লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [ষষ্ঠ পর্ব]

অ+ অ-

 

পড়ুন লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [পঞ্চম পর্ব]

লোকটাকে যেভাবে খুন করেছিলাম [ষষ্ঠ পর্ব]

 

আজ সকাল দশটা তেত্রিশ মিনিটে এসএস এয়ারলাইনসের একটা বিমান ল্যান্ড করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছে। বিমানটির বাম দিকের বড় ডানাটা ভেঙ্গে গেছে। কয়েকজন সামান্য আহত হলেও কেউ মারা যায়নি। বস্তির তিনচারটা ঘর পুড়ে গেলে সংবাদপত্রে খবর হয় না বটে, কিন্তু বিমান ল্যান্ডিংয়ে সামান্য এদিক-ওদিক হলে খবর হয়। আর এ তো ডানা ভাঙ্গা কেস। ই-মেইলে খবরটা এসেছে। আমি সেটা এডিট করে আমাদের ইমিডিয়েট বস সাদেক ভাইকে দিলাম। তিনি দেখে দেওয়ার পর নিউজের কপিটা যাবে প্রুফ রিডিং সেকশনে। সেখান থেকে বানান ঠিক হয়ে আসার পর অনলাইনে প্রকাশিত হবে। খবরের গুরুত্ব থাকলে পরের দিন প্রিন্ট এডিশনেও যেতে পারে নিউজটা। পত্রিকা অফিসে এখন এমনভাবেই নিউজের কাজকর্ম চলে। সাদেক ভাই আমাদের অফিসের একজন আদর্শ কর্মী। সেলফ সেন্সরশীপ বুঝতে হলে আপনাকে সাদেক ভাইয়ের পাশে পুরো চার দিন বসে থাকতে হবে। অনলাইন নিউজ পোর্টালকে কী করে একটি প্রায় সরকারি পোর্টালে পরিণত করা যায় সেই শিক্ষা নিতে হলে আপনাকে সাদেক ভাইয়ের আদর্শ যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।

ধরা যাক শীতকালে কম্বল দিতে গিয়ে কোনো মন্ত্রী বেফাঁস কথা বলে ফেলেছেন, সেই নিউজের হেডিং সাদেক ভাই দেবেন মন্ত্রীর কম্বল বিতরণ। অথচ এটা মন্ত্রীদের রুটিন কাজ। এটা খবর নয়। মন্ত্রীরাই তো কম্বল বিতরণ করবেন। এই হেডিং করার কী আছে! হেডিং হওয়ার কথা বেফাঁস বাক্যটা নিয়ে। সাদেক ভাইকে নিরীহ হেডিংয়ের কারণ জিজ্ঞেস করলে প্রথমেই কতক্ষণ হে হে করে হাসবেন। তারপর বলবেন, তোমরা বোঝ না বলেই তো দ্যাশটার আইজ এই অবস্থা। সে ব্যাটা মন্ত্রী, তারে চটাইয়া লাভ কী। ভেতরে তো আছেই পুরা খবর। হেডিং এমনই যাক। তারপর তার প্রিয় দুই সাগরেদের দিকে ফিরে বলবেন, কী, ঠিক বলছি কিনা? তারা হয়তো তখন কোনো একটা কাজ করছিল, আলাপটা শোনেই নাই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলবে, হ ভাই। ঠিকই তো বলছেন। তখন সাদেক ভাই আমার দিকে তাকিয়ে একটা বিজয়ীর হাসি দিয়ে বলবেন, কী, দেখছো? বলছিলাম না!

