক পরিবেশ উন্নয়নের জন্য কে কী করছি? কিছু ত দেখি না। অন্তত চেষ্টাটা ত আমাদের থাকতে হবে।’
‘উম্ম্…!’
‘আমরা সবাই ত কারখানায় সুন্দর কর্মপরিবেশ চাই। সেটা অবশ্যই সম্ভব। কাজ শুরু করলে পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা তার ফল পেতে পারি। কাজ করতে গিয়ে আমার সে রকম মনে হয়েছে।’
সামগ্রিক পরিবেশ নিয়ে কেউ কিছু করার কথা ভাবেনি কখনও। তারা জানে সেটা সরকারের কাজ। তবু পোশাক পরিষদের সদস্য কোয়েলি বললেন, ‘উম্ম্ম্…ওকে!’ কয়েক সেকেন্ড উম্ম্ উম্‌ম্ করার পর বললেন, ‘আমি তোমাকে পরের শুক্রবার দাওয়াত দিচ্ছি। ওই দিন আফটারনুন আমার একটা মিটিং আছে র‌্যাডিসনে। মিটিং শেষে আমি তোমার সব সাজেশন্স শুনতে চাই। আলোচনা করতে চাই।’
কোয়েলি তার সেলফোনের নোটবুকে স্থান-কাল-পাত্র ইত্যাদি লিখলেন। তারপর রিমাইন্ডার দিয়ে পিএকে পাঠালেন। বৃহস্পতিবার নাশিতাকে মনে করিয়ে দেবেন বলেও জানালেন। ‘ওকে?’
‘ওকে!’ নাশিতা বলল বটে। সে একটু অস্বস্তিতেও পড়ল। সে আসলে কী বলল আর কী হতে যাচ্ছে কে জানে। তার বসরা কী মনে করবেন তারইবা ঠিক কী। এসব নিয়ে বেশিক্ষণ দ্বিধায় ভোগাও ভাল অভ্যাস না। 
খারাপ কিছু হলে নাশিতা খুব সহজেই সেখান থেকে শিক্ষা নিতে পারে। তারপর অল্প সময়ের মধ্যে ভাল পথ বেছে নেওয়ার কাজটা। সেখানে কিভাবে কী করতে হবে তাও বুঝে নেয় সহজেই। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, মেধাবী বন্ধু মাইশা আর আইনজীবী বাবা ভাল পরামর্শ দেয়।
সুতরাং নাশিতা সব ভুলে মিষ্টির দিকে তাকাল। মিষ্টি তার বরাবরই প্রিয় খাবার। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চামচ দিয়ে একটু লকুম কেটে নিয়ে মুখে দিল। এটা বারবার খেতে ইচ্ছে করে। সে বরং দুই চামচ মাউথ ফ্রেশনার আইসক্রিম দিয়ে মুখ মেরে দিল। মিষ্টির দিকে আর তাকাবে না।
মিটিং শেষে নাশিতা শিগগির বাসায় ফেরার জন্য পা বাড়ায়। সারাদিন দোড়োদোড়ি করে কাহিল আছে। শিগগির ঘুমাতে চায়। কিন্তু লিফট দিয়ে নিচে নামতেই বন্ধু মিনহাজুস সালেহিন আটকে দিল।
মিনহাজ একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম চালায়। মাঝে মাঝে বিভিন্ন হোটেলে ডিস্কো পার্টির আয়োজন করে। তার প্রতিনিধিরা ফোনে ফোনে খবর দেয় খদ্দেরদের।
এমন পার্টিতে কয়েকদিন যাওয়ার পর নাশিতার আর ভক্তি হয়নি। কিন্তু আজকের পার্টিটা এখানেই। এখন শুধু লিফট দিয়ে বাইশতালায় উঠতে হবে। সে না বলতে পারল না।
ওপরে উঠতেই কান ফাটানো ড্রামের শব্দে নাশিতার বিরক্তি লাগে। আর আলো-আঁধারি পরিবেশটা এত স্থূল! এবং অশ্লীলও বটে। তবে বন্ধুদের নাচ দেখে লেফট-রাইটের কথা মনে করে বেশ হাসা যায়।
‘নাচ করার এত শখ! ত নাচ শিখলেই ত পার!’
