চর্ব্য চোষ্য [অষ্টাদশ পর্ব]
পড়ুন ► চর্ব্য চোষ্য [সপ্তদশ পর্ব]
চর্ব্য চোষ্য [অষ্টাদশ পর্ব]
সকালে নাশিতার এক সহকারী ফোন করে বলল, পোশাক পরিষদ আশুলিয়ার সব কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেছে। অনির্দিষ্ট কালের জন্য।নাশিতাও এমন কিছুর ইঙ্গিত পেয়েছিল। তা যে আজই তা ভাবেনি। তার মুখ ভার হয়ে গেল। হাতের চিরুনি মাথায় থেমে গেল।
সে আশুলিয়া যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল। সম্প্রতি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা আর শ্রমিকদের বিভিন্ন বিষয়ে সে বিশেষ উত্তেজিত। যেমন, সুপারভাইজার আর শ্রমিকদের বেশির ভাগেরই পারিবারিক-সামাজিক মর্যাদা মোটামুটি একই রকম তাদের গ্রামসমাজে অথচ কারখানায় আসার পর তারা হয়ে যায় দাস-প্রভু।
নাশিতা হতবাক।
কেস স্টাডি আর তথ্য-উপাত্ত ঘাঁটতে গিয়ে তার মনে হয়েছে যে, ওরা ইন্টার পাস বলে সুপারভাইজার আর ওরা ফেল করেছে বলে শ্রমিক। সে না হয় রীতি হল। নির্যাতনের কারণ কী?
নাশিতা আগেই জানত যে, সুপারভাইজাররাই পদোন্নতি পেয়ে উৎপাদন কর্মকর্তা হয়। শ্রমিক চিরকাল শ্রমিকই থেকে যায়। এ অবস্থার পরিবর্তন নিয়েও ভাবছে নাশিতা।
সে হতবাক হল তখন যখন জানল যে, সুপারভাইজার বা উৎপাদন কর্মকর্তারা সুন্দরী শ্রকিদের বিয়ে করতে মোটেই পিছপা হয় না। বরং উদগ্রীব হয় প্রায় সবাই। পৃথিবীর সব অঞ্চলের প্রাচীন সভ্যতা এমনই ছিল। মধ্যযুগেও ছিল। এ যুগেও যে আছে তা নাশিতা জানত না।
তার মাথা যেন অবশ হয়ে যায় থেকে থেকে। এসব সে আরো জানতে চায়। সব না জানলে রূপকল্প তৈরি করা যাচ্ছে না। কাজের পরিবেশ উন্নয়নের রূপকল্প। তারা মনে করে না যে, শুধু বেতন বাড়ালেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
ইসমি তার গোলাপি বাইসাইকেলে করে এসে দরজার সামনে দাঁড়াল।
নাশিতা কামিজ খুলতে খুলতে বলল, ‘এখন আমরা কী করব বল ত?’
‘তুমি অফিসে যাবা না?’
‘আজ অফিস বাতিল।’
‘উয়াউ! তাহলে ত সাঁতারে যাব! সাঁততাআর! রারাররাআআর! রাআরর—রঅঅর—রেএএ—,’ ইসমি কোলাহল করে সারা বাসা মাথায় তুলল। মাঝে মাঝেই সে একেকটা ধ্বনি চিল্লিয়ে বলতে থাকে। অনেকক্ষণ ধরে চলে মাঝে মাঝে। মেয়ের কাণ্ড দেখে এবং অন্য পিচ্চিদের কাণ্ড মনে করে হাসি পায় নাশিতার।
দৈনিক শুক্রবার সকালে সে মেয়েকে নিয়ে সাঁতরাতে যায়। ফিঙ্গেবাড়ি উত্তেজনার কারণে আজ শুক্রবারও সেখানে যেতে চেয়েছিল।
ইসমি দৌড় দিয়ে তার রুমে গেল। সাঁতারের পোশাক নিয়ে আবার দৌড়ে আসল। পোশাক পরা নিয়ে সে প্রতিবারই একটা-না-একটা প্রশ্ন করে। যেমন, ‘আম্মি, পোশাকটা কি পরে বের হব নাকি পুলে গিয়ে পরব?’
‘তোমার ইচ্ছা।’
‘তুমি কখন পরবা?’
‘গিয়ে পরব।’
‘কেন?’
নাশিতা মেয়েকে ব্যাখ্যা দিতে দিতে হলুদ-কালো আজি টানা টি-শার্ট পরল। তারপর তামাটে থ্রি-কোয়ার্টার আর ধূসর কেডস। পরতে পরতে বিছানায় হাজবেন্ডের দিকে তাকাল এক পলক। লিমন ঘুমাচ্ছে।
ইসমি বলল, ‘আম্মি, বলো ত আব্বু কিভাবে ঘুমাচ্ছে?’