সাদেক ভাই নিরীহ-নির্বিবাদী মানুষ। মালিকের স্বার্থ এবং সরকারের তাঁবেদারি তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি সকালে চুলে তেল দিয় অফিসে আসেন, হাতে থাকে একটা চটের ব্যাগ আর একটা চামড়ার ব্যাগ। চামড়ার ব্যাগে কাগজ-কলম থাকে আর চটের ব্যাগে টিফিন বাটিতে থাকে দুই বেলার খাবার। সাদেক ভাই জুনিয়রদের ধমক দিতে পছন্দ করেন, কিন্তু কেউ যদি পাল্টা ধমক দেয় তাহলে তাকে সমঝে চলেন। এমনকি উর্দ্ধতনদের কাছে জুনিয়রদের নামে নালিশ করতেও ভয় পান। তবে দীর্ঘদিন নিউজে কাজ করার কারণে নিউজের অনেক খুঁটিনাটি অল্প সময়ে ধরে ফেলতে পারেন।

নিউজ এডিট করা, বাচ্চাদের জন্য বই লেখার পাশাপাশি সাদেক ভাই মাঝে মাঝে অনলাইনে কলামও লেখেন। সেই লেখা হয় ধরি মাছ না ছুঁই পানি ধরনের। সরকারের এই করা উচিত, জনগণের আরও সচেতন হওয়া উচিত, যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আরও যত্নবান হতে হবেসবসময় এই লাইনেই থাকেন সাদেক ভাই। নিরীহ পরামর্শ টাইপ আরকি। অফিসে যদি কর্মীদের জন্য নতুন কোনো নির্দেশনা জারি হয়, সাদেক ভাই হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলেন, খবর শুনছো? ঘটনা তো ঘইটা গেছে। কেউ যদি বলে শোনে নাই, অমনি সাদেক ভাই শুরু করবেন, তোমরা মিয়া কোনো খবরই রাখো না। অফিসে সিরিয়াস অবস্থা চলতেছে। আর তোমরা চুপচাপ বইসা আছো! একটু এদিক-ওদিক করলে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা হইছে। বেতন কাটা যাবে। চাকরিও যাইতে পারে। সম্পাদক খুব খেপে গেছেন। অথচ পরে দেখা যায় ঘটনা তেমন কিছুই না। সাদেক ভাই নিজে ঘাবড়ে গিয়ে এসব বলেন। বাকীদের ভয় লাগিয়ে দেন।

তো, সাদেক ভাই এসএস এয়ারলাইনসের নিউজটা দেখেই বললেন, অনিক, এই নিউজ তোমারে কে করতে বলছে? এই কোম্পানীর নেগেটিভ নিউজ তো আমরা দেই না। তুমি জানো না?

আমি বললাম, জানি না তো ভাই। শুধু শুধু কষ্ট করে জিনিসটা এডিট করলাম। কিন্তু আমরা এইটা দেই না কেন?

মাসে এরা কত টাকার বিজ্ঞাপন দেয় জানো? তোমরা তো খালি না জাইনাই লাফাও। এইটা ছাপলে কারো চাকরি থাকবে? তারপর সাদেক ভাই কবে কোথায় কীভাবে এরকম আরও অনেকবার পত্রিকাকে লসের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন তার ফিরিস্তি তুলে ধরতে থাকেন। পত্রিকায় এই ধরনের অভিজ্ঞতা আমার নতুন না। এর আগে যেখানে চাকরি করতাম সেই পত্রিকার মালিকের ছিল গার্মেন্টস ব্যবসা। একবার এক গার্মেন্টসে আগুন লেগে সতের জন শ্রমিক মারা গেল। ওই পত্রিকায় লিখতে হয়েছিল গার্মেন্টসে আগুন, তিনজনের মৃত্যু। এমনকি সেই গার্মেন্টেসে যে আগুন লাগলে বের হওয়ায় ইমার্জেন্সি গেটটাও সবসময় তালা মেরে রাখা হতো সেটাও লেখা গেল না। ওই পত্রিকায় এমন কিছু লেখা যেত না যাতে গার্মেন্টস মালিকদের ভাবমূর্তি খারাপ হয়। একান্তই না লিখে পার পাওয়া না গেলে মৃত বা আহতের সংখ্যা কমিয়ে লিখতে হতো। যারা বিজ্ঞাপন দেয় তারা অনেক শক্তিশালী। যে যত টাকার বিজ্ঞাপন দেয় সে তত শক্তিশালী। নেগেটিভ নিউজ হলে বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সুতরাং অলিখিত নিয়মটা চালু থাকে সবসময়। অন্নদাতাদের দোষ আমরা ঢেকে রাখি। পেটে ভাত না থাকলে কিসের সমাজসেবা, কিসের বিপ্লব !