‘শিখব কই? এদিকে কারুর নজর নেই। একদল টাকা বানানোর ধান্দায় মত্ত। আরেক দল আবার—। আনকালচার্ড! ফাকিং! রাব্বিশ কানট্রি! মাদারচোত দেশ থেকে আমি মাইগ্রেট করতে চাই। খুব শিগগিরই,’ আলুথালু ইংরেজি বলল এক বন্ধু। 
এসব কমার্শিয়াল পার্টিতে নাশিতার মেয়েবন্ধুরা আসে না বললেই চলে। ছেলেবন্ধু আসে দুচারজন। অন্য যারা আসে তাদের বেশির ভাগই নাকি নানা কিসিমের ইতরলোক-ছোটলোক। ভাড়াটে মেয়েদের নিয়ে অশ্লীলভাবে কী কী সব করছে। যাকে তারা নাচ বলে। এখান থেকে নাকি আবার মেয়ে ভাড়া করে গাড়িতে নিয়ে যায়। বাড়িতে নিয়ে যায়।
‘কাম অন!’ আরেক বন্ধু নাশিতার হাত ধরে টান দিল। তার হাতে একখান বিয়ার ক্যান। নাশিতা কয়েকটা স্টেপ ফেলার পর পরিচারকের দিকে হাত উঁচু করল। তরুণ পরিচারক এগিয়ে আসলে বলল, ‘ভদকা।’
অনেক দিন ধরে কাজে ব্যস্ত থাকায় বন্ধুদের সাথে বসাও হয় না পানও হয় না। এমনকি গত সপ্তায় বন্ধু জ্যাকোবিনের পার্টিতে যাওয়ার সময় হল না। কী যে সব ঘটনা ঘটছে না এ বছর! লাইফ ইজ—ক্যারিয়ার অ্যান্ড—।
ব্লেড রানার হুইস্কি গ্লাসে এক পেগ ভদকা নিয়ে আসল পরিচারক। নাশিতা এক চুমুক দিয়ে নাচ শুরু করে। শৈশবে ‘ও’ লেভেল পর্যন্ত সে ইন্দিরা গান্ধী সেন্টারে কত্থক কথাকলি ইত্যাদি শিখেছিল। আর আলিয়ঁস ফ্রসেঁজে সালসা পলকা ইত্যাদি। সবকিছু প্রাথমিক পর্যায়ে। তবু সে এক দারুণ সম্পদ। বন্ধুমহলে খুব উপভোগ করা যায়।
ভদকা শেষ করে নাশিতা একটা শিভাস রিগাল নিল। কাল না হয় অফিসে একটু দেরি করে যাওয়া যাক না কেন। তবে অল্পক্ষণেই তার মেয়ের কথা মনে পড়ে। ইসমির কণ্ঠ ভেসে আসে কানের মধ্যে। মেয়ে বলছে, ‘ডু নট টক টু মি। তুমি আমাকে পাইরেট শিপে রাইড করতে দাও নাই।’
‘এটা ডেনজারাস, সোনাপাখি। ভয় লাগে।’
‘আমি চড়ব। তোমার কেন ভয় লাগবে?’
‘তুমি আর আমি ত একই, তাই না?’
‘উম্‌ম্—মানে কী? ইট ইজ কনফিউজিং।’
‘ওওও—ওটা তাহলে আমরা পরে আলোচনা করতে পারি।’
নাশিতা বাসায় ফেরার জন্য পা বাড়াল। কিন্তু বন্ধুরা তাকে অনেক দিন পরে পেয়েছে। সুযোগ হলে আর শিগগির ছাড়তে চায় না।
পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি নাশিতা কথা বলার সময় চোখের মণি প্রায়ই বাঁ দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। বাঁকা চাহনি মনে হয় যা অনুরাগ ছড়ায়। মন না হাসলেও ঠোঁটে হাসি থাকে প্রায় সারাক্ষণ। এ নিয়ে বেশ সমালোচনা হয় বটে। অনেকে মনে করে নাশিতা ছিনালি করে আকর্ষণ বাড়ায়। চাকরি জীবনের শুরুতে নিন্দাবাক্য কানে এসেছে। পরে চোখ আর ঠোঁট শাসনে রাখার চর্চা শুরু করে নাশিতা। অফিসে থাকলে। অফিসের কাজে। অবশ্য একই কারণে তার বন্ধুসংখ্যা অনেক। ছেলেবন্ধু-মেয়েবন্ধু অনেকেই তাকে দেখলে আর সহজে ছাড়তে চায় না।

পড়ুন  [দ্বিতীয় পর্ব]