চর্ব্য চোষ্য [দশম পর্ব]
পড়ুন ► চর্ব্য চোষ্য [নবম পর্ব]
চর্ব্য চোষ্য [দশম পর্ব]
ফিঙ্গেবাড়িতে ভাওয়ালের চার কারখানার সামনে শ্রমিকরা দলে দলে দাঁড়িয়ে আছে। জটলা করছে। আমির তাদের সঙ্গে থাকলেও সারাক্ষণ উসখুস করছে। থেকে থেকে মোড়ের ওপর দিয়ে সেতুর দিকে তাকাচ্ছে। ওই সেতু পার হয়ে উঁচুপদের কর্মকর্তারা আসবে। আসলে মিটিং হবার কথা।
এক তরুণী বলল, ‘মিটিং-সিটিংয়ের কী দরকার? মালিকের ইচ্ছা হলে ঘোষণা দিক। না হলে বন্ধ থাক কারখানা। এই বালের চাকরি করার চাইতে না করা ভাল।’
‘তাহলে কী করবি?’
‘না খেয়ে মরব। তাও ভাল।’
তারা ছয় দফা দাবিতে গতকাল থেকে কাজ বন্ধ রেখেছে। মালিপক্ষ দাবি মানার ঘোষণা না দিলে আর কাজ করবে না। অন্যদেরও করতে দেবে না। বেশির ভাগ শ্রমিক না দেওয়ার পক্ষে রয়েছে ।
আমির আরো অস্থির হয়ে উঠল। সেও মিটিং-সিটিং চায় না। কিন্তু ব্যবস্থাপকরা গতকাল থেকে ফোন দিচ্ছে। পুলিশও দুইবার ফোন করেছে। মিটিংয়ে বসতে বলেছে। পুলিশকে না বলে এত সাহস কার।
এক তরুণ বলল, ‘মালিকেরও বিশেষ গরজ আছে বলে মনে হয় না।’
‘কিন্তু তারাই ত মিটিংয়ে বসার জন্য ফোন দিচ্ছে।’
‘তা কই? চারটা ত বাজল।’
‘তাদের সময় আর তোর সময় কি এক রে বেটা? এক-দুই দিন কাজ বন্ধ থাকলে তাদের কি কোনো সমস্যা হয়? হয় না। যখন দেখবে যে ব্যবসা ত পড়ল—তখন না তারা আসবে।’
‘ত এখানে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকার কী দরকার রোদের মধ্যে?’
‘ঘরে বসে আন্দোলন হয় না। রোদে পুড়েই আন্দোলন করতে হয়। প্রতিবাদ-মিছিল করতে হয়। বোঝাতে হবে ত যে এখানে কিছু একটা হচ্ছে, তাই না?’
তবু সবাই উসখুস করতে লাগল। তারা যুক্তি দেখাল যে, কাজ বন্ধ রাখাই যথেষ্ট। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না।
আমির বিরক্ত হয়ে যায়। মাটির দিকে তাকিয়ে কাঁচাপাকা চুলে খুশকি চুলকাতে থাকে। তারপর ক্ষুব্ধ হয়ে বলে, ‘অধিকার আদায় করে নিতে হয়। আদায় করতে হলে ঘরে বসে থাকলে চলে না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা একটা কাজ। আর থেকে থেকে বিক্ষোভ মিছিল। আমরা চুপ থাকি বলেই মালিকরা আরো পেয়ে বসে।’
এক যুবক ‘জাগো ভাই’ বলে ধুয়ো তুলল। কিন্তু আরেক যুবক বলল, ‘একটু দাঁড়ান, লিডার। বিড়িটা শেষ করি।’
‘এখন আবার বিড়ি ধরালি? তোদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না রে!’ আমির মাঝে মাঝে শক্ত করে ধমক দেয়। আর মাঝে মাঝে ভাবে, যদি এমন একটা মন্তর থাকত যা পড়লেই সব শ্রমিক দৌড়ে চলে আসত! তারপর সবাই তার কথামত চলত! হ্যামিলনের বাঁশিঅলার মত!