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে টুকটাক লেখার অভিজ্ঞতা থাকার কারণে ভেবেছিলাম পত্রিকায় চাকরি করলে হয়তো মন খুলে লেখা যাবে। নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতাটা থাকবে, যেটা সরকারি চাকরি করলে সম্ভব হবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল সেটা মোটেও সত্য নয়। এখন মনে হয় যদি অন্য পেশায় থাকতাম তাহলেই বরং আরেকটু বেশি স্বাধীনতা পেতাম মত প্রকাশের, নিজের কথাটা বলার। অন্তত নিজের মাথার ভেতর সেল্ফ সেন্সরশিপ ঢুকে পড়ত না। পত্রিকায় চাকরি করতে করতে একদিন আমি সাদেক ভাইয়ের মতো হয়ে যাব, একদিন সেল্ফ সেন্সরশীপ এমন পর্যায়ে চলে যাবে যে বিষহীন ঢোড়া সাপের মতো সামান্য ফোঁসফাস ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। এই কয়েক বছরে আমার সেল্ফ সেন্সরশীপ এমন একটা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে এখন নিজের লেখা কলামও দ্বিতীয়বার পড়ে দেখার রুচি হয় না। সাদেক ভাই হওয়ার আতঙ্ক ক্রমশ গ্রাস করতে থাকলে লিনুর ফোন আমাকে বাঁচায়। আমি আপনার অফিসের গেস্টরুমে বসে আছি। তাড়াতাড়ি নামেন তো।

বলে কী এই মেয়ে! অফিসের নিচে এসে বসে আছে! দেখা হওয়ার তিন দিনের মাথায় সরাসরি অফিসে! আমি বেশি কিছু বলতে পারি না। বলাটা অবশ্য ভদ্রতার মধ্যেও পড়বে না। তাছাড়া সত্যি বলতে ও আসায় আমার ভালোই লাগছে। কিন্তু একটু যে চমকাইনি তা নয়। বললাম, আপনি বসেন, হাতের কাজটা সেরে আসি। সে বলল, কতক্ষণ লাগবে? আমি বলি, পাঁচ মিনিট। সে বেশ হুকুমের স্বরে বলে, জলদি আসেন।

এদিকে শিউলির ওপর আমি বিরক্ত। একেক সময় একেক কথা বলছে সে। একবার বলছে আমার প্রেমে পড়েছে, আরেকবার বলছে লোকটা তো এখনও বেঁচে আছে-এই অবস্থায় সে আমার সাথে শারীরিক সম্পর্কে যেতে পারবে না। হতে পারে ঘরে মৃত্যুপথযাত্রী আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা তাকে অন্তরঙ্গ সম্পর্কে যাওয়ার মতো স্থিরতা দিচ্ছে না। রিকশায় ঘোরার সময় আমি কয়েকবার ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করেছি, সে সাড়া দেয়নি। এই ধরনের আচরণ আমার মোটেও ভালো লাগে না, বিরক্ত লাগে। সে কী চায় আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। একবার কথায় কথায় বলেছিল, গত আড়াই বছর তার যৌনজীবন বলতে কিছু নেই। সে আর পারছে না। তার হাজব্যান্ড রোগের প্রথমদিকেই তার যৌনক্ষমতা হারিয়েছে। আবার আমাকেও ঘনিষ্ট হতে দিচ্ছে না। তবে কি ও অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়াচ্ছে? জড়াক তাহলে। আমাকে ডাকাডাকি করার মানে কী? এসব দোটানা আমার খুবই অপছন্দ। সে কি জানে অন্য নারীর সাথে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ আমারও আছে?

