চর্ব্য চোষ্য [দ্বিতীয় পর্ব]

অ+ অ-

 

পড়ুন  [প্রথম পর্ব]

[দ্বিতীয় পর্ব]

ধর্মঘট হয়নি। শ্রমিকরা সবাই মহাসড়ক থেকে কারখানায় ঢুকেছে।
বত্রিশে পা দেওয়া আমির আলি প্যাকিং স্ট্যাপলার হাতে ছটফট করছে। ফিঙ্গেবাড়ি অ্যারিজোনা অ্যাপারেলস কারখানার প্যাকিং শাখায়। তার সামনে শার্টভর্তি কার্ডবোর্ডের কার্টন। পিন মেরে মুখ আটকাতে হবে। কিন্তু আমির পিনটা কোথায় মারবে তা যেন দেখতে পাচ্ছে না।
এক তরুণ সহকর্মী বলল, ‘পিন মারতে না পেরে গোস্বা করেছেন নাকি, নেতাজি?’
আমির চুপ। তার তামাটে মুখ থমথম করছে। অন্যরা তা আমলে না নিয়ে খানিকটা হোহো করল।
ছাব্বিশ বছরের শিউলি খাতুন পলিব্যাগে ভরা শার্ট রাখছিল কাগজের কার্টনে। আমিরের দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘পিন মারামারির অভ্যাস থাকলে এমনই হয়!’
‘এমন মানে কেমন?’
‘মুখ ফুলিয়ে ভুতুমের মত করে রাখা। আবার জিগায় কেমন!’
তবু চুপ আমির আলি। জাতীয় শ্রমিক ইউনিয়নের ফিঙ্গেবাড়ি শাখার সাধারণ সম্পাদক। তার ভারি মুখ আরো ভার হয়। প্রায় এক হাত লম্বা স্ট্যাপলারটা ঘাড়ে তুলল সে। ভারি মুগুর ঘাড়ে করে ধরে যেমন। এখনই সবকিছু গুঁড়িয়ে দেবে যেন। ধর্মঘট না হওয়াটা সে কিছুতেই মানতে পারছে না। আবার সহকর্মীরা তার রাগকে পাত্তা দিচ্ছে না।
একজন বলল, ‘কই পিন মারতে যাবা, চান্দু?’
‘আয়। তোর পাছায় একটা মারি!’ 
আমির মৃদু হেসে স্ট্যাপলারটা এগিয়ে নিল। সহকর্মীও হাসিমুখে পাছা পেতে দিল। আর তরুণী সহকর্মী পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ধর্মঘট নাশতা করতে গেছে। তুমি পানি খাও।’
‘নাশতা করতে গিয়ে ধর্মঘট নিজেই নাশতা হয়ে গেছে।’
‘কয় টাকার নাশতা গো?’
হাসাহাসির শব্দ শুনলে সুপারভাইজার এগিয়ে আসে। সাথে সাথে সবাই আগের মত চুপ হয়ে যায়। এখন শুধু দূর থেকে একবার তাকাল সুপারভাইজার। শ্রমিকরা এখন উত্তেজিত আছে। ঘাঁটাঘাঁটি না করা ভাল। 
কয়েকজন হাসাহাসি করলেও অন্য সব শ্রমিক চোখমুখ আগের মতই পাথর করে রাখে। কাজে মন বসানোর চেষ্টা করে অনেকে। তাদের হাত-পা ছটফট করতে থাকে।
আমির আর কথা না বলে স্ট্যাপলারটা টেবিলে রাখে। তারপর আয়রন শাখার পাশ দিয়ে হনহন করে হাঁটা দেয়। গেটের দিকে। কৃত্রিম টাইলসের মেঝেতে সারি সারি অভার-লক সেলাই মেশিন। একসঙ্গে চার-পাঁচটা সুতো দিয়ে একাধিক কাপড়ের কোনা একসঙ্গে মিশিয়ে নিখুঁতভাবে সেলাই করতে পারে এসব মেশিন।
কারখানাটা অনেক লম্বা। গেট অনেক দূরে। রীতিমত দৌড়ানো যায়। কিন্তু আমি হেঁটেই গেল। গেটের কাছে গেলে ফ্লোর ইনচার্জ বলল, ‘কই যান, নেতা?’