মিনিট খানেকের মধ্যে নাশিতার বেগুনি কার এসে থামল। ভাওয়াল স্যুটিং ফেবরিকের সামনে। আলাদা একটা সাদা প্রাইভেট কারে তার দুই সঙ্গী। আর মাইক্রোবাসে নিরাপত্তার লোকজন যারা মিলিটারি কায়দায় হাঁটে। সচকিতে এদিক-ওদিক চায়। কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা শ্রমিকদের ওপর চোখ বুলিয়ে নেয়।
আজ নাশিতা একা আসতে সাহস করেনি।
ভাওয়ালের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে। ভাওয়াল সিকিউরিটি লিমিটেড। তার প্রধান হিসেবে আছে একজন সাবেক মেজর। তারা নিজেদের বিভিন্ন কারখানা-অফিসের পাশাপাশি অন্য প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা বেচার ব্যবসা করে।
গাড়িটা গেট পার হয়ে ভেতরে ঢোকার পর নামল নাশিতা। তবু নিরাপত্তার লোকজন কারাতে যোদ্ধার ভঙ্গিতে খুঁটি হয়ে থাকে। সবাই স্যুট-বুট পরা। দেখলে মনে হয় বড় বড় কর্মকর্তা। আরো জনা চারেক আছে খাকি পোশাকে। আর কারখানায় দলে দলে গার্ড ত আছেই।
নাশিতা বলল, ‘আপনাদের ভেতরে আসতে কোনো সমস্যা আছে?’
‘না, ম্যাম। আপনি যাতে কমফোর্ট ফিল করেন।’
‘প্রথমে আমরা মিনিট দশেক ইন্টারনাল মিটিং করব। তারপর শ্রমিকদের সাথে বসব। তখন—,’ থেমে গেল নাশিতা। তখন নিরাপত্তাকর্মীরাও ভেতরে থাকলে সে সাহস পায় তা আর বলল না। বেশি হয়ে যায়। আবার তার অস্বস্তি কাটে না।
ভাওয়াল ফ্যাশনের জিএম সৈয়দ শরাফত বললেন, ‘আমি আগেই বলেছিলাম এক জায়গায় বেশি কারখানা করা ঠিক হবে না। এখন একটায় কিছু হলে সব হ্যাং হয়ে যায়।’ কোট পরা জিএম উসখুস করতে থাকেন। এসির তাপ একুশ ডিগ্রি থেকে সতের ডিগ্রিতে নামিয়ে দেন বিরক্ত হাতে।
নাশিতা চকিতে জিএমের দিকে তাকিয়ে নিয়ে ল্যাপটপ খুলল। লোকটা এখন কী করা যায় তা না বলে আগে কী করা হয়নি তাই বলছে।
সব জিএম ঢাকার অফিসে বসেন। সমস্যার কারণে সকালে তারা এখানে এসেছেন। তবে সবার টেনশন নেই। শুধু শরাফতের মাথা নষ্ট হবার জোগাড়। শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে পোশাক কারখানা একদিন বন্ধ থাকলে অনেক ক্রেতা ছুটে যেতে পারে। অনেক অর্ডার বাতিল হয়ে যেতে পারে। সেই ক্ষতি মোকাবিলা করা কঠিন কাজ। না করতে পারলে তার দায় জিএমের ঘাড়েই চাপাবে সবাই।
নাশিতা ভাওয়াল ফ্যাশনের ফাইল খুলল। অডিট প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ অংশে চোখ বুলিয়ে নিল। হা। সে যা ভাবছিল তাই। পারফরমেন্স প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ ছিল তার অর্ধেকও বাস্তবায়ন করতে পারেননি জিএম শরাফত। নাশিতা নোট লিখল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘শ্রমিকরা কী বলছে? তারা কী চায়?’
জিএম মনে মনে বিরক্ত হলেন। শ্রমিকদের চাওয়া ত একটাই। বেতন বাড়াও। এখন নাশিতার এই প্রশ্নের মানে কী। কিন্তু নাশিতা তার দিকে তাকিয়ে উত্তরের অপেক্ষায়। যদিও নাশিতা এসব আগেই জেনে এসেছে।
জিএম উসখুস করতে করতে বললেন, ‘তাদের দাবি, বেসিক্যালি, স্যালারি বাড়াতে হবে।’
‘কত পার্সেন্ট?’
‘তারা ত তা কিছু বলে নাই, ম্যাম।’
‘বেসিক দাবি হচ্ছে স্যালারি। আর অন্যান্য—?’
জিএম কাষ্ঠহাসি হেসে বললেন, ‘তারা গরমে কাজ করতে পারেন না। তারা কারখানায় এসি চান।’
‘আমরা আমাদের সব কারখানায় এসি দিতে পারি না? তাতে উৎপাদন বাড়বে না?’