শিউলির সঙ্গে লিনুর আচরণের আকাশ পাতাল ফারাক। লিনু যখন কথা বলে, মনে হয় ওর সাথে আমার অনেক বছরের সম্পর্ক। বেশিরভাগ কথাই সে বেশ অধিকার নিয়ে বলে। ও বোধ হয় এমনই। সবার সাথেই হয়তো এভাবে কথা বলে।

অফিসের গেস্ট রুমে বসে মোবাইলে কী যেন করছিল সে। আমাকে দেখেই বলল, ‘ছুটি নিয়ে এসেছেন?’
‘না তো!’
‘সে কী? আমি তো আপনাকে নিয়ে এক্ষুণি বের হব ভাবছিলাম।’
‘অফিসে লোক কম আজ, আগে বের হওয়া মুশকিল। চলেন চা খাই।’
‘বুঝতে পেরেছি। চা খাইয়ে বিদায় করতে চান।’
‘আরে নাহ। লাঞ্চ করে যাবেন।’
‘সেটা করতে পারি। তবে কমপক্ষে অফিস টাইমের আধাঘণ্টা আগে বেরুতে হবে আপনাকে।’
‘আচ্ছা দেখি ম্যানেজ করা যায় কিনা। চলেন আগে চা খাই।’
‘দেখাদেখির কিছু নাই। যা বলছি তাই করেন।’
‘কিন্তু আগে বের হলেও তো অনেকটা সময় লাগবে। এতক্ষণ আপনি একা একা কী করবেন?’

আমি কী করব সেটা নিয়ে আপনার মাথা ঘামাতে হবে না। আপনি ঠিক সময়ে চলে আসবেন। আজ আমরা উত্তরার দিকে যাব। দিয়াবড়ির কাশফুলের ছবিতে ফেসবুক সয়লাব। বোঝা গেল লিনু ফেসবুকে ছবি দেওয়ার দৌড়ে পিছিয়ে থাকতে চায় না। তার এসব ছেলেমানুষি উচ্ছ্বাস আমার ভালোই লাগে।

কাজ সারতে সারতে অনকেক্ষণ লেগে গেল। এসে দেখি লিনু গেস্টরুমের সোফায় তেমনই বসে মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত। হয়তো ফেসবুকে কারো সাথে ঝগড়া করছে। ফেসবুকে একবার ঝগড়া লাগলে দিন, সপ্তাহ, এমনকি মাসও পার হয়ে যেতে পারে। ঝগড়া চলতেই থাকে। একা একা সময় কাটানোর জন্য এ ধরনের ঝগড়া খুবই কাজে দেয়। পাশে এসে বসার পরও ওর খেয়াল নেই। উঁকি দিয়ে দেখি সত্যিই সে কমেন্ট লিখছে। আমি বলি, বাদ দেন তো আপনার ঝগড়া। চলেন যাই। আগে ভাত খাই। সে হঠাৎ আমাকে পাশে বসা দেখে চমকে ওঠে। বলে, আরে, আমি তো ভাবছি আপনি আর আসবেনই না। পালাইছেন। এক মিনিট বসেন, হারামজাদারে একটু টাইট দিয়ে আসি।