‘তুমি বলো ত।’
‘ব্যাঙের মত! হা হা হা!’
‘হা হা হা! দাদা-দাদু কী করছে?’
‘নাশতা করছে।’
‘আর জেসমিন কী করছে?’
‘জেসমিন থালাবাটি ধুচ্ছে।’
নাশিতা বের হবার পথে শ্বশুর-শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে, ‘আব্বু! আম্মু! ফেরার সময় আপনাদের জন্য কিছু আনব?’
শ্বশুর-শাশুড়ি ‘না’ বলেন। আর শ্বশুর একটা ধন্যবাদও দেন জিজ্ঞেস করার জন্য।
লিফটে পা দিয়েই বেকায়দায় পড়ল নাশিতা। ওপরতালার দুই নারী ফিসফাস করছেন। একজন ববকাট। কামিজের ওপর স্থূলভাবে ওড়না পরা। আরেকজন খাঁটি বাঙ্গি। কুঁচি দেওয়া সালোয়ারের ওপর কোনা কাটা কামিজ পরেছেন। মোটা ঊরুসহ কোমর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। আর তিনি ওড়নাটা ঘাড়ের ওপর এমন করে রেখেছেন যেন বগল ঢাকতে চেয়েছেন।
নাশিতা পিছিয়ে যাবার জন্য পা বাড়ায়। কিন্তু লিফট থেকে বের হবার আগেই ববকাট নারী তার কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিলেন। এখন আর ফেরা যায় না।
ববকাট নারী ফিসফাস করে বললেন, ‘জানেন, আপা, পাঁচতালায় কী হয়েছে? ওই যে ওই ফাইভ-বি ফ্ল্যাটে একটা মেয়ে আছে না? নাদুস-নুদুস মেয়েটো—। প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছে।’
নাশিতা নির্বিকার।
ববকাট নারী কথা শেষ করে অবাক চোখে তাকালেন নাশিতার মুখের দিকে। তিনি তার প্রতিক্রিয়া দেখতে চান।
নাশিতা মজা করে হেসে বলল, ‘স্মার্ট মেয়ে। সাহস আছে।’
ববকাট নারীও হাসলেন। নাশিতা কী বোঝাতে চাইল তা বুঝতে না পেরে তিনি কিঞ্চিৎ হতাশ বটে। আর নাশিতা মনে মনে শক্ত করে একটা গাল দিল। হারামজাদিরা বিকালে থাপড় খায়। রাতে ঠাপ খায়। সকালে জুতো মোছে। তারপর সারাদিন কে কোথায় কাকে করল কি করল না সেই তত্ত্বতালাশ করে বেড়ায়। আর নিজে খুব সুখে আছে বলে গপ্প শোনায়। সারাক্ষণ। এদের দেখলেই নাশিতার গা জ্বলে।
ইসমি বলল, ‘আম্মি, চলো, দৌড়াই!’
‘চলো।’
নাশিতা আস্তে দৌড় দিল।
ইসমি এক দৌড়ে দূরে গিয়ে বলল, ‘তুমি জোরে দৌড়াতে পার না?’
‘হা। পারি ত।’
নাশিতা একটু গতি বাড়াল। ইসমি যাতে আগে থাকতে পারে। কিন্তু একটা গাড়ি এসে পড়ায় জোর দিতে হয় তাকে।
সাঁতরাতে যাবার পথে তারা দৈনিকই খানিকটা হাঁটে খানিকটা দৌড়ায়।
আশপাশে অনেক সুইমিং পুল আছে। ক্লাবে আছে। হোটেলে আছে।
মা-মেয়ে দুইজনেরই বেশি পছন্দ হোটেলের ছাদ। পানিতে নামলে মনে হয় নীল আকাশে ভাসছে। দারুণ লাগে। ফুরফুরে মেজাজে ব্যায়াম হয়ে যায়। আর এ হচ্ছে সব অঙ্গের জন্য সেরা ব্যায়াম। ঘরে সব অঙ্গের ব্যায়াম করা কঠিন কাজ। কোনো অঙ্গে কম হয় কোনো অঙ্গে বেশি হয় যা ক্ষতিকর হতে পারে।
তাছাড়া সাঁতারটা ইসমি খুব উপভোগ করে।
ইসমির জন্যই নাশিতা বাড়ির কাজ আগামী বছরই শুরু করতে চায়। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই বাড়ির ছাদে পুল থাকবে। সেটা হোটেলের ছাদের চাইতে ভাল হবে। ইসমি যেন কোনো কিছুর অভাব টের না পায়।
ছাদে গিয়েই পুকুরের দিকে দৌড় দিল ইসমি। পানি তার আকর্ষণের তালিকায় এক নম্বরে। লাল টাইলসে বাঁধানো পুলপারে বসে নীল পানিতে পা ডুবিয়ে দিল।
নাশিতা বলল, ‘সাঁতারের পোশাক পরবা না, সুইটি?’