‘অনেক ব্যয় বাড়বে।’
‘ব্যয় না। এটা বিনিয়োগ।’
জিএম চুপ। তার আরো অস্বস্তি হয়। তিনি বোঝেন এটা বিনিয়োগ কিন্তু ওই লাইনে চিন্তাভাবনার অভ্যাস নেই তার। তিনি জানানেন এসি মানে সম্মান। আভিজাত্য। বড়লোকি।
নাশিতা সব শোনার পর বলল, ‘সব মিলিয়ে আপনারা কি কেউ কোনো প্রতিবেদন তৈরি করেছেন?’
জিএমরা বিপদে পড়লেন। সিনিয়র কর্মকর্তাদের সামনে ‘না’ বলা অপরাধ। আবার তাদের এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরির চর্চা নেই। কেনাবেচা কাজের বাইরে। তারা শুধু জরুরি পরিস্থিতি ফোনে ফোনে সিইওকে জানান।
তারা দুই-আড়াই যুগ আগের সরল বিএ। নিতান্তই সেকেলে। জিএম হয়েছেন বিশ-বাইশ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা দিয়ে। আধুনিক ব্যবসা পরিচালনার কায়দা-কৌশল তারা ঠিকমত দেখতেই পান না। আবার তাদের অভিজ্ঞতা ছাড়াও কারখানা চলে না। সুতরাং পলিসি হচ্ছে, আমি বলব। তুমি করবা।
মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকার ভান করে কিছুক্ষণ চুপ থাকল নাশিতা। তারপর অন্য জিএমদের মতামত নিল। সবশেষে শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে মিটিং।
আমির ভেতরে ঢুকলে নাশিতা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কেমন আছেন, আমির ভাই?’
আমির খুব অবাক হয়। এমন সম্বোধন সে কল্পনাও করেনি। নাশিতার কথাগুলো যেন বহুল প্রতীক্ষিত প্রিয়জনের পরশের মত ছড়িয়ে পড়ে তার সারা শরীরে। তার চোখ ছলছল করে ওঠে। সামলে উঠতে তার প্রায় আধা মিনিট সময় লাগল।
আজ নাশিতা মনে মনে মহড়া দিয়ে এসেছে শ্রমিকদের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হবে। কেউ যেন তার কথায় অসম্মানিত না হয় সেদিকে সতর্ক থাকার কথা ভেবেছে বারবার। কাউকে অসম্মানিত করলে তার কাছে বেশি কিছু আশা করা যায় না।
‘জি, ভাল আছি। আপনি ভাল আছেন?’ আমিরের গদগদ কণ্ঠ।
নাশিতা নিজের পরিচয় দেওয়ার পর অন্যদের পরিচয় নিল। কিন্তু আমির কোথায় চাকরি করে তা বলল না। নাশিতা একটু চিন্তায় পড়ে। তবে আপাতত বিষয়টা সে শিকেয় তুলে রাখল। পরে দেখবে। তবু সে আমিরকে দিয়েই শুরু করে, ‘আপনার বাসায় কে কে আছে, আমির ভাই?’
‘বাড়িতে মা আছে। বোন আছে। আর বোনের দুই ছেলে আছে।’
বছর চারেক আগে বোনের হাজবেন্ড আরেক বিয়ে করে ঢাকায় গেছে। তারপর আর ফিরে চায়নি। ঢাকায় সে কী করে তাও আমির ঠিকমত জানে না। শুধু লোকমুখে শুনেছে রিকশা চালায়।
‘আর আপনার বিয়েশাদি?—স্ত্রী-সন্তান—?’
‘ওসব কিছু হয়নি এখনও।’
‘এখানে আপনাদের নিজেদের বাড়ি?’
‘হা। বাড়ি নিজেরই—!’
‘তাহলে ত আপনি বড়লোক,’ নাশিতা হাসল।
আমির গম্ভীর হয়ে যায়। নামেই বাড়ি। তিন রুমের টিনশেড বাড়িতে ঢুকলে তার দম বন্ধ হয়ে যায়। ঘর থেকে বের হলে গা ঘিনঘিন করে। বাড়ির তিন পাশ দিয়ে মুক্ত নর্দমা। একপাশে তার ভাইয়ের ছোট্ট দোতালা ভাঙড়ি। অন্য তিন পাশে চাচাত ভাইদের টিনশেড। বাড়িগুলোর মাঝখান দিয়ে স্যাঁতসেঁতে গলি। হাঁটার সময় দেয়ালে গা ঘষে যায়।
‘এটা কি আপনার পৈত্রিক বাড়ি, আমির ভাই?’