উবারের গাড়িতে ওঠার পর থেকে লিনুর গায়ের ঘ্রাণ আমাকে পাগল করে দিতে থাকে। কাশফুল দেখতে যাবে বলে ও সাদা ব্লাউজ আর আকাশি রঙের শাড়ি পরে এসেছে। যেন জীবন্ত শরৎকাল। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওকে দেখতে থাকি। ও বলে শরৎকাল ওর ভীষণ পছন্দ। আর আমি বরাবরই শরতের ভক্ত। শরতের মতো এত অনিশ্চিত ঋতু আর নেই। এই রোদ তো পর মুহূর্তে বৃষ্টি তেড়ে আসে। এই অনিশ্চয়তাটুকু আমার ভালো লাগে। ভালো লাগে আকাশ ও মেঘের গাঢ় রং। শরতের নদী, জলাভূমি সম্ভবত সবচেয়ে অপরূপ। বিস্তীর্ণ জলভূমিতে যখন ভরা পূর্ণিমার আলো পড়ে তখন মনে হয় এটা বুঝি এই পৃথিবী নয়। অন্য কোনো জগত। ওই সময়ে অনেকের মতো আমারও মরে যেতে ইচ্ছে করে। গাড়ির ভেতর থেকে খণ্ড খণ্ড শাদা মেঘের দিকে আশ্চর্য মুগ্ধভাবে তাকিয়ে থাকে লিনু। আর আমি তাকিয়ে থাকি আমার পাশে আধশোয়া শরতকালের দিকে। ও এমন ভঙ্গিতে শুয়ে আছে, ওর শরীরের বাঁকগুলো প্রখর আর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিজেকে সংবরণ করা এসব সময়ে খুব কঠিন। আমার ওকে পেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এখন আমি কতটুকু এগোব, সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যাই। আদৌ সে রেসপন্স করবে কিনা সেটাই তো জানি না। যদি প্রত্যাখ্যান করে? যদি ওর এই ফুরফুরে মেজাজটা নষ্ট হয়ে যায়? কিন্তু ওর শরীরী ভাষা আমাকে ঝুঁকি নিতে বলে। মনে পড়ে জয় গোস্বামীর কবিতার লাইন জানি, পুরুষের কাছে দস্যুতাই প্রত্যাশা করেছ। দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে আলতো করে আমি ওর একটা হাত তুলে নেই আমার হাতে। ও বাধা দেয় না। চেপে রাখে আমার হাত। বলে, কী সুন্দর আজকের আকাশ!

ভালো লাগে আমার। রোমান্টিক মুডে বলি, লিনুর জন্যই আজকের আকাশ এত নীল। ও হাসে। হাসলে ওর চেহারা একদম পাল্টে যায়। এত প্রাণবন্ত হাসি আমি আর কোনো নারীর দেখিনি। অথবা হয়তো তখন এটাই মনে হয়। ওর হাসি, উচ্ছলতা ওকে অন্য সব নারীর চেয়ে আলাদা করে তোলে। ও আমার দিকে সরে আসে মাথাটা আমার কাঁধে এলিয়ে দেয়। আমি এক হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে রাখি। আমরা কেউ কাউকে ভালোবাসার কথা বলি না। কিন্তু আমাদের সম্বোধন আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসে। আমি ওর কপালে আলতো করে চুমু খাই। ও কিছু বলে না। আমি ওর সম্মতি বুঝতে পারি। ফ্লাইওভার দিয়ে শা শা করে আমাদের গাড়ি ছুটে চলে দিয়াবাড়ির দিকে।

আমাদের গাড়িটা আমরা ওয়েটিং চার্জসহ রেখে দিলাম। লিনু এটাতে চড়ে মজা পেয়েছে। সে ডিসিশান নিয়েছে এটাতেই ফিরবে। গাড়ি থেকে নেমে সে এক হাত পা ছুঁড়ে এক পাক নেচে নিল। লাফাচ্ছে, দৌড়ুচ্ছে, আমাকে হাত ধরে টেনে দৌঁড়াতে বাধ্য করছে। এলাকাটা প্লট আকারে ভাগ করা, সবগুলো প্লটের পাশ দিয়ে রাস্তা গেছে। প্লটগুলো খালি পেয়ে কাশবন এখানে তার শুভ্র সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। এপাশ থেকে ওপাশের রাস্তা দেখা যায় না। দুই মানুষ সমান উঁচু।