‘এটা না পরলে কী হয়?’
‘তুমি বলো ত কী হয়?’
‘পুলের পানিতে ওষুধ দেওয়া থাকে—। তুমি পরবা না, আম্মি?’
‘মাইশা আন্টি আসলে পরব।’
‘আজ মাইশা আন্টির সাথে একটা বোনাস আন্টিও আছে,’ ছাদে পা দিয়ে বললেন ব্যবসায়ী কোয়েলি। তার সাথে আরো চার-পাঁচটা লোক। তাদের মধ্যে একজন তরুণী সাংবাদিকও আছে। তার গলায় হলুদ ফিতায় পরিচয়পত্র ঝুলছে।
নাশিতা অনুমান করতে পারল না কোয়েলি এখানে কী করতে এসেছেন। সে তাকে এখানে কোনো দিন দেখেনি।
কোয়েলি মধুর হেসে বললেন, তাদের আবাসন কম্পানি গুলশান ও বারিধারায় প্লট কিনেছে। দশতলা আবাসিক ভবন হবে।
‘ছোট ছাদে কেমন পুল হতে পারে তাই দেখতে আসলাম। বিদেশে বড় বড় ছাদে খুব সুন্দর লাগে।’
নাশিতা শুকনো হাসি হেসে চুপ থাকল। গুলশান-বনানীতে কেউ বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি করবে শুনলেই তার রাগ লাগে। এলাকাটা সে শৈশবের মতই ফাঁকা দেখতে চায়। একটা-দুইটা বাড়ি ত দুইটা-তিনটা প্লট খালি। প্রায় সব বাড়ি একতালা-দোতালা বা টিনশেড। দূরে দূরে দুই-একটা ছয়তালা-সাততালা। এই যে বনানী লেক। একটু আগালেই গুলশান লেক। কাছেই বারিধারার পাশে গ্রাম। ধানক্ষেত। ফ্রক পরা নাশিতা আর মাইশার নেশা হল দৈনিক বিকালে বাইসাইকেলের প্যাডেল মেরে মেরে আশপাশের সবকিছু গুনে দেখা।
‘ওইখানে কয়টা আমগাছ আছে বলো ত, মাইশা?’
‘একটা, দুইটা, তিনটা…’
‘ওই দেখ, মাইশা! কড়াইল বস্তির কাছেও একটা বিল্ডিং হচ্ছে। এটা কয়তালা হবে, বলো ত?’
‘একতালা।’
‘না। তিনতালা। বা তার চাইতে বেশিও হতে পারে।’
‘কী করে বুঝলে? এখানে কে তিনতালা করতে আসবে?’
‘এই যে আরসিসি পিলার, বিম দেখছ যে—। বড় দালান সব আরসিসির হয়। আরসিসি মানে জানো ত?’
‘হা। রি-ইনফোর্সড সিমেন্ট কংক্রিট। কিন্তু কাছাকাছি কোনো বাড়িঘর নেই ত।’
‘তা না থাক। এই যে দেখছ হাঁটুসমান ইটের প্রাচিল দিয়ে ঘেরা—এগুলোকে প্লট বলে। এসব প্লটে বাড়ি হবে, আব্বু বলল।’
অনেক প্লট অনেক বছর খালি ছিল। কেউ কেউ করেছিল টিনশেড।
তারপর নাশিতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবকিছু আরসিসিতে ঢেকে গেল। চোখের পলকে যেন। এখন গুলশান-বনানীর যেসব বাড়িতে মালিক থাকে না বা থাকবে না সেখানে মাঠ-পার্ক করার জন্য জনমত গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নাশিতা-মাইশা। কাজটা দুরূহ বটে। তারা পলিসি খুঁজছে। কিন্তু বন্ধুরা সাড়া দিচ্ছে না।
কোয়েলি বললেন, ‘দেবে না।’
‘কেন দেবে না?’