‘হা, দাদার আমলের বাড়ি। আগে ছিল মাটির ঘর। ছনের ঘর। একেবারে অজপাড়াগাঁ ছিল।’
আমির বেশ ফুরফুর করে উঠল। যদিও একটু চিন্তায় থাকে সে। নাশিতা আজ এমন সুরে কথা বলছে কেন বোঝার চেষ্টা করে মনে মনে। তবু সে ছোটবেলায় কেমন পাড়াগাঁ দেখেছে তাই বলতে বলতে সহজ হয়ে যায়। আবেগ থৈথৈ করে ওঠে।
নাশিতা বলল, ‘এবার আমরা কাজের কথায় আসতে পারি।’
‘জি!’
‘আপনিই শুরু করেন। আপনি নেতা মানুষ।’
আমির ইতস্তত করতে করতে বলল, ‘কাজের কথা হচ্ছে যে, কাজ যে করব—আমাদের ত আপনারা বাঁচায়ে রাখবেন—নাকি—মরে গেলে ত ল্যাটা চুকে যায়। ব্যাপারটা হল যে, পেটে যদি ভাত না থাকে—গায় যদি বল না থাকে—ত কিভাবে কাজ করব? পনের-ষোল ঘণ্টা কাজ করতে করতে—শ্রমিকদের মুখের দিকে তাকানো যায় না।’
‘জি। অবশ্যই। আমাদের সবারই বেতন বাড়ানো উচিত।’ নাশিতা বলল সেও তাদের মতই বেতনের জন্য চাকরি করে। ‘বেতন ছাড়া আরো কী কী দাবি আছে শুনলাম।’
আমির চিন্তায় পড়ল। সে জানে ঢাকা থেকে আসা উঁচুপদের কর্তারা অত্যন্ত কৌশলী। তারা কোন পাশ দিয়ে কোথায় প্যাঁচ মারে তা বোঝা মুশকিল। পরে দেখা যায় হাত-পা বাঁধা হয়ে গেছে। নড়ার জো নেই।
নাশিতা বলল, ‘আপনাদের সব দাবিদাওয়া শুনে—সব মিলিয়ে দেখব যে কিভাবে সবকিছু ভাল করা যায়। কিভাবে বেতন বাড়ানো যায়। তাই আপনাদের সব কথা শুনতে চাচ্ছি।’
বেশি মিষ্টি কথা আমিরের ভাল লাগল না। সে শক্ত করে বলল, ‘দেড়-দুই বছর আগে সরকার নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করেছে। তা গত বছর কিছুটা বাস্তবায়ন করেছেন। ন্যূনতম মজুরি তিন হাজার টাকা সবাইকে দিচ্ছেন না। মাত্র দুই-চারজনের গ্রেড চেঞ্জ করেছেন। সেদিন যাদের ছাঁটাই করলেন তাদের সবাই প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডের।’
নাশিতার মাথার মধ্যে ঝম করে শক্ত হয়ে উঠল। যেন অভিযোগের তিরটা তার বুকে বিঁধল। যেন সে-ই এর জন্য দায়ী। সে বুঝতে পারছে না কেন নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন করা হয়নি।
দুই বছর ধরে রড-সিমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত ছিল নাশিতা। পোশাক কারখানায় কী হচ্ছে সেসব খেয়াল করেনি। এটা তার দায়িত্বও না। সে ভাওয়াল ফ্যাশনের জিএমকে ফোন করল।
জিএম বলল, ‘শিগগির বাস্তবায়ন করা হবে।’
‘এত দিন না করার কারণটা কি আমি জানতে পারি?’ অনুরোধের সুরে বলল নাশিতা। সে জিএমের কাছে কৈফিয়ত চাইতে পারে না। সেটা তার দায়িত্ব না। তবে যেকোনো তথ্য সে চাইতে পারে।
জিএম একটা খোড়া যুক্তি দেখাল। ‘সময় করতে পারি নাই।’
নাশিতা আর কথা বাড়াল না। সে নিশ্চিত যে, জিএম আসলে ঢিলামি করছে। টাকা যতদিন ব্যাংকে থাকে ততদিনই তার ফল ফলে। এমনকি ব্যাংকগুলোও চা খাইয়ে অনুরোধ করে। জিএম সেই সুযোগটা নিচ্ছে। এতে আশপাশ দিয়ে কিছু সুবিধা জিএমের পকেটে ঢুকে পড়ে। তাছাড়া কম্পানির লাভ বাড়ে। তাতে পারফরমেন্স প্রতিবেদন ভাল হয়ে জিএমের বায়োডাটা ভারি করে। এসব তথ্য অডিট প্রতিবেদনে আসার কথা। বিষয়টার খোঁজ নেওয়া যেতে পারে।
আমির ইতস্তত করে বলল, ‘ভাল কাজ করার জন্য ত ভাল কিছু ব্যবস্থা লাগে। যেমন ধরেন যে, শ্রমিকরা যেখানে কাজ করে, গা-গতর গরমে একেবারে সেদ্ধ হয়ে যায়।’ জানালা বাড়ানোর কথা বলতে গিয়েও বলল না সে। তার এখন বিরক্তি লাগছে। এসব মিটিং-সিটিং হয় শ্রমিকদের থামানোর জন্য। থামিয়ে থামিয়েই বছরকে বছর পার করে দেয় কারখানার কর্মকর্তারা।
নাশিতা নোট নিতে নিতে বলল, ‘আর কিছু?’