গোধূলি পেরিয়ে কখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে আমরা টেরই পাইনি। আবছায়ায় একটু ভয় ভয় লাগছে। যদিও বেশ কিছু লোক এখানে বেড়াতে এসেছে। কিন্তু কোনো কোনো রাস্তায় দেখা গেল কেউ নেই। লিনু ফাঁকা রাস্তাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। আমরা প্রচুর সেলফি তুললাম। সেগুলোতে দেখা গেল আমিই খানিকটা আড়ষ্ট, লিনুর মধ্যে তার বালাই নেই।

ছবি তুলতে তুলতে আমরা বেশ ভেতরের দিকে চলে এলাম। আমি বের হওয়ার রাস্তা মনে রাখতে রাখতে যাচ্ছি, কিন্তু লিনুকে দেখে মনে হয় না ওর আদৌ বের হওয়ার ভাবনা আছে। ভেতরের দিকে একটা গাড়ি পার্ক করা। জানলার কাঁচগুলো আটকানো। কিন্তু গাড়িটা দুলছে। কম্পমান গাড়ি! হঠাৎ সেদিকে তিনটে কিশোর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল। উগ্র চেহারা, সম্ভবত এখানকারই কোনো বস্তিতে থাকে। গাড়ির কাচে টোকা দিলে দেখা গেল ভেতরে দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা সেক্স করছে। এরকম প্রাকৃতিক পরিবেশে অনেক প্রেমিক-প্রেমিকাই বোধ হয় মিলিত হতে রোমাঞ্চিত বোধ করে। কিশোরেরা দেখলাম তেমন ডিসটার্ব করল না। ওদের কাছ থেকে গাড়ির জানলা দিয়ে কিছু টাকা নিয়ে আর অদূরে দাঁড়ানো মাঝবয়সী ড্রাইভারের কাছ থেকে জ্বলন্ত সিগ্রেটটা নিয়ে খুব ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে চলে গেল।

লিনু আমাকে বলল, কী হলো কিছু বুঝতে পারলে?

পুরো ঘটনাটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে আমি একটু চমকে গিয়েছিলাম। আমি যা ভাবছি সেটা ঠিক কিনা সেটা যাচাই করার জন্য বললাম, ছেলেগুলো ওদের কাছ থেকে টাকা নিল?

যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে লিনু বলল, হুম। চলো আমরা আরেকটু ভেতরে যাই।

আমি ভয় পাচ্ছিলাম। বললাম, লিনু, সন্ধ্যা হয়ে গেছে তো। আমরা বরং গাড়িটা নিয়ে মেইন রোডের দিকে এগোই?

লিনু বলল, তুমি কি ভয় পাচ্ছো? ভয় নেই, আমি আছি।

যে কথাটা আমার বলার কথা, সেটা কিনা লিনু বলছে। কথাটা আমার পুরুষত্বে লাগলেও আমি ওর কাছে জানতে চাইলাম, আমাদের সাথে এমন কিছু হলে তুমি আটকাতে পারবে?

সে বলল, হবে না। ওরা লোক চেনে। আর হলে এইখানকার সবগুলোকে বেঁধে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার আছে।

ঢাকায় ওর প্রভাবশালী আত্মীয়স্বজন আছে বলে জানি। তবে তারা ঠিক কতটা কাছের আর কতটা ক্ষমতাবান, সেটা আমার জানা নেই। ওর আত্মবিশ্বাস দেখে আমি অবাক হলেও আমার ভয় একটুও কমলো না। সবচেয়ে বড় ভয় হলো মুড নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়। বেড়াতে এসে মুড একবার নষ্ট হলে ঠিক হতে অনেকক্ষণ লেগে যাবে। আমি বললাম, এখন মশা কামড়াচ্ছে। আর কাছে সিগ্রেটও নেই। খুব সিগ্রেটের পিপাসা পেয়েছে। চলো গাড়িতে গিয়ে বসি।