‘বাঙ্গাল এসব বোঝে না।’
‘বোঝে না বলেই ত বোঝানোর প্রশ্ন আসছে। গুলশানে অন্তত তিনটা বড় সংগঠন আছে। আরো হচ্ছে। তাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে ক্ষমতাবান তারা করেছে একটা বিজনেস ক্লাব। ব্যবসা আর মদিরা নিয়ে ব্যস্ত তারা। আর অন্যরা—। তাদের লজ্জা দিতে চাই।’
‘পরে আলাপ হবে, হুম? আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি।’
কোয়েলি পা বাড়াতেই মাইশার মুখোমুখি।
মাইশা তাকে আটকে দিল, ‘ডক্টর কোয়েলি! আপনি এখানে!’
কোয়েলি তাকে চেনেন না। কিন্তু ‘ডক্টর কোয়েলি’ শুনে তিনি আর নড়তে পারলেন না। ডক্টর কোয়েলি বললে তিনি খুব খুশি হন যা তিনি সুযোগ হলেই গণমাধ্যমকে বলেন। মাইশা জানে। নাশিতা জানে।
মাইশা বলল, ‘অনেক দিন ধরে ভাবছি আপনার সাথে একদিন দেখা করতে যাব।’
‘আমার সৌভাগ্য!’ কোয়েলি গদগদ হয়ে লাজুক হাসি দিলেন। আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তিনি জানেন তার সঙ্গে অনেকেই দেখা করতে চায়। এমনকি দেশের জনপ্রিয় এক পত্রিকা তাকে নিয়ে অনুষ্ঠান করে যেখানে তার পরামর্শ পাবার জন্য নাম নিবন্ধন করতে হয়। তবু দেখা করতে চাওয়া লোকের সংখ্যা যথেষ্ট বলে তার মনে হয় না।
মাইশা বলল, ‘আমি আপনাকে শুধু ব্যবসায়ী বলে জানতাম। সেদিন শুনলাম আপনি কবিতা লিখে পুরস্কার পেয়েছেন। করেছেন পিএইচডি। তারপর আবার জানলাম যে আপনি শ্রমিক স্বার্থে কাজ করেন। আমি খুব মুগ্ধ! আমরা আমাদের সংগঠন থেকে গুণিজন সংবর্ধনার আয়োজন করতে যাচ্ছি। আপনাকে আমরা একেবারে প্রথমে রেখেছি। আপনি না করতে পারবেন না কিন্তু।’
এতক্ষণে মাইশা তার পরিচয় দিল। চাকরির পরিচয় দেওয়ার পর বলল, তাদের একটা সংগঠন আছে। গুলশানের পরিবেশ আন্দোলন।
‘আমি তার সাধারণ সম্পাদক। আর নাশিতা সভাপতি।’
নাম-পদবি অবশ্য তারা ইংরেজিতে ব্যবহার করে। কাগজে-কথায় সব জায়গায়। অফিস মাইশাদের বাড়িতে। গুলশান দুই নম্বরে।
এই পরিচয়ের সঙ্গে অন্যরাও সবাই সবার নাম-পদবি জেনে নিল।
মাইশা ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘আমরা ত কফি খেতে খেতে একটু গপ্প করতে পারি। অ্যাআই! হোটেলের কেউ নেই এখানে?’
আশপাশে তাকাতে তাকাতে জিনসের পকেটে হাত দিল মাইশা। স্যামসাং গ্যালাক্সি বের করে ফোন করল ফ্রন্ট ডেস্কে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ করার আগেই এক কোট পরা পরিচারক এসে পড়েন। মাইশা কফির সাথে আরো কিছু আনতে বলল। আর কোয়েলিকে বলল, ‘বসেন না, প্লিজ!’
কোয়েলি আগ্রহ নিয়ে বসলেন।
নাশিতা হাসি লুকানোর চেষ্টা করতে করতে গলদঘর্ম। সে অনুমান করছে যে, কৌতুককর কিছু একটা হতে যাচ্ছে। কোয়েলি তা কিভাবে হজম করবেন সে বিষয়ে তার কোনো ধারণা নেই।
মাইশা বলল, ‘আপনার সাথে সাংবাদিক আছে দেখছি। আপনি কি সাংবাদিক সাথে করে ঘোরেন নাকি সাংবাদিক আপনার সাথে সাথে ঘোরে, ম্যাম?’
‘দুইটাই!’
‘আপনি বাংলাদেশের পোশাক সস্তা বলতে অপমান বোধ করেন যে—এই ব্যাপারটায় আমি আরো মুগ্ধ। আপনার গুড প্রাইস আইডিয়াটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’
‘এটা চালু করার চেষ্টা করছি। চালু হয়ে যাবে ইনশাললাহ!’