‘প্রায়ই বিভিন্ন কারখানায় আগুন লাগে। কয়েক মাস আগে ভাওয়াল শার্টিংয়ে দুই শ্রমিক মারা গেল। সেটা ছোট কারখানা। সেখানে ছয়-সাতশ শ্রমিক কাজ করে। আললা না করুক—ভাওয়াল ফ্যাশনে এমন কিছু হলে অবস্থা কেমন হবে চিন্তা করে দেখেন।’
নাশিতার মাথার মধ্যে শীতল পরশ বয়ে গেল। কারখানাটায় সে অনেক দিন গেছে। গা ঘিনঘিন করেছে। আগুন লাগলে কী হতে পারে তা ভাবেনি।
আমির মাথা নিচু করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘দুই বছর আগে আশুলিয়ায় হামিমের কারখানায় আগুন লাগলে ২৫ জন মারা গেল! আপনারা শ্রমিকদের কোনো কিছুতে মন দেন না!’
আশুলিয়া ফিঙ্গেবাড়ির কাছেই। নাশিতা ল্যাপটপে নোট লিখল।
শ্রমিকদের একটা দাবি ছিল কারখানায় ক্যান্টিন আর দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা। গড়ে মাসে বিশ দিনের বেশি সকাল আটটা থেকে রাত বারটা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। রান্নার সময় পায় না শ্রমিকরা। কিন্তু আমিরের নিজেকে খুব ছোট মনে হতে লাগল। সে মাথা নিচু করে বলল, ‘না। আর কিছু না।’
‘আপনাদের যেগুলো দাবি, এগুলো যাতে বাস্তবায়ন করা যায়, কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সেসব একটু হিসেব-নিকেশ করে দেখব আমি। আজ রাতেই দেখব। তারপর কাল সকালে মিটিংয়ে বসব। আমার মনে হয় যে, এখন আমাকে যদি আপনারা সপ্তা খানেক সময় দেন—দিয়ে কাজ শুরু করে দেন। আমি আশা করছি আপনারা একটা ভাল খবর পাবেন। এক সপ্তার মধ্যেই।’
আমির আর কিছু বলল না। বলার কিছু নেই। কী ঘোষণা আসে সেটা দেখে পরের পদক্ষেপ নিতে হবে।
নাশিতা বলল, ‘আপনাদের মতামত-পরামর্শও শুনতে চাই। কিভাবে আমরা ভাল করতে পারি। কোথায় কেমন সমস্যা দেখছেন—সেসব।’
আমির কিছু বলল না। সাধারণ সমস্যাগুলো নিয়ে নাশিতা কী করে তাই আগে দেখতে চায়। আর সে চিন্তা করছে যে-কৌশলে সে ভাওয়ালের চার চারটা কারখানা দুই দিন বন্ধ রাখতে পেরেছে, সেই কৌশল কিভাবে বাড়িয়ে তোলা যায়। তার কৌশল হচ্ছে সঙ্গীদের নিয়ে শ্রমিকদের উত্তেজিত করে তোলা। ‘স্বাস্থ্যকর জীবন চাই। এভাবে বাঁচার চাইতে মরা ভাল। মরতে হলে মরণ কামড় দিয়ে মরব।’
মিটিং শেষে নেতারা চলে গেল।
নাশিতা অনেকক্ষণ চোখ বুজে বসে থাকে। ২০১২ সালে তিন হাজার টাকা বেতনে একজন মানুষ কিভাবে বেঁচে থাকে তাই ভাবে। এসব সে আগেও জানত বটে। কখনও অনুভব করেনি। সে শ্রমিকদের সাথে কথা বলার জন্য উঠল। আগে কখনও শ্রমিকদের সাথে কথা বলেনি। কাজ করেছে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে।
[চলবে—আসছে একাদশ পর্ব ]
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন