রাত্রি আর কুয়াশা

অ+ অ-

 

|| ১১ ||

পরিণতিহীন দুপুর। বাইরে রৌদ্রের ঝলসানিতে পুড়ে যাচ্ছে স্মৃতি-বিস্মৃতি। আমি বিছানায় বসে বসে জানালার দিকে তাকাই, নিমফুল যথেষ্ট শাদা হয়ে আছে উপাসনাময় হাওয়ায়। তুমি চলে গেলে কিছুই আর বলতে পারি না আমি। আমাদের মেয়েটার ফ্রক দিন দিন বেগুনি হতে হতে উড়ে যাচ্ছে কোথাও। আমি তার গায়ের ঘ্রাণ লিখে রাখি, লিখে রাখি হাসি যেন তুমি আবার ফিরে আসো প্রতিশ্রুতিহীন এই ছ্যামায়। 

আকাশ আজ ময়ূরের পালকের মতো দ্বিধায় নীল হয়ে আছে। তোমার চলে যাওয়ার অন্ধকারে দূরের গ্রামে বৃষ্টি ঝড়ছে। আর আমাদের মেয়েটা তোমাকে ডাকছে ইশারার সমস্ত ছলেতার প্রতিটা ভঙ্গিমায় হাওয়া এসে পাখি ডাকার ভান করছে এই পরিণতিহীন দুপুরে। 

 

|| ১২ ||

দুপুরে একলা হলে আমার কেবল মনে পড়ে মউতের কথা। কাফনের কাপড় জড়িয়ে একটা প্রত্যন্ত দুপুর আমার বিছানায় বসে থাকে। আমার সাথে কথা বলতে চায়। আমার ডিপ্রেশনের ওষুধগুলো নেড়ে চেড়ে দেখে। নদীর ওপারে যে গ্রামে আমি মাঝেমধ্যে যেতাম সেখানে কারা যেন কবর খুঁড়ে রেখেছে আর একটা ছোট্ট মেয়ে বাবা বাবা বলে কাঁদছে। 

দুপুরে কী সব মনে পড়ে আমার। কাক ডাকতে ডাকতে উড়ে যায় হলুদ গমখেতের দিকে। আমি নদীর পাশে বসে তোমার কথা ভাবি। আমাদের বৃষ্টি দেখার দিন শুধুই পিছিয়ে যায়। আমার ফাঁকা ঘরে কৃষ্ণচূড়ার কাঁপা কাঁপা ছায়া এসে পড়ে। 

 

|| ১৩ ||

একেকটা দুপুর চলে যায়। আমার মশারির মধ্যে হাওয়া এসে আটকে পড়ে বুনো জন্তুর মতো। বারান্দায় দাঁড়ালেই তোমার এঁটো কাপড়গুলো জড়িয়ে ধরে আমাকে। আমি সেসবের ঘ্রাণ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি একা একা। যেন আমার আর কিছুই করার নাই এই দুই হাজার তেইশের ফাঁকা দুপুরে। 

তোমাকে খুব সকালে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দিতে ভাবি কখন ফিরে আসবে তুমি? পর্তুগিজ অশ্বে সোয়ার হয়ে যে সৈনিক এখানে এসেছিল আমি তার কবর দেখতে পাই জঙ্গলে ঘেরা ভাঁট ফুলের মধ্যে। আমার জীবন ছিল দর্জিদের ফেলে দেওয়া ছাট কাপড়ের মতো বিষণ্ন। 

একেকটা দুপুর চলে যায়। আমি জানালার গ্রিলে হাত রেখে ভাবি, আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিন কতটা লাজুক ছিল! এখন আমার জীবন চকোলেটের ন্যায় কেবলই দ্রবীভূত হয়ে যাচ্ছে মিঠি এক শিশুর ছোট্ট লাল জিহ্বার উপর। 

 

|| ১৪ ||

দুপুরে সারা ঘরময় ছড়িয়ে থাকে বিষণ্ন ওষুধ। আমার বিছানায় যে বইগুলো নক্ষত্রম্লান হতে থাকে আমি তাদের পৃষ্ঠা ওল্টালেই দেখতে পাই শতশত ডাচ সৈনিক নেমে আসছে আমাদের আতার জঙ্গলে। তাদের গোরস্থানে পাতা ঝরে আর প্রতিটা ফলে পেকে ওঠে অতীত সময়। আমি দেখতে পাই হাসপাতাল আর আমার বিছানার মধ্যে কেবল ঘুমের দূরত্ব। 

ফিনাইলের গন্ধে ভরে ওঠে সমস্ত স্যানাটোরিয়াম। জানালা খুললে যে পাখি আমার দিকে তাকিয়ে ডেকে উঠত তার ঠোঁটে এখন মউতের ধূসরতা। জীবন যেন বরফকলের নির্জনতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোনো বিবর্ণ বনের পাশে। 

 

|| ১৫ ||

আমার ঘর থেকে তোমার চলে যাওয়ার রাস্তা খুব দূরে নয়। দুপুরে যখন আমি একা একা পায়চারি করি সারা ঘরে থম মেরে থাকে হাওয়া। বাইরে কাক ডাকে আতার গাছে। একজন চুল কিনতে আসা লোক বিপুল স্বরে ডাকতে থাকে অন্ধকার গলির মোহনায়। আমি তার নাম জানি না, ধাম জানি না। হয়তো নদীর ওপারের কোনো গ্রাম থেকে শহরে এসেছে। 

তোমার শুকনা কাপড়গুলো বাতাসে এমনভাবে নড়তে থাকে যেন আমার জীবন কাঁপছে। আমি বারান্দায় দাঁড়ালে একটা বিড়াল হেঁটে যেতে যেতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে যেন আমার দুই চোখ করুণ শঙ্খের মতো বেজে উঠবে সমুদ্রের পাড়ে। 

ইদানীং আমার জীবন বাচ্চাদের শান্ত আইসক্রিমের চেয়েও গলে পড়ে বেশি। আমি কোথাও যেতে চাই না। এই ঘর, জানালার বাতাস মউতের চাইতে বেশি আত্মীয় হয়ে উঠছে আমার। 

 

|| ১৬ ||

দুপুরে সমস্ত হাওয়া একদিন এই তেইশের জুন মাসে আমার বিছানায় এসেছিল। তখনো মশারির প্রতিটা কোনা আমি বেঁধে রেখেছিলাম নক্ষত্রের সাথে। হাওয়া এতটা ফুলে উঠেছিল যে আমার ঘরটাকে মনে হয়েছিল সমুদ্রের মধ্যে ভাসমান অন্তরীপ। জীবনকে দুপুরের কাছে সঁপে দেওয়া ছাড়া আমার আর কোন কাজই ছিল না। মুর্দার কাফনের শাদা কাপড় মনে হয়েছিল জীবন। আমার ওষুধের বাকশো উড়ে গিয়েছিল জলপিপিদের পাখার সাঁপটে। 

এই দুপুরে শুধুই তোমার কথা মনে পড়ে। তুমি চলে গেছ সকালের আলনায় সমস্ত কাপড় রেখে কোন ধানবন আর মৌরিপথের ঠিকানায়। তোমার শিশুটাও ঘ্রাণের অধিক ভালোবেসেছিল আমাকে। আমার ওষুধের নামের সাথে হেসপারাস নক্ষত্রের কত মিল! 

একটা শান্ত দুপুর। পিতলের পাখির মতো গমখেত খুঁজে খুঁজে আমিও উড়ে যাই মেদুরতর হাওয়ায়।