‘হলে কাজের কাজ হবে। আপনি পারবেন বলে আমার মনে হয়।’
‘থ্যাংক ইউ!’
মাইশা ফিঙ্গেবাড়ির প্রসঙ্গ তুলল।
কোয়েলি বললেন, ‘ওখানে একটু ঝামেলা যাচ্ছে। শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর জন্য ভাঙচুর করছে। দুই বছর আগে বেতন বাড়ালাম। এখন আবার তারা—। তবে এর পেছনে হয়ত ভারতের গোয়েন্দারা ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে।’
‘মন্ত্রীরাও তাই বলছে। বেতন বাড়ানোর কোনো উপায় নেই?’
‘বেতন বাড়া মানে পোশাকের দাম বাড়া। এখন বেতন বাড়ালে চিন-ভারত বাজার দখল করে নেবে। ওদিকে আফ্রিকায়ও পোশাক কারখানা হচ্ছে। আফ্রিকার সাথে ইউরোপ-আমেরিকার নৌযোগাযোগ সহজ। পরিবহন খরচ কমানোর এই সুযোগ তারা নেবেই। তারা সস্তা শ্রমের কারণেই এখানে আসে।’
‘চিন-ভারত ত বাংলাদেশের চাইতে বেশি বেতন দেয় শ্রমিকদের।’
‘তারা দামি পোশাক বানায়। আমরা প্রায় সবাই সস্তা পোশাক বানাই।’
‘আপনার ছেলেমেয়েরা কেমন আছে, ডক্টর?’
‘আছে ভাল। আপনার?’
‘আমি নেই। আপনার বাচ্চারা ত সবাই মানারতে যায়, তাই না?’
‘হা। আপনি আমার অনেক কিছু জানেন দেখছি।’
‘আমি আরো জানতে চাই। আপনার কথা সবাইকে বলতে চাই। শিশুদের কেমন বোরখা পরা শেখায় মানারত?’
‘উম্ম্—!’ কোয়েলি কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলেন। তবে দ্রুত সামলে উঠে বললেন, ‘মুসলমান হিসেবে বাঙ্গালির অনেক সমস্যা আছে। মানারত শিক্ষার্থীদের ইসলামি দর্শন শেখায়। এ ব্যাপারে তারা সর্বাধিক নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে। ঠিকমত করে। বিষয়টা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। বাইরে থেকে শুধু বাহিরটাই দেখা যায়।’
‘ও আচ্ছা। আর ওই পাশে আরেকটা কী যেন আছে না? ক্রিশ্চিয়ান দর্শন শেখাতে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যে—গ্রেস না ট্রেস কী যেন নাম?’
‘এসব নিয়ে পরে আমরা আরো আলাপ করতে পারি, হুম? আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি।’
কোয়েলি পা বাড়ালেন। মাইশা আটকে দিল তরুণী সাংবাদিককে। তার লেখার ভক্ত হিসেবে। ‘আমি আপনার অনেক লেখা পড়েছি। ডক্টর কোয়েলি আর তার হাজবেন্ডের সফলতার গল্পটা আশা করেছিলাম।’
‘ওটা লিখেছি ত, ম্যাম!’
‘ওই যে ওই গল্পটা—। মাত্র পঞ্চাশ-ষাট জন শ্রমিক নিয়ে পোশাক কারখানা দিলেন যে—। তারপর মাত্র ছাব্বিশ বছরে গোটা বিশেক কম্পানি। বিভিন্ন খাতে। দশ হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেলেন যে—। শ্রদ্ধায়-প্রশংসায় দারুণ হয়েছে—। কে যেন লিখেছে দেখলাম।’
‘হা। ওটা লিখেছি ত। আমি আপনাকে লিংক দিচ্ছি।’
‘তারপর আরেকটা গল্প—। শ্রমিকদের মানবেতর জীবন—। মাত্র তিন হাজার টাকা বেতন দিয়ে এরা কিভাবে বেঁচে থাকে—। কান্নায়-দুঃখে মরমে লাগার মত।’
‘জি, ম্যাম! ওটাও লিখেছি। আমি আপনাকে লিংক দিচ্ছি।’
‘না। থাক। ওগুলো আপনারই—। মনে পড়ল।’
‘থ্যাংক ইউ।’
‘আমি আপনাকে এমন আরো হাজার খানেক সফল ব্যবসায়ীর খোঁজ দিতে পারি! তারা সবাই কয়েকশ কোটি থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক। সবারই উত্থান বছর বিশেকের মধ্যে।’
‘হাজার লোকের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে, আপু?’