‘একটা বিড়ি গিলে আসি, বস।’
‘যান। মাথা ঠাণ্ডা রাখেন।’
আমির মৃদু হেসে থমকে দাঁড়াল। তার ইচ্ছা চলে যায়। আবার জায়গায় ফিরে কাজ শুরু করে। ধৈর্য ধরার কথা মনে পড়ে তার।
আমিরের যখন চাকরির বয়স ছয় বছর তখন এক সুপারভাইজার তাকে বলেছিল, ‘কিরে আমির? কারখানাটা কি তোর বাপের নাকি রে? দিনে কয়বার বিড়ি ফোঁকা লাগে তোর?’
যদিও ষোল ঘণ্টায় সাধারণত একবারই যেত আমির। মাঝে মাঝে দুইবার। সেদিনই আমির তার সহকর্মীদের সংগঠিত করার কাজে যোগ দেয়। এত দিনে কারখানার কর্মকর্তাদের আচরণ অনেকখানি বদলেছে। কোনো কোনো কারখানায় অনেক বদলেছে।
ফিনিশিং শাখায় এক তরুণী সাদা শার্টের দাগ দূর করছিল। স্প্রেয়ার বন্দুক দিয়ে তরল এনজাইম-ক্লিনার ছিটিয়ে। আমির আসামাত্রই তরুণী বলল, ‘এখন জাতীয় ইঁদুর দলের প্রেসিডেন্ট কে যেন, নেতা?’
আরেক সহকর্মী বলল, ‘কেন, বিড়াল চৌধুরী নেই?’
‘যদ্দিন ইঁদুর আছে তদ্দিন বিড়াল আছে।’
আমির চুপ। তাকে দেখলেই সহকর্মীরা শ্রমিকনেতাদের নিয়ে ঠাট্টা করে। তারা মজা পায়। তবে আমিরকে তারা ভালবাসে। আমিরের কথামত চলে অনেকে। আমির ঠাট্টা-মশকরায় যায় না। আর ইঁদুর সে মোটেও বরদাশত করতে পারে না। তার মনে হচ্ছে সে এখন খাঁচায় আটকা পড়েছে। ইঁদুর হয়ে গেছে। চার পায়ে খাঁচা বেয়ে বেয়ে উঠছে। কিচকিচ করছে। তার লম্বা লেজটা খাঁচার বাইরে ঝুলে পড়ল। একটা হুলো বিড়াল মার্বেল চোখে তাকিয়ে আছে। মোছে তা দিচ্ছে।
গোমড়া মুখে ভারি স্ট্যাপলারটা তুলল আমির।
এক যুবা শ্রমিক বলল, ‘মাইন্ড করছেন নাকি, নেতা?’
‘একটু ধৈর্য ধর। ইঁদুর দল হোক আর বিড়াল প্রেসিডেন্ট হোক—মন্ত্রী যেহেতু বসতে চায়—প্রেসিডেন্টও রাজি হয়ে গেল—। দেখা দরকার কী হয়। আমারও ত এসব মিটিং-চিটিংয়ে ভক্তি নেই।’
‘মিটিং মানেই চিটিং। খাঁটি কথা।’
অস্থিরতার মধ্যেই ডিউটি শেষ করে আমির আলি। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা। সুদেহী। মাথায় ছোট ছোট কোঁকড়া চুল। আজ আর সে তুরাগ তীরে চায়ের দোকানে গেল না। এখন বরং আশপাশের এলাকার কিছু শ্রমিকনেতার সাথে দেখা করতে চায় যারা তুরাগ তীরে বেশি যায় না।
বন্ধু মাহের বলল, ‘চল আগে শটিবাড়ি যাই।’
‘শটিবাড়ি কেন?’
সেখানে আছে ন্যাশনাল শ্রমিক ইউনিটির আঞ্চলিক কার্যালয়। এলাকার সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন। সেখানকার নেতারা কেউ চাকরি করে না। অনেকেই ব্যয়বহুল ফ্ল্যাটে থাকে। বেনসন খায়।
আমির বলল, ‘তারা টাকা পায় কই?’
কোনো কারখানায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ করলে তারা গিয়ে থামায়। সারা মাস এসব চলে কোনো-না-কোনো কারখানায়। মালিকরা তাদের ডেকে নেয় শ্রমিকদের থামাতে। ফি হিসেবে মিষ্টি-মণ্ডা খাওয়ায়। তাতেই তাদের ফ্ল্যাট ভাড়া, বেনসন, মদ-রুটি হয়ে যায়। মাহের জানে বটে। মাঝে মাঝে খুব শক্ত করে গালও দেয়। দাঁতে দাঁত চেপে ঠোঁট ফাঁক করে বলে, ‘কুত্তাচুদা!’