ওহ, তাহলে চলো আমরা বের হই। তুমি সিগ্রেট খাও, তারপর আমরা যাই। গাড়িতে গিয়ে বসে থাকার চেয়ে বরং এখান থেকে বের হওয়াই ভালো।

ফেরার পথে লিনুকে কিছুটা ক্লান্ত লাগে। ও ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না। দুপুরে সে যতটুকু খেয়েছে, সেটা ছয় বছরের একটা বাচ্চার খাবারের সমান। ফিগার মেনটেইন করতে করতে এখনকার মেয়েরা শরীরের কী ভয়াবহ ক্ষতি করে ফেলছে কে জানে। লিনুও তাদের দলে। দিয়াবাড়িতে তেমন ভালো কোনো রেস্টুরেন্ট নেই। ফলে সন্ধ্যাটায় আমাদের কিছু খাওয়া হয়নি। এই সময়টায় বেশ জ্যাম হয়। আজ কেন যেন জ্যাম কম। লিনু একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর দিকে তাকাই। আমার কামনা জেগে ওঠে ভীষণ। আসার পথে আমি ওর কপালে চুমু খেয়েছি, জড়িয়ে রেখেছি। কিন্তু এখন কেন যেন দুরত্ব এসে যাচ্ছে। মনের ভেতরে একটা দোলাচল ক্রমশ বাড়ছে। আমি কি কোনো স্টেপ নেব এখন? একজন সুন্দরী নারী বসে আছে আমার পাশে, যাকে আমি ঘণ্টা তিনেক আগে জড়িয়ে ধরেছি, এখন কেন আড়ষ্ট লাগছে? আমি তো ওকে চাইছি। ও যে আসার পথের ঘটনায় কোনো রিঅ্যাক্ট করেনি, বরং সাড়া দিয়েছে, সেটা খুব ভালো সংকেত। এখন তো ও নিজে থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরবে না। পুরুষ হিসেবে সাধারণভাবে আমারই অগ্রসর হওয়ার কথা। কিন্তু কেন যেন আমার আড়ষ্টতা কাটছে না। অনেকক্ষণ ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম, গাড়ির ভেতরে যতটা ঘনিষ্ট হওয়া সম্ভব সেই চেষ্টা করব, যা হয় হবে। লিনু যদি এতে বাঁধা দেয়, তাহলে ঘটনা এখানেই থেমে যাবে। শরীরি ব্যাপারে আমার কোনো সংস্কার নেই। দুজন মানুষ স্রেফ আনন্দের জন্য মিলিত হতেই পারে। ব্যাপারটা স্বাস্থ্যসম্মত কিনা এটাই একমাত্র বিবেচ্য হতে পারে। অন্য কিছু নয়। 

কোমরে হাত দিয়ে আমার দিকে টেনে নিয়ে এলাম ওকে। লিনু আদুরে গলায় বলল, কী হচ্ছে এসব? আমি কিছু বললাম না। সে যখন আমার চোখের দিকে তাকাল, তখন ওর ঠোঁট আর আমার ঠোঁটের দূরত্ব এক ইঞ্চিরও কম। আমি আর সময় নিলাম না। ওর চুলের ভেতরে হাত দিয়ে, মাথাটা শক্ত করে ধরে মুখের মধ্যে নিয়ে নিলাম ওর সুগন্ধী ঠোঁট। ও চোখ বন্ধ করে ফেলল। তারপর আমার ঠোঁটে ভীষণভাবে চুমু খেতে, চুষতে, কামড়াতে লাগল লিনু। আমি ওর উদ্ধত স্তনের শক্ত বোঁটাগুলোয় হাত রাখলাম। ওর সমস্ত শরীর তখন শঙ্খিনীর মতো পাক খাচ্ছিল।

আসছে সপ্তম পর্ব