‘না। দর্জিদের প্রতি আমার মোটেও ভক্তি নেই। এরা শুধু কাপড় কাটা আর সেলাই করে। সেই কাপড়ের বেশির ভাগ এবং যন্তরপাতির পুরোটাই তারা বিদেশ থেকে আমদানি করে। অল্প কয়েকজনের মাধ্যমে করে। তাদের একজনের ছেলে আমার বয় ফ্রেন্ড। আরেকজনের ছেলে আমার স্কুলের সহপাঠী হিসেবে বন্ধু।’
নাশিতা হাসিতে ফেটে পড়ল। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর কফি খেয়ে সবাই চলে যাবার পর।
মাইশা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘বেশি মজার কথা বলে ফেললাম বুঝি?’
‘তা যাহোক। আমি ভাবছি তোমার কি ডক্টর কোয়েলির সাফল্যে ঈর্ষা হচ্ছে, সখি?’
‘হবে না, বলো কী? মধ্যবিত্ত পরিবারের এক নারী। গোটা তিনেক বিয়ে করল। তিন তিনটা কাচ্চাবাচ্চা জন্ম দিল। মাস্টারি করল। টিভিতে উপস্থাপক হল। তারপর হাজবেন্ডের ব্যবসায় গিয়ে তাক লাগিয়ে দিল! এখন আবার পোশাক পরিষদের প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছে।’
‘আমারও ঈর্ষা হওয়া উচিত, ঠিক?’
‘অবশ্যই!’
‘হা হা হা!’
‘আর আমাকে দেখ। আমার বাপ-দাদা ছিল শিল্পপতি। সত্যিকার এলিট। আর আমি হলাম কিনা কিরানি!’
তার দাদার বেশ বড় একটা জুট মিল ছিল নারায়ণগঞ্জে। চটের বস্তা বানাত। দাদার পরে হাল ধরল বাবা। তত দিনে প্লাস্টিক বস্তার দাপট শুরু হয়ে গেছে। বাবা নাস্তানাবুদ হয়ে গেল। পরিবর্তনের পথে হাঁটতে পারেনি। লোকসান দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত যখন বন্ধ হবার পথে তখন ব্যাংক নিলামে তুলল। মাইশা তখন কেবল ‘এ’ লেভেল শেষ করেছে।
নাশিতা রেগে বলল, ‘তোমার যা ঘোড়া মার্কা ভাব! বাপের এত বড় একটা প্লট রয়েছে গুলশানে! বললাম যে—!’
‘তোমাকে দেখেও আমার হিংসে হয়, সখি। কী সুন্দর একখান মেয়ে জন্ম দিয়েছ! আসো ত, আম্মাজান! তোমাকে একটু আদর করি।’
মাইশা ইসমিকে জড়িয়ে ধরল। শক্ত করে টিপে দিল গাল। নরম গাল লাল হয়ে উঠল।
ইসমি মুখ ভার করে বলল, ‘তোমার আদর ভাল না।’
‘কেন, হানি? আমার আদর কি তিতা লাগে?’
‘আদর কি তিতা হয় নাকি?’
‘তাহলে কেমন হয়? টক হয়?’
ইসমিকে ঘাবড়ে দেওয়ার পর মাইশা ব্যাগ থেকে একটা ভাঁজ করা রাজহাঁস বের করল। হাওয়া কলও আছে তার সাথে। অল্প একটু হাওয়া দিতেই সাদা রাজহাঁস উঠে দাঁড়াল।
‘উয়াউ! আমি কি এটাতে চড়তে পারব, আন্টি?’
‘হা। অবশ্যই। চাইলে তুমি এর নিচে গিয়ে লুকিয়েও থাকতে পার। তাহলে কেউ আর তোমাকে খুঁজে পাবে না।’
‘এর পা দুইটা লাল কেন, আন্টি? ঠোঁটও লাল।’
সংক্ষেপে উত্তর দেওয়ার পর মাইশা তাকে পুলের শেষ মাথায় যেতে উৎসাহিত করল। ইসমি রাজহাঁস নিয়ে পানিতে লাফিয়ে পড়লে সিগারেট ধরাবে।
নাশিতার আইফোনে ডাক পড়ল। সকালে তার সহকারী ভুল খবর দিয়েছে। এখন সংশোধন করল: কারখানা বন্ধ ঘোষণা করেনি পোশাক পরিষদ। কেবল আলোচনা হয়েছে।
মুখ ভার করে রাখল নাশিতা।
মাইশা হোহো করতে করতে সিগারেট ধরাল। এখন বিছানার মত লম্বা চেয়ারে আধাশোয়া হয়ে কাটাবে ঘণ্টা খানেক। সিগারেটের সাথে ইচ্ছা হলে হালকা মদিরা। বিয়ার-টিয়ার কিছু একটা বা চা বা কফি।
ইসমি ফিরে আসার আগেই প্রথম সিগারেট শেষ করে তারা। ইসমি সাঁতারের চশমা পরেনি। নাশিতা তাড়াতাড়ি বোতলের পানি দিয়ে চোখ ধুয়ে দিল।
‘চশমা পরোনি কেন, ডার্লিং?’