‘মানে কী? যাকে কুত্তায় চুদেছে?’
‘মানে কী তা কার ধোনে জানে।’
‘তোর কথা শুনে মনে হয় যে শুধু কুত্তাই চুদে বেড়ায়। বিড়াল কোনো দিন চোদে না!’
আমির একটা ইজিবাইক থামাল। পশ্চিম দিকে মিনিট পাঁচেক গেলে তাঁতিবাড়ি। তারা সাধারণত হেঁটে যায়। মাঝে মাঝে বাসে।
স্থানীয় সংগঠন হিসেবে তাঁতিবাড়ি শ্রমিক ইউনিয়ন যথেষ্ট শক্তিশালী। যদিও তাদের কোনো সদস্য নিবন্ধিত না। সাইনবোর্ড নেই। কমিটি আছে বটে। তার আছে এক স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট। আশুলিয়ার ক্যাটওয়াক ফ্যাশন কারখানার কাটিং ম্যান। তার আছে মনের মত একজন সাধারণ সম্পাদক। সবই অলিখিত। লিখিত থাকলে জানাজানি হবে। মানে চাকরি যাবে।
মাহের বলল, ‘ওদের দিয়ে কী করবি?’
‘ওরা ডাক দিলে কয়েক হাজার শ্রমিক রাস্তায় চলে আসে। দেখিস নে? দেখবি কী। সারাক্ষণ ত চোখ-কান বুজে থাকিস।’
‘চোখ-কান খুলে তুমি কার বাল ছিঁড়েছ, হুম?’
‘বাল ছিঁড়লেই ত কুত্তাচুদা কস! তোরে নিয়ে ত ভারি বিপদ রে!’
মাহের হঠাৎ করে নীরব হয়ে গেল। সে হঠাৎ হঠাৎ সরব হয় আবার হঠাৎ হঠাৎ নীরব।
ছোট্ট টিনের ছাপড়া অফিসে এক পা জোড়া দেওয়া টেবিল। জনা পনের নেতাকর্মী যেন দম বন্ধ করে বসে আছে। পাছার নিচে গোটা তিনেক পুরনো কাঠের চেয়ার আর দুইটা কালো ইস্পাতের বেঞ্চ। বসার জায়গাটুকু বাদে সবখানে ছাতা পড়েছে।
মন্ত্রীর সাথে মিটিংয়ের অপেক্ষায় আছে তারা। বিভিন্ন সংগঠনের জাতীয় শ্রমিকনেতাদের সাথে শ্রমমন্ত্রীর বসার কথা। কিন্তু দিন ত চলে গেল।
আমির বলল, ‘আমি ত দেখি যে মাস-বছর সবই চলে যায়।’
‘দুর্দান্ত এঁড়ে গরু। ছেড়ে দিলে কি আর দাঁড়ায়?’
দু-একজন একটু রসিকতা করে বটে। গুমোট ভাব কিছুতেই কাটে না। সবার মুখ আরো ভার হয়। কেউ কেউ ক্ষোভ ঝাড়ে।
তারা স্কুল থেকে শেখা বাংলা বলে। তাতে সাধু ও চলতি রীতির শব্দ যেমন থাকে তেমনি থাকে যার যার আঞ্চলিক শব্দ। বলার ভঙ্গিতেই সবাই বুঝে নেয়। কোনো কোনো শব্দ বুঝিয়ে দেয় বা এড়িয়ে যায়। অন্য এলাকার দু-একটা শব্দ মজা করে শিখে নিয়ে ব্যবহার করে অনেকে।
আমির বলল, ‘শ্রমিক না এমন সবাইকে সব শ্রমিক সংগঠন থেকে ঝাড়ু দিতে হবে। সে কথায় ত তোরা কেউ কান দিস নে। এই জায়গায় শক্ত না হলে কিচ্ছু হবে না।’
বিষয়টা নিয়ে অনেকক্ষণ কাজের আলাপ হয়। আমির বহুদিন ধরে বগবগ করার পর। আরো হত। জামবাড়ির এক কারখানায় কাজ বন্ধ হবার খবরে প্রসঙ্গ ঘুরে যায়।
আমির কল রিসিভ করে মোবাইলটা কানের ওপর শক্ত করে চেপে ধরল। ওপাশ থেকে এক শ্রমিক বলল, ‘ভাওয়াল ওয়াশিংয়ে কাজ বন্ধ।’
‘কেন?’