‘মনে ছিল না ত।’
‘মনে ছিল না কেন?’
‘উম্ম্—জানি না।’
‘হাঁসটা পেয়ে তুমি উত্তেজিত হয়ে পড়লে। হয়ত এ কারণে।’
নাশিতা উত্তেজনা নিয়ে লেকচার দিতে দিতে কালো ব্যাগ থেকে সাঁতার-চশমা বের করল। চিনে তৈরি ইংল্যান্ডের স্পিডো ব্র্যান্ডের মাল। কমলা রঙ ফ্রেমে সাদা ফাইবার গ্লাস। এতে পানি ধরে না। চোখের চারপাশ দিয়ে এঁটে থাকে। পানি যাতে ভেতরে যেতে না পারে।
তাদের সাঁতারের পোশাকও পানি প্রতিরোধী। হাঁটু থেকে গলা পর্যন্ত একটাই পোশাক। কালো কিন্তু বগল থেকে ঊরু পর্যন্ত দুই পাশে দুইটা সোনালি আজি টানা। ওপরের অংশ টি-শার্টের মত আর নিচের অংশ হাফ প্যান্ট যেন। চামড়ার সাথে লেগে থাকে। চুল ঢেকে রাখার জন্য মাথায় আছে পানি প্রতিরোধী কালো টুপি। সবই বিদেশি।
মাইশা বলল, ‘আজ কোথায় খাবা, সখি?’
‘চলো এখানেই খাই।’
সাঁতার শেষে হোটেলেই দুপুরের খাবার খায় তারা। প্রায় সব ছুটির দিন। মাঝে মাঝে যায় র্যাডিসন বা গুলশান এভিনিউর কোনো রেস্তোরাঁয়। ইসমির বাপ যোগ দেয় মাঝে মাঝে। বিয়ের পর প্রথম দিকে নাশিতাকে একা যেতে বাধা দিত। নাশিতা বাধা মানেনি। হাজবেন্ডকে সব সময় সব জায়গায় সাথে নিতেও সে রাজি না। বেশি ন্যাকামি মনে হয়।
হোটেলটার তিনতালায় একটা লম্বা-চওড়া রেস্তোরাঁ আছে। সাদাটে ঘিয়ে রঙ দেয়াল-সিলিং আর হলুদাভ মেঝে। ফাঁকা ফাঁকা গোল টেবিলগুলো সাদা কাপড়ে ঢাকা।
নাশিতা হোটেলটাকে সাড়ে তিন তারার সনদ দিয়েছে। মাইশা দিয়েছে তিন তারা। অনেকে পাঁচ তারাও দেয়।
পরিচারক আসতেই ইসমি কোলাহল করে বলল, ‘শিরিম্প টেম্পুরা!’