‘এক শ্রমিক অসুস্থ হয়েছিল। ম্যানেজার তাকে ছুটি দেয়নি। পরে সে আরো অসুস্থ হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা গেছে।’
ভাওয়াল ওয়াশিং জামবাড়িতে। অনেক কারখানা পোশাক সেলাইয়ের পর এখান থেকে ওয়াশ করিয়ে নেয়। যাদের নিজস্ব ওয়াশিং প্লান্ট নেই। ওই এলাকায় শ্রমিকদের সংগঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আমিরের সংগঠন।
আমির নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে খবরটা জানাল সবাইকে। তাঁতিবাড়ি শ্রমিক ইউনিয়নের স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট বলল, ‘চলেন যাই!’
‘চল যাই,’ উঠতে উঠতে সিগারেট ধরায় আমির।
তাঁতিবাড়ির দক্ষিণে জামবাড়ি। টঙ্গী-আশু মহাসড়কের পাশে। বিল ভরাট করে গড়ে তোলা ডজন খানেক কারখানা পাশাপাশি। তার মধ্যে তিনটা ভাওয়ালের। একেক কারখানা একেক ধরনের পোশাক বানায়।
ঢাকার বনানীতে ভাওয়ালের নিজস্ব বায়িং হাউজ রয়েছে। ভাওয়াল সোর্সিং। তারা ইউরোপ-আমেরিকা থেকে প্রচুর কাজ নেয়। অনেক কাজ অন্যদের কারখানা থেকে করাতে হয়। সব কাজ নিজে করার জন্য ভাওয়াল তার কারখানা বাড়িয়ে চলেছে। সব এক জায়গায় করার জন্য, বড় কারখানার জন্য, একসঙ্গে বিশ-ত্রিশ একর জমিও তারা খুঁজছে।
ভাওয়াল ওয়াশিংয়ের সামনে শ্রমিকরা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। কাছেই দুই গাড়ি পুলিশ দাঁড়িয়ে।
আমিরকে দেখে পাশের ভাওয়াল লেডিজ ফ্যাশনের এক তরুণ শ্রমিক দৌড়ে আসল। তার নাম রাজ্জাক। মানে রিজিকদাতা।
রাজ্জাক বলল, ‘লেডিজেও চরম উত্তেজনা চলছে!’
‘কেন?’
‘কারুরই কাজে মন নেই। এক শ্রমিক ত সুপারভাইজারকে প্রায় একটা ঘুসিই দিয়ে ফেলল।’
‘প্রায় একটা ঘুসি মানে কী? অর্ধেক ঘুসি?’
‘আরে না বাল! প্রায় একটা মানে—ঘুসিটা একেবারে নাকের কাছে নিয়ে গেছিল। মারার আগেই আমরা ঠেকালাম।’
‘ত ঘুসি মারতে গেল কেন?’
‘তেমন কিছু না। সুপারভাইজার যেই বলছে যে সেলাইটা ঠিকমত হয়নি অমনি সে চেতে গেল।’
‘তারপর?’
‘তার আর পর কী? সুপারভাইজার চুপচাপ ফিরে গেল। কিন্তু ভেতরে থমথম করছে। সবাই কাজ করছে না। সুইপাররাও আর ঘাঁটাচ্ছে না।’
‘সুইপার মানে কী?’
‘সুইপার মানে সুপারভাইজার।’
একটু পরেই অন্য একটা কারখানার হাজার খানেক শ্রমিক রাস্তায় নেমে পড়ে। তারা আশপাশের শ্রমিকদেরও উত্তেজিত করতে চায়। তবে সন্ধে হয়ে যাওয়ায় আর পুলিশের লাঠির সামনে সাহস করে না।
আমির বলল, ‘ফড়িংয়ের মত একটু ফরফর করে লাভ হবে না। বড় একটা কিছু করতে হবে। পুরো দেশ কাঁপায়ে দিতে হবে।’
‘কিভাবে?’
‘থাকবি আমার সাথে?’
‘আপনার সাথে ত আছিই।’
আমির তা জানে বটে। না জানলে তাকে বলত না।
রাজ্জাক উত্তেজিত হয়ে উঠল। আমির কিভাবে কী করতে চায় তা না জানলে তার ঘুম হারাম।

পড়ুন ► [তৃতীয় পর্ব]