‘আজ অন্য কিছু চেখে দেখ।’
নাশিতা মেনু পেপার নিয়ে কয়েকটা খাবারের বর্ণনা দিল। ইসমির কোনোটাই পছন্দ না। রেস্তোরাঁয় গেলে তার শুধু শিরিম্প টেম্পুরার কথাই মনে পড়ে। এটা জাপানিজ খাবার যা ইসমি অনেক আগেই শিখেছে। নাশিতা গেছে আরো এক ধাপ: মধ্যযুগে পর্তুগিজ পাদ্রিরা এই জিনিস জাপানে নিয়ে গেলেও ঐতিহ্যবাহী জাপানিজ খাবার বলে পরিচিত হয়েছে বিভিন্ন দেশে।
মাইশার সামনে ইতিহাস-ঐতিহ্য প্যাঁচাল পাড়া নিষেধ।
খাবারটা বেগুনি ভাজার মতই তৈরি করতে হয়। তবে তারকা হোটেলে আসার বিশেষ বিধান রয়েছে। একেকটা তারার জন্য একেক রকম বিধান। সাধারণ বিধান হল:
কাঁচা চিংড়িতে ভুট্টার আটার প্রলেপ দেওয়ার পরপরই সেটা ‘ময়দা আর ডিমের গোলায়’ ডুবিয়ে নিতে হবে। তারপর ডুবোতেলে ৩৪০ থেকে ৩৬০ ডিগ্র ফারেনহাইট তাপমাত্রার মধ্যে ভাজতে হবে। তাপ সব সময় মোটামুটি একই রকম থাকবে। কমবেশি হলে মান যায়। তাই মাঝে মাঝে তাপ চেক করার জন্য কুকিং থার্মোমিটার কাজে লাগাতে হবে।
গোলা বানাতে হবে ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি দিয়ে যাতে ভাজার সময় বেশি তেল শোষণ করতে না পারে। গোলা বেশি ঘাঁটলে দেখতেও ভাল হবে না স্বাদও বেশি হবে না। ভুলে গেলে চলবে না।
চিংড়ির লেজ থাকতে হবে। সেটা পরিষ্কার করার জন্য ছুরি দিয়ে ঘষাই ভাল। কাপড় দিয়েও হতে পারে। তারপর টিস্যু দিয়ে মুছে ফেলা উচিত। না হলে চকচকে হবে না। চিংড়ির পিঠ কেটে শিরা বের করে ফেলতে হবে। খোসা ছড়িয়ে পেট ভালমত কেচে দিতে হবে যাতে কাঠির মত সোজা হয়ে থাকে। আঙ্গুলে চেপে অথবা চামচ দিয়ে পিটিয়ে একটু থেঁতলে দিতে হবে যাতে নরম হয়। আর তোয়ালে দিয়ে পানি শুষে নিতে হবে যাতে প্যাচপেচে না হয়।
সব চিংড়ির আকার মোটামুটি এক রকম এবং চকচকে হবে। অবশ্যই। তারপর সাদা চিনামাটির থালায় মালার মত করে সাজিয়ে দেওয়ার কাজটাও কিচেন থেকেই হয়।
ইসমি একটার লেজ ধরে সয়া সসে ডুবিয়ে অর্ধেক কামড়ে নিল।
‘একটা চিংড়ির সাথে একটা সবজি। এটা নিয়ম।’ নাশিতার নিয়ম। ইসমি যখন টেম্পুরার বিশেষ ভক্ত হয়ে গেল তখন এমন নিয়ম চালু করল নাশিতা।
সবজিও টেম্পুরা করা। ব্যানানা টেম্পুরা। বিন টেম্পুরা। ব্রকোলি বরবটি বেগুন ফুলকপি ইত্যাদি। ইসমি এগুলোর কথা বারবার ভুলে যায়। নাশিতা তাকে মনে করিয়ে দেয় বটে। সেও মাঝে মাঝে ভুলে যায়।
নাশিতা ভাত খেতে খেতে ইসমিকেও এক চামচ খাওয়ানোর চেষ্টা করল। ডিম-সবজি দিয়ে ভুনা ভাত আর জাপান থেকে আসা ওয়াগিয়ু গরুর মাংস ভাজা। যেভাবে বেগুন ভাজা হয় এবং তেমনি রসালো। সঙ্গে বড় এক থালা সালাদ। মাঝারি আকারের গাজর, শশা আর ভারতীয় পেঁয়াজের মোটা মোটা চাকা, বেবি টমেটো দুই ভাগ করা, আর লেটুস পাতা আর ধনেপাতার সাথে কাঁচামরিচ, ইতালির এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল, টোস্ট করা তিলের তেল, লালমরিচের গুঁড়া আর ভিনেগার দিয়ে প্রস্তুত।
এটা কোনো খাবার হল? ইসমি মুখ ফিরিয়ে নিল। তার অবচেতন মনে এখন আইসক্রিমের ছবি। সচেতন মনে এসেও আসছে না। আশপাশে তাকাতে তাকাতে বলল, ‘আর একটা কী খাবার যেন আছে না, আম্মি?’
আম্মির কানে এখন হেডফোন।
চেয়ারম্যানের পিএ বলছেন, ‘স্যার কাল সকালে শওকত সড়ক যাবেন। আপনাকে ইনভাইট করেছেন।’
নাশিতা খাওয়া শেষ হলে বাসার অন্যদের জন্য তাদের পছন্দমত খাবারের ফরমায়েশ দিল। মাইশাও। দেওয়ার আগে ফোন করে জানিয়ে রাখে। তারা সবাই মাসে গড়ে অন্তত ত্রিশবার বাইরে খায়। দাওয়াতে বা ক্লাবে বা রেস্তোরাঁয়।
► আসছে উনবিংশ পর্ব
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন